ইপেপার । আজ বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দামুড়হুদার সাবেক কৃষি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

পরিবেশবান্ধব নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্পে হ-য-ব-র-ল

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৮:২৭:১৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ নভেম্বর ২০২৩
  • / ৬৮ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদক:
চুয়াডাঙ্গা-দামুড়হুদা উপজেলার সাবেক কৃষি কর্মকর্তা বর্তমানে জীবননগর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কাগজে-কলমে পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্প (১ম সংশোধনী) কার্যক্রম শেষ করা হয়েছে। প্রকল্প শেষ হলেও উঠে আসছে নানা অনিয়ম আর দুর্নীতি। লাখ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্প কোনো কাজে আসেনি প্রান্তিক কৃষকদের। নিম্নমানের উপকরণ ও সুবিধাভোগীদের বরাদ্দের টাকা নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদনের কথা বলা হলেও বাস্তবে ভিন্ন চিত্র দেখা যায় মাঠে। কৃষকরা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছেন সবজিসহ সব ধরণের ফসলে। কৃষকরা কাঙ্খিত সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাঁচ বছর মেয়াদী প্রকল্প হলেও বন্ধ রয়েছে কার্যক্রম। ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন হওয়া প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা সুবিধা নিলেও দায় নিচ্ছে না কেউই।

স্থানীয় পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জানান, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের বিষয়টি আমি কৃষকদের মাধ্যমে শুনছি। অনেক টাকার বিষয়, সেহেতু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’

দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আইপিএম মডেল ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করে। আইপিএম মডেল ইউনিয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন। কিন্তু মাঠে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। কৃষকরা আগের মতোই সবজিসহ সব ফসলে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছেন। যার ফলে বিষযুক্ত সবজি উৎপাদন বাড়ছে। বাজারে ক্রেতারাও কিনছেন এসব সবজি ও ফসল। প্রতিনিয়ত বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। শুরুতে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক সদস্যকে নিয়ে দল গঠন ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

কৃষক-কৃষাণীদের ২ সেশনে দল গঠন ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ২ সেশনের জন্য প্রত্যেক সদস্যর বরাদ্দ ৪০০ টাকা করে। ৫০০ জনকে ২ লাখ টাকা দেওয়া হয়। ৩০ জনের রিফ্রেশমেন্ট বাবদ ২ সেশনে ৬০ হাজার টাকা, ৫০০ জন কৃষকের ৫ সেশনের ২০০ টাকা হারে প্রশিক্ষণের জন্য ৫ লাখ টাকা, ফ্যাসিলিটেটরের ২০টি গ্রুপের ৫ সেশনের ২ জনের ৬০০ টাকা হারে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ২০টি গ্রুপের প্রশিক্ষণ সামগ্রী ক্রয় ৫০ হাজার টাকা, এসএপিপিও/ এসএএও ২০টি গ্রুপের ৫ সেশনের ১ জনের ৪০০ টাকা হারে ৪০ হাজার টাকা, অতিথি বক্তা ভাতা ২০টি গ্রুপের ৫ সেশনের ২ জনের ১ হাজার টাকা হারে ৪০ হাজার টাকা ও অন্যান্য ব্যায় দেখানো হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। খাতগুলোতে মোট ব্যয় দেখানো হয়েছে ১১ লাখ টাকা।

আইপিএম মডেল ইউনিয়ন বাস্তবায়নের জন্য পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়ানের কৃষকদের নিয়ে ২০টি গ্রুপ গঠন করা হয়। প্রত্যোকটি গ্রুপে ২৫ জন করে কৃষক ও কৃষাণী আছেন। ২০টি গ্রুপে ৫০০ জন কৃষক-কৃষাণী এই আইপিএম মডেল ইউনিয়নের সদস্য। পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদনের লক্ষে সরকার এ প্রকল্পে ৭০ লাখ টাকা অর্থ বরাদ্দ দেয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেশের ২০টি ইউনিয়ানে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে।

