ইপেপার । আজশনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কাজী নজরুল ইসলাম: অন্তরালের গল্প

মো. মামুনার রশীদ
  • আপলোড টাইম : ০৬:০১:১৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ মে ২০২৪
  • / ৫৪ বার পড়া হয়েছে

নাম যার দুখু মিয়া তাঁর কপালে কি সুখ সয়! কে জানে, ছোট বেলায় কে তাঁর নাম রেখেছিল দুখু মিয়া। কিন্তু এই নামটি যেন তাঁর যথার্থতা প্রমাণ করতে সারাজীবন দাঁত কেলিয়ে তাঁকে বিদ্রুপ করে গেল। যেন দুখু মিয়া নামটি সার্থক করে তুলতেই বিধাতার এত আয়োজন। মাত্র ৯ বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে অভাবের সংসারে হাল ধরতে স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ থেকে শুরু করে মাজারে খাদেমের কাজ, লেটোর দলে গান গাওয়া, রেলওয়ের এক গার্ডের খানসামা হয়ে কাজ করা, মক্তবে শিক্ষকতা করা এবং আসানসোলে রুটির দোকানে কাজ করেন। আসানসোলে কাজ করার সময় তাঁর প্রতিভার পরিচয় পেয়ে এক পুলিশ ইন্সপেক্টর তাঁকে ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। কিন্তু তিনি তো তারাক্ষাপা। এখানে তাঁর মন বসবে কেন? তিনি আবার ভর্তি হলেন রানিগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে। প্রি-টেস্ট পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেও মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে যোগ দিলেন ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে। ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টন ভেঙ্গে দেওয়া হলে নজরুল কলকাতায় এসে বন্ডু শ্রী শৈলজানন্দের বোডিং হাউসে ওঠেন। মেসের চাকর যখন জানতে পারল নজরুল ইসলাম মুসলমান, তখন সে তাঁর এঁটো বাসন ধুতে অস্বীকার করল। শেষ পর্যন্ত তাঁর ঠাই হলো বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে। এখানেই নজরুলের সাথে পরিচয় ঘটে পুস্তক ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের। আলী আকবর খানের প্ররোচণায় নজরুল কুমিল্লায় আসেন এবং নার্গিস কণ্ঠে জড়িয়ে পড়েন। এই সময়ে নজরুলের জীবনে আলী আকবার খানের ষড়যন্ত্র, সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিসের প্রণয়, ব্যর্থতা নজরুলের জীবন ইতিহাসে এক করুণ অধ্যায় বলে চিহ্নিত হয়ে আছে। যার রেশ কবিকে সারাজীবন ধরেই বহন করতে হয়েছে।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের সবচেয়ে বড় বৈরীপক্ষ ছিল ব্রিটিশ শাসকপক্ষ। সত্য-ন্যায় ও শোষিত মানুষের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে নজরুল ব্রিটিশ রাজের রোষানলে পড়ে জেল খেটেছেন। ১৯২২ সালের ২৬ শে সেপ্টেম্বর তাঁর রচিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের মামলা হয়। প্রহসনের এই বিচারে নজরুলের এক বছরের কারাদণ্ড হয়। ১৯৩০ সালের ৭ই মে প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র বুলবুলের মৃত্যু হয় বসন্ত