ইপেপার । আজ বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঝিনাইদহে টানা খরা-অনাবৃষ্টি, কৃষিখাতে পানির চরম সঙ্কট

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৩:১৩:০৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ ২০২৩
  • / ৩৩ বার পড়া হয়েছে

আসিফ কাজল, ঝিনাইদহ:
প্রায় ৭-৮ মাস ধরে বৃষ্টি নেই ঝিনাইদহ জেলায়। টানা এই অনাবৃষ্টির রেকর্ড আবহাওয়াবিদদের ভাবিয়ে তুলেছে। একশ বছরের ইতিহাসে এমন অস্বাভাবিক খরা-অনাবৃষ্টির কবলে পড়েনি দেশ। তাও এবার আগাম খরা। সেই সঙ্গে চৈত্র-বৈশাখের মতোই প্রখর রোদের তেজ অনুভব করা যাচ্ছে। গত নভেস্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত একটানা এই সাড়ে চার মাসে সারা দেশে সার্বিকভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে গড়ে ৯১ দশমিক ৫ শতাংশই কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। অর্থাৎ বৃষ্টি ‘নেই’ হয়ে গেছে। এরমধ্যে গেল ফেব্রুয়ারি মাসে ৯৪ দশমিক ৭ ভাগই অনাবৃষ্টি। অথচ মৌসুমের এ সময়ে (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি) দেশে বিক্ষিপ্ত হালকা স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এতে মাটি থাকে সতেজ। কিন্তু টানা ৭-৮ মাস যাবৎ ‘স্বাভাবিক’ ছিটেফোঁটা বৃষ্টিরও দেখা নেই। চলতি মার্চ (ফাল্গুন-চৈত্র) মাসেও দেশে স্বাভাবিকের তুলনায় কম বৃষ্টি অর্থাৎ খরা-অনাবৃষ্টি অব্যাহত থাকারই পূর্বাভাস দিচ্ছে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২-১ দিনের মধ্যে কালবৈশাখী ও বজ্রসহ ঝড়বৃষ্টি হতে পারে। বেশ কয়েকদিন ধরে গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছে। দিনে গরম ও রাতে শীতের আমেজ মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। আবহাওয়াবিদদের ভাষ্যমতে, খরা-অনাবৃষ্টি, তাপদাহ পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোতে দীর্ঘায়িত হয়ে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। শতবছরের মধ্যে রেকর্ড খরার ঝুঁকিতে পড়ছে সমগ্র দেশ। কৃষিজমিতে সেচের পানি ও খাবার পানির ভয়াবহ সঙ্কট আসন্ন। ইতঃমধ্যে জেলার অনেক এলাকার নলকূপে পানি উঠছে না। সেচের পানির টানাটানি এবং রোদে পুড়ে ফল-ফসল, শাক-সবজি খেত বিবর্ণ হয়ে যাওয়ার খবর আসছে। অনাবৃষ্টির পরিস্থিতিতে জেলার কৃষিখাতে পানির সঙ্কট চরম আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। ইতঃমধ্যে অনেক খেত ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। মাছ চাষে পানির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। পুকুর মালিকরা ডিজেল ও বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে অনবরত পানি দিচ্ছেন। এতে মাছ চাষে ঝুঁকির সৃষ্টি হচ্ছে।
