ইপেপার । আজ রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চুয়াডাঙ্গায় ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টি নেই, কৃষিতে বিরূপ প্রভাব

এপ্রিল-মে মাসে তীব্র তাপদাহে কৃষিখাতে ক্ষতি ৫৪৭ কোটির ওপরে

নিজস্ব প্রতিবেদক:
  • আপলোড টাইম : ০৫:২৭:০০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ জুলাই ২০২৪
  • / ৩৩ বার পড়া হয়েছে

দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা হলেও চুয়াডাঙ্গা জেলায় এখনো ঠিকমতো বৃষ্টির দেখা নেই। পুরো আষাঢ় মাস জুড়ে জেলায় মোট বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে মাত্র ৯৯ মিলিমিটার। এই পরিস্থিতিতে সেচ ব্যবস্থার ওপরই মূলত এই জেলার চাষিরা নির্ভরশীল। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাব না পড়লেও এপ্রিল-মে মাসে তীব্র তাপদাহে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে কৃষকদের। জেলা প্রশাসন ও উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় জেলা প্রশাসক ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ে বারবার তাগাদা দিলেও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর করে না কোনো হিসাব। ফলে অনেকটা অজানাই থেকে যাচ্ছে জেলার কৃষি এবং কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বলছেন, প্রাথমিকভাবে অধিদপ্তরের ফরম পূরণ করে পাঠিয়েছি, জেলায় মোট ক্ষতির হিসাব করা হয়নি। তবে ওয়েভ ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে এপ্রিল-মে মাসে তীব্র তাপদাহে কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাত মিলিয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৫৪৭ কোটি টাকার ওপরে ক্ষতির তথ্য উঠে এসছে।

চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা যায়, এ বছর জেলায় জানুয়ারি ও এপ্রিল মাসে এক মিলিমিটারও বৃষ্টিপাত হয়নি। ফেব্রুয়ারি মাসে মাত্র ৩ মিলিমিটার, মার্চে ২৩ মিলিমিটার, মে মাসে ১৩১ মিলিমিটার ও জুন মাসে ১০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চলতি জুলাই মাসে মাত্র ৬২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তবে এপ্রিল এবং মে মাসে টানা ৩৭ দিন চুয়াডাঙ্গা জেলায় তীব্র তাপদাহ প্রবাহিত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের তেমন প্রভাব এ জেলায় পড়েনি। রেমালের দিন এ জেলায় সর্বোচ্চ ৪৮ কিলোমিটার গতিবেগে সামান্য ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেছে। ওই দিন বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল মাত্র ৮৪ মিলিমিটার।

বেসরকারি সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশন চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়া এই চার জেলার ১০টি উপজেলার ৫টি খাত নিয়ে তীব্র তাপদাহে ক্ষতির একটি জরিপ করেছিল। ওই জরিপের চুয়াডাঙ্গার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাপদাহ এবং বৃষ্টি না হওয়াতে চলতি মৌসুমে বোরো ধানে বাড়তি সেচ দিতে হয়েছে। এতে বিঘাপ্রতি গড়ে দুই হাজার ৫০০ টাকা হারে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ধানের দানা পুষ্ট না হওয়া ও সময়ের আগেই পেকে যাওয়ার ফলে বোরো ধান বিঘাপ্রতি ২ মণ ফলন কম হওয়ায় গড়ে দুই হাজার টাকা আয় কম হয়েছে। শুধুমাত্র চুয়াডাঙ্গা জেলাতে এ মৌসুমে ৩৫ হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ বাবদ অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬৬ কোটি ৭০ লাখ ৭১ হাজার টাকা। চুয়াডাঙ্গা জেলায় চলতি বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৯৬ মেট্রিক টন। ধানের দানা পুষ্ট না হওয়া এবং সময়ের আগেই পেকে যাওয়ার ফলে ধান কমে উৎপাদন হয়েছে ২১ হাজার ৩৪৬ মেট্রিক টন। এ ক্ষেত্রে জেলাতে বোরো ধানের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার দরুণ আয় কম হবে ৫৩ কোটি ৩৬ লাখ ৫৬ হাজার ৮০০ টাকা। উভয় ক্ষেত্র মিলিয়ে চলতি বোরো মৌসুমে নীট ক্ষতির পরিমাণ ১২০ কোটি ৭ লাখ ২৭ হাজার ৮০০ টাকা। এছাড়া, ভুট্টার দানা সংখ্যা কম ও অপুষ্ট হওয়ায় উৎপাদন কম হয়েছে। ভুট্টার ফলন বিঘা প্রতি গড়ে ৬ মন কম হয়েছে।

