ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সারাদেশে মাঠ প্রশাসনে রদবদল শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) রদবদলে তালিকা করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে নতুন করে ডিসি পদে নিয়োগের জন্যেও ফিটলিস্ট প্রণয়নের কাজ চলছে। এবারের ফিটলিস্টে ২৯তম ব্যাচের কর্মকর্তারা গুরুত্ব পাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে ঘিরে ডিসি পদে ব্যাপক রদবদল হবে। এ লক্ষ্যে যোগ্য কর্মকর্তাদের বাছাই (ফিটলিস্ট) করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এরই মধ্যে ডিসি পদে নিয়োগের জন্য গত বুধবার ২০ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে আরও ২০ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। গত শুক্রবার-শনিবার ছুটির দিনেও কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। আজও সচিবালয়ে ১৫ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা রয়েছে।
তারা হলেন- জয়পুরহাট জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সরকার মোহাম্মদ রায়হান, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এস এম ফেরদৌস ইসলাম, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের উপসচিব মো. রাহাত মান্নান, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার একান্ত সচিব মো. জাহিদুল ইসলাম, মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মৌসুমী মাহবুব, বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের সচিব নাহিদা বারিক, রাজশাহী রেলওয়ে বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. নাদিম সারওয়ার, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আশ্রাফ আহমেদ রাসেল, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এক্সিকিউটিভ সাজিয়া আফরীন, ভূমি আপিল বোর্ডের সচিব (উপসচিব) মিজ আসমাউল হুসনা লিজা, পরিকল্পনা বিভাগের উপপ্রধান মোছা. নাসরীন পারভীন, কুষ্টিয়া জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার মিজ মমতাজ বেগম, পরিকল্পনা বিভাগের উপসচিব বিজেন ব্যানার্জী, গাজীপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী এবং জন বিভাগের উপসচিব মো. রায়হান কবির।
গত ১৫ অক্টোবর ফেনীর ডিসি সাইফুল ইসলামকে চট্টগ্রামের ডিসি পদে বদলি করা হয়। আর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপসচিব মনিরা হক ফেনীর ডিসি পদে নিয়োগ পান। অন্যদিকে, বিদ্যুৎ বিভাগের উপ-সচিব মোহাম্মদ সোলায়মানকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপ-সচিব আফসানা বিলকিসকে মাদারীপুরের ডিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধান এবং আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন চাইলে প্রশাসনের মধ্যে রদবদল আনতে পারে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বলা হয়েছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিভাগীয় কমিশনার, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং তাদের অধস্তন কর্মকর্তাদের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া বদলি করা যাবে না। সে জন্য আগেভাগে জেলা প্রশাসক পদে নতুন মুখ ও রদবদলের প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ আমলে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হযেছে, সেসব নির্বাচনে মাঠ প্রশাসনে দায়িত্বে থাকা ডিসিদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। হয়। গত বছর গণঅভ্যুত্থানের পর অন্ত অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে আগের ডিসিদের প্রত্যাহার করে পর্যায়ক্রমে সব জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেয়। কিন্তু প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে সেই অর্থে দক্ষতার পরিচয় মিলছে না। সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। এ জন্য ২৮ ও ২৯ ব্যাচ থেকেও ডিসি পদায়নের ফিটলিস্ট হচ্ছে। বর্তমানে ২৪তম, ২৫তম এবং ২৭তম বিসিএসের কর্মকর্তারা জেলা প্রশাসক পদে দায়িত্বে আছেন। যুগ্ম সচিব হওয়ার পরও ২০ জেলায় ৭ মাস ধরে ডিসি পদে আছেন- পর্যায়ক্রমে তাদের সরানো হবে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২৪ ও ২৫তম বিসিএসের কর্মকর্তারা বিগত বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের (২০০১-০৬) আমলে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (২০০৭-০৮) আমলে ২৭তম বিসিএসের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দেন। মাঠ প্রশাসনের এই গুরুত্বপূর্ণ পদে ‘যোগ্য’ কর্মকর্তাদের আনার চেষ্টা চলছে। এ জন্য নতুন করে ২৮ ও ২৯তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে বলেন, আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে যোগ্য কর্মকর্তাদের ডিসি পদে পদায়ন করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। অতীতে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তারা কোনোভাবেই ডিসি হতে পারবেন না, সে জন্য নিবিড়ভাবে বাছাই করা হচ্ছে। চলতি মাসের মধ্যেই বাছাইয়ের কাজ শেষ হবে। সে জন্য তোড়জোড় চলছে। এই বদলির সময় ও প্রেক্ষাপট স্পষ্টভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ২৯ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসে সভাপতিত্বে নির্বাচনি প্রস্তুতি সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের প্রথম বৈঠকে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রেস সচিব বলেন, ‘মাঠ প্রশাসনে, বিশেষ করে ডিসি, এডিসি, ইউএনওসহ বিচারিক দায়িত্বে এমন কাউকে পদায়ন করা হবে না; যিনি গত তিনটি নির্বাচনি কাজে যুক্ত ছিলেন। ন্যূনতম ভূমিকা থাকলেও তাকে এই নির্বাচনে দায়িত্বে রাখা হবে না।’ প্রেস সচিব জানান, ‘পদায়নের ক্ষেত্রে কর্মকর্তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, শারীরিক যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, গণমাধ্যমে অনিয়মের প্রতিবেদন হয়েছে কি না- তা দেখা হবে।’
শফিকুল বলেন, সবচেয়ে ফিট কর্মকর্তাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পদায়ন করা হবে। তবে নিজ জেলা বা শ্বশুরবাড়ির এলাকায় কাউকে পদায়ন করা হবে না। তাদের কোনো আত্মীয়-স্বজন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কিনা- পদায়নের ক্ষেত্রে সে বিষয়েও লক্ষ রাখা হবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও সভায় জানিয়েছেন যে পুলিশের পদায়নের বিষয়েও একই ভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৬৪ জেলার এসপিদের তালিকা করা হয়েছে, উল্লেখ করেন প্রেস সচিব। বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের বিতর্কিত নির্বাচনে ভোটাররা ঠিকভাবে ভোট দিতে পারেনি, এবারের নির্বাচনে ভোট দেবেন, এমনটি আশা করছেন। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, জেলা প্রশাসকদের ভূমিকা ততই বাড়ছে। নির্বাচন ছাড়াও মাঠপর্যায়ে সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে ডিসিদের বহু দায়িত্ব রয়েছে।
সমীকরণ প্রতিবেদন