অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দেশে পণ্যমূল্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। অনেক খাদ্যপণ্যের দাম স্বস্তিকর পর্যায়ে নেমেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ৯ শতাংশের নিচে, যা পতিত স্বৈরাচারের আমলে দীর্ঘ সময় ধরে ১০ শতাংশের বেশি ছিল। তবে বর্তমানে যেটুকু নেমেছে তা আশাব্যঞ্জক নয়। কারণ আশপাশের সব দেশের চেয়ে বাংলাদেশে এটি সর্বোচ্চ। বিশ্বব্যাংকের খাদ্য মূল্যস্ফীতির তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখনো বিপজ্জনক পর্যায়ে।
২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে সারা বিশ্বের মতো উপমহাদেশের দেশগুলো উচ্চ মূল্যস্ফীতির শিকার হয়। ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের মতো দেশগুলো সেই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারলেও আমরা এ ক্ষেত্রে এখনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাতে পারেনি।
এই অপারগতার কারণ দ্বিবিধ। প্রথমত, পতিত স্বৈরাচার ভয়াবহ মূল্যস্ফীতির বিষয়টি কখনো স্বীকার করেনি। ব্যবস্থা নেয়া দূরের কথা। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে দেশে বাজার নজরদারি ছিল না বললেই চলে। নিজেদের আখের গোছানো ছাড়া ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দোসরদের আর কোনো ভাবনা ছিল না। জনগণের দুর্ভোগ লাঘবের চিন্তা ছিল গৌণ। ফলে অবাধ লুটপাটের সংস্কৃতি চালু হয়েছিল। মুনাফাখোর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সরকারের মদদে ইচ্ছামতো জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রতিটি ক্ষেত্রে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি পণ্য সরবরাহ ও বিপণন ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
এখন খাদ্য মূল্যস্ফীতি ভারতে ৬ শতাংশের কম। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কায় খাদ্যপণ্যের দাম কমছে। নেপাল ও মালদ্বীপে ৮ শতাংশের কম। অন্য দিকে বাংলাদেশে গত মার্চ শেষে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশের নিচে। দীর্ঘ ১০ মাস পর গত ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের নিচে নামে।
প্রশ্ন হলো- দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সন্তোষজনক পর্যায়ে নেমে আসছে না কেন? বাজার বিশ্বেষকরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির মোকাবেলায় প্রথম থেকেই ব্যবস্থা নিতে শুরু করে; কিন্তু বাংলাদেশ বিষয়টি স্বীকার করতে অনেক সময়ক্ষেপণ করে।
অন্তর্বর্তী সরকার এসে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে। সরকার বলছে, বিগত সরকারের আমলে ডলারের বিনিময় হারের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ওই সরকার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। তবে আওয়ামী সরকারের বিদায়ের পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে যে আশা করা হচ্ছিল, সঙ্গত কারণে সেটিও তেমন হচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে তদারকি এখনো কম। চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। শুধু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পরিবর্তন হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা সন্তোষজনক নয়। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটও সক্রিয়। অভ্যন্তরীণ ও বাইরের শক্তিগুলোর কারসাজিতে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা আসছে না।
এ মুহূর্তে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমানো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আসবে সরকারের সামনে। কারণ বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অথবা বাণিজ্যবান্ধব নয়। পাকিস্তান-ভারতের দ্ব›েদ্ব উপমহাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারও এমন কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার ফুরসত পাচ্ছে না, যাতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দ্রুত কমে আসে।
জনগণ এখনো আশা করে, অন্তর্বর্তী সরকার যেকোনো পরিস্থিতিতে জনকল্যাণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবে না। অন্তত বাজার তদারকির মতো তৎপরতা অব্যাহত রাখতে সমস্যা থাকার কথা নয়।