প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শেষে রবি ও খরিপ মৌমুসে প্রদর্শনীর জন্য প্রত্যেক গ্রুপ বরাদ্দ পায় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। দুই মৌসুমের জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ৫০ লাখ টাকা। ৫০ লাখ টাকা দুই মৌসুমে সমান ব্যয় হওয়ার কথা। ভুক্তভোগী কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রবি মৌসুমে আংশিক বরাদ্দ পেলেও খরিপ মৌসুমে কিছুই পায়নি। একবারই আংশিক সহায়তা পাওয়ার কথা জানান কৃষকরা। খরিপ মৌসুমের বরাদ্দের উপকরণের ভ্যান ও ক্যারেট সরবরাহ করা হয়েছে রবি মৌসুমের সময়। ভ্যান ও ক্যারেটের মূল্য দেখানো হয় ৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
নিম্নমানের বীজ, জৈব সার, ফেরোমন ফাঁদ, স্টিকি ট্রাপ, কীটনাশকসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ বিতরণ করায় প্রকল্পের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। ভ্যান, ক্যারেট, নেটসহ অন্য উপকরণগুলোও ব্যবহারের অনুপযোগী ছিল। ক্যারেট সরবরাহ করা হয় ভাঙা ও পুরাতন। পা-চালিত ভ্যান গাড়িগুলো নিম্নমানের হওয়ায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কৃষকদের ৭টি প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিজেদের খেয়াল খুশি মতো কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। নির্ধারিত বরাদ্দের টাকাও ঠিকমতো দেওয়া হয়নি কৃষকদের। ফলে পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে।

রবি ও খরিপ মৌসুমের জন্য এ প্রকল্প গ্রহণ করে কৃষি বিভাগ। কিন্তু কৃষকদের মাঝে রবি মৌসুমের উপকরণ আংশিক সরবরাহ করে। খরিপ মৌসুমের বরাদ্দের ভ্যান ও ক্যারেট রবি মৌসুমে সদস্যদের মাঝে বিতরণ করে প্রকল্পের ইতি টানেন বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সকল কর্মকর্তারাও নিয়েছেন ভাতা। প্রশিক্ষণ, ভাতা, উপকরণ বরাদ্দের সর্বক্ষেত্রে ফুটে উঠেছে অনিয়ম। প্রকল্পটি এখন অদৃশ্যমান।

দামুড়হুদা উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের কৃষক আইপিএম সদস্য রেজাবুল বলেন, ‘একদিন ২ শ, একদিন ১২ শ টাকা পেয়েছি। আর এক বস্তা জৈব সার দিয়েছে, ওতো মাটি। এক বস্তার ওজন ৮০ কেজি। বীজ, মগ, তাবিজ, হাবিজাবি পেয়েছি। ভ্যান পেয়েছি ওতো ডুপ্লিকেট।’ পারকৃষ্ণপুর গ্রামের আইপিএম সদস্য আজিজুল হাকিম বলেন, ‘আমি তিনবার মিটিং করে ৬ শ টাকা পেয়েছি, চাষের জন্য ১ হাজার টাকা, ১ বস্তা জৈব সার, ১ ফেরেমন ফাঁদ এবং ২ বোতল কীটনাশক পেয়েছি।’

দামুড়হুদা পারকৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষক ও গ্রুপ লিডার আশরাফ আলী বলেন, ‘কৃষি অফিস থেকে যে বীজ দিয়েছিল, তা ভালো না। প্রতি মিটিংয়ে ২ শ করে টাকা দিয়েছে। বড় একটা প্রজেক্টে ১ হাজার টাকা দিয়েছে। সার আমরা পাইনি।’ দামুড়হুদা উপজেলার নাস্তিপুর গ্রামের বাসিন্দা আজিবর রহমান বলেন, ‘আইপিএমের নামে যে প্রকল্প দিয়েছে, তা আমাদের কোনো উন্নয়ন হয়নি। বরং সরকারের কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে।’

দামুড়হুদা উপজেলার পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এ এম জাকারিয়া আলম বলেন, ‘বড় পরিমাণের টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সে পরিমাণ কাজ দেখতে চায়। ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা শুনছি। যারা সংশ্লিষ্ট আছেন, তারা খতিয়ে দেখবেন। আমার ইউনিয়নকে আইপিএম মডেল ইউনিয়ন করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিবান্ধব সরকার। কৃষকদের জন্য তিনি যা বরাদ্দ দিয়েছেন, এর সঠিক কাজ দেখতে চাই। প্রকল্প সমাপনী দিনে বরাদ্দ ও কী কী কাজ করা হয়েছে, তা জানতে চেয়েছিলাম। কৃষি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান আমাকে জানাননি। অল্প কিছু কাজ হয়েছে বলে কৃষকরা জানান। অল্প সম্মানী ও উপকরণ দেওয়া হয়েছে। সমাপনী দিনে আমাকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল আমি যায়নি।’

দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (বর্তমান) শারমিন আক্তার বলেন, ‘কী কী বাস্তবায়ন হয়েছে, আমাকে জিজ্ঞাসা করলে হবে না। আগের অফিসার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। ওই অফিসারের কাছে প্রকল্প সম্পর্কে জানতে হবে। আমি এই প্রকল্পের কোনো তথ্য দিতে পারব না।’

চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও সাবেক দামুড়হুদা উপজেলা কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামানের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরে এই প্রতিবেদক কথা বললে তিনি বলেন, ‘আমি ভাত খাচ্ছি, খাওয়া শেষে কথা বলছি।’ আবার তিনি বলেন, প্রকল্পের বিস্তারিত জেনে কথা বলছি। এক ঘণ্টা পর ফোন করলে তিনি বলেন মাঠ দিবসে আছি। পরে কথা বলব। এছাড়াও দৈনিক সময়ের সমীকরণ অফিস থেকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভি করেননি।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, ‘দুর্নীতির কথা আমরা বলছি না। তৃতীয় পক্ষ বলছে। আর যে কাজ করছে, সে বক্তব্য দেবে।’ পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক মো. সালাহ্ উদ্দীন সরদার বলেন, ‘প্রকল্পে অনিয়ম হওয়ার কথা নয়। অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ পেলে তদন্ত করা হবে। তদন্ত শেষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

দামুড়হুদার সাবেক কৃষি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

পরিবেশবান্ধব নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্পে হ-য-ব-র-ল

আপলোড টাইম : ০৮:২৭:১৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ নভেম্বর ২০২৩

সমীকরণ প্রতিবেদক:
চুয়াডাঙ্গা-দামুড়হুদা উপজেলার সাবেক কৃষি কর্মকর্তা বর্তমানে জীবননগর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কাগজে-কলমে পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্প (১ম সংশোধনী) কার্যক্রম শেষ করা হয়েছে। প্রকল্প শেষ হলেও উঠে আসছে নানা অনিয়ম আর দুর্নীতি। লাখ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্প কোনো কাজে আসেনি প্রান্তিক কৃষকদের। নিম্নমানের উপকরণ ও সুবিধাভোগীদের বরাদ্দের টাকা নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদনের কথা বলা হলেও বাস্তবে ভিন্ন চিত্র দেখা যায় মাঠে। কৃষকরা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছেন সবজিসহ সব ধরণের ফসলে। কৃষকরা কাঙ্খিত সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাঁচ বছর মেয়াদী প্রকল্প হলেও বন্ধ রয়েছে কার্যক্রম। ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন হওয়া প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা সুবিধা নিলেও দায় নিচ্ছে না কেউই।

স্থানীয় পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জানান, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের বিষয়টি আমি কৃষকদের মাধ্যমে শুনছি। অনেক টাকার বিষয়, সেহেতু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’

দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আইপিএম মডেল ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করে। আইপিএম মডেল ইউনিয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন। কিন্তু মাঠে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। কৃষকরা আগের মতোই সবজিসহ সব ফসলে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছেন। যার ফলে বিষযুক্ত সবজি উৎপাদন বাড়ছে। বাজারে ক্রেতারাও কিনছেন এসব সবজি ও ফসল। প্রতিনিয়ত বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। শুরুতে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক সদস্যকে নিয়ে দল গঠন ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