চলতি মৌসুমে চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৪৯ হাজার ৬৬৫ হেক্টর জমিতে ৬ লাখ ৮২ হাজার ৬৩৫ মেট্রিক টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫৯৬ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে। জেলাতে মোট ৮৯ হাজার ৩৯ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার দরুণ কৃষকদের আয় কমেছে প্রায় ২২২ কোটি ৫৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ড্রাগন ফল বিঘা প্রতি গড়ে প্রায় ৫০০ কেজি উৎপাদন হ্রাস পাবে। এ ক্ষেত্রে জেলায় এক হাজার ৯৯৫ বিঘা জমিতে ৮ হাজার ১০ মেট্রিক টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ড্রাগন ফল উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৯৯৮ মেট্রিক টন। ফলে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। মাল্টা ও কমলা বাগানের প্রায় ৭০% ছোট গুটি ফল নষ্ট হয়েছে বা ঝরে গেছে। ফলে প্রায় ৫০% উৎপাদন কম হবে। মাল্টা ও কমলা চাষে বিঘাপ্রতি গড়ে প্রায় দুই হাজার কেজি উৎপাদন কম হবে। এছাড়া কৃষিখাতে পানির অভাবে পুঁইশাক, ঢেঁড়স, করলা, ঝিঙ্গাসহ অন্যান্য সবজি গড়ে প্রায় ২০% উৎপাদন কম/ক্ষতি হয়েছে। পান গাছের মাথা শুকিয়ে যাচ্ছে, ফলে বিঘাপ্রতি ২৫-৩০ হাজার টাকা ক্ষতি হতে পারে। পটল ক্ষেতের বিঘাপ্রতি ১০-১৫ হাজার টাকা আয় কম হবে। ওয়েভ ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় মৎস্য খাতেও ক্ষতির কথা বলা হয়েছে। পুকুরের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য নষ্ট হয়েছে।

তীব্র তাপদাহে মাছ ও মৎস্য সম্পদের জন্য প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণ ও গুণগত মান পরিবর্তন হওয়ায় মাছের গ্রোথ কম হয়েছে, এতে করে লোকসানের মুখে পড়ছেন চাষিরা। একজন চাষী গত বছর ৫ লাখ টাকা লাভ করলেও এবারে তিনি লাভ করেছেন মাত্র ৪ লাখ টাকা। তাপদাহের কারণে পানি অতিরিক্ত গরম হওয়ায় রেনু পোনার মৃত্যুহারও বেড়েছে। রেনু পোনা উৎপাদন ৫০% এ নেমে এসেছে এছাড়া প্রায় ৫০% জলাশয় পানির অভাবে শুকিয়ে গেছে। মাছ চাষীরা মন্তব্য করেছেন যে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০% এর অধিক মাছ উৎপাদন কমে যাবে। তাতে শুধুমাত্র চুয়াডাঙ্গা জেলাতেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ হাজার ৪৯০ মে.টন কম মাছ উৎপাদন হবে যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৯৭ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা। তীব্র গরমে এ অঞ্চলের প্রাণিসম্পদ খাতেও ক্ষতি হয়েছে। তীব্র তাপদাহের মাস এপ্রিলে দুধ উৎপাদন শুধুমাত্র চুয়াডাঙ্গা জেলাতেই প্রায় এক হাজার ৮৩৮ মেট্রিক টন কম হয়েছে।

ফলে সংশ্লিষ্ট খামারীদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১১ কোটি ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। শুধুমাত্র চুয়াডাঙ্গা জেলাতেই মাংশ উৎপাদন কমে গেছে গড়ে প্রায় ১৭.৫% অর্থাৎ এপ্রিল মাসে মাংশ উৎপাদন কম হয়েছে প্রায় এক হাজার ২২৫ মেট্রিক টন। যার ফলে সংশ্লিষ্ট খামারীদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৮১ কোটি ৭০ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা। অনুরূপভাবে, চুয়াডাঙ্গা জেলাতেই এপ্রিল’২৪ মাসে ডিম উৎপাদন কমে গেছে গড়ে প্রায় ২২.৫% অর্থাৎ এপ্রিলে ডিম উৎপাদন কম হয়েছে প্রায় ৪৫ লাখ পিস। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট খামারীদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা। সর্বোপরি, শুধুমাত্র চুয়াডাঙ্গা জেলায় তীব্র তাপদাহের কারণে প্রাণিসম্পদ খাতে খামারীদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে মোট ৯৬ কোটি ৩৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

