ইপেপার । আজ শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঝিনাইদহে অভাব আর বাঞ্চনার শিকার : দুই হাজার পরিবারের দরিদ্র জয়ের গল্প

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৪:৪৭:৪৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১২ মার্চ ২০১৭
  • / ৩৯৫ বার পড়া হয়েছে

ঝিনাইদহ অফিস: এক সময় রেবেকা, মর্জিনা ও সুখজান নেছাদের নিত্য যুদ্ধ ছিল অভাবের সাথে। তাদের সংসারে অভাব অনটনের কারণে “নুন আনতে পান্তায় ফুরায়” দশা ছিল সর্বক্ষন। তারপরও তারা স্থানীয় চেয়ারম্যান বা মেম্বরের কাছে হাত পাতেন নি। নেন নি কোন সরকারী সহায়তা। অভাব আর বাঞ্চনাকে জয় করতে তারা নিজের পায়ে দাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে গ্রামের কর্মক্ষম এ সব অভাবী মহিলা দারিদ্রকে জয় করেছেন অবিশ্বস্য ভাবে। শুধু নিজেরা নয়, গ্রামের দরদ্রি মহিলাদেরকে তাদের এই দিন বদলের ধারায় সম্পৃক্ত করেছেন। ঘরে ঘরে তাদের এখন বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট। মাঠে আবাদী জমি। গোয়ালে গরু আর সন্তানদের করে দিয়েছেন নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ রকম প্রায় তিন হাজার গ্রাম্য মহিলা আত্মনির্ভরশীল হয়ে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছেন। আর তাদের দরিদ্র জয়ের গল্পের পেছনে রয়েছে কেঁচো উৎপাদন ও কম্পোষ্ট সার বিক্রি। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর, রায়গ্রাম ও কোলা ইউনিয়নের ৫৫টি গ্রাম জুড়ে দিন বদলের এই বাস্তব গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামের প্রায় দুই হাজার পরিবার কেঁচো ও কম্পোষ্ট সার বিক্রি করে খুলনা বিভাগের মধ্যে অনন্য নজীর সৃষ্টি করেছেন। এই খবর পেয়ে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আব্দুস সামাদ সম্প্রতি আত্মনির্ভর হয়ে ওঠা মহিলাদের দেখতে আসেন কালীগঞ্জে। তিনি তাদের আশ্বাস দিয়ে পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। ইতিমধ্যে গ্রামের সহজ সরল এই মহিলাদের অনেকেই কৃষি প্রযুক্তির অভিজ্ঞতা অর্জনে ভিয়েতনাম সফর করেছেন। এদের মধ্যে একজন হচ্ছে বলরামপুর গ্রামের মর্জিনা। তিনি একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। গ্রামের নারীদেরকে সংগঠিত করে মর্জিনা অধিকার আদায়ে জনমত সৃষ্টি করে চলেছেন। দাপনা গ্রামের রেবেকা খাতুন, সোনাভান ও সুখজান নেছা জানান, জাপান ভিত্তিক একটি সংস্থার কাছ থেকে তারা অভিজ্ঞতা অর্জন করে গ্রামের মহিলাদের কেঁচো উৎপাদন ও কম্পোষ্ট সার তৈরীতে উদ্বুদ্ধ করেন। সেটা ২০০৫ সালের কথা। মাত্র ১১ বছরে কেঁচো উৎপাদন ও কম্পোষ্ট সার তৈরীর প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর। দাপনা গ্রামের রেবেকা খাতুন জানান, অভাবের কারণে একবার তিনি ঘরের কিছু স্বর্ণালংকার বিক্রি করেন। এতে তার অভাব মেটেনি। এরপর স্থানীয় হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড এর কর্মকর্তা শাহিনুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করে কেঁচো কম্পোষ্ট সার উৎপাদনের উপর প্রশিক্ষন গ্রহন করি। এরপর আর আমার পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন আমার প্রতিমাসে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। উপার্জিত অর্থ দিয়ে আমি সংসার সাজিয়েছি সুন্দর ভাবে। আরেক গৃহীনি সুখজান জানান, তিনি ইদুরের গর্তে ধান সংগ্রহ ও পরের কাঁথা সেলাই করতাম। তারপর আমি কেঁচো সার উৎপাদনের প্রশিক্ষন নিয়ে কাজ শুরু করি। এখন আমার প্রতি মাসে আয় ১৫ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে আমি উন্নত স্যানিটারি পায়খানা, বায়ো গ্যাস প্ল্যান্ট ও ৫টি গরু কিনেছি। এখন আমি একজন সুখি মানুষ। একই গ্রামের সোনাভান জানান, আমি এই পদ্ধতিতে কেঁচো সার উৎপাদন করে আমার প্রতি মাসে আয় ১২ হাজার টাকা। এই টাকা আমি সংসার চালিয়ে সঞ্চয় করছি। নিয়ামত গ্রামের কৃষক আলতাফ হোসেন জানান, মহিলাদের উৎপাদিত কেঁচো সার খুবই উন্নতমানের এবং জমির উর্বারা শক্তি বৃদ্ধিতে কার্যকর। এই সার ব্যবহারে জমির শক্তি দীর্ঘ মেয়াদী বলেও তিনি জানান। হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের কর্মকর্তা শাহিনুর রহমান জানান, তাদের দেওয়া প্রশিক্ষন কাজে লাগিয়ে গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ আজ দ্রুত স্বাবলম্বি হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, অভাবি মানুষকে আলোর পথ দেখাতে রায়গ্রাম ও আগমুন্দিয়া গ্রামে প্রশিক্ষন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, কেঁচো কম্পোষ্ট জৈব সার পরিবশে বান্ধব ও জমির উর্ব্বরা শক্তি দীর্ঘস্থায়ী রাখতে অধিক কার্যকর।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

