ইপেপার । আজ বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ

প্রতিবেদক, মুজিবনগর:
  • আপলোড টাইম : ০৭:৫৬:৩১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
  • / ১৫ বার পড়া হয়েছে

সুরভিত পুষ্পোদ্যান নয়, নয় সুসজ্জিত মোহিত মঞ্চ গ্রীষ্মের গনগনে দিনে উন্মুক্ত উত্তপ্ত ভূমিতে জন্মেছিল এক ইতিহাস সতেরো এপ্রিল, শান্তির পাঁয়রা উড়েছিল আম্রকাননের নিভৃত নিকুঞ্জে ফুটে উঠেছিল উত্তাল একাত্তর। স্বাধীনতার দাবি নিয়ে তুলে ধরা সাড়ে ৭ কোটি হাতে মেলে ধরা লাল-সবুজের পতাকা উড়েছিল বৈদ্যনাথতলা থেকে মুজিবনগর। আজ ১৭ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের এই দিনে আমাদের জাতীয় জীবনে ধ্রবতারার মতো দীপ্ত একটি দিন, এই দিন মেহেরপুরের মুজিবনগর আম্রকাননে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের মধ্যদিয়ে চোখ মেলেছিল নবজাতক শিশু বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুঞ্জয়ী মন্ত্রে দীক্ষিত বাঙালী যে রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্যদিয়ে অর্জন করে হাজার বছরের সপ্নলালিত এক সার্বভৌম রাষ্ট্র, যে সংগ্রামের আবেগমথিত উৎসমূখ ছিল মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ। আমাদের দেশবাসী সূদীর্ঘ দুই শতাব্দীরও অধীককাল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং পাকিস্তানের শাসনে শৃংখলিত ছিল। উপমহাদেশের জনগণ যুগ যুগব্যাপী সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে উৎখাত করেছে বৃটিশ ও ঔপনিবেশিক শাসন।

পরবর্তীকালে পাকিস্তান আমলে আমাদের দেশবাসী গড়ে তোলে গণতন্ত্র এবং জাতীয় স্বাধিকারের জন্য এক গৌরবময় সংগ্রাম। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরের বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা ও শপথ গ্রহণের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহিদের রক্ত আর হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জত, অশ্রু এবং কোটি জনতার আত্মত্যাগের সুমহান ঐতিহ্য সৃষ্টি করে এক বীরত্বপূর্ণ ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মধ্যদিয়ে আমাদের দেশবাসী প্রতিষ্ঠা করেছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

২০০ বছর আগে ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতা সুর্য অস্ত যাওয়ার পর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল আবার সেই তৎকালিন প্রাচীন জেলা নদীয়ার আর এক অংশে মেহেরপুর মুজিবনগরের আম্রকাননে স্বগর্বে আত্নপ্রকাশ করে ছিল বাংলাদেশ-এর স্বাধীনতার সুর্য । আর সেই থেকে পালিত হয়ে আসছে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস। প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও পালন করা হবে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস। এবছর জাঁকজমকভাবে দিনটি পালিত হবে। ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক।
সভাপতিত্ব করবেন জনপ্রশাসন মন্ত্রী ও মেহেরপুর -১ আসনের সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্তনালয়ের প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন এমপি, রাজশাহী সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন এবং ডা. সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি।
