ইপেপার । আজশনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধারাবাহিক কমছে ভোটের হার

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৮:২০:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ মে ২০২৪
  • / ৩৫ বার পড়া হয়েছে

বিগত দেড় দশকের মধ্যে গত ৮ মে অনুষ্ঠিত দেশের ১৪৯টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল সর্বনিম্ন। অর্ধশত উপজেলায় মাত্র ১২ থেকে ১৫ শতাংশ ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বলে ইসির পরিসংখ্যান সূত্রে জানা গেছে। বিএনপির বর্জনের মুখে ভোটার বাড়াতে নৌকা প্রতীক না দিয়ে দলীয় প্রার্থিতা উন্মুক্ত রেখেছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) কমিশনের কর্মকর্তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন জেলা-উপজেলায়। এরপরও ভোটারদের প্রত্যাশিত মাত্রায় আগ্রহী করা যায়নি। প্রশ্ন উঠেছে- শুধু কি বিএনপির বর্জনের কারণেই ভোটের হার কম হয়েছে। নাকি ভোটকেন্দ্রে যেতে সামগ্রিকভাবে ভোটাদের আগ্রহই কমে গেছে? যদি তা-ই হয়, তাহলে এমনটি হলো কেন?
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিগত তিনটি উপজেলা নির্বাচনেই ভোটের হার ধারাবাহিকভাবে কমেছে। এবার প্রথম ধাপের নির্বাচনে ১৩৯টি উপজেলার মধ্যে ৮১টিতেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটারের ২০ শতাংশের কম ভোট পেয়ে। উপজেলা পরিষদের মতো একটি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ভোটের হার দেখে বিষ্ময় প্রকাশ করে বিশ্লেষকরা বলেছেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিই ভোটারদের নিস্পৃহ করে তুলেছে। বিগত ১৫-১৬ বছর ধরে একটি দলই ক্ষমতায় রয়েছে। ভোটাররা বুঝে গেছে কে নির্বাচনে বিজয়ী হবে। তাই কেন কষ্ট করে ভোটাররা ভোট দিতে আসবে- এমন প্রশ্ন রেখেছেন তারা। আবার কেউ কেউ বলেছেন, বিরোধী দলহীন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া প্রভাব থাকায় ভোটারদের আগ্রহ কমে গেছে। সে কারণে দিনে দিনে ভোটের হার কমছে। কে চেয়ারম্যান হলো আর কে ভাইস চেয়ারম্যান হলো তাতে সাধারণ মানুষের তেমন আগ্রহ নেই।
এদিকে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর জানান, ভোটের দিন বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হওয়ায় ও ধান কাটার মৌসুম থাকায় ভোটাররা কেন্দ্রে কম এসেছেন। তার দেয়া তথ্যমতে, সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে সোনাতলা, মীরসরাই ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলায়। সেখানে ভোট পড়েছে ১৭ শতাংশ। সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলায়। সেখানে ভোট পড়েছে ৭৩ দশমিক এক শতাংশ। প্রথম দফা ভোটের পরদিন ইসির দেয়া হিসাবমতে- গত ৮ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ভোট পড়েছে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ। এর মধ্যে ইভিএমে ভোটের হার ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ; আর ব্যালটে ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ। প্রসঙ্গত, ইসির হিসাবেই গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও ভোটের এই নির্বাচন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া ভোট শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে। এ বিষয়টিকেই তারা গুরুত্ব দিতে চাইছেন। ভোটের হার নিয়ে নয়।
