ইপেপার । আজ বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত শহিদের গল্প

‘ঘরে সবই আছে, কেবল রাকিব নেই’

ঝিনাইদহ অফিস:
  • আপলোড টাইম : ০৯:৩৯:০৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪
  • / ৩ বার পড়া হয়েছে

এখনও ফ্রিজে জমানো রয়েছে দুধ, গুড়, নারকেল ও পুলিপিঠার পুর। নিস্তব্ধ ঘরে প্রতিটি জিনিস পরিপাটি সাজানো। টান টান করা বিছানার এক পাশে বালিশ। পড়ার টেবিলে তাকে তাকে সাজানো বই। ড্রয়িং রুমে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে প্রিয় মোটরসাইকেল। তার পাশেই কাপড় ধোয়ার মেশিন। পানিশূন্য পানির ফিল্টারের ভেতরটা শুষ্ক, আয়রনের হালকা আস্তর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই রাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হোসেন (২৯)।
রাকিব চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকতেন। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে তার ঘরটা সবসময় এমনই সাজানো থাকতো তার অপেক্ষায়। পরিপাটি ঘরটি দেখে মনে হবে খানিক পরেই ফিরবে রাকিব। একটা বাড়িতে তিনজনের বসবাস। কিন্তু কোথাও যেন কেউ নেই। নেই কোনো শব্দ। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে যে ঝরে পড়া আরেক নক্ষত্র মো. রাকিবুল হোসেন। যে বাড়িতে বিপ্লবী নক্ষত্রের ঝরে পড়া স্মৃতি জমা থাকে, সেখানে কি আর কখনো শোরগোল জমে? রাকিব শহিদ হয়েছেন আজ ৯২ দিন। কিন্তু তার পরিবারের শোকের মাতম আজও থামেনি।
ঝিনাইদহ জেলার সদর পৌরসভার সার্কিট হাউজ রোডের মহিষাকুণ্ডু গ্রামের বাসিন্দা বিমান বাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন অফিসার (অব.) আবু বকর সিদ্দিক (৬১) এবং হাফিজা খাতুন (৫৮) দম্পতির আদরের ধন রাকিবুল হোসেন। তিনি ঢাকার বনানী সুপার জুট মিলে চাকরি করতেন। ঢাকার মিরপুরে ১১ নম্বরে ভাড়া বাসায় থাকতেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে রাকিব ছোট। বড় ভাই ইকবাল হোসেন (৩৭) সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে ঝিনাইদহ শাখায় কর্মরত।
শহিদ রাকিবের পিতা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমরা রাকিবকে ফোন করলে সে লোকজনের ভিড় থেকে সরে গিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলত। সে যে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, এটা সে আমাদের বুঝতে দিতে চাইতো না। এসব কথা রাকিবুলের সহকর্মীরা পরে আমাদের জানিয়েছে।’