এছাড়াও আলোচনাসভায় সরকারের মন্ত্রীবর্গ, বিভিন্ন জেলার সংসদ সদস্যগণ, বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বক্তব্য রাখবেন। সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে দিবসটি উদ্যাপনের জন্য ঐতিহাসিক আম্রকানন ও মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সসহ এর চারপাশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্নসহ সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়। পুলিশ সুপার এস এম নাজমুল হক জানান, মুজিবনগর দিবস পালন উপলক্ষে চার স্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. শামীম হাসান জানান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ১৭ এপ্রিল পালনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। বাইরে থেকে জেলায় সেসব ভিআইপি গেস্ট এসেছে, তাঁদের থাকার ব্যবস্থাসহ সকল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানান, মুজিবনগর দিবস শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকার পালন করে। অন্যরা মুখে মুজিবনগর সরকারের কথা বলে কিন্তু পালন করে না। দিবসটি আমাদের জাতীয় জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুজিবনগর দিবস পলেনের সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। ইতিহাসের পাতা থেকে ১০ এপ্রিল ইন্ডিয়ার মাটিতে সরকার গঠন করলেও বৈধতার প্রশ্নে দেশের মাটিতে শপথ গ্রহণ করার জন্য প্রথমে আখাউড়া পরে চুয়াডাঙ্গা শেষে নিরাপত্তার জন্য বেছে নেওয়া হয় মেহেরপুর সীমান্তবর্তি বৈদ্যনাথতলার আমবাগান।
১৭ এপ্রিল শনিবার ১৯৭১ সাল, সকাল বেলা তদানীন্তন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলা গাঁয়ের নাম বদলে গিয়ে নতুন নাম হল মুজিবনগর। বিশাল আম্যকাননের ছায়াতলে আত্মপ্রকাশ করল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী বিপ¬বী সরকার। নিশ্চিত হল স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যূদ্বয়। তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি তাজউদ্দিন আহমেদ সেখানে আবেগ প্রবণ কন্ঠে ঘোষনা করেছিলেন, পলাশীর আম্রকাননে ১৭৫৭ সালে বাংলাদেশের যে স্বাধীনতার সুর্য অস্ত গিয়েছিল আজ তার নিকটবর্তী আরেক আম্রকাননে সেই স্বাধীনতার সুর্য পুনরায় উদিত হলো।
প্রকাশ্যে বাংলাদেশের মুজিবনগর মুক্তাঙ্গনে শতাধিক দেশী-বিদেশী সাংবাদিক, প্রেস ফটোগ্রাফার, বেতার ও টিভি প্রতিনিধিদের সম্মুখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও প্রথম মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তৎকালীন মেহেরপুর মহাকুমার এসডিও ছিলেন তৌফিক-ই-এলাহী। তিনি জানতে পারলেন ১৭ এপ্রিল ভবেরপাড়ার জমিদার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে একটি হাই কমান্ডের সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেই মোতাবেক মঞ্চ সজ্জাসহ সার্বিক ব্যবস্থা করলেন তিনি। নেতৃবৃন্দের জন্য আশেপাশের গ্রাম থেকে চেয়ার টেবিল আনা হলো। চেয়ারগুলো ছিল হাতল বিহীন।
বর্তমানে চেয়ার টেবিলগুলো ঢাকা মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে সংরক্ষিত। সকাল ৮টার দিকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানি, পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও অর্থ মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সহ নেতৃবৃন্দ মুজিবনগর পৌঁছালেন।
কলকাতার প্রেসক্লাব থেকে সাংবাদিকদের গাড়ির মিছিল নিয়ে মুজিবনগর পৌঁছাতে প্রায় চার ঘণ্টা সময় লেগেছিল ঐতিহাসিক আমবাগানে পৌঁছাতে। আমবাগানের মাঝামাঝি পশ্চিমপ্রান্তে বর্তমানে যেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। ঠিক তার মাঝখানে সভা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। যে ভিতের ওপর সেদিন বাংলাদেশের পতাকা উঠানো হয়েছিল, ঠিক সেখানে একটি স্তম্ভ তৈরি করা হয়েছিল। আর ঐ স্তম্ভটিকে স্মৃতিসৌধের মাঝখানে রেখে বর্তমান স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথমে সাদা টুপি, চেক লুঙ্গি ও সাদা শার্ট পরে স্থানীয় যুবক বর্তমানে মুজিবনগর ডিগ্রি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক বাকের আলী পবিত্র কুরআন শরীফ থেকে তিলাওয়াত করে সভার শুভ উদ্বোধন করেন।
