ইপেপার । আজ শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪
ধাবমান প্রজন্মের কাছে সমাজের অসুরদের জবাবদিহিতা আছে

চুয়াডাঙ্গায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সাথে মতবিনিময়কালে খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি রেজাউল হক

পারষ্পারিক সহযোগিতায় আমরা সুন্দর ও ঐক্যের চুয়াডাঙ্গা গড়তে চাই : বিএনপি নেতা শরীফ

নিজস্ব প্রতিবেদক:
  • আপলোড টাইম : ০৮:৪১:৫০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪
  • / ২১ বার পড়া হয়েছে




নিজের মতো করে আইন প্রয়োগ করে আইন ব্যবহারের যেই সংস্কৃতি, সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে জুলাই-আগস্টের মুভমেন্টের মতো আবারও সামাজিক শক্তির কাছে মুখোমুখি হতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি রেজাউল হক, পিপিএম।
গতকাল শনিবার দুপুরে চুয়াডাঙ্গায় পূজা মন্দির পরিদর্শন ও মতবিনিময় সভায় এ কথা বলেন তিনি। চুয়াডাঙ্গার পুলিশ সুপার খন্দকার গোলাম মওলার সভাপতিত্বে সভায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সাথে মতবিনিময়কালে রেঞ্জ ডিআইজি রেজাউল হক আরও বলেন, যারা নানা ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত, সমাজকে বিভাজন করতে চায়, তারাই সমাজের অসুর। এ সমাজ এগিয়ে যাবে। এটাকে আপনি কিছু কালের জন্য থমকে দিতে পারেন, স্টপ করতে পারেন। কিন্তু সম্ভব না, সামনের দিনে ধাবমান প্রজন্মের কাছে আপনার একাউন্টিবিলিটি (জবাবদিহি) আছে।
রেজাউল হক বলেন, এখনো পেশাদার পুলিশ অফিসার রয়েছে। আমাদের প্রতি আস্থা রাখবেন, প্রয়োজনে আমাদের মনিটরিং করবেন। আমাদের ভুল-ত্রুটি দেখিয়ে দেন, যাতে আমরা সঠিক পথে চলতে পারি। একই সাথে যখন আপনি আমার ভুল দেখাবেন, তখন আপনি যেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুলের পথে পরিচালিত না হন।
তিনি জানান, জেলা পর্যায়ের পূজা উদ্যাপন কমিটি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নাম ও মোবাইল নম্বরসহ একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এই তালিকা অনুসারে আমরা প্রতিটি মণ্ডপ সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করছি, যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ডিআইজি রেজাউল হক বলেন, ‘পুলিশ বাহিনী অতন্দ্র প্রহরীর মতো আপনাদের নিরাপত্তা রক্ষায় সদা প্রস্তুত রয়েছে। পূজামণ্ডপগুলোতে কোনোরকম বিশৃঙ্খলা বা সমস্যার সৃষ্টি হলে দ্রুততম সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সনাতন ধর্মাবলম্বী পূজার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘এই দেশ আপনার, স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই সমান। আপনারা ভীত না হয়ে নির্বিঘ্নে আপনাদের সকল আচার-অনুষ্ঠান পালন করবেন। আমাদের দায়িত্ব আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।’
স্বাধীনতার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সবাই এক হয়ে দেশ রক্ষায় এগিয়ে এসেছিল। তখন কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিস্টান, এসব কোনো ভেদাভেদ ছিল না। আমরা সবাই বাঙালি ছিলাম, আর সেটিই ছিল আমাদের একমাত্র পরিচয়। আজও সেই স্বাধীনতা সকলের, প্রতিটি নাগরিকের এই দেশে সমান অধিকার রয়েছে। প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের অধিকার রাখে।’
ডিআইজি রেজাউল হক তাঁর বক্তব্যে আরও বলেন, দেশের প্রতিটি নাগরিকের নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা উচিত। তিনি উল্লেখ করেন, ‘একজন নাগরিক হিসেবে দেশের প্রতি আমাদের যে দায়িত্ব রয়েছে, তা পালন করা আমাদের নৈতিক কর্তব্য। দেশকে ভালোবেসে তার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। জাতি গঠনে সকলের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা জরুরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সন্তানের সুশিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করা প্রতিটি পরিবারের দায়িত্ব। আমরা যদি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত করতে পারি, তবেই আমরা একটি শক্তিশালী ও উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।’ তিনি অভিভাবকদের আহ্বান জানান, সন্তানদের শুধু একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত না করে, তাদের সঠিক মানবিক মূল্যবোধ এবং দেশপ্রেমের শিক্ষা দিতে।
ডিআইজি বলেন, ‘শিক্ষাই একটি জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে, আর সেই শিক্ষা শুরু হয় পরিবার থেকেই। তাই প্রত্যেক বাবা-মাকে তার সন্তানের সুশিক্ষা ও নৈতিক উন্নতির দিকে নজর দিতে হবে, যাতে তারা একজন সৎ, দক্ষ, এবং দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে উঠতে পারে।’


ডিআইজি মো. রেজাউল হক তাঁর বক্তব্যে বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘মাস্টারদা সূর্য সেন আমাদের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নাম। তিনি আগে পূজা করেননি, আগে সংগ্রাম করেছেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল দেশের স্বাধীনতা এবং নিপীড়িত মানুষের মুক্তি। পূজা বা আচার-অনুষ্ঠান তখন তাঁর কাছে অপেক্ষা করেছিল, কারণ তিনি প্রথমে নিজের জাতির মুক্তির জন্য লড়াই করেছিলেন। এই মহান বিপ্লবীর জীবন আমাদের শেখায় যে, নিজের অধিকার ও দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামই সবচেয়ে বড় পূজা।’
ডিআইজি মো. রেজাউল হক তাঁর বক্তব্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘আমাদের দেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলন বারবার বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। সেই আন্দোলন আমাদের শিখিয়েছে জাতি, ধর্ম বা সম্প্রদায়ের ভেদাভেদ ভুলে আমরা একত্রিত হয়ে দেশের স্বার্থে কাজ করতে পারি।’
তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আগামী প্রজন্ম আমাদেরই সন্তান। আমরা যেন এমন একটি সমাজ ও পরিবেশ রেখে যেতে পারি, যেখানে তারা তাদের স্বাধীনতা পূর্ণভাবে উপভোগ করতে পারে। দেশের সেবায় সকল ধর্মের মানুষের সঙ্গে ঐক্য বজায় রেখে চলার মানসিকতা তাদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। এই দায়িত্ব আমাদেরই।’
পূজামণ্ডপের সৌন্দর্য ও লাইটিং সম্পর্কেও তিনি বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা সবার আগে, আর এটি শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, যদি সবার সহযোগিতা না থাকে। পূজার আয়োজনের ক্ষেত্রে আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।’
তিনি পূজা উদ্যাপন কমিটির নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে আরও বলেন, ‘যদি লাইটিং পূজার অপরিহার্য অংশ না হয়, তাহলে সেই অর্থ সাশ্রয় করে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা যেতে পারে। এটি মণ্ডপ এবং পূজার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা হবে। আমি আশা করি, আগামীতে আপনারা এ বিষয়টি বিবেচনা করবেন এবং সবার নিরাপত্তার জন্য পদক্ষেপ নেবেন।’
ডিআইজি রেজাউল হক তাঁর বক্তব্যে মণ্ডপগুলোতে উপস্থিত থেকে সার্বিক নিরাপত্তা এবং উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় রাখতে সহযোগিতা করায় রাজনৈতিক নেতা, সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের ধন্যবাদ জানান।
মতবিনিময়কালে চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সদস্যসচিব শরীফুজ্জামান শরীফ বলেন, ‘আজ মন্দির কমিটির সভাপতি-সেক্রেটারির বক্তব্য শুনে ভালো লেগেছে। তারা বললেন, “মনে হচ্ছে আমরা আলোর দিকে ফিরে এসেছি। আগে যেন কোনো গুহার মধ্যে আবদ্ধ ছিলাম। আপনারা আমদেরকে এভাবে ভালোবাসবেন এবং আমাদের পাশে থেকে সমান ধর্ম এবং উৎসব পালনে সমান অধিকার আদায় করে দেবেন, কখনো এটা চিন্তা করিনি।”
শরীফুজ্জামান বলেন, ‘আমি চুয়াডাঙ্গা সদর ও আলমডাঙ্গার বিভিন্ন মন্দির পরিদর্শন করেছি। প্রতিটি মণ্ডপে দেখেছি মসজিদে আজান এবং জামাতের সময়সূচি তারা রেখেছেন। যেন আজান এবং নামাজের সময় বাদ রেখে তারা ঢাক-ঢোল বাজাতে পারেন। এই ভ্রাতৃত্ববোধের জন্য আমি সনাতন ধর্মের নের্তৃবৃন্দ, আমাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীবৃন্দ এবং সাধারণ জনগণের প্রতি ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘এবার একটি ভিন্ন আয়োজনও আমরা করতে চাই। সকলের সমন্বয় করে একটি কমিটি গঠন করে দেব। যেই কমিটি সবগুলো মণ্ডপ পর্যালোচনা করবে এবং সেরা তিনটি মণ্ডপকে পুরস্কৃত করা হবে।’ শরীফুজ্জামান বলেন, ‘আমরা সবসময় এই বিষয়টি মনে রাখতে চাই, আমরা সবাই বাংলাদেশী। যে ধর্মেরই মানুষ হই না কেন, আমরা সবাই চুয়াডাঙ্গাবাসী। এখানে প্রত্যেকেরই নিজ নিজ ধর্ম পালনের সমান অধিকার আছে। একে অপরকে সহযোগিতা করে আমরা সুন্দর ও ঐক্যের চুয়াডাঙ্গা গড়তে চাই।’
জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির অ্যাড. রুহুল আমিন তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা সবসময় শান্তি, সম্প্রীতি, এবং সহমর্মিতার পক্ষে। সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সৌহার্দ্য বজায় রেখে সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হবে।’ এসময় তিনি সমাজের উন্নয়নে সকলকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।
শহরের বড় বাজার দুর্গা মন্দিরে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন অতিরিক্ত ডিআইজি হাসানুজ্জামান, চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম, জেলা বিএনপির সদস্যসচিব শরীফুজ্জামান, জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির রুহুল আমীন, দৈনিক সময়ের সমীকরণ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক নাজমুল হক স্বপন, চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সহসভাপতি রফিক রহমান, জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ডা. মার্টিন হীরক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত কুমার সিংহ রায়, শারদীয় দুর্গা উৎসব পালন বিষয়ক জেলা সমন্বয়ক হেমন্ত কুমার সিংহ রায় চুয়াডাঙ্গাসহ পূজা উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দ। অনুষ্ঠানটি পচিালনা করেন কিংকর কুমার দে ও পলাশ কুমার সাহা।

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

ধাবমান প্রজন্মের কাছে সমাজের অসুরদের জবাবদিহিতা আছে

চুয়াডাঙ্গায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সাথে মতবিনিময়কালে খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি রেজাউল হক

পারষ্পারিক সহযোগিতায় আমরা সুন্দর ও ঐক্যের চুয়াডাঙ্গা গড়তে চাই : বিএনপি নেতা শরীফ

আপলোড টাইম : ০৮:৪১:৫০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪




নিজের মতো করে আইন প্রয়োগ করে আইন ব্যবহারের যেই সংস্কৃতি, সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে জুলাই-আগস্টের মুভমেন্টের মতো আবারও সামাজিক শক্তির কাছে মুখোমুখি হতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি রেজাউল হক, পিপিএম।
গতকাল শনিবার দুপুরে চুয়াডাঙ্গায় পূজা মন্দির পরিদর্শন ও মতবিনিময় সভায় এ কথা বলেন তিনি। চুয়াডাঙ্গার পুলিশ সুপার খন্দকার গোলাম মওলার সভাপতিত্বে সভায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সাথে মতবিনিময়কালে রেঞ্জ ডিআইজি রেজাউল হক আরও বলেন, যারা নানা ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত, সমাজকে বিভাজন করতে চায়, তারাই সমাজের অসুর। এ সমাজ এগিয়ে যাবে। এটাকে আপনি কিছু কালের জন্য থমকে দিতে পারেন, স্টপ করতে পারেন। কিন্তু সম্ভব না, সামনের দিনে ধাবমান প্রজন্মের কাছে আপনার একাউন্টিবিলিটি (জবাবদিহি) আছে।
রেজাউল হক বলেন, এখনো পেশাদার পুলিশ অফিসার রয়েছে। আমাদের প্রতি আস্থা রাখবেন, প্রয়োজনে আমাদের মনিটরিং করবেন। আমাদের ভুল-ত্রুটি দেখিয়ে দেন, যাতে আমরা সঠিক পথে চলতে পারি। একই সাথে যখন আপনি আমার ভুল দেখাবেন, তখন আপনি যেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুলের পথে পরিচালিত না হন।
তিনি জানান, জেলা পর্যায়ের পূজা উদ্যাপন কমিটি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নাম ও মোবাইল নম্বরসহ একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এই তালিকা অনুসারে আমরা প্রতিটি মণ্ডপ সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করছি, যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ডিআইজি রেজাউল হক বলেন, ‘পুলিশ বাহিনী অতন্দ্র প্রহরীর মতো আপনাদের নিরাপত্তা রক্ষায় সদা প্রস্তুত রয়েছে। পূজামণ্ডপগুলোতে কোনোরকম বিশৃঙ্খলা বা সমস্যার সৃষ্টি হলে দ্রুততম সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সনাতন ধর্মাবলম্বী পূজার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘এই দেশ আপনার, স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই সমান। আপনারা ভীত না হয়ে নির্বিঘ্নে আপনাদের সকল আচার-অনুষ্ঠান পালন করবেন। আমাদের দায়িত্ব আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।’
স্বাধীনতার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সবাই এক হয়ে দেশ রক্ষায় এগিয়ে এসেছিল। তখন কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিস্টান, এসব কোনো ভেদাভেদ ছিল না। আমরা সবাই বাঙালি ছিলাম, আর সেটিই ছিল আমাদের একমাত্র পরিচয়। আজও সেই স্বাধীনতা সকলের, প্রতিটি নাগরিকের এই দেশে সমান অধিকার রয়েছে। প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের অধিকার রাখে।’
ডিআইজি রেজাউল হক তাঁর বক্তব্যে আরও বলেন, দেশের প্রতিটি নাগরিকের নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা উচিত। তিনি উল্লেখ করেন, ‘একজন নাগরিক হিসেবে দেশের প্রতি আমাদের যে দায়িত্ব রয়েছে, তা পালন করা আমাদের নৈতিক কর্তব্য। দেশকে ভালোবেসে তার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। জাতি গঠনে সকলের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা জরুরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সন্তানের সুশিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করা প্রতিটি পরিবারের দায়িত্ব। আমরা যদি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত করতে পারি, তবেই আমরা একটি শক্তিশালী ও উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।’ তিনি অভিভাবকদের আহ্বান জানান, সন্তানদের শুধু একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত না করে, তাদের সঠিক মানবিক মূল্যবোধ এবং দেশপ্রেমের শিক্ষা দিতে।
ডিআইজি বলেন, ‘শিক্ষাই একটি জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে, আর সেই শিক্ষা শুরু হয় পরিবার থেকেই। তাই প্রত্যেক বাবা-মাকে তার সন্তানের সুশিক্ষা ও নৈতিক উন্নতির দিকে নজর দিতে হবে, যাতে তারা একজন সৎ, দক্ষ, এবং দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে উঠতে পারে।’


ডিআইজি মো. রেজাউল হক তাঁর বক্তব্যে বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘মাস্টারদা সূর্য সেন আমাদের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নাম। তিনি আগে পূজা করেননি, আগে সংগ্রাম করেছেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল দেশের স্বাধীনতা এবং নিপীড়িত মানুষের মুক্তি। পূজা বা আচার-অনুষ্ঠান তখন তাঁর কাছে অপেক্ষা করেছিল, কারণ তিনি প্রথমে নিজের জাতির মুক্তির জন্য লড়াই করেছিলেন। এই মহান বিপ্লবীর জীবন আমাদের শেখায় যে, নিজের অধিকার ও দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামই সবচেয়ে বড় পূজা।’
ডিআইজি মো. রেজাউল হক তাঁর বক্তব্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘আমাদের দেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলন বারবার বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। সেই আন্দোলন আমাদের শিখিয়েছে জাতি, ধর্ম বা সম্প্রদায়ের ভেদাভেদ ভুলে আমরা একত্রিত হয়ে দেশের স্বার্থে কাজ করতে পারি।’
তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আগামী প্রজন্ম আমাদেরই সন্তান। আমরা যেন এমন একটি সমাজ ও পরিবেশ রেখে যেতে পারি, যেখানে তারা তাদের স্বাধীনতা পূর্ণভাবে উপভোগ করতে পারে। দেশের সেবায় সকল ধর্মের মানুষের সঙ্গে ঐক্য বজায় রেখে চলার মানসিকতা তাদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। এই দায়িত্ব আমাদেরই।’
পূজামণ্ডপের সৌন্দর্য ও লাইটিং সম্পর্কেও তিনি বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা সবার আগে, আর এটি শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, যদি সবার সহযোগিতা না থাকে। পূজার আয়োজনের ক্ষেত্রে আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।’
তিনি পূজা উদ্যাপন কমিটির নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে আরও বলেন, ‘যদি লাইটিং পূজার অপরিহার্য অংশ না হয়, তাহলে সেই অর্থ সাশ্রয় করে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা যেতে পারে। এটি মণ্ডপ এবং পূজার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা হবে। আমি আশা করি, আগামীতে আপনারা এ বিষয়টি বিবেচনা করবেন এবং সবার নিরাপত্তার জন্য পদক্ষেপ নেবেন।’
ডিআইজি রেজাউল হক তাঁর বক্তব্যে মণ্ডপগুলোতে উপস্থিত থেকে সার্বিক নিরাপত্তা এবং উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় রাখতে সহযোগিতা করায় রাজনৈতিক নেতা, সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের ধন্যবাদ জানান।
মতবিনিময়কালে চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সদস্যসচিব শরীফুজ্জামান শরীফ বলেন, ‘আজ মন্দির কমিটির সভাপতি-সেক্রেটারির বক্তব্য শুনে ভালো লেগেছে। তারা বললেন, “মনে হচ্ছে আমরা আলোর দিকে ফিরে এসেছি। আগে যেন কোনো গুহার মধ্যে আবদ্ধ ছিলাম। আপনারা আমদেরকে এভাবে ভালোবাসবেন এবং আমাদের পাশে থেকে সমান ধর্ম এবং উৎসব পালনে সমান অধিকার আদায় করে দেবেন, কখনো এটা চিন্তা করিনি।”
শরীফুজ্জামান বলেন, ‘আমি চুয়াডাঙ্গা সদর ও আলমডাঙ্গার বিভিন্ন মন্দির পরিদর্শন করেছি। প্রতিটি মণ্ডপে দেখেছি মসজিদে আজান এবং জামাতের সময়সূচি তারা রেখেছেন। যেন আজান এবং নামাজের সময় বাদ রেখে তারা ঢাক-ঢোল বাজাতে পারেন। এই ভ্রাতৃত্ববোধের জন্য আমি সনাতন ধর্মের নের্তৃবৃন্দ, আমাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীবৃন্দ এবং সাধারণ জনগণের প্রতি ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘এবার একটি ভিন্ন আয়োজনও আমরা করতে চাই। সকলের সমন্বয় করে একটি কমিটি গঠন করে দেব। যেই কমিটি সবগুলো মণ্ডপ পর্যালোচনা করবে এবং সেরা তিনটি মণ্ডপকে পুরস্কৃত করা হবে।’ শরীফুজ্জামান বলেন, ‘আমরা সবসময় এই বিষয়টি মনে রাখতে চাই, আমরা সবাই বাংলাদেশী। যে ধর্মেরই মানুষ হই না কেন, আমরা সবাই চুয়াডাঙ্গাবাসী। এখানে প্রত্যেকেরই নিজ নিজ ধর্ম পালনের সমান অধিকার আছে। একে অপরকে সহযোগিতা করে আমরা সুন্দর ও ঐক্যের চুয়াডাঙ্গা গড়তে চাই।’
জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির অ্যাড. রুহুল আমিন তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা সবসময় শান্তি, সম্প্রীতি, এবং সহমর্মিতার পক্ষে। সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সৌহার্দ্য বজায় রেখে সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হবে।’ এসময় তিনি সমাজের উন্নয়নে সকলকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।
শহরের বড় বাজার দুর্গা মন্দিরে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন অতিরিক্ত ডিআইজি হাসানুজ্জামান, চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম, জেলা বিএনপির সদস্যসচিব শরীফুজ্জামান, জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির রুহুল আমীন, দৈনিক সময়ের সমীকরণ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক নাজমুল হক স্বপন, চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সহসভাপতি রফিক রহমান, জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ডা. মার্টিন হীরক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত কুমার সিংহ রায়, শারদীয় দুর্গা উৎসব পালন বিষয়ক জেলা সমন্বয়ক হেমন্ত কুমার সিংহ রায় চুয়াডাঙ্গাসহ পূজা উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দ। অনুষ্ঠানটি পচিালনা করেন কিংকর কুমার দে ও পলাশ কুমার সাহা।