বিতর্কের মুখে রাজাকারের তালিকা স্থগিত
- আপলোড তারিখঃ ১৯-১২-২০১৯ ইং
সমীকরণ প্রতিবেদন:
দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে রাজাকারসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের ভুলে ভরা তালিকা স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকেও তালিকাটি সরিয়ে নেওয়া হয়। আগামী ২৬ মার্চ সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর গত রোববার প্রথম ধাপে ১০ হাজার ৭৮৯ রাজাকারসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়। সরকার ঘোষিত স্বাধীনতাবিরোধীদের ওই তালিকায় গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্য ও সংগঠকের নাম আসায় ক্ষোভ আর সমালোচনার ঝড় ওঠে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয়। মুখোমুখি অবস্থান নেয় স্বরাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা থাকা প্রসঙ্গে গত মঙ্গলবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাই প্রকাশ হয়েছে।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আমাদের তথ্য অনুযায়ী তালিকা প্রকাশ হয়নি।’ এরই মধ্যে গতকাল বুধবার দুপুরে স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা যাচাই-বাছাই ও সংশোধনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের কথা জানান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিকেলেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় তালিকা স্থগিত করে। বিভ্রান্তিকর তালিকা স্থগিত করা হলেও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানের ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর মধ্যে এখনও ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এদিকে, গতকালও মানিকগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের এক অনুষ্ঠানে রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা থাকা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। তালিকায় ত্রুটির কথা স্বীকার করে মন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত সরকার ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিল। এ সময়ে তারা হয়তো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রাখা কাগজপত্র কারসাজি করে রাজাকারদের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম লিখে রেখেছে। এটা আমাদের কল্পনারও বাইরে ছিল। এ কারণে ভুলটা হয়েছে।' সমকালের প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, তালিকা প্রকাশের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ ছিল। সেটি কেন প্রশ্নবিদ্ধ হলো, খুঁজে দেখব। মুক্তিযোদ্ধাদের নাম স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় বিএনপি-জামায়াত জোটের সময় যুক্ত হয়েছে, না পরে হয়েছে- তা খতিয়ে দেখা হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সচিবালয়ে তার দপ্তরে সাংবাদিকদের জানান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর প্রকাশিত রাজাকারের তালিকা প্রকৃতপক্ষে কোনো রাজাকার, আলবদর বা আলশামসের তালিকা নয়। এটা ছিল ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সালে দালাল আইনে দায়ের হওয়া মামলার আসামিদের তালিকা। তিনি বলেন, এ ঘটনায় একজন মন্ত্রী হিসেবে নিজেও আহত হয়েছি। এটা দুঃখজনক। তবে আমাদের মন্ত্রণালয়ের কোনো ভুল থাকলে তা তদন্ত করা হবে। যারা ভুল করেছে, তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা হবে। এর আগে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তালিকা প্রসঙ্গে বলেন, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে এসেছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন।
১০ হাজার ৭৮৯ জনের তালিকায় সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান, পাকিস্তান মুসলিম লীগের চেয়ারম্যান ময়মনসিংহের নুরুল আমিন, আইয়ুব সরকারের মন্ত্রী বাগেরহাটের খান এ সবুর, জামায়াতের আমির ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোলাম আযম, আইয়ুব সরকারের সাবেক স্পিকার চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের (ফকা) চৌধুরীসহ আরও অনেক চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীর নাম উঠে আসে। কিন্তু তালিকায় গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠকের নামও পাওয়া যায়। তাদের অনেকে নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের নিয়ে চূড়ান্ত তালিকা হোক :
স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা স্থগিতের পর এ বিষয়ে জানতে চাইলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, তালিকা স্থগিত বা প্রত্যাহার কোনো সমাধান নয়। এটি যথেষ্ট হতে পারে না। এই তালিকা কেন, কীভাবে হয়েছে, তা তদন্ত করতে হবে। তিনি জানান, প্রকাশিত রাজাকারের তালিকা এবং সংশোধিত তালিকা প্রণয়ন নিয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে সংগঠনের মতামত তুলে ধরা হবে। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ডা. এমএ হাসান বলেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের নিয়ে কমিটি করতে হবে। আবারও যাতে তালিকা প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেদিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরী বলেন, একটি নীতিমালা করে উপজেলা পর্যায়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিতে আলোচনার ভিত্তিতে রাজাকার তালিকা চূড়ান্ত করতে হবে। তাহলে সংশোধিত তালিকা নিয়ে বিতর্ক অনেকাংশে কমে যাবে। তালিকা প্রকাশ নিয়ে যদি আবারও তাড়াহুড়া বা গোঁজামিল দেওয়া হয় তাহলে হিতে বিপরীত হবে। সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব বলেন, মন্ত্রীর ভালো একটি উদ্যোগ কিছু ভুলভ্রান্তি ও অভিযোগের কারণে বিতর্কিত হয়েছে। কিন্তু এখন পূর্ণাঙ্গ ও সর্বজনবিদিত স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। আর যাতে এই তালিকা নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর আত্মপক্ষ সমর্থন :