রোগে। ছেলে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় নজরুল ডাক্তার, কবিরাজ, বৈদ্য সবকিছু করেও ছেলেকে সুস্থ করে তুলতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত পিতৃহৃদয় হার মেনে ছিল পুত্রস্নেহের কাছে। পুত্রকে সুস্থ করে তুলতে এক সাধুর শরণাপণ্ন হয়েছিলেন কবি। বিশ্বস্ত দুই সঙ্গী মৈনুদ্দিন আর শান্তিপদ সিংহকে পাঠিয়েছিলেন সাধুকে আনার জন্যে। কবি মৈনুদ্দিন তাঁর ‘যুগস্রষ্টা নজরুল’ গ্রন্থে লিখেছেন, “কবির বাড়িতে যখন সাধুকে নিয়ে এলাম, তখন বেশ রাত হয়েছে। আমাদের সাড়া পেয়ে কবি ছুটে এলেন, বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। বললেন ওরে মৈনুদ্দিন, সাধু কি মরদেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারবে?” বুলবুলের মৃত্যু কবির জীবনযাত্রা একেবারে পাল্টে দিয়েছিল। তিনি সমস্ত উচ্ছ্বাস বর্জন করেছিলেন। যেন এক গভীর রহস্যের সামনে দাঁড়িয়ে পরম সত্যকে অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছিলেন। এরপর তিনি ঝুঁকে পড়েছিলেন আধ্যাত্ম সাধনার দিকে। মুর্শিদাবাদের গৃহযোগী বরদাচরণ মজুমদারকে যোগগুরু হিসেবে গ্রহণ করে গুরুর কথামতো শশ্মানে গিয়েও সাধনা করেছিলেন নজরুল ইসলাম। ১৯৩৯ সালে প্রমীলা দেবী পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলে কবি পরিবারে নেমে আসে বিষাদের কালো মেঘ। প্রমীলা দেবীর চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে কবি বালিগঞ্জের জমিটুকু বিক্রি করে দেন, তখনকার দিনের দামি ‘ক্রাইসলার’ গাড়িটিও বিক্রি করে দেন। কবির জীবনে নেমে আসে সীমাহীন দারিদ্রতা।
এ সম্পর্কে প্রাবন্ধিক জিয়াদ আলী লিখেছেন- ‘শ্যামবাজারের বাড়িতে থাকার সময় এমনও হয়েছে কবির অন্নগ্রহনের প্রিয় কাসার বাসন দোকানে বন্ধক দিয়ে চাল কিনতে হয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরস্কার হিসেবে পাওয়া একভরি ওজনের সোনার তৈরি ‘জগত্তারিণী’ পদক কয়েকবার যে বাঁধা দিতে হয়েছে পরিবারের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য, সে খবর এখন কতজনই বা রাখে।’ ১৯৪১ সালের ৬ই এপ্রিল মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজত জয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন ‘দেখ উন্মাদ তোর জীবনে শেলির মতো, কিটসের মতো খুব বড় একটা ট্রাজেডি আছে। তুই প্রস্তুত হ।’ বিশ্বকবির সেই ভবিষ্যৎ বাণী ১৯৪২ সালে এসে সত্যে পরিণত হয়। ১৯৪২ সালের ৯ই জুলাই কলকাতা বেতারের একটি অডিশনে গান গাইতে গিয়ে তাঁর কণ্ঠ জড়িয়ে আসে। আর তখনি তাঁর অসুস্থতার বিষয়টি সকলের নজরে আসে। নজরুল ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত নজরুলের পত্রাবলির ৭৯ ও ৮০ নম্বর পত্রের মাধ্যমে কবির জীবনের এক মর্মান্তিক বেদনার কথা জানা যায়।