নতুন রাষ্ট্র সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করলেন প্রয়াত প্রভাষক আসাদুল ইসলামসহ স্থানীয় মিশনারির শিল্পীবৃন্দ। জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও নবগঠিত স্থানীয় ১২ জন আনসারের বাহিনীর একটি দল কর্তৃক গার্ড অব অনার গ্রহণের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভামঞ্চে প্রধান অতিথি হিসেবে আসন গ্রহণ করার পর অন্যান্য নেতৃবৃন্দ আসন গ্রহণ করেন। নেতৃবৃন্দের সকলের পরনে ছিল সাদা পায়জামা ও পাঞ্জাবি। একমাত্র পররাষ্ট্রমšী¿র পরনে ছিল গাঁঢ় রং এর লম্বা কোর্ট প্যান্ট এবং টুপি। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাবেক মন্ত্রী আব্দুল মান্নান এম এন এ। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তথ্য, প্রচার ও বেতারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী (সাবেক মন্ত্রী) বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান, তবে তাঁর অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেন। প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন তাজউদ্দীন আহমেদ, মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী, খন্দকার মোস্তাক আহমেদ পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রীর অস্থায়ী দায়িত্ব পেলেন।
শপথ গ্রহণের পর প্রথমে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। এভাবে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ৮ পৃষ্ঠার এক বিবৃতি পাঠ করলেন এবং ঐ স্থানে বৈদ্যনাথতলার নাম রাখলেন মুজিবনগর। বিবৃতিতে তিনি উলে¬খ করলেন ইয়াহিয়া খান গণহত্যা চালিয়ে নিজেই পাকিস্তানের কবর খুঁড়েছেন। বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জনবহুল রাষ্ট্র বাংলাদেশ বিশ্বসভায় স্থান করে নেবেই। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শেষে বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে নাম লেখা হলো ভবেরপাড়ার বৈদ্যনাথতলা থেকে মুজিবনগরের। গঠিত হলো মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাজধানী ও মুক্তিযুদ্ধের সুতিকাগার।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ

আপলোড টাইম : ০৭:৫৬:৩১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪

সুরভিত পুষ্পোদ্যান নয়, নয় সুসজ্জিত মোহিত মঞ্চ গ্রীষ্মের গনগনে দিনে উন্মুক্ত উত্তপ্ত ভূমিতে জন্মেছিল এক ইতিহাস সতেরো এপ্রিল, শান্তির পাঁয়রা উড়েছিল আম্রকাননের নিভৃত নিকুঞ্জে ফুটে উঠেছিল উত্তাল একাত্তর। স্বাধীনতার দাবি নিয়ে তুলে ধরা সাড়ে ৭ কোটি হাতে মেলে ধরা লাল-সবুজের পতাকা উড়েছিল বৈদ্যনাথতলা থেকে মুজিবনগর। আজ ১৭ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের এই দিনে আমাদের জাতীয় জীবনে ধ্রবতারার মতো দীপ্ত একটি দিন, এই দিন মেহেরপুরের মুজিবনগর আম্রকাননে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের মধ্যদিয়ে চোখ মেলেছিল নবজাতক শিশু বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুঞ্জয়ী মন্ত্রে দীক্ষিত বাঙালী যে রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্যদিয়ে অর্জন করে হাজার বছরের সপ্নলালিত এক সার্বভৌম রাষ্ট্র, যে সংগ্রামের আবেগমথিত উৎসমূখ ছিল মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ। আমাদের দেশবাসী সূদীর্ঘ দুই শতাব্দীরও অধীককাল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং পাকিস্তানের শাসনে শৃংখলিত ছিল। উপমহাদেশের জনগণ যুগ যুগব্যাপী সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে উৎখাত করেছে বৃটিশ ও ঔপনিবেশিক শাসন।

পরবর্তীকালে পাকিস্তান আমলে আমাদের দেশবাসী গড়ে তোলে গণতন্ত্র এবং জাতীয় স্বাধিকারের জন্য এক গৌরবময় সংগ্রাম। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরের বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা ও শপথ গ্রহণের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহিদের রক্ত আর হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জত, অশ্রু এবং কোটি জনতার আত্মত্যাগের সুমহান ঐতিহ্য সৃষ্টি করে এক বীরত্বপূর্ণ ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মধ্যদিয়ে আমাদের দেশবাসী প্রতিষ্ঠা করেছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