আবার সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপ মুজিবুল হক চুন্নু মনে করেন, দিনে দিনে ভোটাররা নির্বাচনবিমুখ, ইসি ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। বেশ কয়েকটি ভোটের হার তুলে ধরে কেন ভোটাররা কেন্দ্রে আসছে না তা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভোট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানুষ- যা গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেগের। এই পরিস্থিতির দায় কি আসলে গণতন্ত্রহীনতার, বিরোধী দলের ভোট বর্জনের, নাকি ভোটারদের পছন্দের প্রার্থী না থাকার- সেই প্রশ্নও তুলছেন তারা।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, আমরা দিনের পর দিন লক্ষ্য করছি- বিগত বেশ কয়েকটি নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি খুবই কম। কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, বর্তমানে যে ডেমোক্র্যাসি দেশে চলছে, তা চলতে থাকলে ভোটার আরো কেন্দ্রবিমুখ হবে। কেননা তাদের চলমান গণতন্ত্রের ওপর বিশ্বাস নেই, তারা মনে করেন ভোট দিলেও যা হবে, না দিলেও তা হবে। ভোটাররা মনে করেন, বর্তমান সরকারের অধীনে বিএনপি বা আরো অনেক দল অংশ নিচ্ছে না। ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থী পাচ্ছেন না। তারা মনে করেন, আওয়ামী লীগের এই সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজন উপজেলা নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন, তারা নিশ্চয়ই যেনতেন প্রকারে জিতে যাবেন। আবার ভোটে জিতে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের ভাগ্যের পরিবর্তন হলেও সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন নেই। তারপর কোথাও ১০ শতাংশ ভোট পড়লে তা বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করতে ইসির সময় লাগে না; তাই তাদের ভোটের কোনো মূল্য নেই। সব মিলিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক ধারার ওপর ভোটারদের আস্থাহীনতার কারণে ভোটের হার কমছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, কেন ভোটাররা কেন্দ্রে আসবে এটাই এখন বড় প্রশ্ন? তারা ভোট দিলে যা হবে, না দিলেও তাই হবে। দেশের গণতান্ত্রিক ধারার কী অবস্থা? স্থানীয় সরকার কেন- জাতীয় নির্বাচনেও কি ভোটাররা আগ্রহী ছিল? ভোটের পরিসংখ্যান কী বলে? তিনি বলেন, আসলে গণতান্ত্রিক ধারা বা নির্বাচনী সিস্টেম বদল করা দরকার। সে জন্য কাজকর্ম ফেলে এসব নির্বাচন নিয়ে জনগণের মাথাব্যথা নেই। ভাগ্য পরিবর্তন তো হবে নির্বাচিত প্রার্থীদের, জনগণের কী হবে? কিচ্ছু হবে না। তারা যাই আছে তা-ই থাকবে। আর নির্বাচন কমিশন কেন ভোটার টানতে কাজ করবে? কম ভোট পড়লে কি তাদের চাকরি চলে যাবে, সুযোগ-সুবিধা কমে যাবে? এটাই এ দেশের ধারা চলছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনের প্রতি মানুষের অনাস্থার প্রতিফলন এই ভোটের ফলাফল। আর এই অনাস্থার কারণে মানুষ এখন ভোটবিমুখ। দেশের একটা বড় দল বা অংশ ভোটে অংশ না নেয়ায় পছন্দের প্রার্থী অনেকে পায় না। তাছাড়া নির্বাচনব্যবস্থা এখন টাকার খেলায় পরিণত হয়েছে। তাই এলাকার ভালো, পছন্দের বা উপযুক্ত মানুষ ভোটে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পায় না। গণতান্ত্রিক ধারা এখন একমুখী। এসব কারণে ভোটাররা কেন্দ্রে এসে ভোট দিতে আগ্রহ হারাচ্ছে। বেশির ভাগ উপজেলায় খুব কম ভোট পেয়েও চেয়ারম্যান পদে বসতে যাচ্ছেন নির্বাচিত ব্যক্তিরা। প্রথম ধাপের ১৩৯টি উপজেলার মধ্যে ৮১টিতে ২০ শতাংশের কম ভোট পেয়ে যারা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ১০ জন মোট ভোটারের ১০ শতাংশের কম ভোট পেয়েছেন। অবশ্য প্রদত্ত ভোটের হিসাবে তাদের ভোট পাওয়ার হার আরো বেশি। এর বাইরে ২৬ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন। এছাড়া স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে বাগেরহাট, ফেনী জেলার কয়েকটি উপজেলাসহ অনেক উপজেলায় সব প্রার্থীই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে- জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে ১২ দশমিত ৯৩ শতাংশ, চট্টগ্রামের মীরসরাইতে ১৭ শতাংশ, বগুড়ার সোনাতলায় ১৭ দশমিক ১১ শতাংশ, কুষ্টিয়া সদরে ১৭ দশমিক ৪২ শতাংশ, ঢাকার নবাবগঞ্জে ১৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ, সন্দীপে ১৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ২০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে ৮১টি উপজেলায়।
