ইপেপার । আজশুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঝিনাইদহে এক মাসে সিজারের পর ৬ প্রসূতির মৃত্যু

তদন্ত কমিটিতেও সীমাবদ্ধ সব ঘটনা

ঝিনাইদহ অফিস:
  • আপলোড টাইম : ০৮:৪৫:০৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
  • / ২৯ বার পড়া হয়েছে

ঝিনাইদহের বিভিন্ন ক্লিনিকে সিজারের পর লিভার ও কিডনি ফেল করে প্রসূতি মারা যাওয়ার ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তদন্ত কাজ চলছে ধীরগতিতে। কচ্ছপ গতিতে চলা এই তদন্ত কার্যক্রম আদৌও আলোর মুখ দেখবে কি না সন্দেহ আছে। এদিকে জেলায় গত এক মাসে সিজার অপারেশনের পর ৬ জন প্রসূতি মারা গেছেন। অপারেশনের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং তারপর প্রসূতির কিডনি ও লিভার অকেজো হয়ে মারা যাচ্ছেন।

ঝিনাইদহ সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে বলা হয়েছে, ঝিনাইদহ শহরের শামীমা ক্লিনিকে দুজন, কালীগঞ্জের দারুস শেফা ক্লিনিকে একজন, হাসান ক্লিনিকে একজন, আরাপপুর রাবেয়া হাসপাতালে একজন ও হামদহ প্রিন্স হাসপাতালে একজন প্রসূতি কিডনি ও লিভার ফেল করে মারা গেছেন। গত ২৬ মার্চ শৈলকুপা উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের শারমিন বেগম নামের এক প্রসূতি ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুর এলাকার রাবেয়া হাসপাতালে ভর্তি হন। তাকে সিজার করা হয়। শিশু ও মা সুস্থ ছিল। তবে কয়েক ঘণ্টা পর প্রসূতির অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হয়। রোগী দুর্বল হয়ে পড়ে ও প্রসাব বন্ধ হয়ে যায়। এরপর রোগী কোমায় চলে যায়।

প্রসূতির স্বামী আল আমিন বলেন, অ্যাম্বুলেন্সে করে যশোরে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানে একটি হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়। চার দিন পর মারা যায়। হালিমা খাতুন নামে হরিণাকুণ্ডু উপজেলার পার্বতীপুর গ্রামের এক প্রসূতিকে ৪ এপ্রিল শহরের প্রিন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।  তার স্বামী হাবিবুর রহমান জানান, বেলা সাড়ে ৩টার দিকে সিজার করা হয়। সিজারের ৪/৫ ঘণ্টা পর প্রচুর রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এরপর প্রসূতির কিডনি বিকল হয়ে ঢাকায় মারা যান।

গত ৩০ মার্চ হরিণাকুণ্ডুু উপজেলার তেলটুপি গ্রামের এনামুল কবিরের স্ত্রী লাভলী বেগমকে কালীগঞ্জ শহরের দারুসশেফা হাসপাতালে সিজার করা হয়। সিজারের পর মা ও শিশু সুস্থ ছিল। এরপর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে একই ভাবে মারা যায়। গত ১২ এপ্রিল হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ভবিতপুর গ্রামের রিণা থাতুনকে শহরের শামিমা ক্লিনিকে সিজার করা হয়। প্রসূতির স্বামী আনারুল ইসলাম বলেন, দুপুর ১২টার দিকে সিজার করা হয়। এটি ছিল দ্বিতীয় সিজার। প্রসূতি সুস্থ ছিল। তিনি খবারও খান। তবে সিজারের ৪/৫ ঘণ্টা পর প্রচুর রক্তক্ষরণ শুরু হতে থাকে। পাঠানো হয় ঢাকায়। সেখানেই তিনি মারা যান। ১৬ এপ্রিল শামীমা ক্লিনিকে শৈলকুপা উপজেলার চাঁদপুর গ্রামের লিপি খাতুনকে সিজার করা হয়। সিজারের কয়েক ঘণ্টার পর তার কিডনি ও লিভার অচল হয়ে মারা যান।