২০০ বছর আগে ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতা সুর্য অস্ত যাওয়ার পর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল আবার সেই তৎকালিন প্রাচীন জেলা নদীয়ার আর এক অংশে মেহেরপুর মুজিবনগরের আম্রকাননে স্বগর্বে আত্নপ্রকাশ করে ছিল বাংলাদেশ-এর স্বাধীনতার সুর্য । আর সেই থেকে পালিত হয়ে আসছে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস। প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও পালন করা হবে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস। এবছর জাঁকজমকভাবে দিনটি পালিত হবে। ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক।
সভাপতিত্ব করবেন জনপ্রশাসন মন্ত্রী ও মেহেরপুর -১ আসনের সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্তনালয়ের প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন এমপি, রাজশাহী সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন এবং ডা. সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি।
এছাড়াও আলোচনাসভায় সরকারের মন্ত্রীবর্গ, বিভিন্ন জেলার সংসদ সদস্যগণ, বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বক্তব্য রাখবেন। সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে দিবসটি উদ্যাপনের জন্য ঐতিহাসিক আম্রকানন ও মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সসহ এর চারপাশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্নসহ সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়। পুলিশ সুপার এস এম নাজমুল হক জানান, মুজিবনগর দিবস পালন উপলক্ষে চার স্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. শামীম হাসান জানান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ১৭ এপ্রিল পালনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। বাইরে থেকে জেলায় সেসব ভিআইপি গেস্ট এসেছে, তাঁদের থাকার ব্যবস্থাসহ সকল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানান, মুজিবনগর দিবস শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকার পালন করে। অন্যরা মুখে মুজিবনগর সরকারের কথা বলে কিন্তু পালন করে না। দিবসটি আমাদের জাতীয় জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুজিবনগর দিবস পলেনের সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। ইতিহাসের পাতা থেকে ১০ এপ্রিল ইন্ডিয়ার মাটিতে সরকার গঠন করলেও বৈধতার প্রশ্নে দেশের মাটিতে শপথ গ্রহণ করার জন্য প্রথমে আখাউড়া পরে চুয়াডাঙ্গা শেষে নিরাপত্তার জন্য বেছে নেওয়া হয় মেহেরপুর সীমান্তবর্তি বৈদ্যনাথতলার আমবাগান।
১৭ এপ্রিল শনিবার ১৯৭১ সাল, সকাল বেলা তদানীন্তন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলা গাঁয়ের নাম বদলে গিয়ে নতুন নাম হল মুজিবনগর। বিশাল আম্যকাননের ছায়াতলে আত্মপ্রকাশ করল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী বিপ¬বী সরকার। নিশ্চিত হল স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যূদ্বয়। তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি তাজউদ্দিন আহমেদ সেখানে আবেগ প্রবণ কন্ঠে ঘোষনা করেছিলেন, পলাশীর আম্রকাননে ১৭৫৭ সালে বাংলাদেশের যে স্বাধীনতার সুর্য অস্ত গিয়েছিল আজ তার নিকটবর্তী আরেক আম্রকাননে সেই স্বাধীনতার সুর্য পুনরায় উদিত হলো।
