মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০২৫
সর্বশেষ স্থানীয় সংবাদ জাতীয় রাজনীতি আর্ন্তজাতিক সারাদেশ অর্থনীতি খেলা বিনোদন ফ্যাক্টচেক আজকের পত্রিকা প্রযুক্তি চাকরি

টাকা দিলে অধিক পণ্য নিয়েও পার হওয়া যায় মাথাভাঙ্গা ব্রিজ!

  • আপলোড তারিখঃ ০৮-১২-২০১৯ ইং
টাকা দিলে অধিক পণ্য নিয়েও পার হওয়া যায় মাথাভাঙ্গা ব্রিজ!
ঝুকিপূর্ণ ব্রিজে ভারী যানবাহন পারাপারের অভিযোগ, আবারও ধ্বসে পড়ার আশঙ্কা অনিশ্চয়তায় ব্রিজের উপর নির্ভরশীল চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর জেলার ব্যবসায়ীরাসহ সাধারণ পথচারী   নিজস্ব প্রতিবেদক: নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাতের আঁধারে টাকার বিনিময়ে ঝুঁকিপূর্ণ মাথাভাঙ্গা ব্রিজ দিয়ে চলাচল করছে ভারী যানবাহন। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, প্রতিদিনই রাতের আঁধারে ৮-১০ জনের একটি চক্রের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে যানবাহনগুলো পারাপার করছে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজটি যেকোনো সময় আবারও ধ্বসে পড়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগীরা। জানা যায়, ১৯৬২ সালে মাথাভাঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত হয় ১৪০ মিটার দৈর্ঘ্যরে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলার একমাত্র এ সংযোগ-সেতুটি। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালে বোমা হামলায় শিকার সেতুর পূর্ব দিকের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে ভাঙা অংশ সংস্কার করে চলাচলের উপযোগী করা হয়। দীর্ঘ কয়েক যুগ পর ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবর সেতুটির মাঝের অংশ ধ্বসে পড়ে। ধ্বসে যাওয়া অংশ ইস্পাতের পাটাতন দিয়ে মেরামত করা হয়। ওই অবস্থায় চলাচলের একপর্যায়ে ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি সেতুটির কিছু অংশ আবারও ধসে পড়ে। ওই সময় প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুটির নিচে রেক্টো ফিটিংস বা প্রোটেকশন পিলার বসিয়ে উভয় পাশে ‘ঝুঁকিপূর্ণ সেতু’ সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে সেতু দিয়ে ১০ টনের অধিক মালামাল বোঝাই ভারী যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ভারী যানবাহনগুলো চলাচলের জন্য বিকল্প রুট হিসেবে দামুড়হুদা ও আলমডাঙ্গা এলাকার কয়েকটি সড়ক নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বিকল্প রুটগুলোর প্রবেশমুখে টাঙিয়ে দেওয়া হয় নির্দেশক সাইনবোর্ড। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা ও নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে সেতুটির উভয়পাশে টাকার বিনিময়ে ভারী যানবাহন পারাপারে সহযোগিতাকারী একটি চক্র গড়ে ওঠে। চক্রটির দাপটে ভারী যানবাহন চলাচল ঠেকাতে সেতুটির উভয়পাশে নিজস্ব জনবল দিয়ে পাহারার ব্যবস্থা করে সড়ক বিভাগ। বর্তমানে এই ব্রিজ দিয়ে ১০ টনের অধিক মালবোঝাই যানবাহন পারপার ঠেকাতে সড়ক বিভাগের দুজন করে তিনটি দলে মোট ছয়জন কর্মী পালাক্রমে পাহারা দিচ্ছেন। তবে বিভিন্ন সময় ওই পাহারাদারদের বিরুদ্ধে ভারী যানবাহন পারাপার করার অভিযোগ ওঠে। সত্যতা যাচাইয়ে বিভিন্ন সময় ব্রিজের ওপর দিয়ে যানবাহন পারপারের দৃশ্য দেখতে আশপাশে অবস্থান নেন সময়ের সমীকরণ টিমের সদস্যরা। এ অবস্থায় গত বুধবার রাতে কুষ্টিয়াগামী মারুফ এন্টারপ্রাইজ-এর একটি ভুট্টাবোঝাই ট্রাক (ঢাকা মেট্রো-ট-১৬-৪৪০৮) পারাপার হতে দেখা যায়। ট্রাকচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ট্রাকে ১৭-১৮ টন ভুট্টা বোঝাই রয়েছে। এভাবেই প্রতিনিয়ত পারাপার করছে