গতকাল মানিকগঞ্জ জেলা শহরের বিজয় মেলা মাঠে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সমাবেশে আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, দু-চারজন মুক্তিযোদ্ধার নাম রাজাকারের তালিকায় আসায় তারা দুঃখ পেয়েছেন। আমার নাম তালিকায় এলে যেমন কষ্ট পেতাম, তালিকায় তাদের নাম আসায় একই কষ্ট পাচ্ছি। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম থাকলে অচিরেই যাচাই-বাছাই করে সে নামগুলো প্রত্যাহার করে নেব। তবে রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের নাম থাকবেই। পরবর্তীকালে যে তালিকা প্রকাশ করা হবে, সেগুলো জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে উদ্ধার করে পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করা হবে। এরপর আর যেন ভুল না হয়, তা আমরা যাচাই-বাছাই করে প্রকাশ করব। তিনি আরও বলেন, তালিকায় ইচ্ছাকৃত ভুল ছিল না। রাজাকারের তালিকায় যাদের নাম ছিল, তা সঠিক ছিল বলে বিশ্বাস করা হয়েছিল। এ কারণে যাচাই-বাছাই না করেই তালিকা প্রকাশ করায় আমরা এই হোঁচট খেয়েছি। কাজ করতে গেলে ভুল তো হতেই পারে। ৬৪ জেলার ৪৬০টি উপজেলার যে সম্পূরক তালিকা আসবে, পূর্ণ সতর্কতার সঙ্গে সেই তালিকা প্রকাশ করা হবে। ত্রুটিপূর্ণ তালিকা মন্ত্রণালয়ের নিজ উদ্যোগে সংশোধন করা হবে।
যে কারণে বিতর্ক :
৬৫৯ পৃষ্ঠার তালিকা পর্যালোচনায় দেখা যায়, এটি পাকিস্তান সরকারের রেখে যাওয়া নথিপত্রের ভিত্তিতে প্রণীত স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা নয়। বরং স্বাধীনতার পর দালাল আইনে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল সেই নথিপত্রের ভিত্তিতে করা হয়েছে। এই তালিকায় ৯২ জন সংখ্যালঘু, ৩৮ জন নারী রাজাকারের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ৫৩৮টি মামলায় আসামিদের অব্যাহতি দেওয়া হলেও তাদের নাম তালিকায় রয়ে গেছে। বিভিন্ন জেলার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা সংগঠকের নামও তালিকায় এসেছে। যাদের মধ্যে ছিলেন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি মজিবুল হক, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম আরিফ টিপু, বরিশালের আইনজীবী তপন চক্রবর্তী ও তার মা শহীদজায়া উষা চক্রবর্তী, বগুড়ায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে পরিচিত আইনজীবী মহসিন আলী, আব্দুস সালাম, তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুর রউফ, পুলিশ কর্মকর্তা এস এস আবু তালেব, জয়পুরহাট মহকুমার (সাবডিবিশন) সাবেক গভর্নর কছিম উদ্দীন আহম্মেদ, সাবেক এমএনএ মজিবর রহমান আক্কেলপুরি, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ফরেজ উদ্দীন মাস্টার, প্রয়াত মজিবর রহমান মাস্টার, প্রয়াত তাহের উদ্দীন মাস্টার, প্রয়াত ডা. মহসিন আলী মল্লিক, প্রয়াত হবিবর রহমান, প্রয়াত নজিবর রহমান সরদার, মুক্তিযোদ্ধা আমিরুল ইসলামসহ আরও অনেকে। অথচ একাত্তরে নৃংশস হত্যাকা-ের মদদদাতা আলবদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ ফাঁসি হওয়া অনেক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর নাম স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় আসেনি।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি :
রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি ও স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রকাশিত তালিকা স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল রাতে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা সুফি আব্দুল্লাহিল মারুফ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘গত ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় হতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি ও স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে ১০ হাজার ৭৮৯ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়। তালিকা প্রকাশের পর বিভিন্ন মহল হতে অভিনন্দিত করা হয়েছে, আবার তালিকায় কিছু ভুল-ত্রুটির জন্য তীব্র সমালোচনাও হয়েছে। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির মধ্যে যাতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না হয় সেজন্য রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি ও স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রকাশিত তালিকা স্থগিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হক।; আরও বলা হয়, 'মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী জানান, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী এ তালিকা যাচাই-বাছাই করে সংশোধনের নির্দেশনা দিয়েছেন। কী প্রক্রিয়ায় দ্রুততম সময়ে দেশব্যাপী যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করে প্রকৃত তালিকা প্রকাশ করা যায় সে ব্যাপারে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলোচনা প্রয়োজন। আগামী ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে এ তালিকা প্রকাশের প্রচেষ্টা থাকবে বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী জানিয়েছেন।'
কমেন্ট বক্স