ওয়েভ ফাউন্ডেশনের জরিপ সমীক্ষা দলের অন্যতম সদস্য ও সংস্থাটির উপ-পরিচালক জহির রায়হান বলেন, আমরা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কৃষক, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাসহ এক হাজার জনের সাথে কথা বলেছি। এ জরিপটিতে জেলার সঠিক পরিসংখ্যান উঠে এসছে। আমরা কৃষি বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথেও কথা বলেছি। মূলত এই জেলায় সবথেকে বেশি সমস্যা এখন তীব্র তাপদাহ।

চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের কোনো প্রভাব পড়েনি। এই জেলায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কম। কোথাও বন্যা বা পানি জমার মতো কিছু হয়নি। যার কারণে এ জেলায় ঘূর্ণিঝড় রেমাল বা বন্যায় কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে এপ্রিল-মে মাসে এ জেলায় তীব্র তাপদাহ বয়ে গেছে। এক টানা এক মাসের বেশি সময় তীব্র তাপদাহে এ জেলার চাষিদের ক্ষতি কিছুটা হয়েছে। বলা যায়, চুয়াডাঙ্গার চাষ ব্যবস্থা টিকেই আছে সেচ ব্যবস্থার কারণে। ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করার বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে আমাদের অধিদপ্তরের নির্ধারিত ফরম পূরণ করে পাঠিয়েছি। তবে বিস্তারিত তথ্য এখনো তৈরি করা সম্ভব হয়নি।

সদর উপজেলার বেগমপুর গ্রামের কৃষক আলতাফ আলী বলেন, পানির নাম নেই। বর্ষাকালেই পানি কম। বিলই ভরে না, তো ভাটকাবে (ভাটিয়ে যাওয়া, পাড় ভেঙ্গে যাওয়া) কেমনে? এখন ফসল ডোবে (প্লাবিত) না। শুধু রোদে পোড়ে। তখন প্রচুর পানি লাগে। আবার শীতকালে কালা (ঠান্ডা) পড়ে বেশি। দর্শনা কুড়ুলগাছি গ্রামের কৃষক আব্দুল হান্নান বলেন, ‘আমাদের এদিকে ধীরে ধীরে মাটির নিচের পানিও কমছে। বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা নেই। আর ঘূর্ণিঝড় রেমালে কোনো ক্ষতি হয়নি।

সদর উপজেলার গাড়াবাড়িয়া কৃষি ক্লাবের সদস্য ও তরুণ উদ্যোক্তা সাইদুল ইসলাম বলেন, চুয়াডাঙ্গা চরম ভাবাপণ্ন জেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু শীত আর গরম। শীতের সময় প্রচণ্ড শীত গরমের সময় প্রচণ্ড গরম। সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড জেলা চুয়াডাঙ্গা। এ জেলায় বেশ কয়েক বছর বন্যা নেই। মূলত শীতে কুয়াশায় আর গরমে রোদে ফসলের ক্ষতি হয়। বিশেষ করে গরমে প্রচুর সেচের প্রয়োজন হয়। এতে কৃষকের চাষ খরচ বেড়ে যায়। আমরা কৃষি ক্লাবের পক্ষ থেকে নানা পরামর্শ দিয়ে থাকি।

আলমডাঙ্গা উপজেলার বেলগাছি গ্রামের কৃষক আমির মিয়া বলেন, ‘আমাদের জেলায় তো গরম আর শীত প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পাঁচ/সাত বছর আমি বন্যা দেখিনি। গরমে চাষ খরচ বাড়ছে। অতিরিক্ত সেচ ব্যবস্থা করা লাগে। তবে সেচ ব্যবস্থা থাকায় খুব বেশি প্রভাব পড়েনি।’ আলমডাঙ্গা উপজেলার খুদিয়া খালি গ্রামের পরিতোষ কুমার ঘোষ বলেন, নদীর ধারেই আমার বাড়ি। নদীতেও পানি নেই। কুষ্টিয়া-আলমডাঙ্গা-চুয়াডাঙ্গায় পরিচালিত জিকে খালেও পানি নেই। আসলে টিভিতেই দেখছি একদিকে বন্যা, আরেক দিকে মেশিন দিয়ে চাষে পানি দিতে হচ্ছে। আসলে আমাদের জেলার ভাগ্যটাই খারাপ। তবে এটাও ভালো এদিকে বন্যা নেই।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

