রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৫
সর্বশেষ স্থানীয় সংবাদ জাতীয় রাজনীতি আর্ন্তজাতিক সারাদেশ অর্থনীতি খেলা বিনোদন ফ্যাক্টচেক আজকের পত্রিকা প্রযুক্তি চাকরি

জুলাই সনদ ঘিরে ঝুঁকিতে নির্বাচন

  • আপলোড তারিখঃ ০১-১১-২০২৫ ইং
জুলাই সনদ ঘিরে ঝুঁকিতে নির্বাচন

রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ এখন কারো হাতে তুরুপের তাস; কারো জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহুল আলোচিত এই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সংকট ক্রমশ ঘণিভূত হচ্ছে। ঝুঁকিতে পড়ছে জাতীয় নির্বাচনও। যে ঐক্য নিয়ে জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেই ঐক্যের বাধে ফাটল দিন দিন আরো বড় হচ্ছে। বিশেষ করে একসময়ের দীর্ঘ দিনের মিত্র বর্তমানে প্রভাবশালী দুটি দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে জুলাই সনদ ও গণভোট ইস্যুতে একধরনের কৌশলগত লড়াই চলছে। দল দুটি নিজ নিজ অনড় অবস্থানে থাকায় রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। যার আঁচ পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকারেও। অস্থিরতার জন্য সরকারকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানো হয়েছে। বিএনপি ইতোমধ্যে সংকটের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়ী করে বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দেশ-জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা এবং প্রতারণা করেছে। সরকার ঘোষিত ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে বানচাল ও বিলম্বিত করবার জন্য জামায়াতসহ কয়েকটি দল ঝামেলা করছে। জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।


অবস্থান পাল্টা অভিযোগ করেছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি বলছে, জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেও এখন পল্টি দিয়েছে বিএনপি। এই অবস্থান দলটির দায়িত্বহীনতার পরিচয়। পরিকল্পিতভাবে দেশে রাজনৈতিক সংকট তৈরির অপপ্রয়াস। আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরির একটি অপকৌশল অবলম্বন করেছেন দলের নেতারা। একইসঙ্গে সরকারকে চাপে রাখা হচ্ছে অভিযোগ করে জামায়াতের নেতারা বলেন, কোনো দলের কাছে নতি স্বীকার করলে সরকার নিরপেক্ষতা হারাবে। সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আমাদেরও আস্থা থাকবে না।


গত ২৮ অক্টোবর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দেয়। সেখানে গণভোট জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে এক দিনে অথবা আগে যে কোনো সময় করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রবল মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। বিএনপিসহ কয়েকটি দল জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজনের পক্ষে। আর জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কোনো আদেশ নয়, এর পূর্ণ ভার থাকুক নির্বাচিত সংসদের ওপর। এছাড়া সুপারিশমালায় বিএনপির ভিন্নমতগুলো (নোট অব ডিসেন্ট) বাদ দেয়া হয়েছে। এছাড়া আগামী সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি প্রথম ২৭০ দিন (৯ মাস) সংবিধান সংস্কার পরিষদের কথা বলা হয়েছে তারও আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। একইসঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদে পাস হওয়া ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ-২০২৫’ এ জোটগত ভোটে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করা বাধ্যবাধকতারও আপত্তি রয়েছে দলটির।


অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ ৮টি ইসলামী দলের দাবি, নভেম্বরেই গণভোট আয়োজন করতে হবে। আর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ আসতে হবে প্রধান উপদেষ্টার হাত ধরে। এই দলগুলো গত বৃহস্পতিবার নির্বাচনের কমিশনের সামনে বিক্ষোভ করেছে। নভেম্বরে গণভোট আয়োজনসহ বিভিন্ন দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে। এর আগে গণভোট আগের করার দাবিসহ পাঁচ দফা দাবিতে দুই দফা বিক্ষোভ, গণমিছল, গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি একসময়ে নভেম্বরে গণভোটের দাবি করলেও সেখান থেকে এখন সরে এসেছে। পরস্পরবিরোধী ও উত্তেজিত ভূমিকা নেয়া এই রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলন করেছে গত বছরের জুলাইয়ে।


অন্তর্বর্তী সরকার আগামী বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বারবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের, যা বিশ্বে উদাহরণ হয়ে থাকবে। অবশ্য এই নির্বাচন নিয়ে তিনি সংশয়ের কথাও বলেছেন। গত বুধবার মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নির্বাচন প্রস্তুতি-সংক্রান্ত সভায়ও যেকোনোভাবেই ফেব্রুয়ারিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছে সরকার। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন বানচালের আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। তিনি নির্বাচন বানচালে ভেতরের বা বাইরের যে কোনো ষড়যন্ত্র কিংবা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।


প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, গণভোট ইস্যুতে সিদ্ধান্ত যা-ই হোক না কেন আগামী জাতীয় নির্বাচন ১৫ ফেব্রুয়ারির আগেই হবে। কোনো শক্তি এটাকে ঠেকাতে পারবে না। তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের মতামত দিয়েছে। আমরা এটাকে হুমকি হিসেবে দেখছি না। যেটা সবচেয়ে উত্তম সেটাই করবেন প্রধান উপদেষ্টা।


