করোনার নীরব শিকার কোমলমতি শিশুরা
- আপলোড তারিখঃ ২১-০৮-২০২০ ইং
সমীকরণ প্রতিবেদন:
রাজধানীর গোলাপবাগের বাসিন্দা তপন সরকার এবং তার স্ত্রী শিল্পী রানী সরকার। সম্প্রতি তাদের ছয় বছরের কন্যা তুষি সরকারের অদ্ভুত আচরণে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তারা। নিয়ে যান একজন শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে। তিনি মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখানোর পরামর্শ দেন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তাদের জানান, দীর্ঘদিন বাড়ির ভেতরে থাকার কারণে তুষি গুরুতর মানসিক চাপের মধ্যে পড়েছে। এটা তারই পরিণতি। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত ৫ মাস ধরে ঘরবন্দি থাকার পর বেশিরভাগ শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই তারা অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। এজন্য অভিভাবকরা তাদের শিশু সন্তানদের নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। শিশুরা করোনাভাইরাসে অপেক্ষাকৃত কম আক্রান্ত হলেও বলা হচ্ছে তারা করোনাভাইরাসের নীরব শিকার। শিশু বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনাভাইরাস প্যান্ডেমিক (মহামারি) শুরু হওয়ার পর থেকে শিশুরা এমনিতেই মানসিক চাপে ভুগছেন। স্কুল নেই, বন্ধুদের সাথে দেখা নেই, খেলা নেই, ঘরের চার দেয়াল ছাড়া কোথাও বেড়াতে যাওয়ার উপায় নেই। তারা বলছেন, শিশুরা বুঝতে পারে না করোনাভাইরাস কী, এর ক্ষতিটা কী, কেন তাদের সারাক্ষণ ঘরেই থাকতে হচ্ছে। হঠাৎ করে তার স্বাভাবিক রুটিন এলোমেলো হয়ে গেছে। তাদের আবেগ ও আচরণের মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। অকারণে জেদ করছে, উত্তেজিত হচ্ছে, কান্নাকাটি করছে, নানা বায়না ধরছে, অনলাইন গেমসে আসক্তি বাড়ছে। খাওয়া-দাওয়ার প্রতিও কোনো মনোযোগ নেই।
জানতে চাইলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এ মোহিত কামাল বলেন, করোনাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সামনের সারির ডাক্তার, নার্স, পুলিশ ও সাংবাদিকদের সন্তানদের মনোজগতে বেশি প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেন, 'শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিনোদনের জায়গা। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় সেই বিনোদন আর পাচ্ছে না তারা। এর পাশাপাশি দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকার কারণে বিরক্তি প্রকাশ করছে, রেগে যাচ্ছে শিশুরা। অল্পতেই ভাঙচুর করছে। এদিকে শিশুদের শান্ত করতে গিয়ে বাবা-মা তাদের সামনে বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস তুলে দিচ্ছেন। ফলে টেলিভিশন ও ভিডিও গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ছে শিশুরা। ফলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও হীনম্মন্যতার শিকার হচ্ছে তারা। এতে অনেকের অটিজম, মনোযোগ হ্রাস ও তীব্র বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের প্রফেসর ড. আফরোজা হোসেন বলেন, সাধারণ ক্রিয়াকলাপ থেকে বিচ্ছিন্নতা শিশুদের মানসিক সংকটে ফেলে দেয়। স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্নতা শিশুদের মানসিক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। যা তীব্র স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিজঅর্ডার হতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর বয়সিরা অনেক বেশি সময় ঘরে দরজা আটকে থাকছেন, অনলাইনে অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছেন। তাদের মধ্যে অনেকের বিষণ্নতা দেখা যাচ্ছে। বাবা-মায়ের মানসিক চাপের কারণে শিশুদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পরিমাণ বেড়েছে। যার ব্যাখ্যা হয়তো বুঝতে পারছে না শিশুর সরল মন। এতে বাবা-মায়ের ওপর তাদের ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। তাদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। শিশুদের মনে নিশ্চিতভাবেই দীর্ঘমেয়াদি একটা ট্রমা (মানসিক চাপ) রেখে যাবে করোনাভাইরাস সৃষ্ট এ মহামারি।
প্রসঙ্গত করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকায় গত ১৭ মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর আগে সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তিতে ৬ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা করেছিল সরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পর থেকে ঘরের মধ্যেই জীবনযাপন করছে শিশুরা। শুরুতে তারা এটিকে ছুটি হিসেবে নিয়ে উপভোগ করছিল। পরে আস্তে আস্তে তারা বুঝতে পারে যে বাড়ির বাইরে পা রাখা এবং তাদের বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করারও কোনো সুযোগ নেই। তাদের প্রতিদিনের রুটিন পুরোপুরি বদলে গেছে। তারা বেশিরভাগ শিশু-কিশোরই দেরিতে ঘুমাতে যাচ্ছে এবং সকালে ঘুম থেকে উঠতে সময় নিচ্ছে।