১৯৪২ সালের ১০ই জুলাই কবি তাঁর সুহৃদ সুফি জুলফিকার হায়দারকে একটি চিঠিতে লিখেছেন- ‘খোকাকে পাঠালাম, তুমি এখনই খোকার সাথে চলে এসো। ইষড়ড়ফ ঢ়ৎবংংঁৎব এ শয্যাগত। অতিকষ্টে চিঠি লিখছি। আমার বাড়িতে অসুখ, ঋণ, পাওনাদারের তাগাদা প্রভৃতি ডড়ৎৎরবং। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত খাটুনি। তারপর নবযুগের ডড়ৎৎরবং ৩/৪ মাস পর্যন্ত। এইসব কারণে আমার হবৎাবং ংযধঃঃবৎবফ হয়ে গেছে। ৭ মাস ধরে হক সাহেবের কাছে গিয়ে ভিখারির মতো ৫-৬ ঘণ্টা বসে থেকে ফিরে এসেছি।’ এই পত্র হতে জানা যায়, ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে কবির জীবনে একটা নিদারুন ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা, নিজের চিকিৎসা, সংসারের নিত্য খরচ, পাওনাদারের তাগাদা, সব মিলিয়ে টাকার অভাবে কবি চরম কষ্টে পতিত হন। তিনি টাকার জন্য শেরে বাংলা ফজলুল হক সাহেবকে তাগাদা দিতে থাকেন। এখন কথা হলো হক সাহেবের নিকট কবি কিসের টাকা পেতেন। এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ৮০ নম্বর পত্রে। যা কবি শ্যামা প্রসাদকে লিখেছেন- “নবযুগের সম্পাদনার ভার যখন নিই, তার কিছুদিন আগে ফিল্মের গঁংরপ উরৎবপঃরড়হ- এর জন্য ৭ হাজার টাকার কন্ট্রাক পাই। হক সাহেব ও তাঁর অনেক হিন্দু-মুসলমান ঝঁঢ়ঢ়ড়ৎঃবৎ আমায় বলেন যে, তাঁরা ও ঋণ শোধ করে দেবেন। আমি ঋরষস এর পড়হঃৎধপঃ পধহপবষ করে দিই। আপনি জানেন ঝবপৎবঃধরৎধঃ- এ আপনার সামনে হক সাহেব বলেন, কাজীর ঋণ শোধ করে দিতে হবে।”
অর্থ্যাৎ দ্বিতীয় দফায় ‘নবযুগ’ বের হওয়ার প্রাক্কালে হক সাহেব কবিকে ‘নবযুগ’ সম্পাদনা করতে অনুরোধ করেন। কিন্ত কবি সেসময় একটা ফিল্ম কোম্পানির সাথে ৭ হাজার টাকার কন্ট্রাক্ট করেছিলেন। হক সাহেব কবিকে উক্ত কন্ট্রাক্ট বাতিল করে কবিকে ‘নবযুগ’ সম্পাদনা করতে বলেন। বিনিময়ে তিনি কবিকে ৭ হাজার টাকা পরিশোধ করবেন। কিন্তু সেই টাকা হক সাহেব কবিকে আর পরিশোধ করেননি। অথচ হক সাহেবের জন্য কবি অনেক কিছুই করেছেন। এক সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি হক সাহেবের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। সমস্ত ছাত্র তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপে গিয়েছিল। কমে গিয়েছিল হক সাহেবের জীবনের নিরাপত্তা। এমন পরিস্থিতিতে হক সাহেবকে রক্ষা করেছিলেন নজরুল ইসলাম।
শ্যামাপ্রসাদকে লেখা এক পত্রে কবি বলেন, “হক সাহেব যখন আমার কাছে কাঁদতে থাকেন যে, ‘আমায় রক্ষা কর, মুসলমান ছেলেরা বাইরে বেরুতে দিচ্ছে না’, আমি তখন মুসলিম লীগের ছাত্র ও তরুণ লিডারদের ডেকে তাদের শান্ত করি। তারপর অংংবসনষবু- এর সমস্ত মুসলমান মেম্বারদের কাছে আমি আবেদন করি, তাঁরা আমার আবেদন শুনলেন। ৭৪ জন মেম্বার হক সাহেবকে সমর্থন করতে রাজি হলেন।” তখনকার পরিস্থিতিতে এটা হক সাহেবের জন্য বিরাট কর্মই বলা যায়। কিন্তু হক সাহেবের বৈরি আচরণে কবি ব্যাপক আঘাত পেয়েছিলেন। নজরুল ইসলাম জুলফিকার হায়দারকে লিখেছেন- “হক সাহেব একদিন বললেন, কিসের টাকা? আমি চুপ করে চলে এলাম। তারপর আর তাঁর কাছে যায়নি।” প্রিয় নেতার কাছ থেকে এতটা আঘাত কবি সহ্য করতে পারেননি। অভিমানি কবি জুলফিকার হায়দারকে লিখেছেন- “হয়ত কবি ফেরদৌসির মতো ঐ টাকা আমার জানাজার নামাজের দিন পাব। কিন্তু ঐ টাকা নিতে নিষেধ করেছি আমার আত্মীয়-স্বজনদের।”
