ইপেপার । আজ বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
যুবলীগ নেতা রঞ্জুর বাড়িতে দেওয়া আগুনে মৃত্য চার, গুলিবিদ্ধ একজনের বিষয়ে নিশ্চিত

চুয়াডাঙ্গায় সাধারণ জনতার উদ্ভাসিত আনন্দ মিছিল

দুই এমপিসহ আ.লীগ নেতাদের বাড়ি, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর লুটপাট

নিজস্ব প্রতিবেদক:
  • আপলোড টাইম : ০৫:৩৫:১৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ অগাস্ট ২০২৪
  • / ১০২ বার পড়া হয়েছে

এ এক অন্য রকম পরিস্থিতি। দীর্ঘকাল গোম ধরে শান্ত থাকা চুয়াডাঙ্গা হঠাৎ কেমন জানি উত্তোলিত উদ্ভাসিত। সাধারণ মানুষের ভয় নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থানও নেই। একটি দুটি মানুষ নয়, স্মরণকালের সবথেকে বেশি জমায়েত চুয়াডাঙ্গার প্রধান প্রধান সড়কজুড়ে। এ কারো ডাক নয়, কোনো দলের নয়। সাধারণ মানুষ, যে যেমন পেরেছেন, এসেছেন উল্লাসে। কারফিউ ভেঙ্গে এ যেন এক নতুন উল্লাস। নতুন ইতিহাস। এর মধ্যে নেই কোনো বাঁধা, নেই কারো হুংকার। ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক বলে বড় বড় উঁচু উঁচু আওয়াজ। হই হই, রই রই, ছাত্রলীগ গেলি কই, এ ধরনের আওয়াজও ছিল বেশ মজার। সব মিলিয়ে বেলা দুইটা থেকে চুয়াডাঙ্গা শহর এক অনন্য উদাহরণ। এ উদাহরণ এ প্রজন্মের জন্য একেবারেই নতুন। এবারেই প্রথম। সকলে কথা বলতে পেরেও শান্তি পেয়েছে। আনন্দ-উল্লাস করেছে। তবে এই আনন্দ উল্লাসের সাথে অন্য একটি দিকে উত্তেজনাও দেখা গেছে। চারটি তাজা প্রাণ ঝরেছে। আগুন দেয়া হয়েছে চুয়াডাঙ্গার দুই সংসদ সদস্যের বাড়ি ও জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ বিভিন্ন নেতার বাড়িতে। এসময় যুবলীগ নেতা আরেফিন আলম রঞ্জুর বাড়িতে আগুনে দগ্ধ হয়ে চার যুবক নিহত হয়েছেন। তাদের দুইজনের পরিচয় গতকাল সোমবার গভীর রাত পর্যন্ত জানা যায়নি। এছাড়াও আমজনতা আর উল্লাসকারীদের মধ্যে কিছু দুষ্কৃতিকারী ঢুকে কিছু স্থানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে। ভাঙ্গা হয়েছে একটি স্থানীয় পত্রিকার অফিস। ভাঙ্গা হয়েছে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, বিকেলে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবরে শহরের বড় বাজার, কোর্ট মোড়, পৌরসভা মোড়, নতুনবাজার এলাকায় আনন্দ মিছিল বের হয়। আনন্দ মিছিল চলাকালে শহরের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ব্যানার-ফেস্টুন নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এসময় জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ, দুই সংসদ সদস্যের বাড়ি, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কার্যালয় ও নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর, গাড়ি ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। রাত পর্যন্ত লুট করা হয় এই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর। বিশেষ করে শহরের কবরি রোডে দেখা যায়, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের বাড়ি ও তার ছোট ভাই রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটনের আলিশান বাড়ির দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছেন কেউ কেউ। রাত পর্যন্ত এই লুটের ঘটনা দেখা গেছে।
জানা যায়, চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে গতকাল দুপুরের পর রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই রাস্তায় নেমে পড়ে জনগণ। এসময় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা আগুন দেওয়াসহ ভাঙচুর চালায় এমপি ছেলুন জোয়ার্দ্দারের বাড়ি ও দলীয় কার্যালয়ে। ভাঙচুর ও অগ্নিংযোগ করা হয় সবেক পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটনের বাড়িতে। ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয় চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য আলী আজগার টগরের বাড়িতে ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের তীব্রতায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে জেলাজুড়ে। শহরসহ গ্রাম অঞ্চলেও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়াসহ হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। এছাড়াও আলমডাঙ্গা, দামুড়হুদা, দর্শনা ও জীবননগরে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ভাঙচুর চালানো হয়। একই সাথে রঙ মেখে আনন্দ মিছিলসহ সড়কে টায়ার জ¦ালিয়ে উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা যায় সাধারণ মানুষকে।

