ইপেপার । আজ শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের ওষুধ হরিলুট!

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:০৪:৩১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২২
  • / ৩৩ বার পড়া হয়েছে

ঝিনাইদহ অফিস:

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের সরকারি ওষুধ হরিলুট হচ্ছে। যে যেভাবে পারছে, সরকারি দামি দামি ওষুধ তুলে নিচ্ছে। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে আসা গ্রামের হতদরিদ্র রোগীরা হাসপাতালের সরকারি ওষুধ পাচ্ছে না। হাসপাতালের আশপাশে গড়ে ওঠা ক্লিনিক ও প্যাথলজির কর্মচারী এবং দালাল চক্র এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও রয়েছে মুখচেনা কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি, হাসপাতালের আশেপাশে বসবাসরত প্রতিবেশী, কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা ও ইন্টার্নি করতে আসা শিক্ষার্থীরা। দুপুর পার হতেই আসতে শুরু করে এই সুবিধাভোগী চক্রটি। তারা একাধিক স্লিপ নিয়ে ব্যাগভর্তি সরকারি ওষুধ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এই চিত্র প্রতিদিনের হলেও কোনো প্রতিকার নেই।

এদিকে, এভাবে জাল বহির্বিভাগীয় রোগীর টিকেট তৈরি করে বিপুল পরিমাণ ওষুধ উত্তোলনের সময় ধরা পড়েছেন সাদ্দাম হোসেন ও রাতুল নামে দুই যুবক। ধরাপড়ার পর তাঁদের হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সৈয়দ রেজাউল ইসলামের দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। মুচলেকা নিয়ে তাঁদের ছেড়ে দেন তত্ত্বাবধায়ক। গতকাল রোববার ঘড়ির কাটায় ঠিক দুপুর ১২.৪০টা। ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের ঔষাধাগারের সামনে জটলা। হাসপাতালে মাস্টার রোলে কর্মরত মুস্তাক আহম্মেদ তাঁর স্ত্রীর জন্য কিলম্যাক্স নামে একটি ওষুধ নিতে যান। তাঁর নজরে পড়ে দুই যুবক একাধিক বহির্বিভাগীয় রোগীর টিকেট নিয়ে ব্যাগে করে ওষুধ ভরছেন। বিষয়টি তাঁর সন্দেহ হলে তিনি সাদ্দাম ও রাতুলকে ডেকে নিয়ে যান তত্ত্বাবধায়কের দপ্তরে। তাঁদের কাছে পাওয়া যায় ডা. মারুফ স্বাক্ষরিত একাধিক টিকেট। মাস্টার রোলের কর্মচারী মুস্তাক আহম্মেদ সন্দেহ দূর করতে ডা. মারুফের কাছে ফোন দিলে তিনি ওই যুবকদের চেনেন না বলে জানিয়ে দেন।

ওষুধসহ ধরাপড়ার পর সাদ্দাম হোসেন জানান, তিনি হাসপাতালের সামনে মেডিকেট নামে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে চাকরি করেন। আর রাতুল ছাত্র। তাঁদের বাড়ি যশোরের চৌগাছায়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তাঁদের কাছে থাকা চারটি বহির্বিভাগীয় রোগীর টিকেট জাল। এই চক্রটি আলিম, বুলবুলি ও অহনার নামে জাল টিকেট তৈরি করে তাতে মূলবান ওষুষ লিখে নেন। একটি টিকেট ছিল রাতুলের নামে।

তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের আশেপাশে থাকা ক্লিনিকে প্রতিনিয়ত রোগীর অপারেশন হচ্ছে। এই কাজে ১৫-২০ জন দালাল হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার কাজে লিপ্ত। ঝিনাইদহ আইএইচটি, ম্যাটস ও নার্সিং ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা এসব ক্লিনিকে খণ্ডকালীন চাকরি করেন। তারা ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে ডিউটি করার কারণে অনেকে আবার চিকিৎসকদের স্বাক্ষর নকল করতে পারেন। অনেক সময় চিকিৎসকরা ইন্টার্নিরত শিক্ষার্থীদের আবদারে একাধিক বহির্বিভাগীয় রোগীর টিকেট নম্বর দিয়ে ওষুধের স্লিপ দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একাধিক কর্মচারী জানান, প্রতিদিন যেভাবে হাসপাতালের সরকারি ওষুধ লুটপাট হচ্ছে, তা রোধ না করতে পারলে গ্রামের দরিদ্র রোগীরা মাসব্যাপী ওষুধ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে।

বিষয়টি নিয়ে হাসপাতালের ঔষাধাগারের ইনচার্জ রুহুল আমিন জানান, ‘প্রতিদিন রোগীর যে চাপ থাকে, তাতে আমার একার পক্ষে টিকেট যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয় না।’ তিনি বলেন, ঔষাধাগারে চারটি পদের মধ্যে তিনটিই খালি। তাই রোগীর ভীড়ে আসল-নকল যাচাই করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাছাড়া সমাজের এমন কিছু মানুষ এসে এমন চাপ সৃষ্টি করেন, তাতে আমরা অসহায় হয়ে পড়ি।

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সৈয়দ রেজাউল ইসলাম জানান, ‘আমি নতুন যোগদান করেছি। সাদ্দাম আর রাতুল নামে যে দুইজন জাল টিকেট নিয়ে ধরা পড়েছিল, তারা ছাত্র। এই কারণে তাদের সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখা হলো।’ তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমি পর্যবেক্ষণ করছি, ভবিষ্যতে যাতে এমনটি না হয়, সে জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

ঝিনাইদহের সনাক সভাপতি অধ্যক্ষ সাইদুল আলম জানান, জাল বহির্বিভাগীয় রোগীর টিকেটে ওষুধ নেওয়ার প্রবণতা রোধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ যাতে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের ওষুধ হরিলুট!

