জোট মনোনীত প্রার্থী হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে নিজ দলের প্রতীকেই; অর্থাৎ, সংশ্লিষ্ট প্রার্থী যেই দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত সেই দলটি যদি নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত হয়, তাহলে জোটের প্রার্থী হলেও ঐ প্রার্থীকে নিজ দলের প্রতীকেই লড়তে হবে- এমন বাধ্যবাধকতা রেখেই ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর গেজেট জারি করেছে সরকার। নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন আরপিওর ২০ ধারা সংশোধন করে ‘জোটগত নির্বাচনে প্রতিটি দলকে নিজস্ব প্রতীকে ভোট করতে হবে’- এই বিধানের আপত্তি জানিয়েছিল বিএনপি এবং দলটির মিত্র দল-জোটগুলো। বিএনপি নির্বাচন কমিশন ও আইন মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে তাদের আপত্তির কথা তুলে ধরে। অন্যদিকে, জামায়াত, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল এই সংশোধনের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়। এ নিয়ে দলগুলোর পালটাপালটি বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। আর এই উত্তেজনার মধ্যেই শেষ পর্যন্ত সংশোধনী বহাল রেখে সোমবার রাতে আইন মন্ত্রণালয় অধ্যাদেশের গেজেট জারি করেছে।
গণভোট কখন হবে- সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে নাকি এর আগে এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যেই গত ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশ অনুমোদন করা হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আরপিওর ২০ নম্বর ধারা পরিবর্তন করে ‘জোটগত নির্বাচনে প্রতিটি দলকে নিজস্ব প্রতীকে ভোট করতে হবে’- এমন বিধান যুক্ত করা হয়। এ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভেদ আরো তীব্র হয়ে ওঠে। এই পরিবর্তনের বিরোধিতা করে বিএনপি নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেয়। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের সঙ্গে সচিবালয়ে দেখা করে লিখিতভাবে আপত্তি জানান। জোট মনোনীত প্রার্থীরা নির্বাচনে জোটভুক্ত যে কোনো দলের প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন- আগের এই বিধান বহাল চেয়েছে বিএনপি।
একই দাবি জানিয়ে বিএনপির মিত্র জোট ১২ দলীয় জোটের পক্ষ থেকেও সোমবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, ‘অতীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল জোটবদ্ধ হয়ে নিজেদের বা জোটের অন্য কোনো দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এটা রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার। এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠানে আগে কোনো সমস্যা হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত এই প্রক্রিয়া পরিবর্তনের কোনো দাবিও ছিল না। এছাড়া নির্বাচনের প্রধান অংশীজন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা ছাড়াই এমন একটি বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া অনভিপ্রেত ও অগ্রহণযোগ্য।’ তবে, জামায়াত-এনসিপিসহ কয়েকটি দল বিএনপি ও দলটির মিত্র দল-জোটগুলোর এমন অবস্থানের বিরোধিতা করেছে। সংশোধিত আরপিওর অধ্যাদেশ বহাল রাখার দাবি জানিয়ে সিইসি ও আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে এনসিপি।
উপদেষ্টা পরিষদের ‘জরুরি বৈঠকে’ আলোচনা হলেও উপদেষ্টাদের মতভেদ
জানা গেছে, আরপিওর ২০ ধারার এই সংশোধনী নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থানের বিষয়ে গত সোমবার অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের ‘জরুরি বৈঠকে’ আলোচনা হয়। বৈঠকে উপদেষ্টাদের কেউ কেউ আরপিওর সংশোধিত অধ্যাদেশের খসড়ায় আবার পরিবর্তন আনার কথা বলেন। তাদের যুক্তি ছিল, নির্বাচন কমিশনে যেহেতু অনেক দল আপত্তি জানিয়েছে, তাই আরপিও আবার সংশোধন দরকার। তবে উপদেষ্টাদের কেউ কেউ বৈঠকে মত দিয়ে বলেন, মাত্র ১২ দিনের ব্যবধানে সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে; পাশাপাশি রাজনীতিতেও নতুন বিতর্কের জন্ম দেবে। উপদেষ্টাদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে মতভেদের কারণে শেষ পর্যন্ত সরকার আর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেনি। যদিও আরপিওর বিষয়টি আরো পর্যালোচনা করতে আইন মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ যে কারণে:
আরপিওতে নতুন এই সংশোধনীর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ কেন? এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘জোটগত নির্বাচনে প্রতিটি দলকে নিজস্ব প্রতীকে ভোট করতে হবে’- এমন বিধানে ভোটের হিসাব-নিকাশে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বিএনপি। আর লাভবান হতে পারে জামায়াতসহ দলটির মিত্ররা। বিশ্লেষকদের মতে, ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আছে একসঙ্গে নির্বাচন করার জন্য এবং সংসদ সদস্য পদে জোটের প্রার্থী হওয়ার আশায়। সেক্ষেত্রে বিএনপির ‘ধানের শীষ’ প্রতীককে ছোট দলগুলোর নেতারা জয়ের ক্ষেত্রে ‘ভরসা’ হিসেবে দেখেন। কারণ, বিএনপির সমর্থন পেলেও ব্যক্তি জনপ্রিয়তা না থাকলে ছোট দলগুলোর নেতাদের নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে জেতা কঠিন হয়ে পড়বে। অন্যদিকে, জোটের প্রার্থী হিসেবে বিএনপি আসন ছাড় দিলেও দলের কেউ বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলে সেক্ষেত্রে সমীকরণ আরো জটিল হবে। আর জামায়াতসহ যে আটটি দল নির্বাচনি জোট বা নির্বাচনি সমঝোতা করতে চাইছে- সেই দলগুলোর নেতারা মনে করছেন, তাদের কাছে ‘দাঁড়িপাল্লা’ বা ‘হাতপাখা’ বা ‘রিকশা’ প্রতীক বিষয় নয়। সমঝোতা হলে সবাই ঐ প্রতীকের পক্ষে এক হয়ে কাজ করবে।
সংশোধিত আরপিওতে আরো যা রয়েছে:
সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী, বিভিন্ন মামলায় আদালত কর্তৃক ঘোষিত পলাতক আসামিরা জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। এর আগে অক্টোবরেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে আনা সংশোধনী অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় কারো বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গৃহীত হলে সেই ব্যক্তি জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। সংশোধিত আরপিওতে বলা হয়েছে, কোনো সংসদীয় আসনে অনিয়ম হলে পুরো আসনের ভোট বন্ধ ও ফল বাতিল করতে পারবে নির্বাচন কমিশন। আরপিওতে আগে বিধান ছিল কোনো নির্বাচনি এলাকায় কোনো ভোটকেন্দ্রে অনিয়ম বা গণ্ডগোল হলে শুধু সেই কেন্দ্রের ভোট বন্ধ ও ফলাফল বাতিল করা যাবে। নতুন সংশোধনীর ফলে এখন ইসি যদি মনে করে নির্বাচনি পুরো এলাকায় এত বেশি অনিয়ম হয়েছে যে পুরো আসনের ভোটগ্রহণ বন্ধ বা ফলাফল বাতিল করা উচিত; তাহলে ইসি তা করতে পারবে, সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, আরপিওতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিধান বাতিল, ‘না’ ভোট পুনর্বহাল এবং প্রার্থীদের দেশি-বিদেশি আয় ও সম্পত্তির বিবরণ প্রকাশের বাধ্যবাধকতা। যে সংসদীয় আসনে একজন প্রার্থী থাকবেন, সেখানে ভোটাররা ‘না’ ভোট দিতে পারবেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়া ঠেকাতেই আরপিওতে আনা এই সংশোধনী অনুযায়ী, কোনো সংসদীয় আসনে একজন প্রার্থী থাকলে সেখানে ভোটাররা যদি তাকে পছন্দ না করেন তাহলে তারা ‘না’ ভোট দিতে পারবেন। তখন সেখানে পুনরায় নির্বাচন হবে। সংশোধিত আরপিওতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকেও যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও পুলিশের মতো ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তিন বাহিনীকে নির্বাচনি দায়িত্ব দিতে এখন আর আলাদা কোনো আদেশের প্রয়োজন হবে না।
সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের জামানতের পরিমাণ ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। যারা রাজনৈতিক দলকে দান, অনুদান, চাঁদা যাই হোক না কেন; ৫০ হাজার টাকার বেশি অনুদান বা চাঁদা দিতে হলে তা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দিতে হবে। যিনি দেবেন তার ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে হবে। বিদেশে থাকা প্রবাসী ভোটার ও নির্বাচনি দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আগে ভোট দেওয়ার সুযোগ ছিল না; সংশোধিত আরপিওতে এবার তাদের ভোট প্রদানের সুযোগ রাখা হয়েছে। তারা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারবেন। গণমাধ্যমের কর্মীরা ভোট গণনার স্থানে উপস্থিত থাকতে পারবেন, সংশোধিত আরপিওতে সেই সুযোগও রাখা হয়েছে।
সংশোধিত আরপিওর ৩৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, সমান ভোট পেলে লটারির পরিবর্তে পুনঃভোট হবে। ৪৪ নম্বর ধারায় প্রার্থীর নির্বাচনি ব্যয় ভোটারপ্রতি ১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। দলীয় অনুদান ও ব্যয় সংক্রান্ত তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নির্বাচন কর্মকর্তাদের বদলিতে উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মিথ্যা তথ্য, গুজব বা এআই অপব্যবহার রোধে প্রার্থী ও দলের বিরুদ্ধে অপরাধের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। ৯০ নম্বর ধারায় বলা হয়, কোনো দলের নিবন্ধন স্থগিত হলে সংশ্লিষ্ট দলের প্রতীকও স্থগিত থাকবে। আর ৯১ নম্বরে আচরণবিধি লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া, হলফনামায় অসত্য তথ্য দিলে ভোটের পরেও ইসি ব্যবস্থা নিতে পারবে।
সমীকরণ প্রতিবেদন