ঝিনাইদহে অভাব আর বাঞ্চনার শিকার : দুই হাজার পরিবারের দরিদ্র জয়ের গল্প

আপলোড টাইম : ০৪:৪৭:৪৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১২ মার্চ ২০১৭

ঝিনাইদহ অফিস: এক সময় রেবেকা, মর্জিনা ও সুখজান নেছাদের নিত্য যুদ্ধ ছিল অভাবের সাথে। তাদের সংসারে অভাব অনটনের কারণে “নুন আনতে পান্তায় ফুরায়” দশা ছিল সর্বক্ষন। তারপরও তারা স্থানীয় চেয়ারম্যান বা মেম্বরের কাছে হাত পাতেন নি। নেন নি কোন সরকারী সহায়তা। অভাব আর বাঞ্চনাকে জয় করতে তারা নিজের পায়ে দাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে গ্রামের কর্মক্ষম এ সব অভাবী মহিলা দারিদ্রকে জয় করেছেন অবিশ্বস্য ভাবে। শুধু নিজেরা নয়, গ্রামের দরদ্রি মহিলাদেরকে তাদের এই দিন বদলের ধারায় সম্পৃক্ত করেছেন। ঘরে ঘরে তাদের এখন বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট। মাঠে আবাদী জমি। গোয়ালে গরু আর সন্তানদের করে দিয়েছেন নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ রকম প্রায় তিন হাজার গ্রাম্য মহিলা আত্মনির্ভরশীল হয়ে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছেন। আর তাদের দরিদ্র জয়ের গল্পের পেছনে রয়েছে কেঁচো উৎপাদন ও কম্পোষ্ট সার বিক্রি। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর, রায়গ্রাম ও কোলা ইউনিয়নের ৫৫টি গ্রাম জুড়ে দিন বদলের এই বাস্তব গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামের প্রায় দুই হাজার পরিবার কেঁচো ও কম্পোষ্ট সার বিক্রি করে খুলনা বিভাগের মধ্যে অনন্য নজীর সৃষ্টি করেছেন। এই খবর পেয়ে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আব্দুস সামাদ সম্প্রতি আত্মনির্ভর হয়ে ওঠা মহিলাদের দেখতে আসেন কালীগঞ্জে। তিনি তাদের আশ্বাস দিয়ে পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। ইতিমধ্যে গ্রামের সহজ সরল এই মহিলাদের অনেকেই কৃষি প্রযুক্তির অভিজ্ঞতা অর্জনে ভিয়েতনাম সফর করেছেন। এদের মধ্যে একজন হচ্ছে বলরামপুর গ্রামের মর্জিনা। তিনি একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। গ্রামের নারীদেরকে সংগঠিত করে মর্জিনা অধিকার আদায়ে জনমত সৃষ্টি করে চলেছেন। দাপনা গ্রামের রেবেকা খাতুন, সোনাভান ও সুখজান নেছা জানান, জাপান ভিত্তিক একটি সংস্থার কাছ থেকে তারা অভিজ্ঞতা অর্জন করে গ্রামের মহিলাদের কেঁচো উৎপাদন ও কম্পোষ্ট সার তৈরীতে উদ্বুদ্ধ করেন। সেটা ২০০৫ সালের কথা। মাত্র ১১ বছরে কেঁচো উৎপাদন ও কম্পোষ্ট সার তৈরীর প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর। দাপনা গ্রামের রেবেকা খাতুন জানান, অভাবের কারণে একবার তিনি ঘরের কিছু স্বর্ণালংকার বিক্রি করেন। এতে তার অভাব মেটেনি। এরপর স্থানীয় হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড এর কর্মকর্তা শাহিনুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করে কেঁচো কম্পোষ্ট সার উৎপাদনের উপর প্রশিক্ষন গ্রহন করি। এরপর আর আমার পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন আমার প্রতিমাসে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। উপার্জিত অর্থ দিয়ে আমি সংসার সাজিয়েছি সুন্দর ভাবে। আরেক গৃহীনি সুখজান জানান, তিনি ইদুরের গর্তে ধান সংগ্রহ ও পরের কাঁথা সেলাই করতাম। তারপর আমি কেঁচো সার উৎপাদনের প্রশিক্ষন নিয়ে কাজ শুরু করি। এখন আমার প্রতি মাসে আয় ১৫ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে আমি উন্নত স্যানিটারি পায়খানা, বায়ো গ্যাস প্ল্যান্ট ও ৫টি গরু কিনেছি। এখন আমি একজন সুখি মানুষ। একই গ্রামের সোনাভান জানান, আমি এই পদ্ধতিতে কেঁচো সার উৎপাদন করে আমার প্রতি মাসে আয় ১২ হাজার টাকা। এই টাকা আমি সংসার চালিয়ে সঞ্চয় করছি। নিয়ামত গ্রামের কৃষক আলতাফ হোসেন জানান, মহিলাদের উৎপাদিত কেঁচো সার খুবই উন্নতমানের এবং জমির উর্বারা শক্তি বৃদ্ধিতে কার্যকর। এই সার ব্যবহারে জমির শক্তি দীর্ঘ মেয়াদী বলেও তিনি জানান। হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের কর্মকর্তা শাহিনুর রহমান জানান, তাদের দেওয়া প্রশিক্ষন কাজে লাগিয়ে গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ আজ দ্রুত স্বাবলম্বি হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, অভাবি মানুষকে আলোর পথ দেখাতে রায়গ্রাম ও আগমুন্দিয়া গ্রামে প্রশিক্ষন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, কেঁচো কম্পোষ্ট জৈব সার পরিবশে বান্ধব ও জমির উর্ব্বরা শক্তি দীর্ঘস্থায়ী রাখতে অধিক কার্যকর।