ইপেপার । আজ বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পাঁচকমলাপুর মাদ্রাসায় দোয়া ও কৃতি শিক্ষার্থীদের পুরস্কার প্রদানকালে সাহিদুজ্জামান টরিক

আল্লাহর ওপর বাবার প্রগাঢ় বিশ্বাস এই মাদ্রাসাকে অনন্য উচ্চতায় এনে দিয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক:
  • আপলোড টাইম : ১০:৩৮:১৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১২ জুলাই ২০২৪
  • / ৭৭ বার পড়া হয়েছে

‘মৃত্যুর আগে আমার বাবা বলেছিলেন, তুমি এই মাদ্রাসার সঙ্গে কখনো দূরত্ব বাড়িও না। এই মাদ্রাসা যেন কিয়ামত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে, সেই ব্যবস্থা তুমি করে দিও। বাবা এই মাদ্রাসার জন্য কোনো সরকারি অনুদান নিতে নিষেধ করতেন, আমি তখন বলতাম তাহলে এই মাদ্রাসা চলবে কিভাবে? বাবা বলতেন মাদ্রাসা তুমি চালাবা, কারো সাহায্যের তোমার দরকার নেই সৃষ্টিকর্তা তোমাকে সাহায্য করবে। আল্লাহর ওপর বাবার সেই বিশ্বাস আজ এই মাদ্রাসার উচু ভবন তৈরি করেছে। আমি যে একবারে অনেক টাকা খরচ করে এই মাদ্রাসার ভবন করেছি তা কিন্তু নয়, আমার কাছে এত টাকা ছিলো না, কিন্তু একটার ওপর একটা ইট গাঁথার মত করে এই মাদ্রাসা আল্লাহ করে দিয়েছেন। যেখানে আজ শত শত শিক্ষার্থীরা দ্বিনি শিক্ষা গ্রহণ করছে। কথাগুলো বলেছেন এনআরবি ওয়ার্ল্ডের প্রেসিডেন্ট, সিঙ্গাপুরস্থ বাংলাদেশ বিজনেস অব চেম্বারের (বিডিচ্যাম) প্রেসিডেন্ট, সাহিদ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হোটেল সাহিদ প্যালেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পাঁচ কমলাপুর দারুল উলুম হাফেজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসার পরিচালক চুয়াডাঙ্গার কৃতী সন্তান আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিক। গতকাল বৃহস্পতিবার আলমডাঙ্গা উপজেলার পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম হাফেজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসায় দোয়া, আলোচনা ও কৃর্তি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আবেগঘন কণ্ঠে এসব কথা বলেন তিনি।

আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিক নিজের পিতাকে স্মরণ করে বলেন, ‘আমার বাবা বার বার বলতেন তুমি সারা জীবন দ্বিনি শিক্ষার জন্য কাজ করো। দ্বিনি শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও পরকালীন সাফল্য। কিন্তু কখনো কখনো দ্বিনি শিক্ষা দ্বিন-দুনিয়ার সমূহ কল্যাণেরও কারণ হয়ে যায়। দ্বিনি শিক্ষার সঙ্গে যারা জড়িত আমার বাবা তাঁদেরকে অনেক পছন্দ করতেন। তাদের সঙ্গে সময় কাটাতেন, তাবলীগ করতেন। বাবার ভালোবাসার জায়গা থেকেই আজকের অনুষ্ঠানে এ জেলার বিভিন্ন মাদ্রাসা, তাবলীগ ও দ্বিনি শিক্ষার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অতিথি হিসিবে আমন্ত্রণ করেছি। বাবার অনুপ্রেরণা থেকে ইসলাম ও দ্বিনি শিক্ষার প্রচারে আমি নিজেকে জড়িয়ে রেখেছি।’