স্থানীয়রা জানান, প্রথমে সাবেক পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দারের বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এসময় দুই তলার গ্রীল বেয় নিচে নেমে পালিয়ে যান বাড়ির লোকজন। পরে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের এমপি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের বাড়ির নিচতলায় ভাঙচুরসহ আগুন ধরিয়ে দেয় কিছু উৎসুক জনতা। আগুন ও ভাঙচুরের মধ্যেই নিজ বাড়ির রান্নাঘরে আশ্রয় নেন সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনসহ তার পরিবার। এসময় স্থানীয় কিছু যুবক কৌশলে এমপি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান বলে জানা যায়।

পরে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার খণ্ড খণ্ড মিছিল বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে, আগুন দেওয়াসহ ভাঙচুর লুটপাট চালায় কিছু দুষ্কৃতকারী। এসময় বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতার দখলে চলে যায় চুয়াডাঙ্গার প্রধান প্রধান সড়কসহ জনবহুল স্থান। পরে সরকার বিরোধী স্লোগানসহ জ্বলন্ত আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে বিজয় সূচক চিহ্ন দিয়ে ছবি ওঠেন ছাত্র জনতা। এরপর একে একে লুটপাট ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের মালিক দিলীপ কুমার আগরওয়ালার সরকারি কলেজ রোডের রাজনৈতিক কার্যালয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় তারদেবী ফাউন্ডেশেনের দুটি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স। একই সাথে লুট করে নেওয়া হয় মূল্যবান জিনিসপত্র। দুইতলার বাসাতেও আগুন দেয়া হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় স্থানীয় খাসখবর পত্রিকা অফিস। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় শহরের বিগবাজারে। ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় সাবেক পৌর মেয়র ওবাইদুর রহমান চৌধুরীর বাড়ি। এছাড়াও ইটপাটকেল ছোড়া হয় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আশাদুল হক বিশ্বাসের বাড়িতে। এসময় বিক্ষুব্ধ জনতা আশাদুল হক বিশ্বাসের বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতে চাইলে স্থানীয় লোকজন তাদেরকে থামিয়ে দেয়। পরে ইটপাটকেল ছোড়া হয় আশাদুল হক বিশ্বাসের ভাই আকরামুল হক খোকন বিশ্বাসের বাড়ির নতুন ভবনটিতে। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় রয়েল পরিবহনের কাউন্টারে। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় হোটেল শয়ন বিলাসে। দুষ্কৃতিকারীদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি পদ্মা জুয়েলার্সের দোকান ও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড। এছাড়াও আগুন দেওয়া হয় কেদারগঞ্জ বাজারে স্বেচ্ছাসেবক লীগের দলীয় কার্যালয়ে। ভাঙচুর করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক সহিদুল ইসলাম সাহানের বাড়ি ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বাবুর বাড়িতে।


অপর দিকে, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনায় উঠে আসে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল সড়কের কাঠপট্টি সংলগ্ন একটি বাড়িতে বিক্ষুদ্ধরা আগুন দেন। এসময় সেখানে গোলাগুলিও হয়। বাড়ির গ্যারেজে থাকা প্রাইভেটকার ও একাধিক মোটরসাইকেলে আগুন লাগে। আগুন নিচ থেকে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। বাড়িতে আটকা পড়েন কয়েকজন ভাড়াটিয়া। খবর পেয়ে চুয়াডাঙ্গা ফায়ার সার্ভিসের দুটি গাড়ি দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। দীর্ঘ সময়ের চেষ্টায় নেভানো হয় আগুন। অক্ষত উদ্ধার হয় আটকে পড়া ছয়জন। বাড়িটির মালিক চুয়াডাঙ্গা জেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক আরিফিন আলম রঞ্জু।


আগুন নেভানোর পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, বাড়ির মধ্যে চারটি পুড়ে যাওয়া মৃতদেহ পেয়েছেন তারা। মৃত দেহগুলি ঘর থেকে উদ্ধার করে বাড়ির ছাদে জড় করেন তারা। চারটি মৃতদেহই চারটি তরতাজা যুবকের বলে ধারণা তাদের। বয়স ১৬ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে হতে পারে। আগুনে তাদের মৃত্যু হয়েছে নাকি মৃত্যুর পর আগুনে তাদের দেহ পুড়েছে, জানেন না কেউ। নিহতরা বাড়ির ভাড়াটিয়া বা স্থানীয় কেউ নন, এটাও নিশ্চিত করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তবে মৃতদেহ গুলি কাদের? কেনই বা ওই বাড়িতে পুড়লো তাদের দেহ? কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেননি বাড়ির ভাড়াটিয়াসহ স্থানীয় কেউ। স্থানীয়রা বলছেন, ঘটনার আগেও কয়েকবার গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন।


