ইপেপার । আজশুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাসপাতালে নবজাতক ও মায়ের মৃত্যু; ভুল চিকিৎসা-অবহেলা থামছে না

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৩:৪১:০৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৩
  • / ৫২ বার পড়া হয়েছে

চিকিৎসাসেবা নিতে এসে ক্ষতির শিকার হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের দুর্ভাগ্যের শিকার যদি প্রভাবশালী কেউ হন তাহলে কিছুটা হইচই হয়। অন্যদিকে সমাজের দুর্বল শ্রেণীকে এ জন্য দুঃখ-বেদনা নিয়ে গুমড়ে মরতে হয়। তারা প্রতিকার পাওয়ার কোনো অধিকার রাখেন না। তবে শেষ পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে যারা অপরাধ করেন; তারা ছাড় পেয়ে যান। সর্বোচ্চ কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ হয়তো কেউ পান। এবার এক প্রসূতি হাসপাতালে এসে প্রাণ দিলেন। তিনি একটি বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রী হওয়ায় কিছুটা শোরগোল হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত হয়তো এই ঘটনারও প্রকৃত তদন্ত হবে না। কেউ যদি অপরাধ করে থাকেন তারা পার পেয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ইডেন কলেজের ছাত্রী কুমিল্লার তিতাসের মাহবুবা রহমান আঁখি অস্ত্রোপচার ছাড়া সন্তান জন্ম দিতে চেয়েছিলেন। এ জন্য গর্ভে সন্তান আসার পর ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা: সংযুক্তা সাহার চিকিৎসা নিয়েছেন। ৯ জুন মধ্যরাতে প্রসব বেদনা উঠলে কুমিল্লা থেকে তাকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে আসে পরিবার। তারপর সংযুক্তার সহযোগীরা অস্ত্রোপচার ছাড়া সন্তান প্রসব করানোর চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে জটিলতা সৃষ্টি হলে অস্ত্রোপচার করা হয়। জন্ম হওয়া শিশুটি ওই দিন মারা যায়। মায়ের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। একপর্যায়ে তাকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত রোববার তিনিও মারা যান।

প্রসূতি-নবজাতকের মৃত্যু নিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে জরুরি অবস্থা মোকাবেলার মতো উপযুক্ত যন্ত্রপাতি ছিল না। হাসপাতালটির পক্ষ থেকে রোগীর স্বজনদের মিথ্যা কথাও বলা হয়েছে। অস্ত্রোপচারে আইসিইউ-সিসিইউর ব্যবস্থা থাকতে হয়। অত্যন্ত জরুরি যন্ত্রপাতি অস্ত্রোপচারের সময় অকেজো ছিল। স্পর্শকাতর সময়ে রোগী এর সাপোর্ট পাননি। সন্তান প্রসবের পর তার অনিয়ন্ত্রিত রক্তক্ষরণ হয়। এ সময় তিনি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন। কুমিল্লা থেকে যখন আঁখিকে রাতে হাসপাতালে আনা হয় তাদের জানানো হয় সংযুক্তা হাসপাতালে কর্তব্যরত রয়েছে। বাস্তবে তখন তিনি হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন না। তার পরিবর্তে সহযোগীরা প্রসূতিকে চিকিৎসাসেবা দেন।

খবরে প্রকাশ, সিজারিয়ানের ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলোর যে গাইডলাইন অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক তা মানা হয়নি। উপযুক্ত সরঞ্জামাদির অভাবের পাশাপাশি অবহেলা-গাফিলতিও পাওয়া গেছে। সংযুক্তার দক্ষতা-যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তিনি সামাজিকমাধ্যম ব্যবহার করে রোগী আকর্ষণ করেন। যে উচ্চমানের সেবা দেয়ার কথা তিনি উল্লেখ করেন, সেটি দেন না। অধ্যাপক হওয়ার সব মান পূর্ণ করেছেন কি না তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে।
ভুল চিকিৎসা-গাফিলতিতে রোগীরা নানাভাবে ক্ষতির শিকার হন, অনেক সময় মৃত্যুর কারণ ঘটাচ্ছে। কিন্তু গুরুতর এসব ঘটনার সঠিক তদন্ত নেই, দোষীদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়া হয় না। ফলে একই ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। আঁখির মৃত্যুর ঘটনায় ইডেন কলেজে তার সহপাঠীরা সংযুক্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছেন। আঁখি বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রী হওয়ায় তার পক্ষে অনেকে দাঁড়িয়েছেন। দোষীদের শাস্তির বিষয়টি জোরালোভাবে উঠেছে।

এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী একজন ডাক্তারের অপেশাদারি আচরণ স্পষ্ট। মা ও নবজাতকের মৃত্যু নিয়ে একটি বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত প্রয়োজন। তাতে যাদের দোষ পাওয়া যাবে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। শাস্তি হিসেবে ডাক্তারদের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের ব্যবস্থা রাখা হলেও এমনটি ঘটতে দেখা যায় না। অন্যদিকে হাসপাতাল মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া আরো দূরের ব্যাপার। খোদ রাজধানীতে এমন ভুল চিকিৎসার ঘটনা অহরহ ঘটছে। এ থেকে সারা দেশের অবস্থা কেমন তা সহজেই অনুমেয়। আমরা মনে করি, স্বাস্থ্য প্রশাসনের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আমলে নেয়া উচিত। তাদের নিশ্চিত করতে হবে একজন রোগীও যাতে অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার শিকার না হন।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