আলোচনা সভা, দোয়া ও সংবর্ধনার আয়োজনে জেলার বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক, হাফেজ, মাওলানা ও ওলামায়ে কারিমগণ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে অতিথি থেকে বক্তব্য দেন, বুজরুকগড়গড়ি মাদ্রাসার মুহাদ্দীস মুফতি শোয়াইব আহমাদ কাসেমী, মুহাদ্দীস মুফতি আজিজুল্লাহ, খুলনা বিভাগীয় কাওমি পরিষদ চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সেক্রেটারি মুফতি রুহুল আমিন। অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত করেন মুহা. মাহফুজুর রহমান। স্বাগত বক্তব্য দেন পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম হাফেজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসার মোহতামীম ও শাইখুল হাদিস আল্লামা আব্দুর রাজ্জাক। মাদ্রাসা শুরুর ইতিহাস তুলে ধরে বক্তব্য দেন মাদ্রাসার মুহতামিম আলহাজ্ব হাফেজ ইনারুল ইসলাম ইন্না ও শিক্ষক মাওলানা বায়োজিদ হোসেন। এরপর অনুষ্ঠনে আগত অতিথিদের নিয়ে মাদ্রাসার মূল্যায়ন বিষয়ক আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন মুফতি জুনাইদ আল হবিবী, মাওলানা রুহুল আমিন, মাওলানা জহুরুল ইসলাম আজিজি ও মাওলানা মাহবুবুর রহমান গাওহারী।

পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম হাফেজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব মুস্তাফিজুর রহমান শামীমের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আহসান হাবিব, আলমডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র হাসান কাদির গনু, দৈনিক সময়ের সমীকরণ-এর প্রধান সম্পাদক নাজমুল হক স্বপন, জেষ্ঠ্য সাংবাদিক রফিক রহমান, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. নুরুজ্জামান প্রমুখ।

আলোচনা শেষে দোয়া পরিচালনা করেন মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মরহুম হাজি শামসুজ্জোহা বিশ্বাসের বন্ধু ডা. আইনুল হক। এ সময় পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম হাফেজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বিশিষ্ট্যজন ও স্থানীয় বাসিন্দারা অংশ নেন।

আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এনআরবি ওয়ার্ল্ডের প্রেসিডেন্ট, সিঙ্গাপুরস্থ বাংলাদেশ বিজনেস অব চেম্বারের (বিডিচ্যাম) প্রেসিডেন্ট, আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিক সকলকে মুগ্ধ করেন। অনুপ্রেরণাদায়ক বক্তব্য অনুষ্ঠান স্থলকে মোহিত করে তোলে। আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিক তার বক্তব্যে আরও বলেন, ‘আমার বাবা আমাকে দেশের নামকরা ও শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের মডেল প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করার সুযোগে করে দিয়েছিলেন। কিন্তু একইভাবে তিনি আমাকে ইসলাম ও দ্বিনি শিক্ষার জন্যও কাজ করে যেতে বলতেন। বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিলো বন্ধুর মতো, কর্মজীবনে বাবার উৎসাহ আমাকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। বাবা সব সময় একটি মাদ্রাসার স্বপ্ন দেখতেন। তিনি আমাকে বলতেন, তুমি আমাকে একটি ছোট্ট ঘর বানিয়ে দাও, আমি লোকজন নিয়ে সেখানে দ্বিনি শিক্ষার কাজ শুরু করি। আমি আমার এলাকার ছোট ছোট বাচ্চাদের হৃদয়ে কোরআনের শিক্ষা দিতে চাই। আমি বাবাকে বলতাম, আমি কি করবো বলেন। একদিন বাবা বলেছিলেন তুমি প্রতি মাসে পাঁচশ/এক হাজার করে টাকা দিও, আমি দ্বিনি শিক্ষার কাজ শুরু করি। বাবার সেই স্বপ্ন মহান আল্লাহ আজ পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম হাফেজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসায় পরিণত করেছেন।’