আপলোড টাইম : ০৯:০৪:৩১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২২

ঝিনাইদহ অফিস:

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের সরকারি ওষুধ হরিলুট হচ্ছে। যে যেভাবে পারছে, সরকারি দামি দামি ওষুধ তুলে নিচ্ছে। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে আসা গ্রামের হতদরিদ্র রোগীরা হাসপাতালের সরকারি ওষুধ পাচ্ছে না। হাসপাতালের আশপাশে গড়ে ওঠা ক্লিনিক ও প্যাথলজির কর্মচারী এবং দালাল চক্র এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও রয়েছে মুখচেনা কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি, হাসপাতালের আশেপাশে বসবাসরত প্রতিবেশী, কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা ও ইন্টার্নি করতে আসা শিক্ষার্থীরা। দুপুর পার হতেই আসতে শুরু করে এই সুবিধাভোগী চক্রটি। তারা একাধিক স্লিপ নিয়ে ব্যাগভর্তি সরকারি ওষুধ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এই চিত্র প্রতিদিনের হলেও কোনো প্রতিকার নেই।

এদিকে, এভাবে জাল বহির্বিভাগীয় রোগীর টিকেট তৈরি করে বিপুল পরিমাণ ওষুধ উত্তোলনের সময় ধরা পড়েছেন সাদ্দাম হোসেন ও রাতুল নামে দুই যুবক। ধরাপড়ার পর তাঁদের হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সৈয়দ রেজাউল ইসলামের দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। মুচলেকা নিয়ে তাঁদের ছেড়ে দেন তত্ত্বাবধায়ক। গতকাল রোববার ঘড়ির কাটায় ঠিক দুপুর ১২.৪০টা। ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের ঔষাধাগারের সামনে জটলা। হাসপাতালে মাস্টার রোলে কর্মরত মুস্তাক আহম্মেদ তাঁর স্ত্রীর জন্য কিলম্যাক্স নামে একটি ওষুধ নিতে যান। তাঁর নজরে পড়ে দুই যুবক একাধিক বহির্বিভাগীয় রোগীর টিকেট নিয়ে ব্যাগে করে ওষুধ ভরছেন। বিষয়টি তাঁর সন্দেহ হলে তিনি সাদ্দাম ও রাতুলকে ডেকে নিয়ে যান তত্ত্বাবধায়কের দপ্তরে। তাঁদের কাছে পাওয়া যায় ডা. মারুফ স্বাক্ষরিত একাধিক টিকেট। মাস্টার রোলের কর্মচারী মুস্তাক আহম্মেদ সন্দেহ দূর করতে ডা. মারুফের কাছে ফোন দিলে তিনি ওই যুবকদের চেনেন না বলে জানিয়ে দেন।

ওষুধসহ ধরাপড়ার পর সাদ্দাম হোসেন জানান, তিনি হাসপাতালের সামনে মেডিকেট নামে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে চাকরি করেন। আর রাতুল ছাত্র। তাঁদের বাড়ি যশোরের চৌগাছায়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তাঁদের কাছে থাকা চারটি বহির্বিভাগীয় রোগীর টিকেট জাল। এই চক্রটি আলিম, বুলবুলি ও অহনার নামে জাল টিকেট তৈরি করে তাতে মূলবান ওষুষ লিখে নেন। একটি টিকেট ছিল রাতুলের নামে।

তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের আশেপাশে থাকা ক্লিনিকে প্রতিনিয়ত রোগীর অপারেশন হচ্ছে। এই কাজে ১৫-২০ জন দালাল হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার কাজে লিপ্ত। ঝিনাইদহ আইএইচটি, ম্যাটস ও নার্সিং ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা এসব ক্লিনিকে খণ্ডকালীন চাকরি করেন। তারা ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে ডিউটি করার কারণে অনেকে আবার চিকিৎসকদের স্বাক্ষর নকল করতে পারেন। অনেক সময় চিকিৎসকরা ইন্টার্নিরত শিক্ষার্থীদের আবদারে একাধিক বহির্বিভাগীয় রোগীর টিকেট নম্বর দিয়ে ওষুধের স্লিপ দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একাধিক কর্মচারী জানান, প্রতিদিন যেভাবে হাসপাতালের সরকারি ওষুধ লুটপাট হচ্ছে, তা রোধ না করতে পারলে গ্রামের দরিদ্র রোগীরা মাসব্যাপী ওষুধ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে।

বিষয়টি নিয়ে হাসপাতালের ঔষাধাগারের ইনচার্জ রুহুল আমিন জানান, ‘প্রতিদিন রোগীর যে চাপ থাকে, তাতে আমার একার পক্ষে টিকেট যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয় না।’ তিনি বলেন, ঔষাধাগারে চারটি পদের মধ্যে তিনটিই খালি। তাই রোগীর ভীড়ে আসল-নকল যাচাই করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাছাড়া সমাজের এমন কিছু মানুষ এসে এমন চাপ সৃষ্টি করেন, তাতে আমরা অসহায় হয়ে পড়ি।

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সৈয়দ রেজাউল ইসলাম জানান, ‘আমি নতুন যোগদান করেছি। সাদ্দাম আর রাতুল নামে যে দুইজন জাল টিকেট নিয়ে ধরা পড়েছিল, তারা ছাত্র। এই কারণে তাদের সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখা হলো।’ তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমি পর্যবেক্ষণ করছি, ভবিষ্যতে যাতে এমনটি না হয়, সে জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

ঝিনাইদহের সনাক সভাপতি অধ্যক্ষ সাইদুল আলম জানান, জাল বহির্বিভাগীয় রোগীর টিকেটে ওষুধ নেওয়ার প্রবণতা রোধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ যাতে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।