ইপেপার । আজ শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪

সড়ক দুর্ঘটনায় বিছানাগত স্বামীর পাশে অসহায় স্ত্রী

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৭:২৫:৪০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ জুলাই ২০২২
  • / ২৪ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: সংসারে অভাব থাকলেও সুখের কমতি ছিল না ফরিদা খাতুনের। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই দিন অতিবাহিত করছিলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ করেই তাঁর সুখের দিন শেষ হয়ে যায়। কোমরে ও মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে বিছানাগত হয়ে পড়েন ফরিদা খাতুনের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তাঁর স্বামী নজরুল ইসলাম (৫৫)। চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে ১৭ দিন ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে অবস্থানের পর স্বামী নজরুল ইসলামকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন ফরিদা খাতুন। এর পর থেকেই শুরু হয় তাঁদের মানবেতর জীবনযাপন।

এদিকে, বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝেই নজরুলের কোমরের পেছনের অংশে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। দিনের ২৪ ঘণ্টায় বিছানায় শুয়ে থাকতে হয় তাঁকে। বেশ কয়েকটি ক্ষত শুকিয়ে গেলেও এখনও একটি ক্ষত রয়েই গেছে। সেখান থেকে ছড়ায় দুর্গন্ধ। তবুও হাল ছাড়েননি নজরুলের স্ত্রী ফরিদা খাতুন। প্রতিবেশীদের বাড়িতে সাংসারিক কাজ করেই কোনো মতে এক বেলা খেয়ে দিন কাটে তাঁদের। এখনো তাঁর আশা স্বামী সুস্থ হয়ে উঠবেন। তিনি আবার ফিরে পানের তাঁর পুরোনো সংসার।

গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বনানীপাড়ার একটি বাড়িতে পাওয়া যায় নজরুল ইসলামকে। আধাপাকা বাড়ির একটি কক্ষে খাটের ওপর শুয়েছিলেন তিনি। তাঁর পাশেই ছিলেন স্ত্রী ফরিদা বেগম। পাশের ঘরে তাকাতেই চোখে পড়ে ঘরের মেঝে, চৌকির ওপর সমস্ত স্থানেই থালা-বাসন-বালতি পেতে রাখা। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে এমনিতেই হয়ত সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু তা নয়, শিলাবৃষ্টিতে ঝাঝরা হয়ে যাওয়া টিনের চাল দিয়ে পড়া বৃষ্টির পানি থেকে ঘরকে রক্ষা করতেই এ ব্যবস্থা।

নজরুল ইসলামের স্ত্রী ফরিদা খাতুন জানান, পারিবারিকভাবেই নজরুলের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। সাংসারিক জীবনে তাঁদের দুটি ছেলে রয়েছে। বড় ছেলে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতেই থাকে। ছোট ছেলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। দর্জির কাজ করে কোনো মতে সংসার চালাতেন তার স্বামী (নজরুল)। সংসারে অভাব থাকলেও সুখ ছিল। পাড়ার মধ্যে ঠিকমতো কাজ-কর্ম না থাকায় গত বছরের জানুয়ারি মাসে নজরুল আম গাছে বিষ প্রয়োগের কাজ শুরু করেন। সে মাসের ৩ তারিখে চুয়াডাঙ্গা থেকে কাজের জন্য পাখিভ্যানযোগে আলমডাঙ্গায় যাওয়ার পথে একটি দুর্ঘটনায় নজরুলের কোমর ও মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায়। সেদিন থেকেই তাঁদের সুখের সংসারে চলে আসে কষ্ট।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল থেকে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। পরদিনই স্থানীয়দের সহায়তায় তাঁকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু অর্থের অভাবে কোনো মতে না খেয়ে ১৭ দিন সেখানে অবস্থান করেন তাঁরা। চিকিৎসক অপারেশনের জন্য ২ লাখ টাকা খরচ হবে বলে জানায়। কিন্তু চিকিৎসা খরচ তো দূরের কথা ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে দুজনের খেয়ে বেঁচে থাকার মতো প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকায় ১৭ দিনের মাথায় চলে আসতে হয় নিজ বাড়িতে। এভাবেই কেটে গেছে দেড় বছর। সামান্য চলাচল তো দূরের কথা, বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে এখন দুটি পা সম্পূর্ণ অসাড় হয়ে গেছে নজরুলের। নিজে নিজে উঠে বসতেও পারছেন না তিনি।