বিএনপির বর্তমান ভূমিকা ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে মন্তব্য করে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে একমত হয়ে আমরা সবাই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছি। সবকিছু পর্যালোচনা শেষে সবাই একমত হয়েছি, একটি সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদকে গ্রহণ করা হবে এবং এটার ওপর একটা গণভোট হবে। গণভোটের পর যে নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনের সংসদের মাধ্যমে ২৭০ দিনে এটাকে সংবিধানে যুক্ত করা হবে। সবকিছু ঠিক, আমরাও রাজি, বিএনপিও রাজি। কিন্তু হঠাৎ করেই বিএনপি পল্টি দিয়েছে। জুলাই সনদে স্বাক্ষরের পর এখন বলছে, আমরা এটাকে মানি না। এটি বিএনপির দায়িত্বহীনতার পরিচয়। বিএনপি পরিকল্পিতভাবে দেশে রাজনৈতিক সংকট তৈরির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, এই নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরির একটি অপকৌশল অবলম্বন করেছে তারা। 


দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের জন্য অন্তর্র্বতী সরকারকে দায়ী করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দেশ ও জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। ঐকমত্যের চূড়ান্ত নথিতে বিএনপির মতভেদ বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ গোপন করে আস্থার সেতু ভেঙে দিয়েছে। তিনি বলেন, পরিষ্কার করে বলে দিয়েছি, নির্বাচনের আগে গণভোট করার কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচনের দিনই জনগণ দুটি ব্যালটে ভোট দেবে- একটি প্রার্থী নির্বাচনের জন্য, আরেকটি গণভোটের জন্য। কিন্তু কয়েকটি দল এটি নিয়ে জনগণকে ‘বিভ্রান্ত’ করছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, আমি খুব পরিষ্কারভাবে বলতে চাই- আমরা নির্বাচন করব, নির্বাচন করতে চাই। আমরা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যে ঘোষণা দিয়েছেন সেই ঘোষণার সঙ্গে একমত হয়ে নির্বাচন চাই। সেই নির্বাচনকে বানচাল ও বিলম্বিত করবার জন্য একটা মহল উঠে পড়ে লেগেছে। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন কথাবার্তা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।


গণভোটের দাবিতে আন্দোলনরত দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আজকে যারা এই নিয়ে গোলমাল করছেন, রাস্তায় নেমেছেন, তাদেরকে অনুরোধ করব দয়া করে, জনগণকে অনেক বিভ্রান্ত করেছেন অতীতে, অনেক করেছেন- সেগুলো আমি বলতে চাই না। একসময় এই দেশের সব মানুষের চাহিদা ছিল পাকিস্তান স্বাধীন হবে- আপনারা (জামায়াতে ইসলামী) সেটার বিরোধিতা করেছেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন। আজকে দয়া করে জনগণ যে নির্বাচন চায়, সেই নির্বাচনের বিরোধিতা করবেন না। এই দেশের মানুষ কখনো বিশ্বাসঘাতককে, যারা বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদেরকে ক্ষমা করে না, তারা ক্ষমা পায় না। সুতরাং আপনারা (জামায়াতসহ আন্দোলনরত দলগুলো) ওখান থেকে সরে আসুন। নির্বাচন করুন। তিনি বলেন, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের মতামত প্রতিষ্ঠিত হোক এটাই আমরা সকলে চাই, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক। এই সংকট থেকে আমরা উত্তরণ ঘটাতে পারি সেদিকেই আমাদের যাওয়া দরকার, আমাদেরকে যেতে হবে।


জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, জুলাই সনদে ঐকমত্য কমিশনে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট প্রকৃতপক্ষে নোট অব চিটিং। আর জামায়াত মুখে জুলাই সনদের কথা বললেও তারা নিম্নকক্ষে পিআরের কথা বলে আসন নিয়ে দরকষাকষি করছে। এটা এক ধরনের ভণ্ডামি। তিনি বলেন, জুলাই সনদে আইনি ভিত্তির বিষয়ে একটি দল সংসদের কথা বলেছে। তারা জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট চায়। আরেকটা দল নভেম্বরে গণভোটের কথা বলছে। আমরা গণভোট চাই। তবে নভেম্বরে হতে হবে এমনটি চাই না। শহীদ মিনারে গিয়ে ড. ইউনূসকেই আইনি ভিত্তি দিতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে আমরা মানব না।


বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, সরকার ১৪ মাসেও নির্বাচন করার মতো ফিটনেস তৈরি করতে পারেনি। আমরা সরকারকে বলতে চাই, এই সংস্কার, বিচার এবং পরবর্তী যে ধাপ সেটির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নেন। নির্বাচন কমিশনকে আস্থায় নেন, ভোটারদের আস্থায় নেন। সরকারে পক্ষপাতদুষ্টতা থাকার কোনো কারণ নেই। যে সরিষা দিয়ে আমি ভূত তাড়াব, সেই সরিষার মধ্যে যদি ভূত থাকে তাহলে কিন্তু এই সরকারের পক্ষ থেকে ভালো নির্বাচন দেয়া সম্ভব হবে না।
রাজনৈতিক বিবাদমান পক্ষগুলোকে আবারো অহমিকা এবং তর্ক-বিতর্ক পরিহার করে ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ’ কার্যকরে একমত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি বলেন, ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে নির্বাচন অনিশ্চিত এবং ড. ইউনুসকে পদত্যাগ করতে হতে পারে। এছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি ভয়ানক রকম জটিল হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। মঞ্জু বলেন, আগে রাজনীতি ছিল বিএনপি-আওয়ামী লীগ দ্বিদলীয় বলয়ে আবদ্ধ। আওয়ামী লীগের পতন হতে না হতে সে বলয় ভেঙে এখন বিএনপি-জামায়াত দ্বিদলীয় বলয় তৈরির চেষ্টা চলছে।



কমেন্ট বক্স
notebook

চুয়াডাঙ্গার গাইদঘাটে কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত