* নতুন ঘরের চাল দিয়ে পড়ছে পানি
* পুরোনো সেডের হদিস নেই, প্লাস্টার যাচ্ছে ঝরে
* দুই মাসের ব্যবধানে দেয়ালেও দেখা গেছে ফাটল
* ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, দাবিয়ে দেয়া হচ্ছে অনিয়ম
টেন্ডার ছাড়াই আশ্রয়ন প্রকল্পের পুরাতন ঘর ভেঙে মালামাল লোপাট, নতুন ঘর নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রীর ব্যবহার ও ঘর বণ্টনে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে দামুড়হুদার সদ্য সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মমতাজ মহলের বিরুদ্ধে। প্রকল্প বাস্তবায়নে কমিটির সদস্যদের পাশ কাটিয়ে একক ক্ষমতায় তড়িঘড়ি করে ওই প্রকল্পের কাজ শেষ করেন ওই কর্মকর্তা। কমিটির সদস্যরা বলছেন, তাদেরকে কিছুই জানাননি সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার মমতাজ মহল। এদিকে, মমতাজ মহলের সময়কালে তৈরিকৃত ২৬৪টি ঘর নিয়েই বিপাকে আছেন ভুক্তভোগীরা। নতুন হলেও প্রত্যেকটি ঘর দিয়ে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি পড়ছে। কোনো কোনো স্থানে দেবে গেছে ঘর। আবার মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে দেয়ালেও দেখা গেছে ফাটল। প্লাস্টারের বালি ঝরে পড়ছে। তিন লাখ টাকার উপরে ঘরপ্রতি বরাদ্দ থাকলেও কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সকলে। তবে অজানা কারণে বারবার প্রশাসন ও সাংবাদিক মহল বিষয়টি চেপে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। দামুড়হুদার সদ্য সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার মমতাজ মহল বর্তমানে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আইন কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন।
সরেজমিনে দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা আবাসন প্রকল্প ঘুরে দেখা যায়, পুরাতন ব্যারাক ভেঙে নতুন করে গৃহ নির্মাণকাজ শুরু হয় গত বছরের জুলাই মাসে। আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় এই ইউনিয়নের চারটি ব্লকে ২৬৪টি নতুন ঘর তৈরি করা হয়। ঘর প্রতি ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ লাখ টাকার অধিক। অভিযোগ রয়েছে, পুরাতন ১৫টি ব্যারাক ভাঙার পর ব্যবহৃত টিন, লোহা ও ইট লোপাট হয়েছে। লাখ লাখ টাকার সরকারি মালামাল টেন্ডার ছাড়াই আত্মসাৎ করেছেন সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার মমতাজ মহল। নতুন ঘর নির্মাণেও উঠেছে অনিয়মের অভিযোগ। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারে এক মাসের মাথায় দেখা দিয়েছে ফাটল। কোথাও কোথাও দেবে গেছে ঘর। নতুন নির্মিত প্রত্যেকটা ঘরেই আছে ব্যাপক সমস্যা। টিনের চালাই ফিনিশিং দেয়া হয়নি সঠিকভাবে। বর্ষায় আরও বেড়েছে দুর্ভোগ। বৃষ্টি হলেই নতুন প্রত্যেকটা ঘরের চালা দিয়ে অঝোরে বৃষ্টির পানি ঘরে ঢোকে। সবমিলিয়ে যেখানে অসহায় গৃহহীনদের স্বস্তিতে থাকার কথা ছিল, সেখানে তারাই আছেন কষ্টে। একাধিকবার উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে গিয়ে বিষয়টি জানালেও নেয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ।
স্থানীয় ভুক্তভোগীরা বলছেন, ঘর নির্মাণের পূর্বে তারা টিন সেডের ঘরে থাকতেন। সেই সেড ভেঙ্গে নেয়া হয়েছে। তবে সেই সেডও বিক্রি করেছেন সাবেক ইউএনও মমতাজ মহল। একটি ঘরের মালিক ভুক্তভোগী মর্জিনা খাতুন বলেন, ‘যে টিন সেডে ছিলাম, তাতেই ভালো ছিলাম। এখানে খুব কষ্ট হচ্ছে। নতুন করে দেয়া একটি ঘরের চালাও ঠিক না। প্রত্যেকটা দিয়ে অঝোরে পানি পড়ে। আমার ঘরের চাল সামান্য ঝড়ে কয়েকদিন আগে উড়ে গিয়েছিলো। আবার দেয়ালে ফাটল আছে। দুই মাস হয়নি, দেয়ালে ফাটল ধরেছে। তাহলে বোঝেন, কেমন ঘর দিয়েছে। পানি (বৃষ্টি) হলে ঘরে থাকতি পারিনে। সারাঘরে পানি ঢোকে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্ত দিয়ে এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আগে যে টিন সেডের ব্যারাকে ছিলাম। ইউএনও স্যার বললেন, এই ঘর তোমাদের দেয়া যাবে না। নতুন ঘর করে দেয়া হবে। আমি শুনেছিলাম, একেকটি ঘর ২ লাখ টাকা করে বিক্রি করা হয়েছে। আর আমাদের এমন ঘর দিয়েছে, যে টিনের চাল দিয়ে পানি পড়ে। একটি ঘরের কাজও ভালো হয়নি। টাকার তছরুপ করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগের টিন সেডের একটি নাটেও (পেরেক) হাত দিতে দেয়নি। বলেছে, নাটে যদি হাত দেও, ঘর তো পাবাই না। জেলও খাটতে হবে।’
আরেক ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করার শর্ত দিয়ে বলেন, ‘এখানে কী করতে এসছেন। কত সাংবাদিক এলো। সবাইকে বললাম। কতো কান্নাকাটি করলাম। কই কিছুই তো হলো না। ঘর যদি দেবে, তাহলে কমপেক্ষ থাকার মতো দিতো। খেলনা ঘর দাড় করিয়ে রাখা হয়েছে। প্রত্যেকটি চাল দিয়ে পানি পড়ে। কার্নিশের পানি গড়িয়ে ঘরে ঢোকে। ঘরের জানালায় এতো ছোট সানসেট দেয়া হয়েছে, যে তা দিয়েও বৃষ্টির পানি ঢোকে ঘরে। আমাদের দেখার কেউ নেই।’ এক ভুক্তভোগী অনেকটা সাংবাদিকদের প্রতি ক্ষোভ দেখিয়েই বলেন, ‘ভাই আর কতজনকে আমাদের বলতে হবে। কেউ তো কিচু করে না। একবার দেখেন, এই ঘরে মানুষ কীভাবে বাস করবে। ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে। ভালো করে চালটা বাধাও হয়নি। এখনি ঘরের দেয়াল যাচ্ছে ফেটে। সিমেন্টও খসে পড়ছে।’ আরেক ভুক্তভোগী মারুফা বেগম বলেন, ‘আমাদের বেশি লাগবে না। ইউএনও স্যার শুধু পানি যাতে না পড়ে, সেই ব্যবস্থাটা করে দিক। নতুন ঘর কখনো এমন হয় শুনিনি-দেখিওনি। আমাদের বেশি কিছু চাওয়ার নেই। ছেলে মেয়ে নিয়ে যাতে বৃষ্টির রাতে অন্তত ঘুমাতে পারি।’
শুধু তাই নয়, প্রকল্প বাস্তবায়নে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন হলেও বাকি সদস্যদের পাশ কাটিয়েই নিজ ক্ষমতায় কাজ শেষ করেন তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ মহল। ঘরের ব্যাপারে কিছুই জানেন না অন্য সদস্যরা। কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল করিম বলেন, ‘তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মমতাজ মহল নিজে তদারকি করে এই প্রকল্পের ঘরগুলো নির্মাণ করেন। ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে আমিও প্রকল্প কমিটির সদস্য ছিলাম নামমাত্র। আমি এই প্রকল্পের ঘরগুলো নির্মাণকাজ সম্পর্কে কিছুই জানি না। তাছাড়া সেখানে আগের পুরাতন যে ঘরগুলো ছিল, সেগুলো কীভাবে বেচাকেনা হয়েছে, তা আমি নিজেও জানি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘কানে অনেক কথাই আসে, আমি দেখেছি ইউএনও মহোদয় নিজে এসে প্রকল্পের কাজের তদারকি করতেন। কিন্তু ঘরগুলো বাসিন্দাদের মনপছন্দ হয়নি। এছাড়াও এই প্রকল্পের কাজে অনেক অনিয়মও হয়েছে। এখন শুনছি ঘরগুলোতে নানা ধরনের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এটা দুঃখজনক বিষয়, নতুন ঘরেই বৃষ্টির পানি পড়ছে। ফেটে যাচ্ছে, দেবে যাচ্ছে। আমি আগে কখনো এরকম দেখিনি। এটার একটা সুষ্ঠু সমাধান হওয়া প্রয়োজন। মানুষগুলো কষ্ট করছে। অবশ্যই খোঁজ নিয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ।’
দামুড়হুদা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কেএইচ তাসফিকুর রহমান বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের খতিয়ান, দলিল ও বরাদ্দের কাজটি আমি করেছি। এসিল্যান্ড হিসেবে এই প্রকল্পের কমিটিতে আমি ছিলাম। তবে নির্মাণসামগ্রী থেকে নির্মাণকাজ সবকিছুর তদারকিই সে সময়ের উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) স্যার মমতাজ মহল ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সম্পাদন করেন। এখন ঘরগুলোতে ত্রুটি দেখা দেয়া বা ঘর মালিকদের অভিযোগ সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই।’
এ বিষয়ে জানতে আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণ কমিটির আহ্বায়ক তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মমতাজ মহল ও সদস্যসচিব প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু কেউই কল রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে এসএমএস-এর মাধ্যমে জানানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
দামুড়হুদার বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তিথি মিত্র বলেন, ‘আমি আসার আগেই আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গেছে। ঘর নিয়ে কোনো অভিযোগ সরাসরি আমাকে কেউ করেনি। একটি ঘরে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে জেনেছি। কিন্তু এই প্রকল্পের মেরামত বা তদারকি ব্যয় বা বরাদ্দের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু জানতে পারিনি। তবে যতটুকু শুনেছি, আমার আগের স্যার যতটুকু জানিয়েছেন নির্মাণকাজে কোনো গাফিলতি ছিল না।’ তিনি বলেন, ‘আমি যে অভিযোগ পেয়েছি তা, একটা-দুইটা ঘরে সামান্য সমস্যা হয়েছে। নিজের বাড়ি নির্মাণ করলেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে বেশিরভাগ ঘরেই সমস্যা থাকা বা এমন বড় কোনো অভিযোগ এখন পর্যন্ত আমি পাইনি। আমাদের কাছে অভিযোগ পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘কিছুদিন পূর্বেই আমি সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে কেউ কোনো ধরনের অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’