রাকিবের মা হাফিজা খাতুন বলেন, ‘১৮ জুলাই ঢাকায় যখন আন্দোলনে হামলা শুরু হয়, তখন থেকেই আমরা ভয়ে ছিলাম। শুধু ভাবতাম আমার রাকিব অফিসে যাবে কীভাবে? ১৯ জুলাই শুক্রবার রাকিবকে ফোন করে বললাম, আব্বু অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফেরা যাবে না? প্রতি উত্তরে সে বলেছিল, না মা, ফেরা যাবে না।’ তবে ফিরেছে লাশ হয়ে। এ কথা বলে তার মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। নিজেকে সামলে আবার বলতে শুরু করে বলেন, ‘১৯ জুলাই, শুক্রবার, বেলা আড়াইটার পরে আমার ছেলের সঙ্গে শেষ কথা হয়। রুটি আর ডিম ভাজি দিয়ে সকালের নাস্তা করেছিল রাকিব।
হাফিজা খাতুন বলেন, ‘১৯ জুলাই মিরপুর-১১ তে মেট্রোরেল লাইনের নিচে আন্দোলনকারীদের মাঝে আমার ছেলে পানি বিতরণ করছিল। শিক্ষার্থীদের মাঝে সে যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ নিরাপদেই ছিল। যখনই সে পানি বিতরণ শেষে শিক্ষার্থীদের থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে যায়, তখনই তাকে টার্গেট করে গুলি করা হয়। আমার ছেলের সাথে থাকা সহকর্মীরা জানিয়েছে, ওপর থেকে গুলি এসে তার গলায় ঢুকে যায়। পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আমার ছেলেটা মারা যায়।’
রাকিবের বাবা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘আমার ছেলের বন্ধু পিয়াস জানিয়েছে, সে সময় একজন বয়স্ক মহিলা দৌঁড়ে রাস্তা পার হতে যেয়ে রাকিবের সামনে এসে পড়ে যায়। ওই সময় রাকিব তাকে টেনে তুলতে এগিয়ে গিয়েছিল। আর তখনই ওপর থেকে নিখুঁত টার্গেটে আমার ছেলেকে গুলি করা হয়।’ তিনি জানান, রাকিবের বন্ধু পিয়াস প্রথম বাড়িতে খবর দেন। পিয়াসই রাকিবের অফিসের সহকর্মী সালমান ও ফয়সালকে দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে মৃতদেহ ঢাকা থেকে ঝিনাইদহে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
হরিণাকুণ্ডু উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে শহিদ রাকিবকে দাফন করা হয়েছে। রাকিবের মা বলেন, ১৯ জুলাই রাত আটটার দিকে একমাত্র ভাতিজা রাফসানের (৪) সাথেই রাকিবের শেষ কথা হয়। রাফসান রাকিবকে ‘ছোট আব্বু’ বলে ডাকত। ফোনে কথা বলার সময় রাফসান রাকিবকে বলেছিল- ‘ছোট আব্বু তুমি বাড়ি চলে আসো। গাড়ি না পেলে তোমার বাইক নিয়ে চলে আসো। না হয় তুমি অ্যাম্বুলেন্সে বাড়ি চলে আসো।’ কে জানতো চার বছরের অবুঝ শিশুটির সেই কথাই এমন নির্মম বাস্তবে পরিণতি পেয়ে যাবে! রাকিব বাড়ি ফিরেছে ঠিকই। প্রিয় বাইক কিংবা গাড়িতে নয়, বরং নিথর দেহে অ্যাম্বুলেন্সে চেপেই শেষবারের মতো বাড়ি ফেরা হলো তার।
আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ছেলের শোকে রাতে বিছানায় ঘুমাতে পারি না। আমার খোকার সখের মোটরসাইকেল, পড়ার টেবিল, হেলমেট, বই-পত্র দেখলেই বুক ফেটে কান্না আসে।’ ঘরে সবই আছে, কেবল আমার খোকা নেই।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত শহিদের গল্প