দারিদ্রতার কারণে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা পায়নি কবি। বেশিরভাগ বন্ধ-বান্ধব দূরে সরে গিয়েছিলেন। প্রাবন্ধিক জিয়াদ আলী লিখেছেন- “কবি যখন সুস্থ ছিলেন, কত মানুষের আনাগোনা ছিল তাঁর কাছে। কবি যখন গ্রামোফোন কোম্পানির ট্রেনার ও সুরকার তখন কত শিল্পীর সমাগম ঘটে তাকে কেন্দ্র করে, কিন্তু কবির অসুস্থতার পর অবস্থাটা একেবারেই বদলে গেল।” বস্তুত কবির অসুস্থতাজনিত এই অসহায়তার সুযোগে কবি ও কবি পরিবারের সাহায্যের নামে নোংরা রাজনীতি কম হয়নি। আগেই বলেছি নাম যার দুখু মিয়া তাঁর কপালে কি সুখ সয়। কবির কপালেও সুখ সয়নি। নিজের শারীরিক অসুস্থতা, অর্থসংকট, স্ত্রীর অসুস্থতা, ঘনিষ্ঠজনদের প্রতারণা সবমিলিয়ে একটা প্রাণসংহারী বেদনার নীল বিষে বিষিয়ে উঠেছিল আমাদের প্রাণপ্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন। আজ ২৫ শে মে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ। দ্রোহ ও প্রেমের কবি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে শব্দের মিছিলে কুর্নিশ জানাই প্রিয় কবিকে।

মো. মামুনার রশীদ
সিনিয়র শিক্ষক
ভিক্টোরিয়া জুবিলি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চুয়াডাঙ্গা।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

কাজী নজরুল ইসলাম: অন্তরালের গল্প

আপলোড টাইম : ০৬:০১:১৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ মে ২০২৪

নাম যার দুখু মিয়া তাঁর কপালে কি সুখ সয়! কে জানে, ছোট বেলায় কে তাঁর নাম রেখেছিল দুখু মিয়া। কিন্তু এই নামটি যেন তাঁর যথার্থতা প্রমাণ করতে সারাজীবন দাঁত কেলিয়ে তাঁকে বিদ্রুপ করে গেল। যেন দুখু মিয়া নামটি সার্থক করে তুলতেই বিধাতার এত আয়োজন। মাত্র ৯ বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে অভাবের সংসারে হাল ধরতে স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ থেকে শুরু করে মাজারে খাদেমের কাজ, লেটোর দলে গান গাওয়া, রেলওয়ের এক গার্ডের খানসামা হয়ে কাজ করা, মক্তবে শিক্ষকতা করা এবং আসানসোলে রুটির দোকানে কাজ করেন। আসানসোলে কাজ করার সময় তাঁর প্রতিভার পরিচয় পেয়ে এক পুলিশ ইন্সপেক্টর তাঁকে ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। কিন্তু তিনি তো তারাক্ষাপা। এখানে তাঁর মন বসবে কেন? তিনি আবার ভর্তি হলেন রানিগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে। প্রি-টেস্ট পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেও মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে যোগ দিলেন ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে। ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টন ভেঙ্গে দেওয়া হলে নজরুল কলকাতায় এসে বন্ডু শ্রী শৈলজানন্দের বোডিং হাউসে ওঠেন। মেসের চাকর যখন জানতে পারল নজরুল ইসলাম মুসলমান, তখন সে তাঁর এঁটো বাসন ধুতে অস্বীকার করল। শেষ পর্যন্ত তাঁর ঠাই হলো বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে। এখানেই নজরুলের সাথে পরিচয় ঘটে পুস্তক ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের। আলী আকবর খানের প্ররোচণায় নজরুল কুমিল্লায় আসেন এবং নার্গিস কণ্ঠে জড়িয়ে পড়েন। এই সময়ে নজরুলের জীবনে আলী আকবার খানের ষড়যন্ত্র, সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিসের প্রণয়, ব্যর্থতা নজরুলের জীবন ইতিহাসে এক করুণ অধ্যায় বলে চিহ্নিত হয়ে আছে। যার রেশ কবিকে সারাজীবন ধরেই বহন করতে হয়েছে।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের সবচেয়ে বড় বৈরীপক্ষ ছিল ব্রিটিশ শাসকপক্ষ। সত্য-ন্যায় ও শোষিত মানুষের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে নজরুল ব্রিটিশ রাজের রোষানলে পড়ে জেল খেটেছেন। ১৯২২ সালের ২৬ শে সেপ্টেম্বর তাঁর রচিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের মামলা হয়। প্রহসনের এই বিচারে নজরুলের এক বছরের কারাদণ্ড হয়। ১৯৩০ সালের ৭ই মে প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র বুলবুলের মৃত্যু হয় বসন্ত রোগে। ছেলে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় নজরুল ডাক্তার, কবিরাজ, বৈদ্য সবকিছু করেও ছেলেকে সুস্থ করে তুলতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত পিতৃহৃদয় হার মেনে ছিল পুত্রস্নেহের কাছে। পুত্রকে সুস্থ করে তুলতে এক সাধুর শরণাপণ্ন হয়েছিলেন কবি। বিশ্বস্ত দুই সঙ্গী মৈনুদ্দিন আর শান্তিপদ সিংহকে পাঠিয়েছিলেন সাধুকে আনার জন্যে। কবি মৈনুদ্দিন তাঁর ‘যুগস্রষ্টা নজরুল’ গ্রন্থে লিখেছেন, “কবির বাড়িতে যখন সাধুকে নিয়ে এলাম, তখন বেশ রাত হয়েছে। আমাদের সাড়া পেয়ে কবি ছুটে এলেন, বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। বললেন ওরে মৈনুদ্দিন, সাধু কি মরদেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারবে?” বুলবুলের মৃত্যু কবির জীবনযাত্রা একেবারে পাল্টে দিয়েছিল। তিনি সমস্ত উচ্ছ্বাস বর্জন করেছিলেন। যেন এক গভীর রহস্যের সামনে দাঁড়িয়ে পরম সত্যকে অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছিলেন। এরপর তিনি ঝুঁকে পড়েছিলেন আধ্যাত্ম সাধনার দিকে। মুর্শিদাবাদের গৃহযোগী বরদাচরণ মজুমদারকে যোগগুরু হিসেবে গ্রহণ করে গুরুর কথামতো শশ্মানে গিয়েও সাধনা করেছিলেন নজরুল ইসলাম। ১৯৩৯ সালে প্রমীলা দেবী পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলে কবি পরিবারে নেমে আসে বিষাদের কালো মেঘ। প্রমীলা দেবীর চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে কবি বালিগঞ্জের জমিটুকু বিক্রি করে দেন, তখনকার দিনের দামি ‘ক্রাইসলার’ গাড়িটিও বিক্রি করে দেন। কবির জীবনে নেমে আসে সীমাহীন দারিদ্রতা।