ফরিদা খাতুন কান্না জড়িক কণ্ঠে আরও বলেন, ‘বড় ছেলে কোনো খোঁজ নেয় না। আমার ছোট ছেলে লেখাপড়ার পাশাপাশি মাঝে মধ্যে বিভিন্ন মানুষের কাজ-কর্ম করে দু’তিনশ টাকা বাড়িতে নিয়ে আসে। প্রতিবেশীদের বাড়িতে কাজ করে কোনো মতে এক বেলা খেয়ে বেঁচে আছি। উপায় না পেয়ে এ মাসেই ছোট ছেলে একটি পোশাক বিক্রির দোকানে মাসে ৩ হাজার টাকা বেতনে কাজে লেগেছে। আমার বাবার বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব একটা ভালো না। সেখান থেকেও তেমন কোনো সহযোগিতা পায় না। এর ভেতর থেকেই কোনো মতে ওনার ওষুধ কিনি। আমার ছোট ছেলের লেখাপড়ার বয়স, বাবার আদর-ভালোবাসা পাওয়ার বয়সে সে বঞ্চিত হয়েছে। তার দিকে তাকালে কষ্টে বুক ফেটে যায়। আল্লাহ যতদিন শক্তি দিয়েছে, স্বামীর সেবা করে যেতে চাই। মাঝে মাঝে ওষুধ কেনার টাকা থাকে না। একদিন খাওয়ালে দুদিন খাওয়াতে পারি না।’ স্বামী নজরুলের সুস্থতার জন্য সবার কাছে দোয়া ও সাহায্য চেয়েছেন তিনি।

প্রতিবেশী শিরিন সুলতানা নামের এক নারী বলেন, ‘চোখের সামনে একটি সংসারের করুণ পরিণতি হতে দেখছি। চিকিৎসার অভাবে দীর্ঘ দেড় বছর ধরে নজরুল ইসলাম অমানবিক কষ্ট ভোগ করছে। মানবেতর জীবনযাপন করছে পুরো পরিবারটি। যখন যেভাবে পেরেছি পরিবারটিকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। সমাজের বিত্তবানেরা যদি এই পরিবারটির দিকে একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে হয়ত তারা আবার তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে।’

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

সড়ক দুর্ঘটনায় বিছানাগত স্বামীর পাশে অসহায় স্ত্রী

আপলোড টাইম : ০৭:২৫:৪০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ জুলাই ২০২২

নিজস্ব প্রতিবেদক: সংসারে অভাব থাকলেও সুখের কমতি ছিল না ফরিদা খাতুনের। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই দিন অতিবাহিত করছিলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ করেই তাঁর সুখের দিন শেষ হয়ে যায়। কোমরে ও মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে বিছানাগত হয়ে পড়েন ফরিদা খাতুনের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তাঁর স্বামী নজরুল ইসলাম (৫৫)। চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে ১৭ দিন ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে অবস্থানের পর স্বামী নজরুল ইসলামকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন ফরিদা খাতুন। এর পর থেকেই শুরু হয় তাঁদের মানবেতর জীবনযাপন।

এদিকে, বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝেই নজরুলের কোমরের পেছনের অংশে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। দিনের ২৪ ঘণ্টায় বিছানায় শুয়ে থাকতে হয় তাঁকে। বেশ কয়েকটি ক্ষত শুকিয়ে গেলেও এখনও একটি ক্ষত রয়েই গেছে। সেখান থেকে ছড়ায় দুর্গন্ধ। তবুও হাল ছাড়েননি নজরুলের স্ত্রী ফরিদা খাতুন। প্রতিবেশীদের বাড়িতে সাংসারিক কাজ করেই কোনো মতে এক বেলা খেয়ে দিন কাটে তাঁদের। এখনো তাঁর আশা স্বামী সুস্থ হয়ে উঠবেন। তিনি আবার ফিরে পানের তাঁর পুরোনো সংসার।

গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বনানীপাড়ার একটি বাড়িতে পাওয়া যায় নজরুল ইসলামকে। আধাপাকা বাড়ির একটি কক্ষে খাটের ওপর শুয়েছিলেন তিনি। তাঁর পাশেই ছিলেন স্ত্রী ফরিদা বেগম। পাশের ঘরে তাকাতেই চোখে পড়ে ঘরের মেঝে, চৌকির ওপর সমস্ত স্থানেই থালা-বাসন-বালতি পেতে রাখা। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে এমনিতেই হয়ত সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু তা নয়, শিলাবৃষ্টিতে ঝাঝরা হয়ে যাওয়া টিনের চাল দিয়ে পড়া বৃষ্টির পানি থেকে ঘরকে রক্ষা করতেই এ ব্যবস্থা।

নজরুল ইসলামের স্ত্রী ফরিদা খাতুন জানান, পারিবারিকভাবেই নজরুলের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। সাংসারিক জীবনে তাঁদের দুটি ছেলে রয়েছে। বড় ছেলে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতেই থাকে। ছোট ছেলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। দর্জির কাজ করে কোনো মতে সংসার চালাতেন তার স্বামী (নজরুল)। সংসারে অভাব থাকলেও সুখ ছিল। পাড়ার মধ্যে ঠিকমতো কাজ-কর্ম না থাকায় গত বছরের জানুয়ারি মাসে নজরুল আম গাছে বিষ প্রয়োগের কাজ শুরু করেন। সে মাসের ৩ তারিখে চুয়াডাঙ্গা থেকে কাজের জন্য পাখিভ্যানযোগে আলমডাঙ্গায় যাওয়ার পথে একটি দুর্ঘটনায় নজরুলের কোমর ও মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায়। সেদিন থেকেই তাঁদের সুখের সংসারে চলে আসে কষ্ট।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল থেকে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। পরদিনই স্থানীয়দের সহায়তায় তাঁকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু অর্থের অভাবে কোনো মতে না খেয়ে ১৭ দিন সেখানে অবস্থান করেন তাঁরা। চিকিৎসক অপারেশনের জন্য ২ লাখ টাকা খরচ হবে বলে জানায়। কিন্তু চিকিৎসা খরচ তো দূরের কথা ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে দুজনের খেয়ে বেঁচে থাকার মতো প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকায় ১৭ দিনের মাথায় চলে আসতে হয় নিজ বাড়িতে। এভাবেই কেটে গেছে দেড় বছর। সামান্য চলাচল তো দূরের কথা, বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে এখন দুটি পা সম্পূর্ণ অসাড় হয়ে গেছে নজরুলের। নিজে নিজে উঠে বসতেও পারছেন না তিনি।

ফরিদা খাতুন কান্না জড়িক কণ্ঠে আরও বলেন, ‘বড় ছেলে কোনো খোঁজ নেয় না। আমার ছোট ছেলে লেখাপড়ার পাশাপাশি মাঝে মধ্যে বিভিন্ন মানুষের কাজ-কর্ম করে দু’তিনশ টাকা বাড়িতে নিয়ে আসে। প্রতিবেশীদের বাড়িতে কাজ করে কোনো মতে এক বেলা খেয়ে বেঁচে আছি। উপায় না পেয়ে এ মাসেই ছোট ছেলে একটি পোশাক বিক্রির দোকানে মাসে ৩ হাজার টাকা বেতনে কাজে লেগেছে। আমার বাবার বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব একটা ভালো না। সেখান থেকেও তেমন কোনো সহযোগিতা পায় না। এর ভেতর থেকেই কোনো মতে ওনার ওষুধ কিনি। আমার ছোট ছেলের লেখাপড়ার বয়স, বাবার আদর-ভালোবাসা পাওয়ার বয়সে সে বঞ্চিত হয়েছে। তার দিকে তাকালে কষ্টে বুক ফেটে যায়। আল্লাহ যতদিন শক্তি দিয়েছে, স্বামীর সেবা করে যেতে চাই। মাঝে মাঝে ওষুধ কেনার টাকা থাকে না। একদিন খাওয়ালে দুদিন খাওয়াতে পারি না।’ স্বামী নজরুলের সুস্থতার জন্য সবার কাছে দোয়া ও সাহায্য চেয়েছেন তিনি।

প্রতিবেশী শিরিন সুলতানা নামের এক নারী বলেন, ‘চোখের সামনে একটি সংসারের করুণ পরিণতি হতে দেখছি। চিকিৎসার অভাবে দীর্ঘ দেড় বছর ধরে নজরুল ইসলাম অমানবিক কষ্ট ভোগ করছে। মানবেতর জীবনযাপন করছে পুরো পরিবারটি। যখন যেভাবে পেরেছি পরিবারটিকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। সমাজের বিত্তবানেরা যদি এই পরিবারটির দিকে একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে হয়ত তারা আবার তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে।’