প্রধানমন্ত্রী পদে কোনো ব্যক্তি যেন দুই মেয়াদের বেশি না থাকতে পারেন- এমন প্রস্তাবে বিএনপি সম্মতি দেওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের মধ্যদিয়ে সংবিধান সংস্কার ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে করে দীর্ঘদিন পর একটি স্পর্শকাতর ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনা তৈরি হলো। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চলমান বৈঠকে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, তারা এখন একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ বা ১০ বছর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকার পক্ষে। এর আগে দলটি এক মেয়াদ বিরতি দিয়ে পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ রাখার পক্ষে থাকলেও গত মঙ্গলবার রাতে ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বড় ধরনের ছাড় দিয়ে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।
লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে আলোচনার পর এই সিদ্ধান্ত জানানো হয় এবং গতকাল বুধবার কমিশনের বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানান। তবে বিএনপি ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ (এনসিসি) নামে একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছে। দলটির মতে, এ ধরনের কাউন্সিল সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বরং বিদ্যমান নিয়োগ আইন সংস্কার ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে স্বচ্ছ সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিয়োগের পক্ষেই দলটির অবস্থান। এই অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বিএনপি নেতারা বলেন, গণতন্ত্র রক্ষায় ফ্রিডম অব প্রেস, একটি কার্যকর ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, শক্তিশালী দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য। এইসব প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার আওতায় আনাই হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রকৃত রক্ষাকবচ।
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে জানানো হয়, পূর্বের প্রস্তাবিত এনসিসি কাঠামোর পরিবর্তে ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ নিয়োগ কমিটি’ নামে একটি নতুন কাঠামো প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির নাম বাদ রাখা হয়েছে এবং নিয়োগ কমিটির সদস্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি ও আইন দ্বারা নির্ধারিত রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়। বিএনপি’র মতে, এই কাঠামোর মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের প্রভাবহীন একটি নিরপেক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা যেতে পারে, তবে নতুন করে সংবিধানে আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান না এনে বিদ্যমান আইনের সংস্কারের মাধ্যমে নিয়োগ ব্যবস্থা কার্যকর করাই হবে গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বৈঠকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়েও আলোচনা হয়। সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি—এই ছয়টি মূলনীতি নিয়ে অধিকাংশ দল একমত হলেও চূড়ান্ত ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি।
জামায়াতে ইসলামী বলেছে, সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও আস্থা’, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এবং পঞ্চম সংশোধনীর ধারা থাকতে হবে। অন্যদিকে, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি, বাসদসহ কিছু দল বলছে, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী থাকা উচিত এবং তা কোনোভাবে পরিবর্তন বা আপসযোগ্য নয়। জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের কোনো সম্পর্ক নেই। মুজিববাদী দর্শনের বাইরে গিয়ে নতুন ভিত্তিতে ঐকমত্য তৈরি করতে হবে।’ অন্যদিকে আমার বাংলাদেশ পার্টির সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা না রেখে বিরোধীদলীয় নেতাসহ সব পক্ষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করলে নিয়োগ প্রক্রিয়া আরও গ্রহণযোগ্য হবে।’
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘কমিশন এনসিসি কাঠামো থেকে সরে এসে নতুন নিয়োগ কমিটি প্রস্তাব করেছে, যেখানে নিয়োগ শুধু সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে। অ্যাটর্নি জেনারেল ও সেনাবাহিনী প্রধানদের নিয়োগ এ কমিটির আওতায় আসবে না।’ তিনি জানান, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্প্রীতি ও পক্ষপাতহীনতা এই সাতটি বিষয়ের মধ্যে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সমর্থন থাকলেও পুরোপুরি ঐকমত্য তৈরি হয়নি।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘মূলনীতির ক্ষেত্রে একটি আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে ঐক্যমত্য জরুরি। আমরা আশাবাদী, ভবিষ্যতের আলোচনায় এই বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে উঠবে।’ একইসঙ্গে, বৈঠকে বিএনপি এও উল্লেখ করে যে, যেহেতু কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থাটি বাতিল হয়েছে, তাই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, একটি পূর্ণ স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং শক্তিশালী দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ছাড়া কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। তিনি বলেন, ‘ফ্রিডম অব প্রেস যেখানে শক্তিশালী, সেখানে গণতন্ত্র টিকে থাকে। তাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা গণতন্ত্র রক্ষার পূর্বশর্ত।’
গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, সিপিবি, বাসদ, এলডিপি, খেলাফত মজলিস, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, আমার বাংলাদেশ পার্টি, নাগরিক ঐক্য, জাসদ, এনডিএম, গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি, গণঅধিকার পরিষদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় নাগরিক পার্টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও গণফোরামসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। কমিশনের পক্ষ থেকে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আগামী বৈঠকে আবারও তোলা হবে।