হাসপাতালে নবজাতক ও মায়ের মৃত্যু; ভুল চিকিৎসা-অবহেলা থামছে না

আপলোড টাইম : ০৩:৪১:০৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৩

চিকিৎসাসেবা নিতে এসে ক্ষতির শিকার হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের দুর্ভাগ্যের শিকার যদি প্রভাবশালী কেউ হন তাহলে কিছুটা হইচই হয়। অন্যদিকে সমাজের দুর্বল শ্রেণীকে এ জন্য দুঃখ-বেদনা নিয়ে গুমড়ে মরতে হয়। তারা প্রতিকার পাওয়ার কোনো অধিকার রাখেন না। তবে শেষ পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে যারা অপরাধ করেন; তারা ছাড় পেয়ে যান। সর্বোচ্চ কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ হয়তো কেউ পান। এবার এক প্রসূতি হাসপাতালে এসে প্রাণ দিলেন। তিনি একটি বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রী হওয়ায় কিছুটা শোরগোল হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত হয়তো এই ঘটনারও প্রকৃত তদন্ত হবে না। কেউ যদি অপরাধ করে থাকেন তারা পার পেয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ইডেন কলেজের ছাত্রী কুমিল্লার তিতাসের মাহবুবা রহমান আঁখি অস্ত্রোপচার ছাড়া সন্তান জন্ম দিতে চেয়েছিলেন। এ জন্য গর্ভে সন্তান আসার পর ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা: সংযুক্তা সাহার চিকিৎসা নিয়েছেন। ৯ জুন মধ্যরাতে প্রসব বেদনা উঠলে কুমিল্লা থেকে তাকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে আসে পরিবার। তারপর সংযুক্তার সহযোগীরা অস্ত্রোপচার ছাড়া সন্তান প্রসব করানোর চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে জটিলতা সৃষ্টি হলে অস্ত্রোপচার করা হয়। জন্ম হওয়া শিশুটি ওই দিন মারা যায়। মায়ের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। একপর্যায়ে তাকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত রোববার তিনিও মারা যান।

প্রসূতি-নবজাতকের মৃত্যু নিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে জরুরি অবস্থা মোকাবেলার মতো উপযুক্ত যন্ত্রপাতি ছিল না। হাসপাতালটির পক্ষ থেকে রোগীর স্বজনদের মিথ্যা কথাও বলা হয়েছে। অস্ত্রোপচারে আইসিইউ-সিসিইউর ব্যবস্থা থাকতে হয়। অত্যন্ত জরুরি যন্ত্রপাতি অস্ত্রোপচারের সময় অকেজো ছিল। স্পর্শকাতর সময়ে রোগী এর সাপোর্ট পাননি। সন্তান প্রসবের পর তার অনিয়ন্ত্রিত রক্তক্ষরণ হয়। এ সময় তিনি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন। কুমিল্লা থেকে যখন আঁখিকে রাতে হাসপাতালে আনা হয় তাদের জানানো হয় সংযুক্তা হাসপাতালে কর্তব্যরত রয়েছে। বাস্তবে তখন তিনি হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন না। তার পরিবর্তে সহযোগীরা প্রসূতিকে চিকিৎসাসেবা দেন।

খবরে প্রকাশ, সিজারিয়ানের ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলোর যে গাইডলাইন অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক তা মানা হয়নি। উপযুক্ত সরঞ্জামাদির অভাবের পাশাপাশি অবহেলা-গাফিলতিও পাওয়া গেছে। সংযুক্তার দক্ষতা-যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তিনি সামাজিকমাধ্যম ব্যবহার করে রোগী আকর্ষণ করেন। যে উচ্চমানের সেবা দেয়ার কথা তিনি উল্লেখ করেন, সেটি দেন না। অধ্যাপক হওয়ার সব মান পূর্ণ করেছেন কি না তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে।
ভুল চিকিৎসা-গাফিলতিতে রোগীরা নানাভাবে ক্ষতির শিকার হন, অনেক সময় মৃত্যুর কারণ ঘটাচ্ছে। কিন্তু গুরুতর এসব ঘটনার সঠিক তদন্ত নেই, দোষীদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়া হয় না। ফলে একই ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। আঁখির মৃত্যুর ঘটনায় ইডেন কলেজে তার সহপাঠীরা সংযুক্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছেন। আঁখি বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রী হওয়ায় তার পক্ষে অনেকে দাঁড়িয়েছেন। দোষীদের শাস্তির বিষয়টি জোরালোভাবে উঠেছে।

এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী একজন ডাক্তারের অপেশাদারি আচরণ স্পষ্ট। মা ও নবজাতকের মৃত্যু নিয়ে একটি বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত প্রয়োজন। তাতে যাদের দোষ পাওয়া যাবে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। শাস্তি হিসেবে ডাক্তারদের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের ব্যবস্থা রাখা হলেও এমনটি ঘটতে দেখা যায় না। অন্যদিকে হাসপাতাল মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া আরো দূরের ব্যাপার। খোদ রাজধানীতে এমন ভুল চিকিৎসার ঘটনা অহরহ ঘটছে। এ থেকে সারা দেশের অবস্থা কেমন তা সহজেই অনুমেয়। আমরা মনে করি, স্বাস্থ্য প্রশাসনের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আমলে নেয়া উচিত। তাদের নিশ্চিত করতে হবে একজন রোগীও যাতে অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার শিকার না হন।