অপর দিকে, দুটি পরিবার দাবি করে সেখানে থাকা চারটি মরদেহের মধ্যে দুটি মরদেহের একজন আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদাহ গ্রামের মোজাম্মেল হোসেনের ছেলে সাকিব হোসেন ডিজে (২০)। তিনি শহরের বেলগাছি ঈদগাহ পাড়ায় মামা বাড়িতে থাকতেন। এবং অন্যজন চুয়াডাঙ্গা পুলিশ লাইন্স এলাকার সাইদুর রহমানের ছেলে তাফিম (১৬)। পরিবারের সদস্যদের দাবি, গুলিবিদ্ধ করলেও পুলিশের পক্ষ থেকে নিহত চারজনের বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়া হয়নি। তবে পরিবারের বরাত দিয়ে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে লাশ দুটি তাদেরই। রাত ১১টার পরে পরিবারের সদস্যরা তাদের স্বজনের লাশ দাবি করে দুটি মরদেহ ওই বাড়ির ছাদ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গেছেন বলেও জানা গেছে। তবে রাতেই আইনি প্রক্রিয়ার জন্য লাশটি পরিবারের সদস্যরা সদর হাসপাতাল মর্গে নিয়ে যায়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দুটি মরদেহ আরিফিন আলম রঞ্জুর বাড়ির ছাদেই পড়ে ছিল।

এদিকে, উদ্ধারকৃত লাশ দুটির মধ্যে একটি লাশের বুকে গুলির চিহ্ন পেয়েছেন বলে পরিবারের লোকজন জানিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে ওই বাড়িতে যখন বিক্ষুব্ধ জনতা প্রবেশ করার চেষ্টা করেন, তখন ওই বাড়ির ওপরেই ছিলেন আরেফিন আলম রনজু। স্থানীয়দের অনেকের ধারণা, ওপর তলা থেকে গুলি করা হয় ওই সময়। নিহত আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদাহ গ্রামের মোজাম্মেল হোসেনের ছেলে সাকিব হোসেনের পরিবার তার শরীরে বুকে গুলির চিহ্নে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

যুবলীগ নেতা রঞ্জুর বাড়িতে দেওয়া আগুনে মৃত্য চার, গুলিবিদ্ধ একজনের বিষয়ে নিশ্চিত

চুয়াডাঙ্গায় সাধারণ জনতার উদ্ভাসিত আনন্দ মিছিল

দুই এমপিসহ আ.লীগ নেতাদের বাড়ি, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর লুটপাট

আপলোড টাইম : ০৫:৩৫:১৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ অগাস্ট ২০২৪