‘ঘরে সবই আছে, কেবল রাকিব নেই’

আপলোড টাইম : ০৯:৩৯:০৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪

এখনও ফ্রিজে জমানো রয়েছে দুধ, গুড়, নারকেল ও পুলিপিঠার পুর। নিস্তব্ধ ঘরে প্রতিটি জিনিস পরিপাটি সাজানো। টান টান করা বিছানার এক পাশে বালিশ। পড়ার টেবিলে তাকে তাকে সাজানো বই। ড্রয়িং রুমে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে প্রিয় মোটরসাইকেল। তার পাশেই কাপড় ধোয়ার মেশিন। পানিশূন্য পানির ফিল্টারের ভেতরটা শুষ্ক, আয়রনের হালকা আস্তর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই রাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হোসেন (২৯)।
রাকিব চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকতেন। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে তার ঘরটা সবসময় এমনই সাজানো থাকতো তার অপেক্ষায়। পরিপাটি ঘরটি দেখে মনে হবে খানিক পরেই ফিরবে রাকিব। একটা বাড়িতে তিনজনের বসবাস। কিন্তু কোথাও যেন কেউ নেই। নেই কোনো শব্দ। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে যে ঝরে পড়া আরেক নক্ষত্র মো. রাকিবুল হোসেন। যে বাড়িতে বিপ্লবী নক্ষত্রের ঝরে পড়া স্মৃতি জমা থাকে, সেখানে কি আর কখনো শোরগোল জমে? রাকিব শহিদ হয়েছেন আজ ৯২ দিন। কিন্তু তার পরিবারের শোকের মাতম আজও থামেনি।
ঝিনাইদহ জেলার সদর পৌরসভার সার্কিট হাউজ রোডের মহিষাকুণ্ডু গ্রামের বাসিন্দা বিমান বাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন অফিসার (অব.) আবু বকর সিদ্দিক (৬১) এবং হাফিজা খাতুন (৫৮) দম্পতির আদরের ধন রাকিবুল হোসেন। তিনি ঢাকার বনানী সুপার জুট মিলে চাকরি করতেন। ঢাকার মিরপুরে ১১ নম্বরে ভাড়া বাসায় থাকতেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে রাকিব ছোট। বড় ভাই ইকবাল হোসেন (৩৭) সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে ঝিনাইদহ শাখায় কর্মরত।
শহিদ রাকিবের পিতা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমরা রাকিবকে ফোন করলে সে লোকজনের ভিড় থেকে সরে গিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলত। সে যে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, এটা সে আমাদের বুঝতে দিতে চাইতো না। এসব কথা রাকিবুলের সহকর্মীরা পরে আমাদের জানিয়েছে।’
রাকিবের মা হাফিজা খাতুন বলেন, ‘১৮ জুলাই ঢাকায় যখন আন্দোলনে হামলা শুরু হয়, তখন থেকেই আমরা ভয়ে ছিলাম। শুধু ভাবতাম আমার রাকিব অফিসে যাবে কীভাবে? ১৯ জুলাই শুক্রবার রাকিবকে ফোন করে বললাম, আব্বু অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফেরা যাবে না? প্রতি উত্তরে সে বলেছিল, না মা, ফেরা যাবে না।’ তবে ফিরেছে লাশ হয়ে। এ কথা বলে তার মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। নিজেকে সামলে আবার বলতে শুরু করে বলেন, ‘১৯ জুলাই, শুক্রবার, বেলা আড়াইটার পরে আমার ছেলের সঙ্গে শেষ কথা হয়। রুটি আর ডিম ভাজি দিয়ে সকালের নাস্তা করেছিল রাকিব।
হাফিজা খাতুন বলেন, ‘১৯ জুলাই মিরপুর-১১ তে মেট্রোরেল লাইনের নিচে আন্দোলনকারীদের মাঝে আমার ছেলে পানি বিতরণ করছিল। শিক্ষার্থীদের মাঝে সে যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ নিরাপদেই ছিল। যখনই সে পানি বিতরণ শেষে শিক্ষার্থীদের থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে যায়, তখনই তাকে টার্গেট করে গুলি করা হয়। আমার ছেলের সাথে থাকা সহকর্মীরা জানিয়েছে, ওপর থেকে গুলি এসে তার গলায় ঢুকে যায়। পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আমার ছেলেটা মারা যায়।’
রাকিবের বাবা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘আমার ছেলের বন্ধু পিয়াস জানিয়েছে, সে সময় একজন বয়স্ক মহিলা দৌঁড়ে রাস্তা পার হতে যেয়ে রাকিবের সামনে এসে পড়ে যায়। ওই সময় রাকিব তাকে টেনে তুলতে এগিয়ে গিয়েছিল। আর তখনই ওপর থেকে নিখুঁত টার্গেটে আমার ছেলেকে গুলি করা হয়।’ তিনি জানান, রাকিবের বন্ধু পিয়াস প্রথম বাড়িতে খবর দেন। পিয়াসই রাকিবের অফিসের সহকর্মী সালমান ও ফয়সালকে দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে মৃতদেহ ঢাকা থেকে ঝিনাইদহে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
হরিণাকুণ্ডু উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে শহিদ রাকিবকে দাফন করা হয়েছে। রাকিবের মা বলেন, ১৯ জুলাই রাত আটটার দিকে একমাত্র ভাতিজা রাফসানের (৪) সাথেই রাকিবের শেষ কথা হয়। রাফসান রাকিবকে ‘ছোট আব্বু’ বলে ডাকত। ফোনে কথা বলার সময় রাফসান রাকিবকে বলেছিল- ‘ছোট আব্বু তুমি বাড়ি চলে আসো। গাড়ি না পেলে তোমার বাইক নিয়ে চলে আসো। না হয় তুমি অ্যাম্বুলেন্সে বাড়ি চলে আসো।’ কে জানতো চার বছরের অবুঝ শিশুটির সেই কথাই এমন নির্মম বাস্তবে পরিণতি পেয়ে যাবে! রাকিব বাড়ি ফিরেছে ঠিকই। প্রিয় বাইক কিংবা গাড়িতে নয়, বরং নিথর দেহে অ্যাম্বুলেন্সে চেপেই শেষবারের মতো বাড়ি ফেরা হলো তার।
আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ছেলের শোকে রাতে বিছানায় ঘুমাতে পারি না। আমার খোকার সখের মোটরসাইকেল, পড়ার টেবিল, হেলমেট, বই-পত্র দেখলেই বুক ফেটে কান্না আসে।’ ঘরে সবই আছে, কেবল আমার খোকা নেই।