তিনি বলেন, ‘আমার দুটি ছেলে সন্তান যখন আমাকে দোয়া করতে দেখে, যখন আমাকে দোয়ায় কান্না করতে দেখে তখন তারা বলে, বাবা আমরাও তোমার জন্য দোয়া করবো। টাকা পয়সা স্থায়ী নয়, তবে দ্বিনি শিক্ষা চিরস্থায়ী। আমি তাদের হৃদয়েও দ্বিনি শিক্ষা গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তারা তাদের দাদাকে দেখেনি, কিন্তু এই মাদ্রাসার প্রতি তাদের ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে। আমি তাদেরকে সব সময় বলি, আমি না থাকলে তোমরা এই মাদ্রাসার দেখাশোনা করবা। মাদ্রাসায় যাবা, তোমরা যদি খাও তাহলে এই মাদ্রাসার ছাত্রদেরও খাইয়ে রাখতে হবে। তিনি বলেন, আমার বাবা যেমন আমার হৃদয়ে একটি বীজ গেঁথে দিয়েছিলেন, আমিও আমার সন্তানদের হৃদয়ে সেই বীজ গেঁথে দিয়েছি।’

আলোচনা সভা পুরষ্কার বিতরণ শেষে মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে সকলে মধ্যহ্ন ভোজে অংশ নেয়।
প্রসঙ্গত, এনআরবি ওয়ার্ল্ডের প্রেসিডেন্ট, সিঙ্গাপুরস্থ বাংলাদেশ বিজনেস অব চেম্বারের (বিডিচ্যাম) প্রেসিডেন্ট, সাহিদ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চুয়াডাঙ্গার কৃতী সন্তান ও হোটেল সাহিদ প্যালেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিক, এক সময়ের সাংবাদিক ও বর্তমান বিশিষ্ট প্রবাসী ব্যবসায়ী আরিফুজ্জামান আরিফ ও দৈনিক সময়ের সমীকরণের প্রকাশক-সম্পাদক শরীফুজ্জামান শরীফের পিতা মরহুম শামসুজ্জোহা বিশ্বাস একটি সুন্দর দ্বীনি-শিক্ষার ভাবনা নিয়ে মরহুম হাজি শামসুজ্জোহা বিশ্বাস ২০০১ সালে মাত্র ১৩ জন ছাত্র ও একজন শিক্ষক নিয়ে একটি চালা-ঘরে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার খাদিমপুর ইউনিয়নের পাঁচকমলাপুর গ্রামে ‘পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম কওমিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা’ নামে দ্বীনি-শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১০ সালে হাজি শামসুজ্জোহা বিশ্বাসের মৃত্যুর পর এই মাদ্রাসাটির পরিচালকের দায়িত্ব নেন তাঁর পুত্র চুয়াডাঙ্গার কৃতী সন্তান ও দানবীর হিসেবে খ্যাত আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিক। একজন সুযোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে পিতার সুস্বপ্নকে আন্তরিকতা, ভালোবাসা, মেধা ও শ্রম দিয়ে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। মাদ্রাসাটি পরিচালনার জন্য সাহিদুজ্জামান টরিক চুয়াডাঙ্গায় তিন তারকা মানের হোটেল সাহিদ প্যালেস অ্যান্ড কনভেনশন সেন্টার নির্মাণ করেছেন। সেখানে থেকে আয়কৃত সম্পূর্ণ অর্থ এ মাদ্রাসা কার্যক্রমে ব্যয় করা হয়। ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে মাদ্রাসাটিতে ছাত্রদের জন্য লিল্লাহ বোর্ডিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। যেখানে তিন বেলা মাদ্রাসার সকল ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়।

চুয়াডাঙ্গা জেলা ও খুলনা বিভাগে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান অর্জনসহ পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম হাফেজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসাটি দিন দিন আরও অগ্রগতির দিকে যাচ্ছে। প্রতি বছরই মেধাবী শিক্ষার্থীরা উপহার দিচ্ছে নানা স্বীকৃতি। কয়েকদিন আগে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় জেলা পর্যায়ে সর্বোচ্চ মেধাস্থান অর্জন করেছে এই মাদ্রাসা। এর আগে ১৪৪৬-হিজরি/২০২৩-ঈসাব্দ শিক্ষাবর্ষে সর্বোচ্চ মেধাস্থান অর্জন করায় খুলনা বিভাগীয় কওমী মাদ্রাসা পরিষদ চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখা থেকে বিশেষ সম্মাননা সনদও দেওয়া হয়েছিলো প্রতিষ্ঠানটিকে। এর আগের বছরও কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় সর্বোচ্চ মেধাস্থান অর্জন করে মাদ্রাসাটি। এছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় মাদ্রাসাটির সাফল্য বলার মতো। একের পর এক স্বীকৃতি ও শিক্ষার্থীদের উত্তম ফলাফল একটি সুন্দর দ্বীনি-শিক্ষার অভূতপূর্ব সাফল্যে ঘেরা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে মাদ্রাসাটিকে। মাদ্রাসাটির ইসলামি জ্ঞানচর্চার পরিবেশকে সুন্দর ও উন্নত করতে দারুণ ইন্টিরিয়র ও মনোরম পরিবেশে একটি পাঠাগার স্থাপন করা হয়। এ বছরও মাদ্রাসাটি কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে ভালো ফলাফল করেছে। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ কাওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড ২০২৪ এর ৪৭ তম পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মাদ্রাসার দশজন শিক্ষার্থী মুমতাজ (জিপিএ-৫) ও আটজন মেধাস্থান অর্জন করায় তাদেরকে পুরস্কার প্রদান করা হয়। তাদের মধ্যে মারহালা: ইবতিদাইয়্যাহ হতে সাতজন মেধাস্থান অর্জনকারী ছাত্র হলেন- মো. রোকনুজ্জামান মেধাস্থান ৩৮, মো. পারভেজ মেধাস্থান ৩৮, মো. আব্দুল্লাহ মেধাস্থান ৬৬, মো, তহিদুল ইসলাম মেধাস্থান ৭৩, মো. রাফাউল্লাহ মেধাস্থান ৭৬, মো. বায়েজিদ ও মো. শাহরুখ ইসলাম মেধাস্থান ৮৩, মারহালা মুতাওয়াসসিতাহ্ শ্রেণি থেকে ৪৫ তম স্থান অর্জনকারী শিক্ষার্থী ওয়াজ কুরুনী। এছাড়াও মারহালা মুতাওয়াসসিতাহ শ্রেণি থেকে চারজন শিক্ষার্থী মো. ওয়াজ কুরুনী, মো. নাফিজ ইকবাল, মো. তাহেরুল ও মো. তাসিব আহমদ রামিম মুমতাজ (জিপিএ-৫) অর্জন করেছে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

পাঁচকমলাপুর মাদ্রাসায় দোয়া ও কৃতি শিক্ষার্থীদের পুরস্কার প্রদানকালে সাহিদুজ্জামান টরিক

আল্লাহর ওপর বাবার প্রগাঢ় বিশ্বাস এই মাদ্রাসাকে অনন্য উচ্চতায় এনে দিয়েছে

আপলোড টাইম : ১০:৩৮:১৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১২ জুলাই ২০২৪

‘মৃত্যুর আগে আমার বাবা বলেছিলেন, তুমি এই মাদ্রাসার সঙ্গে কখনো দূরত্ব বাড়িও না। এই মাদ্রাসা যেন কিয়ামত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে, সেই ব্যবস্থা তুমি করে দিও। বাবা এই মাদ্রাসার জন্য কোনো সরকারি অনুদান নিতে নিষেধ করতেন, আমি তখন বলতাম তাহলে এই মাদ্রাসা চলবে কিভাবে? বাবা বলতেন মাদ্রাসা তুমি চালাবা, কারো সাহায্যের তোমার দরকার নেই সৃষ্টিকর্তা তোমাকে সাহায্য করবে। আল্লাহর ওপর বাবার সেই বিশ্বাস আজ এই মাদ্রাসার উচু ভবন তৈরি করেছে। আমি যে একবারে অনেক টাকা খরচ করে এই মাদ্রাসার ভবন করেছি তা কিন্তু নয়, আমার কাছে এত টাকা ছিলো না, কিন্তু একটার ওপর একটা ইট গাঁথার মত করে এই মাদ্রাসা আল্লাহ করে দিয়েছেন। যেখানে আজ শত শত শিক্ষার্থীরা দ্বিনি শিক্ষা গ্রহণ করছে। কথাগুলো বলেছেন এনআরবি ওয়ার্ল্ডের প্রেসিডেন্ট, সিঙ্গাপুরস্থ বাংলাদেশ বিজনেস অব চেম্বারের (বিডিচ্যাম) প্রেসিডেন্ট, সাহিদ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হোটেল সাহিদ প্যালেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পাঁচ কমলাপুর দারুল উলুম হাফেজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসার পরিচালক চুয়াডাঙ্গার কৃতী সন্তান আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিক। গতকাল বৃহস্পতিবার আলমডাঙ্গা উপজেলার পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম হাফেজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসায় দোয়া, আলোচনা ও কৃর্তি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আবেগঘন কণ্ঠে এসব কথা বলেন তিনি।

আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিক নিজের পিতাকে স্মরণ করে বলেন, ‘আমার বাবা বার বার বলতেন তুমি সারা জীবন দ্বিনি শিক্ষার জন্য কাজ করো। দ্বিনি শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও পরকালীন সাফল্য। কিন্তু কখনো কখনো দ্বিনি শিক্ষা দ্বিন-দুনিয়ার সমূহ কল্যাণেরও কারণ হয়ে যায়। দ্বিনি শিক্ষার সঙ্গে যারা জড়িত আমার বাবা তাঁদেরকে অনেক পছন্দ করতেন। তাদের সঙ্গে সময় কাটাতেন, তাবলীগ করতেন। বাবার ভালোবাসার জায়গা থেকেই আজকের অনুষ্ঠানে এ জেলার বিভিন্ন মাদ্রাসা, তাবলীগ ও দ্বিনি শিক্ষার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অতিথি হিসিবে আমন্ত্রণ করেছি। বাবার অনুপ্রেরণা থেকে ইসলাম ও দ্বিনি শিক্ষার প্রচারে আমি নিজেকে জড়িয়ে রেখেছি।’

আলোচনা সভা, দোয়া ও সংবর্ধনার আয়োজনে জেলার বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক, হাফেজ, মাওলানা ও ওলামায়ে কারিমগণ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে অতিথি থেকে বক্তব্য দেন, বুজরুকগড়গড়ি মাদ্রাসার মুহাদ্দীস মুফতি শোয়াইব আহমাদ কাসেমী, মুহাদ্দীস মুফতি আজিজুল্লাহ, খুলনা বিভাগীয় কাওমি পরিষদ চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সেক্রেটারি মুফতি রুহুল আমিন। অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত করেন মুহা. মাহফুজুর রহমান। স্বাগত বক্তব্য দেন পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম হাফেজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসার মোহতামীম ও শাইখুল হাদিস আল্লামা আব্দুর রাজ্জাক। মাদ্রাসা শুরুর ইতিহাস তুলে ধরে বক্তব্য দেন মাদ্রাসার মুহতামিম আলহাজ্ব হাফেজ ইনারুল ইসলাম ইন্না ও শিক্ষক মাওলানা বায়োজিদ হোসেন। এরপর অনুষ্ঠনে আগত অতিথিদের নিয়ে মাদ্রাসার মূল্যায়ন বিষয়ক আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন মুফতি জুনাইদ আল হবিবী, মাওলানা রুহুল আমিন, মাওলানা জহুরুল ইসলাম আজিজি ও মাওলানা মাহবুবুর রহমান গাওহারী।

পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম হাফেজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব মুস্তাফিজুর রহমান শামীমের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আহসান হাবিব, আলমডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র হাসান কাদির গনু, দৈনিক সময়ের সমীকরণ-এর প্রধান সম্পাদক নাজমুল হক স্বপন, জেষ্ঠ্য সাংবাদিক রফিক রহমান, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. নুরুজ্জামান প্রমুখ।

আলোচনা শেষে দোয়া পরিচালনা করেন মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মরহুম হাজি শামসুজ্জোহা বিশ্বাসের বন্ধু ডা. আইনুল হক। এ সময় পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম হাফেজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বিশিষ্ট্যজন ও স্থানীয় বাসিন্দারা অংশ নেন।

আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এনআরবি ওয়ার্ল্ডের প্রেসিডেন্ট, সিঙ্গাপুরস্থ বাংলাদেশ বিজনেস অব চেম্বারের (বিডিচ্যাম) প্রেসিডেন্ট, আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিক সকলকে মুগ্ধ করেন। অনুপ্রেরণাদায়ক বক্তব্য অনুষ্ঠান স্থলকে মোহিত করে তোলে। আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিক তার বক্তব্যে আরও বলেন, ‘আমার বাবা আমাকে দেশের নামকরা ও শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের মডেল প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করার সুযোগে করে দিয়েছিলেন। কিন্তু একইভাবে তিনি আমাকে ইসলাম ও দ্বিনি শিক্ষার জন্যও কাজ করে যেতে বলতেন। বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিলো বন্ধুর মতো, কর্মজীবনে বাবার উৎসাহ আমাকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। বাবা সব সময় একটি মাদ্রাসার স্বপ্ন দেখতেন। তিনি আমাকে বলতেন, তুমি আমাকে একটি ছোট্ট ঘর বানিয়ে দাও, আমি লোকজন নিয়ে সেখানে দ্বিনি শিক্ষার কাজ শুরু করি। আমি আমার এলাকার ছোট ছোট বাচ্চাদের হৃদয়ে কোরআনের শিক্ষা দিতে চাই। আমি বাবাকে বলতাম, আমি কি করবো বলেন। একদিন বাবা বলেছিলেন তুমি প্রতি মাসে পাঁচশ/এক হাজার করে টাকা দিও, আমি দ্বিনি শিক্ষার কাজ শুরু করি। বাবার সেই স্বপ্ন মহান আল্লাহ আজ পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম হাফেজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসায় পরিণত করেছেন।’

তিনি বলেন, ‘আমার দুটি ছেলে সন্তান যখন আমাকে দোয়া করতে দেখে, যখন আমাকে দোয়ায় কান্না করতে দেখে তখন তারা বলে, বাবা আমরাও তোমার জন্য দোয়া করবো। টাকা পয়সা স্থায়ী নয়, তবে দ্বিনি শিক্ষা চিরস্থায়ী। আমি তাদের হৃদয়েও দ্বিনি শিক্ষা গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তারা তাদের দাদাকে দেখেনি, কিন্তু এই মাদ্রাসার প্রতি তাদের ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে। আমি তাদেরকে সব সময় বলি, আমি না থাকলে তোমরা এই মাদ্রাসার দেখাশোনা করবা। মাদ্রাসায় যাবা, তোমরা যদি খাও তাহলে এই মাদ্রাসার ছাত্রদেরও খাইয়ে রাখতে হবে। তিনি বলেন, আমার বাবা যেমন আমার হৃদয়ে একটি বীজ গেঁথে দিয়েছিলেন, আমিও আমার সন্তানদের হৃদয়ে সেই বীজ গেঁথে দিয়েছি।’

আলোচনা সভা পুরষ্কার বিতরণ শেষে মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে সকলে মধ্যহ্ন ভোজে অংশ নেয়।
প্রসঙ্গত, এনআরবি ওয়ার্ল্ডের প্রেসিডেন্ট, সিঙ্গাপুরস্থ বাংলাদেশ বিজনেস অব চেম্বারের (বিডিচ্যাম) প্রেসিডেন্ট, সাহিদ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চুয়াডাঙ্গার কৃতী সন্তান ও হোটেল সাহিদ প্যালেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিক, এক সময়ের সাংবাদিক ও বর্তমান বিশিষ্ট প্রবাসী ব্যবসায়ী আরিফুজ্জামান আরিফ ও দৈনিক সময়ের সমীকরণের প্রকাশক-সম্পাদক শরীফুজ্জামান শরীফের পিতা মরহুম শামসুজ্জোহা বিশ্বাস একটি সুন্দর দ্বীনি-শিক্ষার ভাবনা নিয়ে মরহুম হাজি শামসুজ্জোহা বিশ্বাস ২০০১ সালে মাত্র ১৩ জন ছাত্র ও একজন শিক্ষক নিয়ে একটি চালা-ঘরে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার খাদিমপুর ইউনিয়নের পাঁচকমলাপুর গ্রামে ‘পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম কওমিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা’ নামে দ্বীনি-শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১০ সালে হাজি শামসুজ্জোহা বিশ্বাসের মৃত্যুর পর এই মাদ্রাসাটির পরিচালকের দায়িত্ব নেন তাঁর পুত্র চুয়াডাঙ্গার কৃতী সন্তান ও দানবীর হিসেবে খ্যাত আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিক। একজন সুযোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে পিতার সুস্বপ্নকে আন্তরিকতা, ভালোবাসা, মেধা ও শ্রম দিয়ে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। মাদ্রাসাটি পরিচালনার জন্য সাহিদুজ্জামান টরিক চুয়াডাঙ্গায় তিন তারকা মানের হোটেল সাহিদ প্যালেস অ্যান্ড কনভেনশন সেন্টার নির্মাণ করেছেন। সেখানে থেকে আয়কৃত সম্পূর্ণ অর্থ এ মাদ্রাসা কার্যক্রমে ব্যয় করা হয়। ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে মাদ্রাসাটিতে ছাত্রদের জন্য লিল্লাহ বোর্ডিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। যেখানে তিন বেলা মাদ্রাসার সকল ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়।

