ইপেপার । আজ মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪

ফের আলোচনায় শেখ হাসিনার ‘পদত্যাগপত্র’

সমীকরণ প্রতিবেদন:
  • আপলোড টাইম : ০৯:৪৯:০৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪
  • / ৩ বার পড়া হয়েছে

ফের আলোচনায় শেখ হাসিনার ‘পদত্যাগপত্র’

পালিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার প্রায় আড়াই মাস পর আবারো আলোচনায় ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র’। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ৫ আগস্ট তার কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে যাননি- গত রোববার প্রকাশিত একটি পত্রিকার সম্পাদকের লেখায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের এমন বক্তব্যের পর নানা আলোচনা তৈরি হয়েছে। স্পষ্টতই, বিরক্ত ও বিব্রত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংশ্লিষ্টরা। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কারো কারো মন্তব্যেও। রাষ্ট্রপতির এমন বক্তব্য শপথ লঙ্ঘনের শামিল মন্তব্য করে তার স্বপদে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক উপদেষ্টা। আর রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া দরকার, তার জায়গা কোথায় হওয়া দরকার, তা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ নতুন করে নির্ধারণ করবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অন্যদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি মীমাংসিত এবং এ বিষয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল কিংবা বিব্রত করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। অবশ্য শেখ হাসিনার ‘পদত্যাগ’ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে দেশে কোনো সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হবে না বলে উল্লেখ করেছেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।
প্রসঙ্গত, একটি পত্রিকার সম্পাদকের কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন মন্তব্য করেছেন শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট তার কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে যাননি। ‘উনি তো কিছুই বলে গেলেন না…’ শিরোনামে গত রোববার প্রকাশিত লেখায় মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী উল্লেখ করেছেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন কি করেননি এই নিয়ে বিতর্ক এখনো জারি রয়েছে। হয়ত অনেক দিন থাকবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় একাধিকবার দাবি করেছেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান মিডিয়ার সামনে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের খবর জানিয়েছিলেন।’
তিন সপ্তাহ ধরে এই বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে শেষ পর্যন্ত বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের মুখোমুখি হন মতিউর রহমান চৌধুরী। লিখেন- ‘আপনার কাছে কি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্রটা আছে- এমন প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রপতি বলেন, আমি শুনেছি তিনি পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু আমার কাছে কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি হয়ত সময় পাননি’। এর আগে আগস্ট মাসে ‘আমার মা পদত্যাগ করেননি’ বলে রয়টার্সকে জানিয়েছিলেন তার ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। ভারতে চলে যাওয়ার আগে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেননি এবং সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনের উদ্দেশে রওনা দেয়ায় তিনি চলে যান বলে মন্তব্য করেন তিনি। জয় বলেন, ‘মা কখনই আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেননি। তিনি সময় পাননি। তিনি একটি বিবৃতি দিয়ে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে মিছিল নিয়ে যেতে শুরু করে। সময় ছিল না। তিনি ব্যাগ গোছানোর সময়টুকুও পাননি। যতদূর জানি, সংবিধান অনুযায়ী তিনি এখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।’ জয় ওই সময় বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি সামরিক প্রধান ও বিরোধী রাজনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা করে সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ না করায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগ ইস্যু নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি না করার আহ্বান রাষ্ট্রপতির :
এদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি মীমাংসিত এবং এ বিষয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল কিংবা বিব্রত করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। গতকাল সোমবার রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের উপপ্রেস সচিব শিপলু জামানের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ইস্যুতে রাষ্ট্রপতিকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে প্রচারণা চালানো হয়েছে তা জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে সুস্পস্ট বক্তব্য হলো, ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও দেশত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেয়া এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতার ওপর যত ধরনের প্রশ্ন জনমনে উদ্রেক হয়েছে সেগুলোর যাবতীয় উত্তর স্পেশাল রেফারেন্স নম্বর-০১/২০২৪ এ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের গত ৮ আগস্টের আদেশে প্রতিফলিত হয়েছে। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ এই মতামত দিয়েছিলেন বলে এতে উল্লেখ করা হয়।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, মীমাংসিত এ বিষয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল কিংবা বিব্রত করা থেকে বিরত থাকার জন্য রাষ্ট্রপতি সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আপিল বিভাগের ওই স্পেশাল রেফারেন্সে বলা হয়েছিল, দেশের বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং রাষ্ট্রপতি গত ৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েছেন, সেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) অনুসারে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেয়া সম্ভবপর নয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার বিষয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ থেকে ৮ আগস্টের একটি চিঠিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত যাচনা করা হয়েছে।
শপথ ভঙ্গের শামিল- আইন উপদেষ্টা :
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের বক্তব্য মিথ্যাচার, শপথ লঙ্ঘনের শামিল বলে মন্তব্য করেছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি যে বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পাননি, এটা মিথ্যাচার এবং শপথ লঙ্ঘনের শামিল। কারণ, তিনি নিজেই ৫ আগস্ট রাত ১১টা ২০ মিনিটে পেছনে তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং তিনি তা গ্রহণ করেছেন।
আইন উপদেষ্টা বলেন, এরপর রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে জানতে চাওয়া হয়, এই পরিস্থিতিতে করণীয় কী? এটার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকরা মিলে একটা মতামত দেন। আইন উপদেষ্টা জানান, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে যে একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা যায়- সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এই মতামতের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি নোট রাষ্ট্রপতির দপ্তরে পাঠানো হয়। সেই মতামত রাষ্ট্রপতি দেখেছেন এবং গ্রহণ করেছেন। এরপর তিনি নিজেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছেন।
রাষ্ট্রপতির বক্তব্য দ্বিমুখী :
রাষ্ট্রপতির এমন বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রপতির কাছে মৌখিকভাবে পদত্যাগ করেছিলেন শেখ হাসিনা। পদত্যাগপত্র নিয়ে বঙ্গভবনে যাওয়ার কথা থাকলেও ছাত্র-জনতা গণভবনের কাছাকাছি চলে এলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর রাজনীতি করার জন্য দেশে ফিরতে পারবে না বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহও। এক ভিডিও বার্তায় হাসনাত বলেন, আওয়ামী শক্তির উত্থান ও পুনর্বাসন ঠেকাতে দল-মতনির্বিশেষে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি বলেছেন, শেখ হাসিনা তার কাছে কোনো পদত্যাগপত্র জমা দেননি।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