এ এক অন্য রকম পরিস্থিতি। দীর্ঘকাল গোম ধরে শান্ত থাকা চুয়াডাঙ্গা হঠাৎ কেমন জানি উত্তোলিত উদ্ভাসিত। সাধারণ মানুষের ভয় নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থানও নেই। একটি দুটি মানুষ নয়, স্মরণকালের সবথেকে বেশি জমায়েত চুয়াডাঙ্গার প্রধান প্রধান সড়কজুড়ে। এ কারো ডাক নয়, কোনো দলের নয়। সাধারণ মানুষ, যে যেমন পেরেছেন, এসেছেন উল্লাসে। কারফিউ ভেঙ্গে এ যেন এক নতুন উল্লাস। নতুন ইতিহাস। এর মধ্যে নেই কোনো বাঁধা, নেই কারো হুংকার। ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক বলে বড় বড় উঁচু উঁচু আওয়াজ। হই হই, রই রই, ছাত্রলীগ গেলি কই, এ ধরনের আওয়াজও ছিল বেশ মজার। সব মিলিয়ে বেলা দুইটা থেকে চুয়াডাঙ্গা শহর এক অনন্য উদাহরণ। এ উদাহরণ এ প্রজন্মের জন্য একেবারেই নতুন। এবারেই প্রথম। সকলে কথা বলতে পেরেও শান্তি পেয়েছে। আনন্দ-উল্লাস করেছে। তবে এই আনন্দ উল্লাসের সাথে অন্য একটি দিকে উত্তেজনাও দেখা গেছে। চারটি তাজা প্রাণ ঝরেছে। আগুন দেয়া হয়েছে চুয়াডাঙ্গার দুই সংসদ সদস্যের বাড়ি ও জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ বিভিন্ন নেতার বাড়িতে। এসময় যুবলীগ নেতা আরেফিন আলম রঞ্জুর বাড়িতে আগুনে দগ্ধ হয়ে চার যুবক নিহত হয়েছেন। তাদের দুইজনের পরিচয় গতকাল সোমবার গভীর রাত পর্যন্ত জানা যায়নি। এছাড়াও আমজনতা আর উল্লাসকারীদের মধ্যে কিছু দুষ্কৃতিকারী ঢুকে কিছু স্থানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে। ভাঙ্গা হয়েছে একটি স্থানীয় পত্রিকার অফিস। ভাঙ্গা হয়েছে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, বিকেলে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবরে শহরের বড় বাজার, কোর্ট মোড়, পৌরসভা মোড়, নতুনবাজার এলাকায় আনন্দ মিছিল বের হয়। আনন্দ মিছিল চলাকালে শহরের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ব্যানার-ফেস্টুন নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এসময় জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ, দুই সংসদ সদস্যের বাড়ি, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কার্যালয় ও নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর, গাড়ি ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। রাত পর্যন্ত লুট করা হয় এই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর। বিশেষ করে শহরের কবরি রোডে দেখা যায়, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের বাড়ি ও তার ছোট ভাই রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটনের আলিশান বাড়ির দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছেন কেউ কেউ। রাত পর্যন্ত এই লুটের ঘটনা দেখা গেছে।
জানা যায়, চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে গতকাল দুপুরের পর রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই রাস্তায় নেমে পড়ে জনগণ। এসময় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা আগুন দেওয়াসহ ভাঙচুর চালায় এমপি ছেলুন জোয়ার্দ্দারের বাড়ি ও দলীয় কার্যালয়ে। ভাঙচুর ও অগ্নিংযোগ করা হয় সবেক পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটনের বাড়িতে। ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয় চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য আলী আজগার টগরের বাড়িতে ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের তীব্রতায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে জেলাজুড়ে। শহরসহ গ্রাম অঞ্চলেও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়াসহ হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। এছাড়াও আলমডাঙ্গা, দামুড়হুদা, দর্শনা ও জীবননগরে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ভাঙচুর চালানো হয়। একই সাথে রঙ মেখে আনন্দ মিছিলসহ সড়কে টায়ার জ¦ালিয়ে উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা যায় সাধারণ মানুষকে।

স্থানীয়রা জানান, প্রথমে সাবেক পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দারের বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এসময় দুই তলার গ্রীল বেয় নিচে নেমে পালিয়ে যান বাড়ির লোকজন। পরে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের এমপি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের বাড়ির নিচতলায় ভাঙচুরসহ আগুন ধরিয়ে দেয় কিছু উৎসুক জনতা। আগুন ও ভাঙচুরের মধ্যেই নিজ বাড়ির রান্নাঘরে আশ্রয় নেন সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনসহ তার পরিবার। এসময় স্থানীয় কিছু যুবক কৌশলে এমপি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান বলে জানা যায়।

পরে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার খণ্ড খণ্ড মিছিল বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে, আগুন দেওয়াসহ ভাঙচুর লুটপাট চালায় কিছু দুষ্কৃতকারী। এসময় বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতার দখলে চলে যায় চুয়াডাঙ্গার প্রধান প্রধান সড়কসহ জনবহুল স্থান। পরে সরকার বিরোধী স্লোগানসহ জ্বলন্ত আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে বিজয় সূচক চিহ্ন দিয়ে ছবি ওঠেন ছাত্র জনতা। এরপর একে একে লুটপাট ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের মালিক দিলীপ কুমার আগরওয়ালার সরকারি কলেজ রোডের রাজনৈতিক কার্যালয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় তারদেবী ফাউন্ডেশেনের দুটি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স। একই সাথে লুট করে নেওয়া হয় মূল্যবান জিনিসপত্র। দুইতলার বাসাতেও আগুন দেয়া হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় স্থানীয় খাসখবর পত্রিকা অফিস। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় শহরের বিগবাজারে। ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় সাবেক পৌর মেয়র ওবাইদুর রহমান চৌধুরীর বাড়ি। এছাড়াও ইটপাটকেল ছোড়া হয় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আশাদুল হক বিশ্বাসের বাড়িতে। এসময় বিক্ষুব্ধ জনতা আশাদুল হক বিশ্বাসের বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতে চাইলে স্থানীয় লোকজন তাদেরকে থামিয়ে দেয়। পরে ইটপাটকেল ছোড়া হয় আশাদুল হক বিশ্বাসের ভাই আকরামুল হক খোকন বিশ্বাসের বাড়ির নতুন ভবনটিতে। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় রয়েল পরিবহনের কাউন্টারে। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় হোটেল শয়ন বিলাসে। দুষ্কৃতিকারীদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি পদ্মা জুয়েলার্সের দোকান ও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড। এছাড়াও আগুন দেওয়া হয় কেদারগঞ্জ বাজারে স্বেচ্ছাসেবক লীগের দলীয় কার্যালয়ে। ভাঙচুর করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক সহিদুল ইসলাম সাহানের বাড়ি ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বাবুর বাড়িতে।


