বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর, ২০২৫
সর্বশেষ স্থানীয় সংবাদ জাতীয় রাজনীতি আর্ন্তজাতিক সারাদেশ অর্থনীতি খেলা বিনোদন ফ্যাক্টচেক আজকের পত্রিকা প্রযুক্তি চাকরি

গণভোটে একমত দলগুলো, বাস্তবায়নে মতভেদ

  • আপলোড তারিখঃ ০৮-১০-২০২৫ ইং
গণভোটে একমত দলগুলো, বাস্তবায়নে মতভেদ

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে জনগণের সম্মতি নেওয়ার জন্য গণভোট আয়োজনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। প্রস্তাবিত সনদ বাস্তবায়নে ‘গণভোট’ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (আপত্তি বা দ্বিমত) নিয়ে নতুন জটিলতা দেখা দিয়েছে। এতে পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে বড় দুই দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। জটিলতা নিরসনে আজ বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও সংলাপে বসছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সংশ্লিষ্টরা জানান, কমিশনের সংলাপে বিএনপিসহ কয়েকটি দল প্রস্তাব করেছে, ‘নোট অব ডিসেন্ট’ জুলাই সনদের অংশ। যে দলের যে সংস্কারে ভিন্নমত আছে, তারা সংসদ নির্বাচনে জয়ী হলে সেগুলো কার্যকরের বাধ্যবাধকতা থাকবে না। এমন বিধান রেখেই গণভোট হতে হবে। আর জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জুলাই সনদে থাকা ৮৪ প্রস্তাবকে একটি প্যাকেজ বিবেচনা করে গণভোট হতে হবে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ বিজয়ী হলে সনদে উল্লেখিত সব প্রস্তাব বাস্তবায়নে বাধ্য থাকবে পরবর্তী সংসদ ও সরকার।


তবে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, ঐকমত্য কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হওয়া গণভোটের কোনো আইনি বিধান বর্তমানে নেই। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংবিধান ও আইনি কাঠামোর মধ্যেই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, বিগত শেখ হাসিনার শাসনামলে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে গণভোটের বিধান বাতিল করা হয়। এছাড়া গণভোট আইন, ১৯৯১-এর মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নসংক্রান্ত গণভোট আয়োজন করলেও তা আইনসিদ্ধ হবে না। কারণ এ আইনে শুধু সংসদে পাস হওয়া কোনো বিল নিয়ে গণভোট করার কথা বলা হয়েছে। এ অবস্থায় অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৯১ সালের এ আইনটিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন এনে গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গত ডিসেম্বরে দেওয়া হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের আলোকে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীকে সাংবিধানিক ভিত্তি ধরতে হবে। গণভোটের সিদ্ধান্ত হলে সেটি বাস্তবায়নের জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর সংশোধনও প্রয়োজন পড়বে। বিদ্যমান আইনের এসব সংশোধন ছাড়া গণভোট অনুষ্ঠান আইনসংগত হবে না বলে জানান তিনি।


রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বলেন, বাংলাদেশের গণভোটের ঐতিহ্য খুবই খারাপ। মূলত জনগণের সম্মতি ছাড়া যারা ক্ষমতা দখল করেছিল, তারা নিজেদের বৈধতা দিতে গণভোট প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করেছে তখন। ফলে তখনকার এ গণভোট আসলে সেভাবে জনমনে স্বীকৃতিই পায়নি। কারণ এর কার্যত কোনো গুরুত্বই ছিল না। তবে গণভোটে জনমতের প্রতিফলন আগে না এলেও সামনে কেমন হবে, তা নির্ভর করবে ভোটটি কখন কার অধীনে কোন বিষয় নিয়ে হবে তার ওপর। তিনি বলেন, এবারের গণভোট আলাদা। কারণ এটি কোনো ব্যক্তি বা সামরিক শাসকের বৈধতা দেওয়ার জন্য নয় বরং একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক সনদ বাস্তবায়নের জন্য। তাই এর গুরুত্ব আগের গণভোট থেকে অনেক বেশি। ফলে গণভোটকে যদি অবহেলা করা হয়, তবে তা জনগণের প্রত্যাশা ভঙ্গ করবে এবং আবারও রাজনৈতিক আস্থাহীনতা তৈরি করবে।


সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, দেশে এখন গণভোটের কোনো আইন নেই। এছাড়া জুলাই সনদ অনেক পাতার। এর মধ্যে কেউ কিছু পাতার বিষয়ের সঙ্গে একমত, আবার আরেক পাতার সঙ্গে একমত নন। সে ক্ষেত্রে এটা পড়ে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ সিদ্ধান্ত কীভাবে নেবেন সেই প্রশ্ন রয়েছে। তার মতে, ডকুমেন্টের ওপর গণভোট হয় না। তিনি বলেন, ধরেন সনদ চার পাতার। এ চার পাতা পড়ে বোঝার মতো মানুষ কয়জন। কেবল পড়তে জানলেই তো হবে না, পড়ে বিষয়টা বুঝতে হবে। চার পাতা পড়ে পক্ষে-বিপক্ষে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলবে কীভাবে। এরকম গণভোট দুনিয়ার কোথাও নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।


বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, যদি জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট করা হয়, তাহলে সংবিধান আদেশ বা সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যাতে ম্যান্ডেটের অভাব না হয়, জনগণ এটা সমর্থন করে কি না, সে অনুমতির জন্য গণভোট হবে। জাতীয় নির্বাচনের দিনই আলাদা ব্যালটে জনগণের মত নেওয়া যায়। তাতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা বাধ্যতামূলক হবে এবং কেউ আর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। গত সোমবার এক আলোচনা সভায় তিনি একটি অধ্যাদেশ জারি করে গণভোট আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্ব দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তবে সনদে যেসব প্রস্তাবে কোন দল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে সেই দলের ওইসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা থাকবে না বলে মনে করেন সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘নোট অব ডিসেন্ট’ এখন জুলাই সনদেরই অংশ। গণভোট হবে সনদের ওপর। সেখানে লেখা থাকবে- কোন দলের কোন বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে। ফলে জনগণ তা জেনেই আগামী সংসদকে সনদ বাস্তবায়নে দায়িত্ব দেবে। যে দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, সেই তাদের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ অনুযায়ী সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবে। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব কমিশনের সংলাপে তুলে ধরা হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, গণভোটে জনগণ সনদ অনুমোদন করলে সব সংস্কার বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দল বাধ্য থাকবে। গণভোট হবে জুলাই সনদের পক্ষে। এ ক্ষেত্রে ‘হ্যাঁ’ বিজয়ী হলে, অর্থাৎ জনগণ সনদের পক্ষে রায় দিলে তা আগামী সংসদ ও সরকারকে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোন দল কী ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে, তা বিবেচ্য নয়।


জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার স্বার্থে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সহ জুলাই সনদ প্রণয়ন করা হলেও তা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে ফের আলোচনা শুরু করেছে কমিশন। গতকাল মঙ্গলবার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠকে একাধিক প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে নতুন প্রস্তাব আজ বুধবার দুপুরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংলাপে দলগুলোর কাছে তুলে ধরা হবে। দলগুলোর সঙ্গে এটিই হবে কমিশনের সর্বশেষ বৈঠক। বৈঠকের আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে আগামী ১০ অক্টোরের মধ্যে বাস্তবায়ন সুপারিশসহ জুলাই সনদের চূড়ান্ত কপি সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে কমিশন। এরপর সরকার জুলাই সনদ স্বাক্ষরের তারিখ নির্ধারণ করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরের পর জুলাই সনদের পক্ষে গণভোট আয়োজনের আহ্বান জানাবে সরকার। এরপর নির্বাচন কমিশন গণভোটের আয়োজন করবে।


ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, তারা মনে করেন, জুলাই সনদের অন্তর্ভুক্ত সব বিষয় গণভোটে যাওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের একমত হওয়া বিষয়গুলো একটা প্যাকেজে রাখা এবং যেগুলোয় ভিন্নমত আছে, সেগুলো আরেকটা প্যাকেজে রাখা। দুটি আলাদা প্রস্তাব হিসেবে উপস্থাপন করা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো গণভোটের বিষয়ে একমত হলেও সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে একাধিক প্রস্তাব করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ ও তা নিয়ে আবারও দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। 


রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা এবং নাগরিক সমাজের পরামর্শ ও বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে ইতিমধ্যে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করেছে কমিশন। সনদে উল্লেখিত সংস্কারের ৮৪ সিদ্ধান্তের ৭৩টিতে অধিকাংশ দল একমত হয়েছে। তবে সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ যে ১৯টি বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, সেখানে ১০টি বিষয়ে ভিন্নমত ও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে। সেই প্রস্তাবগুলো হচ্ছে- সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ; সংসদীয় কমিটির সভাপতিত্ব; নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ; রাষ্ট্রপতির ক্ষমাসংক্রান্ত বিধান; বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ; জরুরি অবস্থা ঘোষণা; প্রধান বিচারপতি নিয়োগ; প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান; নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান; প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল; সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব; দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ বিশেষত উচ্চকক্ষের গঠন; সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি; উচ্চকক্ষের এখতিয়ার; রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি; রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব; তত্ত্বাবধায়ক সরকার; নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ এবং রাষ্ট্রের মূলনীতি। এর মধ্যে বিএনপির ৯টি বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে।


উল্লেখ্য, সংবিধানের ১৪২ (১ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংবিধানের প্রস্তাব অথবা কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ সংশোধনের জন্য সংসদে বিল পাস হওয়ার পর তাতে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেবেন কি না, সে প্রশ্নটি যাচাইয়ের জন্য গণভোটের বিধান রয়েছে। এ উদ্দেশ্যে ‘গণভোট আইন-১৯৯১’ প্রণীত হয়। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে গণভোটের ব্যবহার মূলত তিনবার হয়েছে। তার প্রথম দুটিকে বলা হয় প্রশাসনিক গণভোট আর তৃতীয়টিকে বলা হয় সাংবিধানিক গণভোট। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের পক্ষে ‘হ্যাঁ’-তে ভোট পড়েছিল ৯৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। এর আগে ওই বছরের এপ্রিলে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থেকে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন তিনি। আর ১৯৮৫ সালে দ্বিতীয় প্রশাসনিক গণভোটে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল ৯৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। এ নির্বাচনে বিষয়বস্তু ছিল এরশাদের নীতি ও কর্মসূচির প্রতি আস্থা এবং নির্বাচনের আগে পর্যন্ত তার রাষ্ট্রপতি পদে থাকায় জনগণের সম্মতি আছে কি না।



কমেন্ট বক্স