ফের আলোচনায় শেখ হাসিনার ‘পদত্যাগপত্র’

আপলোড টাইম : ০৯:৪৯:০৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪

পালিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার প্রায় আড়াই মাস পর আবারো আলোচনায় ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র’। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ৫ আগস্ট তার কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে যাননি- গত রোববার প্রকাশিত একটি পত্রিকার সম্পাদকের লেখায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের এমন বক্তব্যের পর নানা আলোচনা তৈরি হয়েছে। স্পষ্টতই, বিরক্ত ও বিব্রত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংশ্লিষ্টরা। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কারো কারো মন্তব্যেও। রাষ্ট্রপতির এমন বক্তব্য শপথ লঙ্ঘনের শামিল মন্তব্য করে তার স্বপদে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক উপদেষ্টা। আর রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া দরকার, তার জায়গা কোথায় হওয়া দরকার, তা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ নতুন করে নির্ধারণ করবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অন্যদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি মীমাংসিত এবং এ বিষয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল কিংবা বিব্রত করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। অবশ্য শেখ হাসিনার ‘পদত্যাগ’ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে দেশে কোনো সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হবে না বলে উল্লেখ করেছেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।
প্রসঙ্গত, একটি পত্রিকার সম্পাদকের কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন মন্তব্য করেছেন শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট তার কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে যাননি। ‘উনি তো কিছুই বলে গেলেন না…’ শিরোনামে গত রোববার প্রকাশিত লেখায় মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী উল্লেখ করেছেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন কি করেননি এই নিয়ে বিতর্ক এখনো জারি রয়েছে। হয়ত অনেক দিন থাকবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় একাধিকবার দাবি করেছেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান মিডিয়ার সামনে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের খবর জানিয়েছিলেন।’
তিন সপ্তাহ ধরে এই বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে শেষ পর্যন্ত বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের মুখোমুখি হন মতিউর রহমান চৌধুরী। লিখেন- ‘আপনার কাছে কি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্রটা আছে- এমন প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রপতি বলেন, আমি শুনেছি তিনি পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু আমার কাছে কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি হয়ত সময় পাননি’। এর আগে আগস্ট মাসে ‘আমার মা পদত্যাগ করেননি’ বলে রয়টার্সকে জানিয়েছিলেন তার ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। ভারতে চলে যাওয়ার আগে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেননি এবং সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনের উদ্দেশে রওনা দেয়ায় তিনি চলে যান বলে মন্তব্য করেন তিনি। জয় বলেন, ‘মা কখনই আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেননি। তিনি সময় পাননি। তিনি একটি বিবৃতি দিয়ে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে মিছিল নিয়ে যেতে শুরু করে। সময় ছিল না। তিনি ব্যাগ গোছানোর সময়টুকুও পাননি। যতদূর জানি, সংবিধান অনুযায়ী তিনি এখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।’ জয় ওই সময় বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি সামরিক প্রধান ও বিরোধী রাজনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা করে সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ না করায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগ ইস্যু নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি না করার আহ্বান রাষ্ট্রপতির :
এদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি মীমাংসিত এবং এ বিষয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল কিংবা বিব্রত করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। গতকাল সোমবার রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের উপপ্রেস সচিব শিপলু জামানের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ইস্যুতে রাষ্ট্রপতিকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে প্রচারণা চালানো হয়েছে তা জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে সুস্পস্ট বক্তব্য হলো, ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও দেশত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেয়া এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতার ওপর যত ধরনের প্রশ্ন জনমনে উদ্রেক হয়েছে সেগুলোর যাবতীয় উত্তর স্পেশাল রেফারেন্স নম্বর-০১/২০২৪ এ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের গত ৮ আগস্টের আদেশে প্রতিফলিত হয়েছে। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ এই মতামত দিয়েছিলেন বলে এতে উল্লেখ করা হয়।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, মীমাংসিত এ বিষয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল কিংবা বিব্রত করা থেকে বিরত থাকার জন্য রাষ্ট্রপতি সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আপিল বিভাগের ওই স্পেশাল রেফারেন্সে বলা হয়েছিল, দেশের বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং রাষ্ট্রপতি গত ৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েছেন, সেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) অনুসারে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেয়া সম্ভবপর নয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার বিষয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ থেকে ৮ আগস্টের একটি চিঠিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত যাচনা করা হয়েছে।
শপথ ভঙ্গের শামিল- আইন উপদেষ্টা :
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের বক্তব্য মিথ্যাচার, শপথ লঙ্ঘনের শামিল বলে মন্তব্য করেছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি যে বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পাননি, এটা মিথ্যাচার এবং শপথ লঙ্ঘনের শামিল। কারণ, তিনি নিজেই ৫ আগস্ট রাত ১১টা ২০ মিনিটে পেছনে তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং তিনি তা গ্রহণ করেছেন।
আইন উপদেষ্টা বলেন, এরপর রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে জানতে চাওয়া হয়, এই পরিস্থিতিতে করণীয় কী? এটার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকরা মিলে একটা মতামত দেন। আইন উপদেষ্টা জানান, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে যে একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা যায়- সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এই মতামতের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি নোট রাষ্ট্রপতির দপ্তরে পাঠানো হয়। সেই মতামত রাষ্ট্রপতি দেখেছেন এবং গ্রহণ করেছেন। এরপর তিনি নিজেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছেন।
রাষ্ট্রপতির বক্তব্য দ্বিমুখী :
রাষ্ট্রপতির এমন বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রপতির কাছে মৌখিকভাবে পদত্যাগ করেছিলেন শেখ হাসিনা। পদত্যাগপত্র নিয়ে বঙ্গভবনে যাওয়ার কথা থাকলেও ছাত্র-জনতা গণভবনের কাছাকাছি চলে এলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর রাজনীতি করার জন্য দেশে ফিরতে পারবে না বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহও। এক ভিডিও বার্তায় হাসনাত বলেন, আওয়ামী শক্তির উত্থান ও পুনর্বাসন ঠেকাতে দল-মতনির্বিশেষে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি বলেছেন, শেখ হাসিনা তার কাছে কোনো পদত্যাগপত্র জমা দেননি।