প্রকাশ্যে বাংলাদেশের মুজিবনগর মুক্তাঙ্গনে শতাধিক দেশী-বিদেশী সাংবাদিক, প্রেস ফটোগ্রাফার, বেতার ও টিভি প্রতিনিধিদের সম্মুখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও প্রথম মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তৎকালীন মেহেরপুর মহাকুমার এসডিও ছিলেন তৌফিক-ই-এলাহী। তিনি জানতে পারলেন ১৭ এপ্রিল ভবেরপাড়ার জমিদার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে একটি হাই কমান্ডের সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেই মোতাবেক মঞ্চ সজ্জাসহ সার্বিক ব্যবস্থা করলেন তিনি। নেতৃবৃন্দের জন্য আশেপাশের গ্রাম থেকে চেয়ার টেবিল আনা হলো। চেয়ারগুলো ছিল হাতল বিহীন।
বর্তমানে চেয়ার টেবিলগুলো ঢাকা মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে সংরক্ষিত। সকাল ৮টার দিকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানি, পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও অর্থ মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সহ নেতৃবৃন্দ মুজিবনগর পৌঁছালেন।
কলকাতার প্রেসক্লাব থেকে সাংবাদিকদের গাড়ির মিছিল নিয়ে মুজিবনগর পৌঁছাতে প্রায় চার ঘণ্টা সময় লেগেছিল ঐতিহাসিক আমবাগানে পৌঁছাতে। আমবাগানের মাঝামাঝি পশ্চিমপ্রান্তে বর্তমানে যেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। ঠিক তার মাঝখানে সভা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। যে ভিতের ওপর সেদিন বাংলাদেশের পতাকা উঠানো হয়েছিল, ঠিক সেখানে একটি স্তম্ভ তৈরি করা হয়েছিল। আর ঐ স্তম্ভটিকে স্মৃতিসৌধের মাঝখানে রেখে বর্তমান স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথমে সাদা টুপি, চেক লুঙ্গি ও সাদা শার্ট পরে স্থানীয় যুবক বর্তমানে মুজিবনগর ডিগ্রি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক বাকের আলী পবিত্র কুরআন শরীফ থেকে তিলাওয়াত করে সভার শুভ উদ্বোধন করেন।
নতুন রাষ্ট্র সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করলেন প্রয়াত প্রভাষক আসাদুল ইসলামসহ স্থানীয় মিশনারির শিল্পীবৃন্দ। জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও নবগঠিত স্থানীয় ১২ জন আনসারের বাহিনীর একটি দল কর্তৃক গার্ড অব অনার গ্রহণের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভামঞ্চে প্রধান অতিথি হিসেবে আসন গ্রহণ করার পর অন্যান্য নেতৃবৃন্দ আসন গ্রহণ করেন। নেতৃবৃন্দের সকলের পরনে ছিল সাদা পায়জামা ও পাঞ্জাবি। একমাত্র পররাষ্ট্রমšী¿র পরনে ছিল গাঁঢ় রং এর লম্বা কোর্ট প্যান্ট এবং টুপি। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাবেক মন্ত্রী আব্দুল মান্নান এম এন এ। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তথ্য, প্রচার ও বেতারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী (সাবেক মন্ত্রী) বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান, তবে তাঁর অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেন। প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন তাজউদ্দীন আহমেদ, মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী, খন্দকার মোস্তাক আহমেদ পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রীর অস্থায়ী দায়িত্ব পেলেন।
শপথ গ্রহণের পর প্রথমে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। এভাবে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ৮ পৃষ্ঠার এক বিবৃতি পাঠ করলেন এবং ঐ স্থানে বৈদ্যনাথতলার নাম রাখলেন মুজিবনগর। বিবৃতিতে তিনি উলে¬খ করলেন ইয়াহিয়া খান গণহত্যা চালিয়ে নিজেই পাকিস্তানের কবর খুঁড়েছেন। বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জনবহুল রাষ্ট্র বাংলাদেশ বিশ্বসভায় স্থান করে নেবেই। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শেষে বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে নাম লেখা হলো ভবেরপাড়ার বৈদ্যনাথতলা থেকে মুজিবনগরের। গঠিত হলো মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাজধানী ও মুক্তিযুদ্ধের সুতিকাগার।