ভারীযানবাহনগুলো। গত শুক্র ও শনিবার রাতেও আরও তিনটি অধিক পণ্য বোঝাই ট্রাককে ঝুঁকিপূর্ণ এই ব্রিজটি পারাপার করতে দেখা যায়। `` অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ব্রিজটির উভয় পাশের পাহারাদারদের ভয়-ভীতি, হুমকি-ধামকি দিয়ে, এমনকি মারধর করেও বেপরোয়া চক্রটি বিশেষ ব্যবস্থায় সব ধরনের ভারী যানবাহন পারাপার করাচ্ছে। এ বিষয়ে ব্রিজের পাহারাদারদের সঙ্গে কথা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, ‘আমরা সবাই হতদরিদ্র পরিবারের সদস্য। সেতু কর্তৃপক্ষ আমাদের পাহারায় বসিয়েছে। পাহারা চলাকালে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি ভারী যানবাহনগুলো যাতে ব্রিজটির ওপর না ওঠে। কিন্তু ব্রিজটির আশপাশের ৮-১০ জনের একটি চক্র ভয়-ভীতি দেখিয়ে ভারী যানবাহনগুলো পার করে নিয়ে যায়। বাধা দিতে গেলে মা-বাবা তুলে গালিগালাজসহ হাত-পায়ের রগ কেটে দেওয়ারও ভয় দেখানো হয়। এ অবস্থায় আমরা কী করতে পারি?’ তাই নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবি জানান পাহারাদারেরা। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেন, ভারী যানবাহন পারাপার করানো চক্রটি ৫০০, ৩০০, ২০০ টাকার বিনিময়ে পণ্যবাহী ভারী ট্রাকগুলো পারাপার করছে। আর এতে করে ব্রিজটিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে প্রতি রাতে ২০-২৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। ব্রিজটির উভয় পাশে গত কয়েক দিনের অনুসন্ধানে দেখা যায়, মেহেরপুর অঞ্চল থেকে আসা পণ্যবাহী ভারী যানবাহনগুলো দৌলাতদিয়াড় টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের আশপাশে অবস্থান নেয়। আবার মেহেরপুর যাওয়ার জন্য পণ্যবাহী ভারী যানবাহনগুলো সরকারি বালিকা বিদ্যালয়সহ একাডেমি মোড় পর্যন্ত অবস্থান নেয়। পরে সুযোগমতো ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজটি পার হতে চক্রটির খোঁজ করেন চালকেরা। আবার মালামাল ভর্তি ট্রাকগুলোর কাছেও চক্রটির কেউ কেউ হাজির হয়ে যান। দামদর ঠিক হয়ে গেলে কখনো পণ্যবাহী গাড়ির সামনে মটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দিতে দিতে, আবার কখনো ব্রিজে দায়িত্বরত পাহারাদারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে গাড়িগুলো পার করে চক্রটি। প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, চক্রটির দৌলাতদিয়াড় অংশের নিয়ন্ত্রণ করছেন দক্ষিণপাড়ার ফকির মিয়ার ছেলে বুলেট, একই এলাকার আকুব্বরের ছেলে ছানোয়ার ও সর্দারপাড়ার কাতর মন্ডলের ছেলে চকলা। প্রথম দিকে বিভিন্ন দোকানের মাধ্যমে টাকা নিলেও এখন সেতুর আশপাশে অবস্থান নিয়ে সরাসরি নিজ হাতে টাকা নিয়ে অতিরিক্ত পণ্যবাহী ট্রাকগুলো পার করছেন তাঁরা। এ চক্রটির দাপট এতটাই যে তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করতেও ভয় পান স্থানীয়রা। এ ছাড়াও অন্য আরও একটি চক্র বড় বাজার অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এ চক্রটির বেশির ভাগ সদস্যই বড় বাজার-মেহেরপুর লোকাল বাস কাউন্টারের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তাঁরা আরও অভিযোগ করেন, ওই চক্রের সদস্য বিদ্যুৎ, সুরাপ মটরসাইকেল নিয়ে পণ্যবাহী ট্রাকের সামনে মহড়া দিতে দিতে ভারী যানবাহনগুলো পার করে নিয়ে যান। এ ছাড়াও সেতু, রানাসহ আরও ৪-৫ জন এ চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। স্থানীয়রা আশঙ্কা প্রকাশ করে আরও বলেন, দৌলাতদিয়ার থেকে আলুকদিয়া পর্যন্ত এলাকাকে চুয়াডাঙ্গা জেলার ব্যবসাপ্রধান অঞ্চল হিসেবে ধরা হয়। সব ধরনের যানবাহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এ এলাকাটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। শেষবার