কৃষক-কৃষাণীদের ২ সেশনে দল গঠন ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ২ সেশনের জন্য প্রত্যেক সদস্যর বরাদ্দ ৪০০ টাকা করে। ৫০০ জনকে ২ লাখ টাকা দেওয়া হয়। ৩০ জনের রিফ্রেশমেন্ট বাবদ ২ সেশনে ৬০ হাজার টাকা, ৫০০ জন কৃষকের ৫ সেশনের ২০০ টাকা হারে প্রশিক্ষণের জন্য ৫ লাখ টাকা, ফ্যাসিলিটেটরের ২০টি গ্রুপের ৫ সেশনের ২ জনের ৬০০ টাকা হারে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ২০টি গ্রুপের প্রশিক্ষণ সামগ্রী ক্রয় ৫০ হাজার টাকা, এসএপিপিও/ এসএএও ২০টি গ্রুপের ৫ সেশনের ১ জনের ৪০০ টাকা হারে ৪০ হাজার টাকা, অতিথি বক্তা ভাতা ২০টি গ্রুপের ৫ সেশনের ২ জনের ১ হাজার টাকা হারে ৪০ হাজার টাকা ও অন্যান্য ব্যায় দেখানো হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। খাতগুলোতে মোট ব্যয় দেখানো হয়েছে ১১ লাখ টাকা।

আইপিএম মডেল ইউনিয়ন বাস্তবায়নের জন্য পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়ানের কৃষকদের নিয়ে ২০টি গ্রুপ গঠন করা হয়। প্রত্যোকটি গ্রুপে ২৫ জন করে কৃষক ও কৃষাণী আছেন। ২০টি গ্রুপে ৫০০ জন কৃষক-কৃষাণী এই আইপিএম মডেল ইউনিয়নের সদস্য। পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদনের লক্ষে সরকার এ প্রকল্পে ৭০ লাখ টাকা অর্থ বরাদ্দ দেয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেশের ২০টি ইউনিয়ানে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে।

প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শেষে রবি ও খরিপ মৌমুসে প্রদর্শনীর জন্য প্রত্যেক গ্রুপ বরাদ্দ পায় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। দুই মৌসুমের জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ৫০ লাখ টাকা। ৫০ লাখ টাকা দুই মৌসুমে সমান ব্যয় হওয়ার কথা। ভুক্তভোগী কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রবি মৌসুমে আংশিক বরাদ্দ পেলেও খরিপ মৌসুমে কিছুই পায়নি। একবারই আংশিক সহায়তা পাওয়ার কথা জানান কৃষকরা। খরিপ মৌসুমের বরাদ্দের উপকরণের ভ্যান ও ক্যারেট সরবরাহ করা হয়েছে রবি মৌসুমের সময়। ভ্যান ও ক্যারেটের মূল্য দেখানো হয় ৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
নিম্নমানের বীজ, জৈব সার, ফেরোমন ফাঁদ, স্টিকি ট্রাপ, কীটনাশকসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ বিতরণ করায় প্রকল্পের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। ভ্যান, ক্যারেট, নেটসহ অন্য উপকরণগুলোও ব্যবহারের অনুপযোগী ছিল। ক্যারেট সরবরাহ করা হয় ভাঙা ও পুরাতন। পা-চালিত ভ্যান গাড়িগুলো নিম্নমানের হওয়ায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কৃষকদের ৭টি প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিজেদের খেয়াল খুশি মতো কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। নির্ধারিত বরাদ্দের টাকাও ঠিকমতো দেওয়া হয়নি কৃষকদের। ফলে পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে।

রবি ও খরিপ মৌসুমের জন্য এ প্রকল্প গ্রহণ করে কৃষি বিভাগ। কিন্তু কৃষকদের মাঝে রবি মৌসুমের উপকরণ আংশিক সরবরাহ করে। খরিপ মৌসুমের বরাদ্দের ভ্যান ও ক্যারেট রবি মৌসুমে সদস্যদের মাঝে বিতরণ করে প্রকল্পের ইতি টানেন বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সকল কর্মকর্তারাও নিয়েছেন ভাতা। প্রশিক্ষণ, ভাতা, উপকরণ বরাদ্দের সর্বক্ষেত্রে ফুটে উঠেছে অনিয়ম। প্রকল্পটি এখন অদৃশ্যমান।