এদিকে দীর্ঘমেয়াদি অনাবৃষ্টির কারণে ধুলোবালির রাজত্ব কায়েম হয়েছে। রাস্তায় ধুলোর কারণে যেমন হাঁটাচলা করা যাচ্ছে না, তেমনি রাস্তার ধুলো ঘরে উঠছে। এতে জনস্বাস্থ্যের ওপর পড়েছে ক্ষতিকর প্রভাব। জ্বর-কাঁশি, শ^াসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বেড়ে গেছে। ফল-ফসলেও বেড়েছে রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ। আবহাওয়া ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামুদ্রিক ও ভূপৃষ্ঠের আবহাওয়ায় ‘লা নিনা’ থেকে পালাবদলে ‘এল নিনো’র ধাক্কা অর্থাৎ ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টিপাতের ধারা পাল্টে গিয়ে খরতাপের দিকে ধাবিত হওয়ার কারণেই অকালে খরা-অনাবৃষ্টি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর পেছনে দায়ী আবহাওয়া-জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব। এ অবস্থায় আবহাওয়ার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ও আচরণ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। রুক্ষ-রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে পরিবেশ ও প্রকৃতি। এ বছর বাংলাদেশসহ বিশ^জুড়ে তাপদাহ হতে পারে আরও অসহনীয়। বাড়বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনদুর্ভোগ।
আমেরিকান আবহাওয়া সংস্থা ‘নোয়া’র বরাত দিয়ে অতি সম্প্রতি ভারতের আবহাওয়া বিভাগ জানায়, এবারের গ্রীষ্ম মৌসুম থেকেই খরা-অনাবৃষ্টি পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এমনকি স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের কারণে খরা আগামী জুলাই-আগস্ট মাসে অর্থাৎ ভরা বর্ষাকাল পর্যন্ত খরা বিলম্বিত হতে পারে। এদিকে এখন থেকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় গরম বাতাসের একটি ‘উষ্ণ বলয়’ তৈরি হয়েছে। যার প্রভাবে এ অঞ্চলের আবহাওয়ায় ‘এল নিনো’ অবস্থা বিরাজ করছে। সাধারণত তিন থেকে ছয় বছর পর এ ধরনের অবস্থা তৈরি হতে দেখা যায়। বসন্ত ঋতুতেই আগাম খরা-অনাবৃষ্টির কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্টক হ্রাস পাচ্ছে। দ্রুত নিচের দিকেই নামছে পানির স্তর। কোথাও ১০ থেকে ১৫ ফুট, কোথাও তা ৩০ থেকে ৫০ ফুটও নিচে নেমে গেছে। নলকূপে পানি উঠছে না। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানি রিচার্জ হচ্ছে না। ভূ-উপরিভাগে নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাওড়, জলাশয়, পুকুরসহ পানির উৎসগুলো শুকিয়ে তলানিতে ঠেকেছে। অনেক জায়গায় নদ-নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন বসন্তকালেই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৩৬ ডিগ্রির সেলসিয়াসের আশপাশে উঠে গেছে।
খরা ও অনাবৃষ্টি নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আজগার আলী জানান, অনাবৃষ্টির কারণে ঝিনাইদহের কৃষকরা আউস ধানের বীজতলা তৈরি করতে পারছে না। এছাড়া তিল, মুগ ও পাট চাষে ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, অনাবৃষ্টি ও খরার কারণে ফল-ফসল, খেত-খামার, মাছ চাষসহ নানা ক্ষেত্রে সমস্য দেখা দিয়েছে। ভূ-উপরিভাগের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের চাপ বেড়ে গেছে। এর ফলে মাটির নিচে পানির স্টক কমে আসছে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