চুয়াডাঙ্গায় ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টি নেই, কৃষিতে বিরূপ প্রভাব

এপ্রিল-মে মাসে তীব্র তাপদাহে কৃষিখাতে ক্ষতি ৫৪৭ কোটির ওপরে

আপলোড টাইম : ০৫:২৭:০০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ জুলাই ২০২৪

দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা হলেও চুয়াডাঙ্গা জেলায় এখনো ঠিকমতো বৃষ্টির দেখা নেই। পুরো আষাঢ় মাস জুড়ে জেলায় মোট বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে মাত্র ৯৯ মিলিমিটার। এই পরিস্থিতিতে সেচ ব্যবস্থার ওপরই মূলত এই জেলার চাষিরা নির্ভরশীল। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাব না পড়লেও এপ্রিল-মে মাসে তীব্র তাপদাহে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে কৃষকদের। জেলা প্রশাসন ও উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় জেলা প্রশাসক ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ে বারবার তাগাদা দিলেও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর করে না কোনো হিসাব। ফলে অনেকটা অজানাই থেকে যাচ্ছে জেলার কৃষি এবং কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বলছেন, প্রাথমিকভাবে অধিদপ্তরের ফরম পূরণ করে পাঠিয়েছি, জেলায় মোট ক্ষতির হিসাব করা হয়নি। তবে ওয়েভ ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে এপ্রিল-মে মাসে তীব্র তাপদাহে কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাত মিলিয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৫৪৭ কোটি টাকার ওপরে ক্ষতির তথ্য উঠে এসছে।

চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা যায়, এ বছর জেলায় জানুয়ারি ও এপ্রিল মাসে এক মিলিমিটারও বৃষ্টিপাত হয়নি। ফেব্রুয়ারি মাসে মাত্র ৩ মিলিমিটার, মার্চে ২৩ মিলিমিটার, মে মাসে ১৩১ মিলিমিটার ও জুন মাসে ১০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চলতি জুলাই মাসে মাত্র ৬২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তবে এপ্রিল এবং মে মাসে টানা ৩৭ দিন চুয়াডাঙ্গা জেলায় তীব্র তাপদাহ প্রবাহিত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের তেমন প্রভাব এ জেলায় পড়েনি। রেমালের দিন এ জেলায় সর্বোচ্চ ৪৮ কিলোমিটার গতিবেগে সামান্য ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেছে। ওই দিন বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল মাত্র ৮৪ মিলিমিটার।

বেসরকারি সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশন চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়া এই চার জেলার ১০টি উপজেলার ৫টি খাত নিয়ে তীব্র তাপদাহে ক্ষতির একটি জরিপ করেছিল। ওই জরিপের চুয়াডাঙ্গার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাপদাহ এবং বৃষ্টি না হওয়াতে চলতি মৌসুমে বোরো ধানে বাড়তি সেচ দিতে হয়েছে। এতে বিঘাপ্রতি গড়ে দুই হাজার ৫০০ টাকা হারে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ধানের দানা পুষ্ট না হওয়া ও সময়ের আগেই পেকে যাওয়ার ফলে বোরো ধান বিঘাপ্রতি ২ মণ ফলন কম হওয়ায় গড়ে দুই হাজার টাকা আয় কম হয়েছে। শুধুমাত্র চুয়াডাঙ্গা জেলাতে এ মৌসুমে ৩৫ হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ বাবদ অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬৬ কোটি ৭০ লাখ ৭১ হাজার টাকা। চুয়াডাঙ্গা জেলায় চলতি বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৯৬ মেট্রিক টন। ধানের দানা পুষ্ট না হওয়া এবং সময়ের আগেই পেকে যাওয়ার ফলে ধান কমে উৎপাদন হয়েছে ২১ হাজার ৩৪৬ মেট্রিক টন। এ ক্ষেত্রে জেলাতে বোরো ধানের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার দরুণ আয় কম হবে ৫৩ কোটি ৩৬ লাখ ৫৬ হাজার ৮০০ টাকা। উভয় ক্ষেত্র মিলিয়ে চলতি বোরো মৌসুমে নীট ক্ষতির পরিমাণ ১২০ কোটি ৭ লাখ ২৭ হাজার ৮০০ টাকা। এছাড়া, ভুট্টার দানা সংখ্যা কম ও অপুষ্ট হওয়ায় উৎপাদন কম হয়েছে। ভুট্টার ফলন বিঘা প্রতি গড়ে ৬ মন কম হয়েছে।