ব্রিজটি ধ্বসে পড়লে সে সময় উভয় পাশে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। ফলে এ এলাকার ব্যবসায় ধ্বস নেমে আসে। সরকারও হারায় কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। পরবর্তীতে ব্রিজটি মেরামত করে সর্বোচ্চ ১০ টনের যানবাহন চলাচলে কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো আবারও প্রাণ ফিরে পায়। তবে একটি চক্র টাকার বিনিময়ে ভারী যানবাহনগুলো পারাপার করিয়ে দেওয়ার কারণে ব্রিজটি আবারও হুমকির মুখে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে চুয়াডাঙ্গা সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আদম আলী বলেন, ‘এ বিষয়ে লিখিত ও মৌখিকভাবে একাধিকবার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের পক্ষ থেকে এখনো কোনো কার্যকরী সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। এই ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর ওপর দিয়ে যেন ১০ টনের অধিক ভারী যানবাহন যাতায়াত না করে, সেটির নিয়ন্ত্রণ করতে হয় সড়ক বিভাগকেই। অথচ সড়ক বিভাগের জনবল-সংকটের কারণে প্রতিনিয়ত সড়ক ও সেতু দেখাশোনা ও সংস্কারের পাশাপাশি মাথাভাঙ্গা ব্রিজ পাহারা দিতে হিমশিম খেতে হয়। কিছু মাস্তান ছেলে আছে, যারা আমাদের কর্মীদের মারধর করে যানবাহন থেকে টাকা নিয়ে সেতু পার করে দেয়। আবার তারাই পাল্টা অভিযোগ করে আমাদের ও আমাদের কর্মীদের নামে।’ তিনি আরও জানান, গত ২৩ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসক বরাবর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত আহমেদ মজুমদার স্বাক্ষরিত এক পত্রে (স্মারক নং : ১৫৫৩, তারিখ : ২৩/০৯/২০১৯ ইং) মাথাভাঙ্গা ব্রিজে ১০ টনের অধিক ভারী যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়। এমতাবস্থায়, সূত্রস্থ স্মারক সভার সড়ক বিভাগে নিয়োজিত সড়ক শ্রমিকদের সঙ্গে বাস-ট্রাক মালিক সমিতির প্রতিনিধি ও পুলিশ প্রশাসনের লোকবলের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ মাথাভাঙ্গা ব্রিজের ওপর দিয়ে ১০ টনের অধিক ভারী যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার ও পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে অভিযোগ পেয়েছেন। তবে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানাতে না পারলেও মাথাভাঙ্গা ব্রিজ দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় কার্যকরী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তাঁরা। এর আগে ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজটি মেরামতের জন্য প্রায় তিন কোটি টাকা বরাদ্দ আসে চুয়াডাঙ্গা সড়ক ও জনপথ বিভাগের হাতে। সেই টাকা দিয়ে ঠিকাদারের মাধ্যমে সেতুটির নিচে রেক্টো ফিটিংস বা প্রোটেকশন পিলার বসানোর পর হালকা যানবাহনগুলো চলাচলের অনুমতি দেয় কর্তৃপক্ষ। এর কিছুদিন পর ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজটির পাশে নতুন ব্রিজের নির্মাণ কাজ শুরু করে কর্তৃপক্ষ। তবে এই নতুন ব্রিজ নির্মাণ হতে প্রায় দুই বছর সময় লাগবে। নতুন ব্রিজ নির্মাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত পুরোনো এ ব্রিজটি দিয়েই যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখতে হবে। তবে এর মধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত পুরোনো ব্রিজটি আবারও ধ্বসে পড়লে পুনরায় মেরামতের জন্য কোনো বরাদ্দ পাওয়া যাবে না। আবার বরাদ্দ এলেও তাতে অনেক সময় লেগে যাবে। এই সময়ের মধ্যে ব্রিজটি কার্য-সক্ষম রাখতে ১০ টনের অধিক পণ্যবোঝাই যানচলাচল নিয়ন্ত্রণ জরুরি।


কমেন্ট বক্স
notebook

১০ পুলিশ সুপারকে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি