ইপেপার । আজ শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

‘টাকায় পদ কিনে মাঠে নামবে কেন’

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১১:২২:৫৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪
  • / ৫২ বার পড়া হয়েছে

আওয়ামী লীগে পদ-বাণিজ্য বন্ধের জোর দাবি উঠেছে। রাজধানীর থানা-ওয়ার্ড পর্যায়ের দলীয় একাধিক নেতা এ দাবি জানিয়ে বলেন, সম্মেলনের পর নতুন করে পদ নিতে গেলে অনেকেরই টাকা লাগছে। টাকা দিলেই পদ পাওয়া যাবে, এটা যেন এখন ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে। আর যেসব নেতা টাকায় পদ কিনেন তারা মাঠে নামবেন কেন? আর টাকা দিয়ে বেশির ভাগ পদ তো বাগিয়ে নিচ্ছেন হাইব্রিড, সুবিধাভোগী, বিতর্কিত ও স্বাধীনতাবিরোধী মতাদর্শীরা। দলের ক্রান্তিকালে এরা তো মাঠে থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখবেন দুর্দিনে ত্যাগী ও সত্যিকারের আদর্শ ধারণকারী নেতা-কর্মীরাই ঝুঁকি নেন। সুবিধাবাদী নেতাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। যা কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা চলাকালে চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সংকট নিয়ে গত তিন দিনের পর্যালোচনা সভায় তৃণমূলের নেতারা এ কথা বলেন। দীর্ঘদিন পর ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের থানা-ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত কমিটির তালিকা দুই সপ্তাহ আগে জমা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় দপ্তরে। অভিযোগ উঠেছে, কমিটিতে চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি, ফুটপাত-জমি দখলবাজ, ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত ও হত্যা মামলার আসামিরাও স্থান পেয়েছে। একটি পদের জন্য ১০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত নেতার পকেটে ঢুকেছে। পদ বাগাতে নেতাকে দামি গাড়ি উপহারেরও ঘটনা ঘটেছে। আবার মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েও বনিবনা না হওয়ায় ছিটকে পড়েন অনেকে। এমনকি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এসব কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রস্তাব করা হয়েছে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকের নামও। এছাড়া ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে শীর্ষ নেতার সন্তানসহ স্বজনের নামও তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে।
সূত্র জানায়, পর্যালোচনা সভায় এ প্রসঙ্গটি তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এই প্রস্তাবিত কমিটির কারণেই দলের অনেকেই সহিংসতা মোকাবিলায় মাঠে নামেননি। এ কারণে থানা-ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত কমিটি আর কখনো আলোর মুখ দেখবে না। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ বেশ কিছু এলাকা চিহ্নিত করেছে আওয়ামী লীগ। এসব এলাকার সংসদ সদস্য, দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী ও দলীয় কাউন্সিলরদের সঙ্গে ধারাবাহিক পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা ১১, ১৪, ১৫, ১৬ আসনের দলীয় সংসদ সদস্য, এসব এলাকার আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী ও দলীয় কাউন্সিলরদের সঙ্গে পর্যালোচনা সভা করেন ওবায়দুল কাদের। তেজগাঁওস্থ ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে হট্টগোলের ঘটনাও ঘটেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে সহিংসতা প্রতিরোধে ‘কে মাঠে ছিল, আর কে মাঠে ছিল না’ সেগুলো নিয়েই সভায় উচ্চবাক্য ও ‘চিল্লাচিল্লি’ হয় বলে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে। এক পক্ষ অপর পক্ষকে মাঠে না থাকার অভিযোগ করার পরিপ্রেক্ষিতে এই হট্টগোলের ঘটনা ঘটে।
সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, বি এম মোজাম্মেল হক, কার্যনির্বাহী সদস্য সাহাবুদ্দিন ফরাজী প্রমুখ। সভায় বিভিন্ন আসনের সংসদ সদস্য, থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলরা বক্তব্য রাখেন। নেতারা যখন বক্তব্য দেন, কর্মীরা তখন হট্টগোল শুরু করেন। হট্টগোলের কারণ জানতে চাইলে একাধিক নেতা বলেন, কোটা আন্দোলনের সময় ঢাকার বিভিন্ন স্থানে দুষ্কৃতকারীরা সহিংসতা চালায়। এসময় যারা প্রতিরোধ কর্মসূচিতে অংশ নেননি, তারা যখন নিজের অবস্থান তুলে ধরে নিজেকে জাহির করেন, তখন সেই এলাকার নেতা-কর্মীরাই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। নেতা-কর্মীদের হট্টগোল দেখে অনেক নেতাকেই বক্তব্য থেকে বসিয়ে দেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, মিরপুরের সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লা দেশের বাইরে অবস্থান করেছিলেন। তিনি দেশে না থাকলেও তার পক্ষে সেই এলাকার এক কাউন্সিলর গুণগান করতে শুরু করেন। তখন নেতা-কর্মীরা হট্টগোল শুরু করেন। বলতে থাকেন যে, তিনি (ইলিয়াস মোল্লা) তো দেশেই নেই। তার আবার অবস্থান কী? এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের এক সিনিয়র নেতা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে নেতাদের কাছ থেকে বিবরণ শুনতে কয়েক জনকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু বক্তব্য দিতে এসে অনেকে নিজের গুণগান গাইতে শুরু করেন। আবার অনেকে মাঠে ছিলেন না, তাদের বক্তব্য দিতে দেখে অনেকে উত্তেজিত হয়ে যান। তখন তাদের আমরা বসিয়ে দেই।
মহানগর ও যুবলীগের দুই নেতার বাগিবতণ্ডা :
জানা গেছে, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় পর্যালোচনা সভায় থানা ও ওয়ার্ডের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-১৪ আসনের এমপি মাইনুল হোসেন খান নিখিল দ্বন্দ্বে জড়ান। পুরো সময় দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে এক পক্ষকে হেয় করে অন্য পক্ষ স্লোগান দিতে থাকে। পরে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সাময়িক সময়ের জন্য শান্ত হলেও থেমে থেমে চলে হট্টগোল। একপর্যায়ে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খানকে বেয়াদব বলায় তিনি উচ্চ স্বরে তেড়ে এসে কথা বলতে থাকেন। এই পর্যায়ে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমসহ কেন্দ্রীয় নেতারা দুজনকে থামিয়ে মিলিয়ে দেন। সভা অসমাপ্ত রেখে আলাদা কক্ষে ঐ দুই নেতাকে নিয়ে মিলিয়ে দেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
সভা সূত্র জানায়, মতবিনিময় সভার শুরুতে কাফরুল থানার ৯৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক আমির উদ্দিন বক্তব্য দেন। তিনি তার এলাকার সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদারের পক্ষে বক্তব্য দেন। তিনি জানান, কামাল আহমেদ মজুমদারের নির্দেশে তিনি মাঠে ছিলেন। এমন বক্তব্যের পরই নেতা-কর্মীরা হট্টগোল শুরু করেন। ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের ভাষ্য, কামাল আহমেদ মজুমদার ও তার অনুসারীরা কেউ ওই এলাকায় ছিলেন না। পক্ষে-বিপক্ষে স্লোগান চলতে থাকে। এসময় মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি মানা করলেও যে যার অবস্থাান থেকে চিৎকার করতে থাকেন। পরে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম হুঁশিয়ারি দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর বক্তব্য দেন কাফরুল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি জামাল মোস্তফা। তিনি তার বক্তব্যে দলের সমন্বয়হীনতা এবং দলের থানা ওয়ার্ডের কমিটি না থাকার কথা বলেন। এই পরিস্থািতি থেকে উত্তরণের জন্য দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এ সময় উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি তাকে থামিয়ে দেন। তিনি সবাইকে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কথা বলার জন্য অনুরোধ করেন।
পরে সভা সমাপ্ত ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘আপনারা কারা মাঠে ছিলেন আর কারা মাঠে ছিলেন না, আমাদের কাছে সব তথ্য আছে। আপনারা দলের পদে থেকে ঘরে বসে থাকবেন? দলের খারাপ সময়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখবেন? তা হতে পারে না। যারা মাঠে ছিলেন না, তাদের তালিকা হচ্ছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তালিকা ধরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ সভায় উত্তর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘আমরা একটা উদ্দেশ্য নিয়ে আজকের সভা করেছি। কিন্তু আপনাদের যে উপস্থিতি, তাতে আমাদের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়নি। আমরা আরো উপস্থিতি আসা করেছিলাম।’ এ সময় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। পরে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে সভাস্থাল ত্যাগ করেন তিনি।
মাঠে না নামায় ভেঙে দেওয়া হলো আ.লীগের ২৭টি ইউনিট:
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা প্রতিরোধ কর্মসূচিতে অংশ না নেওয়ায় ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের অন্তর্গত মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরেবাংলা নগর থানার ২৭টি ইউনিট আওয়ামী লীগের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় মোহাম্মদপর সূচনা কমিউনিটি সেন্টারে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের অন্তর্গত ঢাকা-১৩ আসনের তিন থানা ও ওয়ার্ড নেতাদের নিয়ে এক মতবিনিময় সভায় এসব কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

 

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

‘টাকায় পদ কিনে মাঠে নামবে কেন’

আপলোড টাইম : ১১:২২:৫৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪

আওয়ামী লীগে পদ-বাণিজ্য বন্ধের জোর দাবি উঠেছে। রাজধানীর থানা-ওয়ার্ড পর্যায়ের দলীয় একাধিক নেতা এ দাবি জানিয়ে বলেন, সম্মেলনের পর নতুন করে পদ নিতে গেলে অনেকেরই টাকা লাগছে। টাকা দিলেই পদ পাওয়া যাবে, এটা যেন এখন ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে। আর যেসব নেতা টাকায় পদ কিনেন তারা মাঠে নামবেন কেন? আর টাকা দিয়ে বেশির ভাগ পদ তো বাগিয়ে নিচ্ছেন হাইব্রিড, সুবিধাভোগী, বিতর্কিত ও স্বাধীনতাবিরোধী মতাদর্শীরা। দলের ক্রান্তিকালে এরা তো মাঠে থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখবেন দুর্দিনে ত্যাগী ও সত্যিকারের আদর্শ ধারণকারী নেতা-কর্মীরাই ঝুঁকি নেন। সুবিধাবাদী নেতাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। যা কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা চলাকালে চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সংকট নিয়ে গত তিন দিনের পর্যালোচনা সভায় তৃণমূলের নেতারা এ কথা বলেন। দীর্ঘদিন পর ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের থানা-ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত কমিটির তালিকা দুই সপ্তাহ আগে জমা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় দপ্তরে। অভিযোগ উঠেছে, কমিটিতে চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি, ফুটপাত-জমি দখলবাজ, ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত ও হত্যা মামলার আসামিরাও স্থান পেয়েছে। একটি পদের জন্য ১০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত নেতার পকেটে ঢুকেছে। পদ বাগাতে নেতাকে দামি গাড়ি উপহারেরও ঘটনা ঘটেছে। আবার মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েও বনিবনা না হওয়ায় ছিটকে পড়েন অনেকে। এমনকি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এসব কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রস্তাব করা হয়েছে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকের নামও। এছাড়া ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে শীর্ষ নেতার সন্তানসহ স্বজনের নামও তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে।
সূত্র জানায়, পর্যালোচনা সভায় এ প্রসঙ্গটি তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এই প্রস্তাবিত কমিটির কারণেই দলের অনেকেই সহিংসতা মোকাবিলায় মাঠে নামেননি। এ কারণে থানা-ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত কমিটি আর কখনো আলোর মুখ দেখবে না। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ বেশ কিছু এলাকা চিহ্নিত করেছে আওয়ামী লীগ। এসব এলাকার সংসদ সদস্য, দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী ও দলীয় কাউন্সিলরদের সঙ্গে ধারাবাহিক পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা ১১, ১৪, ১৫, ১৬ আসনের দলীয় সংসদ সদস্য, এসব এলাকার আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী ও দলীয় কাউন্সিলরদের সঙ্গে পর্যালোচনা সভা করেন ওবায়দুল কাদের। তেজগাঁওস্থ ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে হট্টগোলের ঘটনাও ঘটেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে সহিংসতা প্রতিরোধে ‘কে মাঠে ছিল, আর কে মাঠে ছিল না’ সেগুলো নিয়েই সভায় উচ্চবাক্য ও ‘চিল্লাচিল্লি’ হয় বলে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে। এক পক্ষ অপর পক্ষকে মাঠে না থাকার অভিযোগ করার পরিপ্রেক্ষিতে এই হট্টগোলের ঘটনা ঘটে।
সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, বি এম মোজাম্মেল হক, কার্যনির্বাহী সদস্য সাহাবুদ্দিন ফরাজী প্রমুখ। সভায় বিভিন্ন আসনের সংসদ সদস্য, থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলরা বক্তব্য রাখেন। নেতারা যখন বক্তব্য দেন, কর্মীরা তখন হট্টগোল শুরু করেন। হট্টগোলের কারণ জানতে চাইলে একাধিক নেতা বলেন, কোটা আন্দোলনের সময় ঢাকার বিভিন্ন স্থানে দুষ্কৃতকারীরা সহিংসতা চালায়। এসময় যারা প্রতিরোধ কর্মসূচিতে অংশ নেননি, তারা যখন নিজের অবস্থান তুলে ধরে নিজেকে জাহির করেন, তখন সেই এলাকার নেতা-কর্মীরাই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। নেতা-কর্মীদের হট্টগোল দেখে অনেক নেতাকেই বক্তব্য থেকে বসিয়ে দেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, মিরপুরের সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লা দেশের বাইরে অবস্থান করেছিলেন। তিনি দেশে না থাকলেও তার পক্ষে সেই এলাকার এক কাউন্সিলর গুণগান করতে শুরু করেন। তখন নেতা-কর্মীরা হট্টগোল শুরু করেন। বলতে থাকেন যে, তিনি (ইলিয়াস মোল্লা) তো দেশেই নেই। তার আবার অবস্থান কী? এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের এক সিনিয়র নেতা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে নেতাদের কাছ থেকে বিবরণ শুনতে কয়েক জনকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু বক্তব্য দিতে এসে অনেকে নিজের গুণগান গাইতে শুরু করেন। আবার অনেকে মাঠে ছিলেন না, তাদের বক্তব্য দিতে দেখে অনেকে উত্তেজিত হয়ে যান। তখন তাদের আমরা বসিয়ে দেই।
মহানগর ও যুবলীগের দুই নেতার বাগিবতণ্ডা :
জানা গেছে, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় পর্যালোচনা সভায় থানা ও ওয়ার্ডের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-১৪ আসনের এমপি মাইনুল হোসেন খান নিখিল দ্বন্দ্বে জড়ান। পুরো সময় দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে এক পক্ষকে হেয় করে অন্য পক্ষ স্লোগান দিতে থাকে। পরে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সাময়িক সময়ের জন্য শান্ত হলেও থেমে থেমে চলে হট্টগোল। একপর্যায়ে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খানকে বেয়াদব বলায় তিনি উচ্চ স্বরে তেড়ে এসে কথা বলতে থাকেন। এই পর্যায়ে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমসহ কেন্দ্রীয় নেতারা দুজনকে থামিয়ে মিলিয়ে দেন। সভা অসমাপ্ত রেখে আলাদা কক্ষে ঐ দুই নেতাকে নিয়ে মিলিয়ে দেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
সভা সূত্র জানায়, মতবিনিময় সভার শুরুতে কাফরুল থানার ৯৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক আমির উদ্দিন বক্তব্য দেন। তিনি তার এলাকার সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদারের পক্ষে বক্তব্য দেন। তিনি জানান, কামাল আহমেদ মজুমদারের নির্দেশে তিনি মাঠে ছিলেন। এমন বক্তব্যের পরই নেতা-কর্মীরা হট্টগোল শুরু করেন। ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের ভাষ্য, কামাল আহমেদ মজুমদার ও তার অনুসারীরা কেউ ওই এলাকায় ছিলেন না। পক্ষে-বিপক্ষে স্লোগান চলতে থাকে। এসময় মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি মানা করলেও যে যার অবস্থাান থেকে চিৎকার করতে থাকেন। পরে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম হুঁশিয়ারি দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর বক্তব্য দেন কাফরুল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি জামাল মোস্তফা। তিনি তার বক্তব্যে দলের সমন্বয়হীনতা এবং দলের থানা ওয়ার্ডের কমিটি না থাকার কথা বলেন। এই পরিস্থািতি থেকে উত্তরণের জন্য দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এ সময় উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি তাকে থামিয়ে দেন। তিনি সবাইকে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কথা বলার জন্য অনুরোধ করেন।
পরে সভা সমাপ্ত ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘আপনারা কারা মাঠে ছিলেন আর কারা মাঠে ছিলেন না, আমাদের কাছে সব তথ্য আছে। আপনারা দলের পদে থেকে ঘরে বসে থাকবেন? দলের খারাপ সময়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখবেন? তা হতে পারে না। যারা মাঠে ছিলেন না, তাদের তালিকা হচ্ছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তালিকা ধরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ সভায় উত্তর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘আমরা একটা উদ্দেশ্য নিয়ে আজকের সভা করেছি। কিন্তু আপনাদের যে উপস্থিতি, তাতে আমাদের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়নি। আমরা আরো উপস্থিতি আসা করেছিলাম।’ এ সময় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। পরে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে সভাস্থাল ত্যাগ করেন তিনি।
মাঠে না নামায় ভেঙে দেওয়া হলো আ.লীগের ২৭টি ইউনিট:
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা প্রতিরোধ কর্মসূচিতে অংশ না নেওয়ায় ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের অন্তর্গত মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরেবাংলা নগর থানার ২৭টি ইউনিট আওয়ামী লীগের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় মোহাম্মদপর সূচনা কমিউনিটি সেন্টারে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের অন্তর্গত ঢাকা-১৩ আসনের তিন থানা ও ওয়ার্ড নেতাদের নিয়ে এক মতবিনিময় সভায় এসব কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।