পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকে ছাত্রীর গায়ে আগুন
- আপলোড তারিখঃ ০৭-০৪-২০১৯ ইং
সমীকরণ প্রতিবেদন:
ফেনীর সোনাগাজীতে আলিম পরীক্ষাকেন্দ্রের ভেতর গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে এক ছাত্রীকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর নাম নুসরাত জাহান রাফি (১৮)। গতকাল শনিবার সকালে পরীক্ষা শুরুর আগে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় একজন শিক্ষকসহ তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। রাফির বরাত দিয়ে তাঁর পরিবার অভিযোগ করেছে, ওই মাদরাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির মামলা প্রত্যাহারের জন্য রাফিকে চাপ দেওয়া হয়েছিল। রাজি না হওয়ায় তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। রাফিকে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং পরে ফেনী সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। রাফির শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। রাফি সোনাগাজী পৌর এলাকার ২ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর চরচান্দিয়ার এ কে এম মুসা মিয়ার মেয়ে। তিনি মা-বাবার তিন সন্তানের মধ্যে একমাত্র মেয়ে। রাফি এবার ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা থেকে আলিম পরীক্ষা দিচ্ছিলেন।
রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান জানান, তিনি তাঁর বোনকে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে চলে আসেন। কিছুক্ষণ পর শুনতে পান, তাঁর বোন অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। তিনি স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের সহযোগিতায় রাফিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। ঘটনা সম্পর্কে রাফির বক্তব্যের আড়াই মিনিটের একটি অডিও সাংবাদিকদের হাতে এসেছে। ওই অডিও থেকে জানা যায়, সকাল পৌনে ১০টার দিকে তিনি পরীক্ষার হলে বসে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ওই সময় এক ছাত্রী এসে তাঁকে বলেন, ‘পাশের চারতলা ভবনের ছাদে তোমার বান্ধবী নিশাতকে মারধর করা হচ্ছে।’ এ কথা শুনে রাফি তখনই সেখানে ছুটে যান। যাওয়ার পর সেখানে বোরকা পরা চারজন তাঁকে ঘিরে ধরে এবং তারা তাঁকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেয়। কিন্তু তিনি রাজি না হওয়ায় তাঁকে কিল-ঘুষি মারে তারা। রাফি তাদের বলেন, ‘আমি অবশ্যই শিক্ষকদের সম্মান করি। তবে যে শিক্ষক ছাত্রীর গায়ে হাত দেয়, আমি তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আমরা এ মামলা প্রত্যাহার করব না। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।’ এর এক পর্যায়ে তারা রাফির গায়ে কেরোসিনজাতীয় দাহ্য পদার্থ ঢেলে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যায়। অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় রাফির চিৎকার শুনে ছুটে যান পরীক্ষাকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনরত পুলিশ কনস্টেবল রাসেল ও মাদরাসার অফিস সহায়ক মোস্তফা। তাঁরা দ্রুত রাফির গায়ে কার্পেট জড়িয়ে দিয়ে আগুন নেভান।
পরীক্ষাকেন্দ্রের সচিব নুরুল আফছার ফারুকী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা শিক্ষক মিলনায়তনে বসে প্রশ্নপত্র হলে হলে পাঠানোর ব্যবস্থা করছিলাম। ওই সময় এক শিক্ষার্থীর করুণ আর্তনাদ শুনে আমরা ছুটে যাই।’ এরপর ওই শিক্ষার্থীকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো হয় বলে তিনি জানান। জানা যায়, রাফিকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকরা তাঁকে ফেনী সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। ফেনী সদর হাসপাতালে তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। ফেনী সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. আবু তাহের বলেন, নুসরাত জাহান রাফির শরীরে কেরোসিনজাতীয় পদার্থ দিয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে। এতে তাঁর শরীরের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পুড়ে যায়। তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন বলে তিনি জানান। খবর পেয়ে ফেনীর জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজ্জামান ও পুলিশ সুপার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার হাসপাতালে গিয়ে রাফির চিকিৎসার খবর নেন। ঘটনার পর সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাসেলুল কাদের ও সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন ওই মাদরাসায় গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং ঘটনা জানার চেষ্টা করেন।
নুসরাত জাহান রাফির ভাই নোমান জানান, গত ২৭ মার্চ তাঁর বোনের শ্লীলতাহানির অভিযোগে ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁর মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে মামলা করেন সোনাগাজী থানায়। ওই মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজ ফেনী কারাগারে আছেন। এ ঘটনার জের ধরে শনিবারের আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে তিনি অভিযোগ করেন। অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করার পর গত ২৯ মার্চ তাঁর অনুগত শিক্ষার্থী ও সোনাগাজী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকসুদ আলমসহ অনেকেই তাঁর মুক্তি চেয়ে বিক্ষোভ করেন। ওই দিন অধ্যক্ষের শাস্তি দাবি করে শিক্ষার্থীদের একাংশ এবং অভিভাবকদের অনেকেই বিক্ষোভ করেছিলেন। এরপর ২ এপ্রিল আবার অধ্যক্ষের মুক্তি চেয়ে তাঁর সমর্থকরা বিক্ষোভ করে। সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির গায়ে আগুন দেওয়ার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওই মাদরাসার ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক নূরুল আফছার, আলিম পরীক্ষার্থী আরিফুর রহমান ও অফিস সহায়ক মোস্তফাকে আটক করা হয়েছে। ঘটনায় জড়িতদেরও আটকের চেষ্টা চলছে। এর যথাযথ তদন্ত ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন তিনি।
‘আমাকে বাঁচান স্যার’
পুরো শরীরে ব্যান্ডেজ নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) কাতরাচ্ছেন নুসরাত জাহান রাফি। চিকিৎসকদের কাছে আকুতি জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমাকে বাঁচান স্যার।’ এমন তথ্য সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বার্ন অ্যান্ড সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন। গতকাল রাতে ডা. সামন্ত লাল সাংবাদিকদের জানান, এই শিক্ষার্থীর শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে। মুখ ছাড়া সারা শরীর আগুনে দগ্ধ হয়েছে। তাঁর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। কথা বলার সময় শিক্ষার্থী তাঁর কাছে অনুরোধ করে বলেন, ‘আমাকে বাঁচান স্যার।’ সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘আমরা তাঁকে আইসিইউতে রেখে বাঁচানোর চেষ্টা করছি।’
কমেন্ট বক্স