প্রথম ধাপের ৬৩টি উপজেলায় তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। এসব উপজেলায় বিজয়ী প্রার্থীর সঙ্গে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোটের ব্যবধান ১০ হাজারের বেশি। মাত্র ১৩টি উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে বেশি। এই উপজেলাগুলোতে ব্যবধান ১ হাজার ভোটের কম। ৩১টি উপজেলায় ভোটের ব্যবধান হয়েছে ৩ হাজারের কম। সবচেয়ে বেশি ভোটের ব্যবধান হয়েছে ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলায়। সেখানে মোট ভোটার ছিলেন ৬ লাখ ১১ হাজার ৬১০ জন। ভোট পড়েছে ৩৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। বিজয়ী প্রার্থী আওয়ামী লীগের নেতা শাহিন আহমেদ পেয়েছেন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৩৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আলতাব হোসেন পেয়েছেন ৬০ হাজার ২৯৩ ভোট। ভোটের ব্যবধান হয়েছে ১ লাখের বেশি। ১৫ বছর আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে তৃতীয় উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। এরপর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬১ শতাংশের মতো। আর ২০১৯ সালে প্রথমবার দলীয় প্রতীকে উপজেলা নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ। এবার প্রথম ধাপে ভোটের হার ৩৬ শতাংশে নেমে এসেছে। পরপর চারটি উপজেলা নির্বাচনে ভোট কমেছে ধারাবাহিকভাবে। এবার ভোটের হার সর্বনিম্ন। এছাড়া ২০১৯ সালের উপজেলা ভোটে চেয়ারম্যান পদে ১১৫ জন বিনা ভোটে জয়ী হলেও এবার প্রথম ধাপে ১৪৪ উপজেলার মধ্যে মাত্র পাঁচটিতে সব প্রার্থী বিনা ভোটে (২৬ জন) জয়ী হয়েছেন।
এ নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, প্রথম ধাপে ভোট পড়ার হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে হতে পারে। ধান কাটার মৌসুম ও সকালে বৃষ্টি হওয়ায় ভোট পড়ার হার কম হতে পারে। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, ভোটাররা ধান কাটায় ব্যস্ত থাকায় কেন্দ্রে যাননি। এছাড়া কিছু কিছু জায়গায় ঝড়-বৃষ্টিও হয়েছে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

ধারাবাহিক কমছে ভোটের হার

আপলোড টাইম : ০৮:২০:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ মে ২০২৪

বিগত দেড় দশকের মধ্যে গত ৮ মে অনুষ্ঠিত দেশের ১৪৯টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল সর্বনিম্ন। অর্ধশত উপজেলায় মাত্র ১২ থেকে ১৫ শতাংশ ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বলে ইসির পরিসংখ্যান সূত্রে জানা গেছে। বিএনপির বর্জনের মুখে ভোটার বাড়াতে নৌকা প্রতীক না দিয়ে দলীয় প্রার্থিতা উন্মুক্ত রেখেছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) কমিশনের কর্মকর্তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন জেলা-উপজেলায়। এরপরও ভোটারদের প্রত্যাশিত মাত্রায় আগ্রহী করা যায়নি। প্রশ্ন উঠেছে- শুধু কি বিএনপির বর্জনের কারণেই ভোটের হার কম হয়েছে। নাকি ভোটকেন্দ্রে যেতে সামগ্রিকভাবে ভোটাদের আগ্রহই কমে গেছে? যদি তা-ই হয়, তাহলে এমনটি হলো কেন?