চলতি মৌসুমে চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৪৯ হাজার ৬৬৫ হেক্টর জমিতে ৬ লাখ ৮২ হাজার ৬৩৫ মেট্রিক টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫৯৬ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে। জেলাতে মোট ৮৯ হাজার ৩৯ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার দরুণ কৃষকদের আয় কমেছে প্রায় ২২২ কোটি ৫৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ড্রাগন ফল বিঘা প্রতি গড়ে প্রায় ৫০০ কেজি উৎপাদন হ্রাস পাবে। এ ক্ষেত্রে জেলায় এক হাজার ৯৯৫ বিঘা জমিতে ৮ হাজার ১০ মেট্রিক টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ড্রাগন ফল উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৯৯৮ মেট্রিক টন। ফলে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। মাল্টা ও কমলা বাগানের প্রায় ৭০% ছোট গুটি ফল নষ্ট হয়েছে বা ঝরে গেছে। ফলে প্রায় ৫০% উৎপাদন কম হবে। মাল্টা ও কমলা চাষে বিঘাপ্রতি গড়ে প্রায় দুই হাজার কেজি উৎপাদন কম হবে। এছাড়া কৃষিখাতে পানির অভাবে পুঁইশাক, ঢেঁড়স, করলা, ঝিঙ্গাসহ অন্যান্য সবজি গড়ে প্রায় ২০% উৎপাদন কম/ক্ষতি হয়েছে। পান গাছের মাথা শুকিয়ে যাচ্ছে, ফলে বিঘাপ্রতি ২৫-৩০ হাজার টাকা ক্ষতি হতে পারে। পটল ক্ষেতের বিঘাপ্রতি ১০-১৫ হাজার টাকা আয় কম হবে। ওয়েভ ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় মৎস্য খাতেও ক্ষতির কথা বলা হয়েছে। পুকুরের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য নষ্ট হয়েছে।

তীব্র তাপদাহে মাছ ও মৎস্য সম্পদের জন্য প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণ ও গুণগত মান পরিবর্তন হওয়ায় মাছের গ্রোথ কম হয়েছে, এতে করে লোকসানের মুখে পড়ছেন চাষিরা। একজন চাষী গত বছর ৫ লাখ টাকা লাভ করলেও এবারে তিনি লাভ করেছেন মাত্র ৪ লাখ টাকা। তাপদাহের কারণে পানি অতিরিক্ত গরম হওয়ায় রেনু পোনার মৃত্যুহারও বেড়েছে। রেনু পোনা উৎপাদন ৫০% এ নেমে এসেছে এছাড়া প্রায় ৫০% জলাশয় পানির অভাবে শুকিয়ে গেছে। মাছ চাষীরা মন্তব্য করেছেন যে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০% এর অধিক মাছ উৎপাদন কমে যাবে। তাতে শুধুমাত্র চুয়াডাঙ্গা জেলাতেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ হাজার ৪৯০ মে.টন কম মাছ উৎপাদন হবে যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৯৭ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা। তীব্র গরমে এ অঞ্চলের প্রাণিসম্পদ খাতেও ক্ষতি হয়েছে। তীব্র তাপদাহের মাস এপ্রিলে দুধ উৎপাদন শুধুমাত্র চুয়াডাঙ্গা জেলাতেই প্রায় এক হাজার ৮৩৮ মেট্রিক টন কম হয়েছে।

ফলে সংশ্লিষ্ট খামারীদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১১ কোটি ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। শুধুমাত্র চুয়াডাঙ্গা জেলাতেই মাংশ উৎপাদন কমে গেছে গড়ে প্রায় ১৭.৫% অর্থাৎ এপ্রিল মাসে মাংশ উৎপাদন কম হয়েছে প্রায় এক হাজার ২২৫ মেট্রিক টন। যার ফলে সংশ্লিষ্ট খামারীদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৮১ কোটি ৭০ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা। অনুরূপভাবে, চুয়াডাঙ্গা জেলাতেই এপ্রিল’২৪ মাসে ডিম উৎপাদন কমে গেছে গড়ে প্রায় ২২.৫% অর্থাৎ এপ্রিলে ডিম উৎপাদন কম হয়েছে প্রায় ৪৫ লাখ পিস। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট খামারীদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা। সর্বোপরি, শুধুমাত্র চুয়াডাঙ্গা জেলায় তীব্র তাপদাহের কারণে প্রাণিসম্পদ খাতে খামারীদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে মোট ৯৬ কোটি ৩৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