এ সম্পর্কে প্রাবন্ধিক জিয়াদ আলী লিখেছেন- ‘শ্যামবাজারের বাড়িতে থাকার সময় এমনও হয়েছে কবির অন্নগ্রহনের প্রিয় কাসার বাসন দোকানে বন্ধক দিয়ে চাল কিনতে হয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরস্কার হিসেবে পাওয়া একভরি ওজনের সোনার তৈরি ‘জগত্তারিণী’ পদক কয়েকবার যে বাঁধা দিতে হয়েছে পরিবারের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য, সে খবর এখন কতজনই বা রাখে।’ ১৯৪১ সালের ৬ই এপ্রিল মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজত জয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন ‘দেখ উন্মাদ তোর জীবনে শেলির মতো, কিটসের মতো খুব বড় একটা ট্রাজেডি আছে। তুই প্রস্তুত হ।’ বিশ্বকবির সেই ভবিষ্যৎ বাণী ১৯৪২ সালে এসে সত্যে পরিণত হয়। ১৯৪২ সালের ৯ই জুলাই কলকাতা বেতারের একটি অডিশনে গান গাইতে গিয়ে তাঁর কণ্ঠ জড়িয়ে আসে। আর তখনি তাঁর অসুস্থতার বিষয়টি সকলের নজরে আসে। নজরুল ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত নজরুলের পত্রাবলির ৭৯ ও ৮০ নম্বর পত্রের মাধ্যমে কবির জীবনের এক মর্মান্তিক বেদনার কথা জানা যায়।
১৯৪২ সালের ১০ই জুলাই কবি তাঁর সুহৃদ সুফি জুলফিকার হায়দারকে একটি চিঠিতে লিখেছেন- ‘খোকাকে পাঠালাম, তুমি এখনই খোকার সাথে চলে এসো। ইষড়ড়ফ ঢ়ৎবংংঁৎব এ শয্যাগত। অতিকষ্টে চিঠি লিখছি। আমার বাড়িতে অসুখ, ঋণ, পাওনাদারের তাগাদা প্রভৃতি ডড়ৎৎরবং। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত খাটুনি। তারপর নবযুগের ডড়ৎৎরবং ৩/৪ মাস পর্যন্ত। এইসব কারণে আমার হবৎাবং ংযধঃঃবৎবফ হয়ে গেছে। ৭ মাস ধরে হক সাহেবের কাছে গিয়ে ভিখারির মতো ৫-৬ ঘণ্টা বসে থেকে ফিরে এসেছি।’ এই পত্র হতে জানা যায়, ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে কবির জীবনে একটা নিদারুন ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা, নিজের চিকিৎসা, সংসারের নিত্য খরচ, পাওনাদারের তাগাদা, সব মিলিয়ে টাকার অভাবে কবি চরম কষ্টে পতিত হন। তিনি টাকার জন্য শেরে বাংলা ফজলুল হক সাহেবকে তাগাদা দিতে থাকেন। এখন কথা হলো হক সাহেবের নিকট কবি কিসের টাকা পেতেন। এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ৮০ নম্বর পত্রে। যা কবি শ্যামা প্রসাদকে লিখেছেন- “নবযুগের সম্পাদনার ভার যখন নিই, তার কিছুদিন আগে ফিল্মের গঁংরপ উরৎবপঃরড়হ- এর জন্য ৭ হাজার টাকার কন্ট্রাক পাই। হক সাহেব ও তাঁর অনেক হিন্দু-মুসলমান ঝঁঢ়ঢ়ড়ৎঃবৎ আমায় বলেন যে, তাঁরা ও ঋণ শোধ করে দেবেন। আমি ঋরষস এর পড়হঃৎধপঃ পধহপবষ করে দিই। আপনি জানেন ঝবপৎবঃধরৎধঃ- এ আপনার সামনে হক সাহেব বলেন, কাজীর ঋণ শোধ করে দিতে হবে।”