২৫ এপ্রিল ঝিনাইদহ শহরের ডাক্তার হাসানুজ্জামানের ক্লিনিকে সিজারের পর আকলিমা খাতুন নামে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়। তিনি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামের একরামুল হোসেনের স্ত্রী। মৃত প্রসূতির বাবা আকরাম হোসেন জানান, গত বুধবার সকালে তার মেয়েকে ডা. হাসানুজ্জামানের ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে সিজার করা হয়। সিজারের পর মা ও শিশু ভালো ছিল। কয়েক ঘণ্টা পর প্রসূতি অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর হাসানুজ্জামান ক্লিনিকের সবাই গাঢাকা দেন।

গাইনি চিকিৎসায় অভিজ্ঞ ডা. শামীমা সুলতানা বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে সিজার করেন। রোগীর কিডনি লিভার ফেল করে মৃত্যুর ঘটনা আগে ঘটেনি। এখন দেখি রোগীর শ^াসকষ্ঠও হচ্ছে। তিনি বলেন, সিজারকালে ইনজেকশন অক্সিটোসিন, ইনজেকশন ডুরাটোসিন, ট্যাবলেট সাইটোমিস ও স্যালাইন লিবরা দেওয়া হয়। এসব ওষুধে কোনো ভেজাল আছে কিনা এ নিয়ে প্রশান তোলেন তিনি।

সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মিথিলা ইসলাম জানান, তাকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা অপারেশন থিয়েটারে ব্যবহৃত ওষুধের ১৭টি স্যাম্পল ঢাকায় পাঠিয়েছি পরীক্ষার জন্য পাঠিিেছ। তাছাড়া ঢাকা ও খুলনার ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।  তিনি জানান, ক্লিনিকে প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা কাজ শুরু করেছেন।

জেলা বিএমএর সভাপতি ডা. রেজা সেকেন্দার বলেন, সিজার করার পর প্রসুতিদের অস্বাভাবিক রক্তরক্ষণ শুরু হচ্ছে। এরপর কিডনি ও লিভার অকেজো হয়ে যাচ্ছে। শুধু ঝিনাইদহে নয়, দেশের আরো কয়েক স্থানে এভাবে সিজারের পর কিডনি ফেল করে প্রসূতির মৃত্যু হচ্ছে বলে তিনি জানান।

ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন ডা. শুভ্রা রানী দেবনাথ বলেন, কি কারণে সিজারের পর প্রসূতির অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা অজানা রয়েছে। তবে রোগীদের যে ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে তাতে কোনো সমস্যা আছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর জানা যাবে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

ঝিনাইদহে এক মাসে সিজারের পর ৬ প্রসূতির মৃত্যু

তদন্ত কমিটিতেও সীমাবদ্ধ সব ঘটনা

আপলোড টাইম : ০৮:৪৫:০৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

ঝিনাইদহের বিভিন্ন ক্লিনিকে সিজারের পর লিভার ও কিডনি ফেল করে প্রসূতি মারা যাওয়ার ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তদন্ত কাজ চলছে ধীরগতিতে। কচ্ছপ গতিতে চলা এই তদন্ত কার্যক্রম আদৌও আলোর মুখ দেখবে কি না সন্দেহ আছে। এদিকে জেলায় গত এক মাসে সিজার অপারেশনের পর ৬ জন প্রসূতি মারা গেছেন। অপারেশনের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং তারপর প্রসূতির কিডনি ও লিভার অকেজো হয়ে মারা যাচ্ছেন।

ঝিনাইদহ সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে বলা হয়েছে, ঝিনাইদহ শহরের শামীমা ক্লিনিকে দুজন, কালীগঞ্জের দারুস শেফা ক্লিনিকে একজন, হাসান ক্লিনিকে একজন, আরাপপুর রাবেয়া হাসপাতালে একজন ও হামদহ প্রিন্স হাসপাতালে একজন প্রসূতি কিডনি ও লিভার ফেল করে মারা গেছেন। গত ২৬ মার্চ শৈলকুপা উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের শারমিন বেগম নামের এক প্রসূতি ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুর এলাকার রাবেয়া হাসপাতালে ভর্তি হন। তাকে সিজার করা হয়। শিশু ও মা সুস্থ ছিল। তবে কয়েক ঘণ্টা পর প্রসূতির অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হয়। রোগী দুর্বল হয়ে পড়ে ও প্রসাব বন্ধ হয়ে যায়। এরপর রোগী কোমায় চলে যায়।

প্রসূতির স্বামী আল আমিন বলেন, অ্যাম্বুলেন্সে করে যশোরে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানে একটি হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়। চার দিন পর মারা যায়। হালিমা খাতুন নামে হরিণাকুণ্ডু উপজেলার পার্বতীপুর গ্রামের এক প্রসূতিকে ৪ এপ্রিল শহরের প্রিন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।  তার স্বামী হাবিবুর রহমান জানান, বেলা সাড়ে ৩টার দিকে সিজার করা হয়। সিজারের ৪/৫ ঘণ্টা পর প্রচুর রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এরপর প্রসূতির কিডনি বিকল হয়ে ঢাকায় মারা যান।

গত ৩০ মার্চ হরিণাকুণ্ডুু উপজেলার তেলটুপি গ্রামের এনামুল কবিরের স্ত্রী লাভলী বেগমকে কালীগঞ্জ শহরের দারুসশেফা হাসপাতালে সিজার করা হয়। সিজারের পর মা ও শিশু সুস্থ ছিল। এরপর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে একই ভাবে মারা যায়। গত ১২ এপ্রিল হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ভবিতপুর গ্রামের রিণা থাতুনকে শহরের শামিমা ক্লিনিকে সিজার করা হয়। প্রসূতির স্বামী আনারুল ইসলাম বলেন, দুপুর ১২টার দিকে সিজার করা হয়। এটি ছিল দ্বিতীয় সিজার। প্রসূতি সুস্থ ছিল। তিনি খবারও খান। তবে সিজারের ৪/৫ ঘণ্টা পর প্রচুর রক্তক্ষরণ শুরু হতে থাকে। পাঠানো হয় ঢাকায়। সেখানেই তিনি মারা যান। ১৬ এপ্রিল শামীমা ক্লিনিকে শৈলকুপা উপজেলার চাঁদপুর গ্রামের লিপি খাতুনকে সিজার করা হয়। সিজারের কয়েক ঘণ্টার পর তার কিডনি ও লিভার অচল হয়ে মারা যান।

২৫ এপ্রিল ঝিনাইদহ শহরের ডাক্তার হাসানুজ্জামানের ক্লিনিকে সিজারের পর আকলিমা খাতুন নামে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়। তিনি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামের একরামুল হোসেনের স্ত্রী। মৃত প্রসূতির বাবা আকরাম হোসেন জানান, গত বুধবার সকালে তার মেয়েকে ডা. হাসানুজ্জামানের ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে সিজার করা হয়। সিজারের পর মা ও শিশু ভালো ছিল। কয়েক ঘণ্টা পর প্রসূতি অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর হাসানুজ্জামান ক্লিনিকের সবাই গাঢাকা দেন।

গাইনি চিকিৎসায় অভিজ্ঞ ডা. শামীমা সুলতানা বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে সিজার করেন। রোগীর কিডনি লিভার ফেল করে মৃত্যুর ঘটনা আগে ঘটেনি। এখন দেখি রোগীর শ^াসকষ্ঠও হচ্ছে। তিনি বলেন, সিজারকালে ইনজেকশন অক্সিটোসিন, ইনজেকশন ডুরাটোসিন, ট্যাবলেট সাইটোমিস ও স্যালাইন লিবরা দেওয়া হয়। এসব ওষুধে কোনো ভেজাল আছে কিনা এ নিয়ে প্রশান তোলেন তিনি।

সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মিথিলা ইসলাম জানান, তাকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা অপারেশন থিয়েটারে ব্যবহৃত ওষুধের ১৭টি স্যাম্পল ঢাকায় পাঠিয়েছি পরীক্ষার জন্য পাঠিিেছ। তাছাড়া ঢাকা ও খুলনার ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।  তিনি জানান, ক্লিনিকে প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা কাজ শুরু করেছেন।

জেলা বিএমএর সভাপতি ডা. রেজা সেকেন্দার বলেন, সিজার করার পর প্রসুতিদের অস্বাভাবিক রক্তরক্ষণ শুরু হচ্ছে। এরপর কিডনি ও লিভার অকেজো হয়ে যাচ্ছে। শুধু ঝিনাইদহে নয়, দেশের আরো কয়েক স্থানে এভাবে সিজারের পর কিডনি ফেল করে প্রসূতির মৃত্যু হচ্ছে বলে তিনি জানান।

ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন ডা. শুভ্রা রানী দেবনাথ বলেন, কি কারণে সিজারের পর প্রসূতির অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা অজানা রয়েছে। তবে রোগীদের যে ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে তাতে কোনো সমস্যা আছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর জানা যাবে।