আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনের অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এদিন বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। সেখানে ইভিএম সংক্রান্ত বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞাতে আর্মি, নেভি এবং এয়ারফোর্স অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন মামলায় পলাতক ব্যক্তিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না- এই বিধান যুক্ত করা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা বলেন, জেলাগুলোতে যে নির্বাচন অফিস আছে সেগুলো জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা ঠিক করবেন। যারা নির্বাচন করবেন তাদের দেশি এবং বিদেশি উৎস থেকে যত আয় আছে, সম্পত্তি আছে সমস্ত কিছুর বিবরণ দিতে হবে। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এসব নির্দেশ দিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রার্থীদের দেশি ও বিদেশি আয়ের উৎস, সম্পত্তির বিবরণ নির্বাচন কমিশনে দিতে হবে এবং আমরা তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করব। আসিফ নজরুল বলেন, জামানতের পরিমাণ ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া ‘না’ ভোটের বিধান করা হয়েছে। যে নির্বাচনে একজন প্রার্থী থাকবে, ২০১৪ সালের ভুয়া ইলেকশনে বিনা ভোটে ১৫৪ জন নির্বাচিত হয়েছিলেন, এই ধরনের নির্বাচন যেন না হয়। একজন প্রার্থী থাকলে সেখানে যারা ভোটার আছে তারা ‘না’ ভোট দিতে পারবেন। তখন সেখানে আবার নির্বাচন হবে। তিনি আরও জানান, নির্বাচনে রাজনৈতিক জোট হিসেবে অংশ নিলেও তাদের দলীয় প্রতীকে অংশ নিতে হবে। তাহলে ভোটাররা পরিষ্কার ধারণা পাবেন যে কোন দলের। নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকা কর্মকর্তা কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভোট দেওয়ার সুযোগ ছিল না। এবার বিধান করা হয়েছে পোস্টাল ব্যালটে তারা ভোট দেবেন। আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, গণমাধ্যম কর্মীরা ভোট গণনার স্থানে থাকতে পারবেন। আর যারা রাজনৈতিক দলকে দান, অনুদান, চাঁদা যাই হোক না কেন ৫০ হাজার টাকার বেশি হলে তা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দিতে হবে। যিনি দেবেন তার ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে হবে। আর নির্বাচন কমিশনের আগে বিধান ছিল কোনো নির্বাচন এলাকায় কোনো ভোট কেন্দ্রে গ-গোল হলে সেটার ফলাফল বাতিল করার বিধান ছিল। এখন নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে নির্বাচনী পুরো এলাকায় এত বেশি অনিয়ম হয়েছে যে পুরো নির্বাচনী এলাকার ভোট বাতিল করা উচিত। তাহলে নির্বাচন কমিশন তা করতে পারবে, সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
দুটি আইন অনুমোদন, তিনটি নীতিগত:
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে দুইটি আইন চূড়ান্তভাবে অনুমোদন ও তিনটি আইন নীতিগতভাবে অনুমোদন করা হয়েছে। শ্রম আইন অ্যামেন্ডমেন্ট ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট আরপিও আইন চূড়ান্তভাবে পাস হয়েছে। আর দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, জুলাই স্মৃতি জাদুঘর আইন ও সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় আইনের ব্যাপারে নীতিগত অনুমোদন করা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আমাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুইটা আইন পাস হয়েছে। তিনটা আইনের নীতিগত অনুমোদন হয়েছে। যে আইনগুলো পাস হয়েছে চূড়ান্তভাবে, একটা হচ্ছে বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ। আরেকটা হচ্ছে আরপিও (জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ), এটা নির্বাচন-সংক্রান্ত। এই দুইটা আইন পাস হয়েছে। তিনটা আইন নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়েছে। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় আইন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ও জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর আইন। এই তিনটা আইন নীতিগতভাবে অনুমোদন হয়েছে। আরেকটু আমাদের আলোচনা করতে হতে পারে। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আবার উপদেষ্টা পরিষদে তোলা হবে।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, চূড়ান্তভাবে যে আইন অনুমোদন হয়েছে, এটা খুবই যুগান্তকারী একটা আইন। আমি বলব বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, এখানে আমাদের শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য, তাদের কল্যাণের জন্য অনেকগুলো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ৯০টি সেকশনে সংশোধনী আনা হয়েছে। তিনটা শিডিউলে ৯০টি সেকশনে সংশোধনী আনা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা বলেন, শ্রম আইন এখন থেকে নন-প্রফিট যে অর্গানাইজেশন আছে সেটার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। শ্রমিকের ডেফিনেশনকে বিস্তৃত করা হয়েছে। গৃহপরিচারক যারা আছেন, নাবিক যারা আছেন, তারাও এখন শ্রমিক হিসেবে শ্রম আইনের সুরক্ষা পাবেন। ব্ল্যাকলিস্টিং একটা প্রথা ছিল যে, শ্রমিক যাদের বিরুদ্ধে মালিকদের অভিযোগ থাকত, তারা ব্ল্যাকলিস্ট করত, তারা অন্য কোথাও চাকরি পেত না। ব্ল্যাকলিস্টিংকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
তিনি জানান, যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার বিধান করা হয়েছে। প্রসূতি যারা থাকবেন, তাদের কল্যাণমূলক সুবিধা অনেক বাড়ানো হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং রেজিস্ট্রেশন অনেক সহজ করা হয়েছে। শ্রমিকদের মধ্যে বৈষম্য (ডিসক্রিমিনেশন), আপনারা জানেন, একই কাজ ছেলে এবং মেয়েরা করলে মেয়েদের কম বেতন দেওয়া হতো। সেই বৈষম্যকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দুর্ঘটনা ক্ষতিপূরণ তহবিল, দুর্ঘটনা যদি হয় কর্মস্থলে, সেটার জন্য একটা ফান্ড গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। যারা দুর্ঘটনার শিকার হবেন তাদের পুনর্বাসনের জন্য বা চিকিৎসার জন্য আরও অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর অধ্যাদেশ অনুমোদন:
‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এই অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। খসড়া অধ্যাদেশ প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমরা নীতিগতভাবে অনুমোদন করেছি, সেটা হচ্ছে জুলাই ‘গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর অধ্যাদেশ’। গণভবনের জায়গায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে আমাদের যে তরুণরা প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের চিরস্থায়ী অঙ্গহানি হয়েছে, আমাদের যে অপূরণীয় আত্মত্যাগের ঘটনা আছে, আর ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারকে পতনের একটা স্মারক হিসেবে স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য, জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য আমরা গণভবনে জুলাই স্মৃতি জাদুঘর করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটা আমরা একটা আলাদা জাদুঘর হিসেবে স্থাপন করতে চাই। সেখানে লোকবল লাগবে, আর্থিক সংশ্লিষ্টতা আছে, সেজন্য আরও একটু আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। এটাও আমরা খুব দ্রুত চেষ্টা করব। খুব দ্রুত এটা চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করার জন্য মোটামুটি আইনগত বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’ আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫, এটা নিয়ে বোধহয় আমরা ২৫-৩০ বছর যাবৎ কথা বলছি। এটা ২০০৬ সালের দিকে খুব ভালোভাবে একটা চেষ্টাও করা হয়েছে। চেষ্টাও হয়েছিল আইনটা করার। কোনোভাবেই করা যাচ্ছিল না। কিন্তু আপনারা জানেন, আমাদের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আছে, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন আছে, সংস্কারের রোডম্যাপ আছে, সব জায়গায় সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। আমরা এই আইনটা নীতিগতভাবে অনুমোদন করেছি।’
সমীকরণ প্রতিবেদন