অর্থ্যাৎ দ্বিতীয় দফায় ‘নবযুগ’ বের হওয়ার প্রাক্কালে হক সাহেব কবিকে ‘নবযুগ’ সম্পাদনা করতে অনুরোধ করেন। কিন্ত কবি সেসময় একটা ফিল্ম কোম্পানির সাথে ৭ হাজার টাকার কন্ট্রাক্ট করেছিলেন। হক সাহেব কবিকে উক্ত কন্ট্রাক্ট বাতিল করে কবিকে ‘নবযুগ’ সম্পাদনা করতে বলেন। বিনিময়ে তিনি কবিকে ৭ হাজার টাকা পরিশোধ করবেন। কিন্তু সেই টাকা হক সাহেব কবিকে আর পরিশোধ করেননি। অথচ হক সাহেবের জন্য কবি অনেক কিছুই করেছেন। এক সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি হক সাহেবের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। সমস্ত ছাত্র তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপে গিয়েছিল। কমে গিয়েছিল হক সাহেবের জীবনের নিরাপত্তা। এমন পরিস্থিতিতে হক সাহেবকে রক্ষা করেছিলেন নজরুল ইসলাম।
শ্যামাপ্রসাদকে লেখা এক পত্রে কবি বলেন, “হক সাহেব যখন আমার কাছে কাঁদতে থাকেন যে, ‘আমায় রক্ষা কর, মুসলমান ছেলেরা বাইরে বেরুতে দিচ্ছে না’, আমি তখন মুসলিম লীগের ছাত্র ও তরুণ লিডারদের ডেকে তাদের শান্ত করি। তারপর অংংবসনষবু- এর সমস্ত মুসলমান মেম্বারদের কাছে আমি আবেদন করি, তাঁরা আমার আবেদন শুনলেন। ৭৪ জন মেম্বার হক সাহেবকে সমর্থন করতে রাজি হলেন।” তখনকার পরিস্থিতিতে এটা হক সাহেবের জন্য বিরাট কর্মই বলা যায়। কিন্তু হক সাহেবের বৈরি আচরণে কবি ব্যাপক আঘাত পেয়েছিলেন। নজরুল ইসলাম জুলফিকার হায়দারকে লিখেছেন- “হক সাহেব একদিন বললেন, কিসের টাকা? আমি চুপ করে চলে এলাম। তারপর আর তাঁর কাছে যায়নি।” প্রিয় নেতার কাছ থেকে এতটা আঘাত কবি সহ্য করতে পারেননি। অভিমানি কবি জুলফিকার হায়দারকে লিখেছেন- “হয়ত কবি ফেরদৌসির মতো ঐ টাকা আমার জানাজার নামাজের দিন পাব। কিন্তু ঐ টাকা নিতে নিষেধ করেছি আমার আত্মীয়-স্বজনদের।”
দারিদ্রতার কারণে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা পায়নি কবি। বেশিরভাগ বন্ধ-বান্ধব দূরে সরে গিয়েছিলেন। প্রাবন্ধিক জিয়াদ আলী লিখেছেন- “কবি যখন সুস্থ ছিলেন, কত মানুষের আনাগোনা ছিল তাঁর কাছে। কবি যখন গ্রামোফোন কোম্পানির ট্রেনার ও সুরকার তখন কত শিল্পীর সমাগম ঘটে তাকে কেন্দ্র করে, কিন্তু কবির অসুস্থতার পর অবস্থাটা একেবারেই বদলে গেল।” বস্তুত কবির অসুস্থতাজনিত এই অসহায়তার সুযোগে কবি ও কবি পরিবারের সাহায্যের নামে নোংরা রাজনীতি কম হয়নি। আগেই বলেছি নাম যার দুখু মিয়া তাঁর কপালে কি সুখ সয়। কবির কপালেও সুখ সয়নি। নিজের শারীরিক অসুস্থতা, অর্থসংকট, স্ত্রীর অসুস্থতা, ঘনিষ্ঠজনদের প্রতারণা সবমিলিয়ে একটা প্রাণসংহারী বেদনার নীল বিষে বিষিয়ে উঠেছিল আমাদের প্রাণপ্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন। আজ ২৫ শে মে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ। দ্রোহ ও প্রেমের কবি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে শব্দের মিছিলে কুর্নিশ জানাই প্রিয় কবিকে।

মো. মামুনার রশীদ
সিনিয়র শিক্ষক
ভিক্টোরিয়া জুবিলি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চুয়াডাঙ্গা।