চুয়াডাঙ্গা জেলা ও খুলনা বিভাগে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান অর্জনসহ পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম হাফেজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসাটি দিন দিন আরও অগ্রগতির দিকে যাচ্ছে। প্রতি বছরই মেধাবী শিক্ষার্থীরা উপহার দিচ্ছে নানা স্বীকৃতি। কয়েকদিন আগে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় জেলা পর্যায়ে সর্বোচ্চ মেধাস্থান অর্জন করেছে এই মাদ্রাসা। এর আগে ১৪৪৬-হিজরি/২০২৩-ঈসাব্দ শিক্ষাবর্ষে সর্বোচ্চ মেধাস্থান অর্জন করায় খুলনা বিভাগীয় কওমী মাদ্রাসা পরিষদ চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখা থেকে বিশেষ সম্মাননা সনদও দেওয়া হয়েছিলো প্রতিষ্ঠানটিকে। এর আগের বছরও কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় সর্বোচ্চ মেধাস্থান অর্জন করে মাদ্রাসাটি। এছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় মাদ্রাসাটির সাফল্য বলার মতো। একের পর এক স্বীকৃতি ও শিক্ষার্থীদের উত্তম ফলাফল একটি সুন্দর দ্বীনি-শিক্ষার অভূতপূর্ব সাফল্যে ঘেরা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে মাদ্রাসাটিকে। মাদ্রাসাটির ইসলামি জ্ঞানচর্চার পরিবেশকে সুন্দর ও উন্নত করতে দারুণ ইন্টিরিয়র ও মনোরম পরিবেশে একটি পাঠাগার স্থাপন করা হয়। এ বছরও মাদ্রাসাটি কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে ভালো ফলাফল করেছে। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ কাওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড ২০২৪ এর ৪৭ তম পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মাদ্রাসার দশজন শিক্ষার্থী মুমতাজ (জিপিএ-৫) ও আটজন মেধাস্থান অর্জন করায় তাদেরকে পুরস্কার প্রদান করা হয়। তাদের মধ্যে মারহালা: ইবতিদাইয়্যাহ হতে সাতজন মেধাস্থান অর্জনকারী ছাত্র হলেন- মো. রোকনুজ্জামান মেধাস্থান ৩৮, মো. পারভেজ মেধাস্থান ৩৮, মো. আব্দুল্লাহ মেধাস্থান ৬৬, মো, তহিদুল ইসলাম মেধাস্থান ৭৩, মো. রাফাউল্লাহ মেধাস্থান ৭৬, মো. বায়েজিদ ও মো. শাহরুখ ইসলাম মেধাস্থান ৮৩, মারহালা মুতাওয়াসসিতাহ্ শ্রেণি থেকে ৪৫ তম স্থান অর্জনকারী শিক্ষার্থী ওয়াজ কুরুনী। এছাড়াও মারহালা মুতাওয়াসসিতাহ শ্রেণি থেকে চারজন শিক্ষার্থী মো. ওয়াজ কুরুনী, মো. নাফিজ ইকবাল, মো. তাহেরুল ও মো. তাসিব আহমদ রামিম মুমতাজ (জিপিএ-৫) অর্জন করেছে।