সম্প্রতি ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণা দেখা গেছে, করোনার প্রাদুর্ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় উল্লেখযোগ্য হারে কমছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সময়। আগে যেখানে গ্রামের শিক্ষার্থীরা দিনে স্কুল, কোচিং ও বাড়িতে নিজেদের পড়ালেখা মিলে ১০ ঘণ্টা ব্যয় করত, এখন তা নেমে এসেছে মাত্র দুই ঘণ্টায়। সেই হিসেবে ৮০ শতাংশ সময় কমেছে পড়াশোনার। গবেষণায় দেখা যায়, মাত্র ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনে 'ঘরে বসে শিখি' ও 'আমার ঘরে আমার স্কুল' এই দুটি অনুষ্ঠান দেখছে। ঢাকার শিশু হাসপাতালের ডেভেলপমেন্টাল পিডিয়াট্রিশিয়ান ডা. রিয়াজ মোবারক বলেছেন, অনেক পরিবারে খাদ্য সংকট কারণে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে। শিশুর যে সুসম পুষ্টি সেটা হচ্ছে না। সে কারণে শিশুর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি, ওজন বাড়া এসব কমে যাবে। তিনি বলছেন, ঘরে বসে থেকে শিশুরা একাকিত্বে ভুগছে। বুদ্ধির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে আরেকটি সমবয়সিদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ শিশুরা সবচেয়ে বেশি পায় স্কুলে, প্রতিবেশী, আত্মীয়দের পরিবারে। সেই সুযোগ তাদের একেবারেই কমে গেছে। শিশু চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বদ্ধ জীবন শিশুদের খিটখিটে করে তুলছে। তারা হয়ে উঠছে আরও অবাধ্য। অবস্থার এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে মানসিক অবসাদ কাটাতে লকডাউনের মধ্যে অভিভাবকরা ছুটছেন চিকিৎসকের কাছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, বিষয়টি যথেষ্ট চিন্তার।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত পাঁচ মাসে অন্য রোগীদের তুলনায় মানসিক সমস্যা নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। অন্য সময় দিনে যেখানে ১৫-২০ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে আসতেন এখন সেখানে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ থেকে ৭০ জনের কাছাকাছি। এর মধ্যে আবার ১০-২০ জন শিশু। তবে তাদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে অবসাদ শিশুদের সংখ্যা। চিকিৎসকদের মতে, বন্দি জীবনে সবচেয়ে বেশি বকুনির মুখে পড়তে হচ্ছে শিশুদের। যা তাদের মনে গভীর চাপ তৈরি করছে। একজন শিশু চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার এক শিশু রোগী পাঁচ মাস ধরে তার প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে পারছে না। এমনকি স্কুলের এক অঙ্কের দিদিমণি যিনি খুব মজা করে ক্লাস নেন তাকেও অনলাইন ক্লাসে দেখতে না পাওয়ায় তার মনের ওপর চাপ পড়েছে। ওই রোগীর মা জানিয়েছেন 'মেয়ে এমনিতেই শান্ত প্রকৃতির; কিন্তু ইদানীং কেমন যেন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। কথা শুনছে না। নিষেধ করলে সেই কাজটা আরও বেশি করে করছে। লকডাউনের কারণে শিশুদের জীবনাচার বদলে যাওয়ায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে- এই সময় অভিভাবকদের উচিত, সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে বেশি করে সময় কাটানো। বন্ধু-আত্মীয়দের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে কথা বলানো। বাড়ির মধ্যে বাগানে, ছাদে, প্রকৃতির সঙ্গে শিশুদের নিয়ে সময় কাটানো। শুধু তাই নয়, কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে শিশুদের ইচ্ছাকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে যা চলছে সে বিষয়ে জানার অধিকার শিশুদেরও রয়েছে। বড়দেরও দায়িত্ব রয়েছে তাদের মানসিক যন্ত্রণা থেকে দূরে রাখা। তাদের বয়স অনুযায়ী কথা বলা। তারা কী প্রতিক্রিয়া দেখায় তা খেয়াল রাখা, তাদের উদ্বেগের মাত্রা অনুধাবনের চেষ্টা করা ও তাদের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া। শিশুদের দিকে বিশেষ মনোযোগ ও তাদের হাসিখুশি রাখার উদ্যোগ নিতে অভিভাবকদের প্রতি পরামর্শ দিয়েছেন শিশু ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ঘরবন্দি অবস্থায় থাকতে গিয়ে শিশুদের মধ্যে মানসিক অবসাদ তৈরি হচ্ছে। যা তাদের মনোজগতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এ প্রসঙ্গে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বলেন, দীর্ঘ সময় বাইরে না যাওয়ার ফলে শিশুরা ভয় পেতে পারে, বিরক্ত হতে পারে, রাগ করতে পারে, হতাশ হতে পারে, দুষ্টুমি বেড়ে যেতে পারে। এটা স্বাভাবিক। তাই অযথা বাচ্চাকে বকাঝকা না করার জন্য অভিভাবকদের প্রতি পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। অতিরিক্ত বকাঝকা শিশুকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতে পারে। এতে করে অবস্থা আরও দুর্বিষহ হতে পারে।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের উপপরিচালক সাবিরা সুলতানা নূপুর বলেন, শিশুদের আগ্রহের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার এটি একটি সুযোগ। এ সুযোগে নতুন ছবি আঁকা, নতুন গান বা নাচ তুলে নেওয়া কিংবা যার যেটিতে আগ্রহ তাকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে। করোনাকালে শিশুর এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় বলতে গিয়ে মোহিত কামাল বলেন, 'স্মার্টফোনে কবিতা আবৃত্তি, চিত্র আঁকা, গান ও ছড়া পরিবেশন করে শিশুর সৃজনশীলতা বাড়ানো যেতে পারে। অর্থাৎ ডিজিটাল ডিভাইসের ইতিবাচক দিকগুলোতে শিশুদের ব্যস্ত রাখতে পারেন অভিভাবকরা। এক্ষেত্রে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ রাখার কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া করোনাভাইরাস সম্পর্কে বেশি আতঙ্কিত না করে এ বিষয়ে শিশুদের বুঝিয়ে বলতে হবে।
কমেন্ট বক্স