ওয়েভ ফাউন্ডেশনের জরিপ সমীক্ষা দলের অন্যতম সদস্য ও সংস্থাটির উপ-পরিচালক জহির রায়হান বলেন, আমরা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কৃষক, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাসহ এক হাজার জনের সাথে কথা বলেছি। এ জরিপটিতে জেলার সঠিক পরিসংখ্যান উঠে এসছে। আমরা কৃষি বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথেও কথা বলেছি। মূলত এই জেলায় সবথেকে বেশি সমস্যা এখন তীব্র তাপদাহ।

চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের কোনো প্রভাব পড়েনি। এই জেলায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কম। কোথাও বন্যা বা পানি জমার মতো কিছু হয়নি। যার কারণে এ জেলায় ঘূর্ণিঝড় রেমাল বা বন্যায় কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে এপ্রিল-মে মাসে এ জেলায় তীব্র তাপদাহ বয়ে গেছে। এক টানা এক মাসের বেশি সময় তীব্র তাপদাহে এ জেলার চাষিদের ক্ষতি কিছুটা হয়েছে। বলা যায়, চুয়াডাঙ্গার চাষ ব্যবস্থা টিকেই আছে সেচ ব্যবস্থার কারণে। ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করার বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে আমাদের অধিদপ্তরের নির্ধারিত ফরম পূরণ করে পাঠিয়েছি। তবে বিস্তারিত তথ্য এখনো তৈরি করা সম্ভব হয়নি।

সদর উপজেলার বেগমপুর গ্রামের কৃষক আলতাফ আলী বলেন, পানির নাম নেই। বর্ষাকালেই পানি কম। বিলই ভরে না, তো ভাটকাবে (ভাটিয়ে যাওয়া, পাড় ভেঙ্গে যাওয়া) কেমনে? এখন ফসল ডোবে (প্লাবিত) না। শুধু রোদে পোড়ে। তখন প্রচুর পানি লাগে। আবার শীতকালে কালা (ঠান্ডা) পড়ে বেশি। দর্শনা কুড়ুলগাছি গ্রামের কৃষক আব্দুল হান্নান বলেন, ‘আমাদের এদিকে ধীরে ধীরে মাটির নিচের পানিও কমছে। বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা নেই। আর ঘূর্ণিঝড় রেমালে কোনো ক্ষতি হয়নি।

সদর উপজেলার গাড়াবাড়িয়া কৃষি ক্লাবের সদস্য ও তরুণ উদ্যোক্তা সাইদুল ইসলাম বলেন, চুয়াডাঙ্গা চরম ভাবাপণ্ন জেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু শীত আর গরম। শীতের সময় প্রচণ্ড শীত গরমের সময় প্রচণ্ড গরম। সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড জেলা চুয়াডাঙ্গা। এ জেলায় বেশ কয়েক বছর বন্যা নেই। মূলত শীতে কুয়াশায় আর গরমে রোদে ফসলের ক্ষতি হয়। বিশেষ করে গরমে প্রচুর সেচের প্রয়োজন হয়। এতে কৃষকের চাষ খরচ বেড়ে যায়। আমরা কৃষি ক্লাবের পক্ষ থেকে নানা পরামর্শ দিয়ে থাকি।

আলমডাঙ্গা উপজেলার বেলগাছি গ্রামের কৃষক আমির মিয়া বলেন, ‘আমাদের জেলায় তো গরম আর শীত প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পাঁচ/সাত বছর আমি বন্যা দেখিনি। গরমে চাষ খরচ বাড়ছে। অতিরিক্ত সেচ ব্যবস্থা করা লাগে। তবে সেচ ব্যবস্থা থাকায় খুব বেশি প্রভাব পড়েনি।’ আলমডাঙ্গা উপজেলার খুদিয়া খালি গ্রামের পরিতোষ কুমার ঘোষ বলেন, নদীর ধারেই আমার বাড়ি। নদীতেও পানি নেই। কুষ্টিয়া-আলমডাঙ্গা-চুয়াডাঙ্গায় পরিচালিত জিকে খালেও পানি নেই। আসলে টিভিতেই দেখছি একদিকে বন্যা, আরেক দিকে মেশিন দিয়ে চাষে পানি দিতে হচ্ছে। আসলে আমাদের জেলার ভাগ্যটাই খারাপ। তবে এটাও ভালো এদিকে বন্যা নেই।