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিগত তিনটি উপজেলা নির্বাচনেই ভোটের হার ধারাবাহিকভাবে কমেছে। এবার প্রথম ধাপের নির্বাচনে ১৩৯টি উপজেলার মধ্যে ৮১টিতেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটারের ২০ শতাংশের কম ভোট পেয়ে। উপজেলা পরিষদের মতো একটি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ভোটের হার দেখে বিষ্ময় প্রকাশ করে বিশ্লেষকরা বলেছেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিই ভোটারদের নিস্পৃহ করে তুলেছে। বিগত ১৫-১৬ বছর ধরে একটি দলই ক্ষমতায় রয়েছে। ভোটাররা বুঝে গেছে কে নির্বাচনে বিজয়ী হবে। তাই কেন কষ্ট করে ভোটাররা ভোট দিতে আসবে- এমন প্রশ্ন রেখেছেন তারা। আবার কেউ কেউ বলেছেন, বিরোধী দলহীন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া প্রভাব থাকায় ভোটারদের আগ্রহ কমে গেছে। সে কারণে দিনে দিনে ভোটের হার কমছে। কে চেয়ারম্যান হলো আর কে ভাইস চেয়ারম্যান হলো তাতে সাধারণ মানুষের তেমন আগ্রহ নেই।
এদিকে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর জানান, ভোটের দিন বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হওয়ায় ও ধান কাটার মৌসুম থাকায় ভোটাররা কেন্দ্রে কম এসেছেন। তার দেয়া তথ্যমতে, সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে সোনাতলা, মীরসরাই ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলায়। সেখানে ভোট পড়েছে ১৭ শতাংশ। সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলায়। সেখানে ভোট পড়েছে ৭৩ দশমিক এক শতাংশ। প্রথম দফা ভোটের পরদিন ইসির দেয়া হিসাবমতে- গত ৮ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ভোট পড়েছে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ। এর মধ্যে ইভিএমে ভোটের হার ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ; আর ব্যালটে ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ। প্রসঙ্গত, ইসির হিসাবেই গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও ভোটের এই নির্বাচন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া ভোট শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে। এ বিষয়টিকেই তারা গুরুত্ব দিতে চাইছেন। ভোটের হার নিয়ে নয়।
আবার সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপ মুজিবুল হক চুন্নু মনে করেন, দিনে দিনে ভোটাররা নির্বাচনবিমুখ, ইসি ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। বেশ কয়েকটি ভোটের হার তুলে ধরে কেন ভোটাররা কেন্দ্রে আসছে না তা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভোট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানুষ- যা গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেগের। এই পরিস্থিতির দায় কি আসলে গণতন্ত্রহীনতার, বিরোধী দলের ভোট বর্জনের, নাকি ভোটারদের পছন্দের প্রার্থী না থাকার- সেই প্রশ্নও তুলছেন তারা।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, আমরা দিনের পর দিন লক্ষ্য করছি- বিগত বেশ কয়েকটি নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি খুবই কম। কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, বর্তমানে যে ডেমোক্র্যাসি দেশে চলছে, তা চলতে থাকলে ভোটার আরো কেন্দ্রবিমুখ হবে। কেননা তাদের চলমান গণতন্ত্রের ওপর বিশ্বাস নেই, তারা মনে করেন ভোট দিলেও যা হবে, না দিলেও তা হবে। ভোটাররা মনে করেন, বর্তমান সরকারের অধীনে বিএনপি বা আরো অনেক দল অংশ নিচ্ছে না। ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থী পাচ্ছেন না। তারা মনে করেন, আওয়ামী লীগের এই সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজন উপজেলা নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন, তারা নিশ্চয়ই যেনতেন প্রকারে জিতে যাবেন। আবার ভোটে জিতে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের ভাগ্যের পরিবর্তন হলেও সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন নেই। তারপর কোথাও ১০ শতাংশ ভোট পড়লে তা বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করতে ইসির সময় লাগে না; তাই তাদের ভোটের কোনো মূল্য নেই। সব মিলিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক ধারার ওপর ভোটারদের আস্থাহীনতার কারণে ভোটের হার কমছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, কেন ভোটাররা কেন্দ্রে আসবে এটাই এখন