অপর দিকে, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনায় উঠে আসে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল সড়কের কাঠপট্টি সংলগ্ন একটি বাড়িতে বিক্ষুদ্ধরা আগুন দেন। এসময় সেখানে গোলাগুলিও হয়। বাড়ির গ্যারেজে থাকা প্রাইভেটকার ও একাধিক মোটরসাইকেলে আগুন লাগে। আগুন নিচ থেকে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। বাড়িতে আটকা পড়েন কয়েকজন ভাড়াটিয়া। খবর পেয়ে চুয়াডাঙ্গা ফায়ার সার্ভিসের দুটি গাড়ি দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। দীর্ঘ সময়ের চেষ্টায় নেভানো হয় আগুন। অক্ষত উদ্ধার হয় আটকে পড়া ছয়জন। বাড়িটির মালিক চুয়াডাঙ্গা জেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক আরিফিন আলম রঞ্জু।


আগুন নেভানোর পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, বাড়ির মধ্যে চারটি পুড়ে যাওয়া মৃতদেহ পেয়েছেন তারা। মৃত দেহগুলি ঘর থেকে উদ্ধার করে বাড়ির ছাদে জড় করেন তারা। চারটি মৃতদেহই চারটি তরতাজা যুবকের বলে ধারণা তাদের। বয়স ১৬ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে হতে পারে। আগুনে তাদের মৃত্যু হয়েছে নাকি মৃত্যুর পর আগুনে তাদের দেহ পুড়েছে, জানেন না কেউ। নিহতরা বাড়ির ভাড়াটিয়া বা স্থানীয় কেউ নন, এটাও নিশ্চিত করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তবে মৃতদেহ গুলি কাদের? কেনই বা ওই বাড়িতে পুড়লো তাদের দেহ? কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেননি বাড়ির ভাড়াটিয়াসহ স্থানীয় কেউ। স্থানীয়রা বলছেন, ঘটনার আগেও কয়েকবার গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন।


অপর দিকে, দুটি পরিবার দাবি করে সেখানে থাকা চারটি মরদেহের মধ্যে দুটি মরদেহের একজন আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদাহ গ্রামের মোজাম্মেল হোসেনের ছেলে সাকিব হোসেন ডিজে (২০)। তিনি শহরের বেলগাছি ঈদগাহ পাড়ায় মামা বাড়িতে থাকতেন। এবং অন্যজন চুয়াডাঙ্গা পুলিশ লাইন্স এলাকার সাইদুর রহমানের ছেলে তাফিম (১৬)। পরিবারের সদস্যদের দাবি, গুলিবিদ্ধ করলেও পুলিশের পক্ষ থেকে নিহত চারজনের বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়া হয়নি। তবে পরিবারের বরাত দিয়ে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে লাশ দুটি তাদেরই। রাত ১১টার পরে পরিবারের সদস্যরা তাদের স্বজনের লাশ দাবি করে দুটি মরদেহ ওই বাড়ির ছাদ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গেছেন বলেও জানা গেছে। তবে রাতেই আইনি প্রক্রিয়ার জন্য লাশটি পরিবারের সদস্যরা সদর হাসপাতাল মর্গে নিয়ে যায়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দুটি মরদেহ আরিফিন আলম রঞ্জুর বাড়ির ছাদেই পড়ে ছিল।

এদিকে, উদ্ধারকৃত লাশ দুটির মধ্যে একটি লাশের বুকে গুলির চিহ্ন পেয়েছেন বলে পরিবারের লোকজন জানিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে ওই বাড়িতে যখন বিক্ষুব্ধ জনতা প্রবেশ করার চেষ্টা করেন, তখন ওই বাড়ির ওপরেই ছিলেন আরেফিন আলম রনজু। স্থানীয়দের অনেকের ধারণা, ওপর তলা থেকে গুলি করা হয় ওই সময়। নিহত আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদাহ গ্রামের মোজাম্মেল হোসেনের ছেলে সাকিব হোসেনের পরিবার তার শরীরে বুকে গুলির চিহ্নে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।