দামুড়হুদা উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের কৃষক আইপিএম সদস্য রেজাবুল বলেন, ‘একদিন ২ শ, একদিন ১২ শ টাকা পেয়েছি। আর এক বস্তা জৈব সার দিয়েছে, ওতো মাটি। এক বস্তার ওজন ৮০ কেজি। বীজ, মগ, তাবিজ, হাবিজাবি পেয়েছি। ভ্যান পেয়েছি ওতো ডুপ্লিকেট।’ পারকৃষ্ণপুর গ্রামের আইপিএম সদস্য আজিজুল হাকিম বলেন, ‘আমি তিনবার মিটিং করে ৬ শ টাকা পেয়েছি, চাষের জন্য ১ হাজার টাকা, ১ বস্তা জৈব সার, ১ ফেরেমন ফাঁদ এবং ২ বোতল কীটনাশক পেয়েছি।’

দামুড়হুদা পারকৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষক ও গ্রুপ লিডার আশরাফ আলী বলেন, ‘কৃষি অফিস থেকে যে বীজ দিয়েছিল, তা ভালো না। প্রতি মিটিংয়ে ২ শ করে টাকা দিয়েছে। বড় একটা প্রজেক্টে ১ হাজার টাকা দিয়েছে। সার আমরা পাইনি।’ দামুড়হুদা উপজেলার নাস্তিপুর গ্রামের বাসিন্দা আজিবর রহমান বলেন, ‘আইপিএমের নামে যে প্রকল্প দিয়েছে, তা আমাদের কোনো উন্নয়ন হয়নি। বরং সরকারের কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে।’

দামুড়হুদা উপজেলার পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এ এম জাকারিয়া আলম বলেন, ‘বড় পরিমাণের টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সে পরিমাণ কাজ দেখতে চায়। ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা শুনছি। যারা সংশ্লিষ্ট আছেন, তারা খতিয়ে দেখবেন। আমার ইউনিয়নকে আইপিএম মডেল ইউনিয়ন করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিবান্ধব সরকার। কৃষকদের জন্য তিনি যা বরাদ্দ দিয়েছেন, এর সঠিক কাজ দেখতে চাই। প্রকল্প সমাপনী দিনে বরাদ্দ ও কী কী কাজ করা হয়েছে, তা জানতে চেয়েছিলাম। কৃষি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান আমাকে জানাননি। অল্প কিছু কাজ হয়েছে বলে কৃষকরা জানান। অল্প সম্মানী ও উপকরণ দেওয়া হয়েছে। সমাপনী দিনে আমাকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল আমি যায়নি।’

দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (বর্তমান) শারমিন আক্তার বলেন, ‘কী কী বাস্তবায়ন হয়েছে, আমাকে জিজ্ঞাসা করলে হবে না। আগের অফিসার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। ওই অফিসারের কাছে প্রকল্প সম্পর্কে জানতে হবে। আমি এই প্রকল্পের কোনো তথ্য দিতে পারব না।’

চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও সাবেক দামুড়হুদা উপজেলা কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামানের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরে এই প্রতিবেদক কথা বললে তিনি বলেন, ‘আমি ভাত খাচ্ছি, খাওয়া শেষে কথা বলছি।’ আবার তিনি বলেন, প্রকল্পের বিস্তারিত জেনে কথা বলছি। এক ঘণ্টা পর ফোন করলে তিনি বলেন মাঠ দিবসে আছি। পরে কথা বলব। এছাড়াও দৈনিক সময়ের সমীকরণ অফিস থেকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভি করেননি।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, ‘দুর্নীতির কথা আমরা বলছি না। তৃতীয় পক্ষ বলছে। আর যে কাজ করছে, সে বক্তব্য দেবে।’ পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক মো. সালাহ্ উদ্দীন সরদার বলেন, ‘প্রকল্পে অনিয়ম হওয়ার কথা নয়। অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ পেলে তদন্ত করা হবে। তদন্ত শেষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’