বড় প্রশ্ন? তারা ভোট দিলে যা হবে, না দিলেও তাই হবে। দেশের গণতান্ত্রিক ধারার কী অবস্থা? স্থানীয় সরকার কেন- জাতীয় নির্বাচনেও কি ভোটাররা আগ্রহী ছিল? ভোটের পরিসংখ্যান কী বলে? তিনি বলেন, আসলে গণতান্ত্রিক ধারা বা নির্বাচনী সিস্টেম বদল করা দরকার। সে জন্য কাজকর্ম ফেলে এসব নির্বাচন নিয়ে জনগণের মাথাব্যথা নেই। ভাগ্য পরিবর্তন তো হবে নির্বাচিত প্রার্থীদের, জনগণের কী হবে? কিচ্ছু হবে না। তারা যাই আছে তা-ই থাকবে। আর নির্বাচন কমিশন কেন ভোটার টানতে কাজ করবে? কম ভোট পড়লে কি তাদের চাকরি চলে যাবে, সুযোগ-সুবিধা কমে যাবে? এটাই এ দেশের ধারা চলছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনের প্রতি মানুষের অনাস্থার প্রতিফলন এই ভোটের ফলাফল। আর এই অনাস্থার কারণে মানুষ এখন ভোটবিমুখ। দেশের একটা বড় দল বা অংশ ভোটে অংশ না নেয়ায় পছন্দের প্রার্থী অনেকে পায় না। তাছাড়া নির্বাচনব্যবস্থা এখন টাকার খেলায় পরিণত হয়েছে। তাই এলাকার ভালো, পছন্দের বা উপযুক্ত মানুষ ভোটে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পায় না। গণতান্ত্রিক ধারা এখন একমুখী। এসব কারণে ভোটাররা কেন্দ্রে এসে ভোট দিতে আগ্রহ হারাচ্ছে। বেশির ভাগ উপজেলায় খুব কম ভোট পেয়েও চেয়ারম্যান পদে বসতে যাচ্ছেন নির্বাচিত ব্যক্তিরা। প্রথম ধাপের ১৩৯টি উপজেলার মধ্যে ৮১টিতে ২০ শতাংশের কম ভোট পেয়ে যারা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ১০ জন মোট ভোটারের ১০ শতাংশের কম ভোট পেয়েছেন। অবশ্য প্রদত্ত ভোটের হিসাবে তাদের ভোট পাওয়ার হার আরো বেশি। এর বাইরে ২৬ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন। এছাড়া স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে বাগেরহাট, ফেনী জেলার কয়েকটি উপজেলাসহ অনেক উপজেলায় সব প্রার্থীই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে- জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে ১২ দশমিত ৯৩ শতাংশ, চট্টগ্রামের মীরসরাইতে ১৭ শতাংশ, বগুড়ার সোনাতলায় ১৭ দশমিক ১১ শতাংশ, কুষ্টিয়া সদরে ১৭ দশমিক ৪২ শতাংশ, ঢাকার নবাবগঞ্জে ১৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ, সন্দীপে ১৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ২০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে ৮১টি উপজেলায়।
প্রথম ধাপের ৬৩টি উপজেলায় তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। এসব উপজেলায় বিজয়ী প্রার্থীর সঙ্গে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোটের ব্যবধান ১০ হাজারের বেশি। মাত্র ১৩টি উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে বেশি। এই উপজেলাগুলোতে ব্যবধান ১ হাজার ভোটের কম। ৩১টি উপজেলায় ভোটের ব্যবধান হয়েছে ৩ হাজারের কম। সবচেয়ে বেশি ভোটের ব্যবধান হয়েছে ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলায়। সেখানে মোট ভোটার ছিলেন ৬ লাখ ১১ হাজার ৬১০ জন। ভোট পড়েছে ৩৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। বিজয়ী প্রার্থী আওয়ামী লীগের নেতা শাহিন আহমেদ পেয়েছেন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৩৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আলতাব হোসেন পেয়েছেন ৬০ হাজার ২৯৩ ভোট। ভোটের ব্যবধান হয়েছে ১ লাখের বেশি। ১৫ বছর আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে তৃতীয় উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। এরপর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬১ শতাংশের মতো। আর ২০১৯ সালে প্রথমবার দলীয় প্রতীকে উপজেলা নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ। এবার প্রথম ধাপে ভোটের হার ৩৬ শতাংশে নেমে এসেছে। পরপর চারটি উপজেলা নির্বাচনে ভোট কমেছে ধারাবাহিকভাবে। এবার ভোটের হার সর্বনিম্ন। এছাড়া ২০১৯ সালের উপজেলা ভোটে চেয়ারম্যান পদে ১১৫ জন বিনা ভোটে জয়ী হলেও এবার প্রথম ধাপে ১৪৪ উপজেলার মধ্যে মাত্র পাঁচটিতে সব প্রার্থী বিনা ভোটে (২৬ জন) জয়ী হয়েছেন।
এ নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, প্রথম ধাপে ভোট পড়ার হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে হতে পারে। ধান কাটার মৌসুম ও সকালে বৃষ্টি হওয়ায় ভোট পড়ার হার কম হতে পারে। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, ভোটাররা ধান কাটায় ব্যস্ত থাকায় কেন্দ্রে যাননি। এছাড়া কিছু কিছু জায়গায় ঝড়-বৃষ্টিও হয়েছে।