ঝিনাইদহে টানা খরা-অনাবৃষ্টি, কৃষিখাতে পানির চরম সঙ্কট

আপলোড টাইম : ০৩:১৩:০৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ ২০২৩

আসিফ কাজল, ঝিনাইদহ:
প্রায় ৭-৮ মাস ধরে বৃষ্টি নেই ঝিনাইদহ জেলায়। টানা এই অনাবৃষ্টির রেকর্ড আবহাওয়াবিদদের ভাবিয়ে তুলেছে। একশ বছরের ইতিহাসে এমন অস্বাভাবিক খরা-অনাবৃষ্টির কবলে পড়েনি দেশ। তাও এবার আগাম খরা। সেই সঙ্গে চৈত্র-বৈশাখের মতোই প্রখর রোদের তেজ অনুভব করা যাচ্ছে। গত নভেস্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত একটানা এই সাড়ে চার মাসে সারা দেশে সার্বিকভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে গড়ে ৯১ দশমিক ৫ শতাংশই কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। অর্থাৎ বৃষ্টি ‘নেই’ হয়ে গেছে। এরমধ্যে গেল ফেব্রুয়ারি মাসে ৯৪ দশমিক ৭ ভাগই অনাবৃষ্টি। অথচ মৌসুমের এ সময়ে (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি) দেশে বিক্ষিপ্ত হালকা স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এতে মাটি থাকে সতেজ। কিন্তু টানা ৭-৮ মাস যাবৎ ‘স্বাভাবিক’ ছিটেফোঁটা বৃষ্টিরও দেখা নেই। চলতি মার্চ (ফাল্গুন-চৈত্র) মাসেও দেশে স্বাভাবিকের তুলনায় কম বৃষ্টি অর্থাৎ খরা-অনাবৃষ্টি অব্যাহত থাকারই পূর্বাভাস দিচ্ছে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২-১ দিনের মধ্যে কালবৈশাখী ও বজ্রসহ ঝড়বৃষ্টি হতে পারে। বেশ কয়েকদিন ধরে গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছে। দিনে গরম ও রাতে শীতের আমেজ মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। আবহাওয়াবিদদের ভাষ্যমতে, খরা-অনাবৃষ্টি, তাপদাহ পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোতে দীর্ঘায়িত হয়ে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। শতবছরের মধ্যে রেকর্ড খরার ঝুঁকিতে পড়ছে সমগ্র দেশ। কৃষিজমিতে সেচের পানি ও খাবার পানির ভয়াবহ সঙ্কট আসন্ন। ইতঃমধ্যে জেলার অনেক এলাকার নলকূপে পানি উঠছে না। সেচের পানির টানাটানি এবং রোদে পুড়ে ফল-ফসল, শাক-সবজি খেত বিবর্ণ হয়ে যাওয়ার খবর আসছে। অনাবৃষ্টির পরিস্থিতিতে জেলার কৃষিখাতে পানির সঙ্কট চরম আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। ইতঃমধ্যে অনেক খেত ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। মাছ চাষে পানির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। পুকুর মালিকরা ডিজেল ও বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে অনবরত পানি দিচ্ছেন। এতে মাছ চাষে ঝুঁকির সৃষ্টি হচ্ছে।
এদিকে দীর্ঘমেয়াদি অনাবৃষ্টির কারণে ধুলোবালির রাজত্ব কায়েম হয়েছে। রাস্তায় ধুলোর কারণে যেমন হাঁটাচলা করা যাচ্ছে না, তেমনি রাস্তার ধুলো ঘরে উঠছে। এতে জনস্বাস্থ্যের ওপর পড়েছে ক্ষতিকর প্রভাব। জ্বর-কাঁশি, শ^াসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বেড়ে গেছে। ফল-ফসলেও বেড়েছে রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ। আবহাওয়া ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামুদ্রিক ও ভূপৃষ্ঠের আবহাওয়ায় ‘লা নিনা’ থেকে পালাবদলে ‘এল নিনো’র ধাক্কা অর্থাৎ ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টিপাতের ধারা পাল্টে গিয়ে খরতাপের দিকে ধাবিত হওয়ার কারণেই অকালে খরা-অনাবৃষ্টি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর পেছনে দায়ী আবহাওয়া-জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব। এ অবস্থায় আবহাওয়ার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ও আচরণ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। রুক্ষ-রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে পরিবেশ ও প্রকৃতি। এ বছর বাংলাদেশসহ বিশ^জুড়ে তাপদাহ হতে পারে আরও অসহনীয়। বাড়বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনদুর্ভোগ।
আমেরিকান আবহাওয়া সংস্থা ‘নোয়া’র বরাত দিয়ে অতি সম্প্রতি ভারতের আবহাওয়া বিভাগ জানায়, এবারের গ্রীষ্ম মৌসুম থেকেই খরা-অনাবৃষ্টি পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এমনকি স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের কারণে খরা আগামী জুলাই-আগস্ট মাসে অর্থাৎ ভরা বর্ষাকাল পর্যন্ত খরা বিলম্বিত হতে পারে। এদিকে এখন থেকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় গরম বাতাসের একটি ‘উষ্ণ বলয়’ তৈরি হয়েছে। যার প্রভাবে এ অঞ্চলের আবহাওয়ায় ‘এল নিনো’ অবস্থা বিরাজ করছে। সাধারণত তিন থেকে ছয় বছর পর এ ধরনের অবস্থা তৈরি হতে দেখা যায়। বসন্ত ঋতুতেই আগাম খরা-অনাবৃষ্টির কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্টক হ্রাস পাচ্ছে। দ্রুত নিচের দিকেই নামছে পানির স্তর। কোথাও ১০ থেকে ১৫ ফুট, কোথাও তা ৩০ থেকে ৫০ ফুটও নিচে নেমে গেছে। নলকূপে পানি উঠছে না। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানি রিচার্জ হচ্ছে না। ভূ-উপরিভাগে নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাওড়, জলাশয়, পুকুরসহ পানির উৎসগুলো শুকিয়ে তলানিতে ঠেকেছে। অনেক জায়গায় নদ-নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন বসন্তকালেই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৩৬ ডিগ্রির সেলসিয়াসের আশপাশে উঠে গেছে।
খরা ও অনাবৃষ্টি নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আজগার আলী জানান, অনাবৃষ্টির কারণে ঝিনাইদহের কৃষকরা আউস ধানের বীজতলা তৈরি করতে পারছে না। এছাড়া তিল, মুগ ও পাট চাষে ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, অনাবৃষ্টি ও খরার কারণে ফল-ফসল, খেত-খামার, মাছ চাষসহ নানা ক্ষেত্রে সমস্য দেখা দিয়েছে। ভূ-উপরিভাগের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের চাপ বেড়ে গেছে। এর ফলে মাটির নিচে পানির স্টক কমে আসছে।