ইপেপার । আজ বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পাচারের অর্থ ফেরাতে সহায়তা কামনা, ২০০ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে ইউএসএইড

সংস্কারে সরাসরি যুক্ত থাকবে যুক্তরাষ্ট্র

সমীকরণ প্রতিবেদন:
  • আপলোড টাইম : ১১:৪৩:০৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / ৪৪ বার পড়া হয়েছে

অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সফরে আসা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে রাষ্ট্র সংস্কার প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত থাকার আগ্রহের কথা জানিয়েছে। এ জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। গতকাল রোববার সফরের দ্বিতীয় দিনে দিনভর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ বিভিন্ন উপদেষ্টা ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তারা এ বার্তা দেন। বাংলাদেশের পক্ষেও এ রাষ্ট্র পুনর্গঠন, সংস্কার ও বিশেষত পাচার হয়ে যাওয়া বিশাল অংকের অর্থ ফেরত আনতে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুসহ ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দল গতকাল সকালে পরপর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে তারা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় মার্কিন প্রতিনিধি দল ওয়ার্কিং লাঞ্চে অংশ নেন পররাষ্ট্র সচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাণিজ্য সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। বিকালে বৈঠক হয় বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের সঙ্গে। এর বাইরে আরও বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে ব্যস্ত সময় পার করেন তারা।

রাষ্ট্র পুনর্গঠন, সংস্কার ও পাচার অর্থ ফেরাতে সহায়তার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার :
রাষ্ট্র পুনর্গঠন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এবং পাচার হওয়া সম্পদ ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি দল তাঁর সঙ্গে দেখা করলে প্রধান উপদেষ্টা এ সহায়তা চান। এসময় আগের স্বৈরাচারী শাসনের সঙ্গে জড়িত দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের পাচারকৃত সম্পদ ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। ঘুষ-দুর্নীতি প্রতিরোধে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আমরা দুর্নীতির সাগরে ছিলাম। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা ওই প্রতিনিধি দলকে জানান, তাঁর প্রশাসন অর্থনীতিকে পুনরায় একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে এবং সচল করতে আর্থিক খাতে দ্রুত সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে। একই সঙ্গে বিচার বিভাগ ও পুলিশের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিক করতে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ঘণ্টাব্যাপী আলোচনায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক সংস্কার, বিনিয়োগ, শ্রমিক ইস্যু, রোহিঙ্গা সংকট এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন নিউইয়র্ক সফর নিয়ে আলোচনা হয়। মার্কিন প্রতিনিধি দলের কাছে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিপ্লবের কথা তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, এটি আমাদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় এবং আমাদের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যা বাংলাদেশে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। প্রধান উপদেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গৃহীত সংস্কার উদ্যোগের একটি রূপরেখা তুলে ধরেন মার্কিন প্রতিনিধি দলের কাছে। তিনি বলেন, ভোট কারচুপি প্রতিরোধ, বিচার বিভাগ, পুলিশ, বেসামরিক প্রশাসন, দেশের দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা এবং সংবিধান সংশোধনের প্রয়াসে তাঁর সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেই ছয়টি কমিশন গঠন করেছে।

মার্কিন প্রতিনিধি দলের প্রধান ব্রেন্ট নেইম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলেন, এ সংস্কার কার্যক্রমে সহায়তা করতে পারলে ওয়াশিংটন খুশি হবে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলেন, তাদের দেশ অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কার উদ্যোগে প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক সহায়তা দিতে আগ্রহী। বৈঠকে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান; সঙ্গে ছিলেন দেশটির সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু, সহকারী মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ, উপ-সহকারী প্রশাসক অঞ্জলি কৌর এবং মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের পরিচালক জেরোড ম্যাসন। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, সিনিয়র সচিব ও এসডিজিবিষয়ক প্রধান লামিয়া মোর্শেদ, পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন।

সংস্কারে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা :
দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক ও মধ্যাহ্নভোজের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন। পররাষ্ট্র সচিব জানান, অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সেগুলোর বিষয়ে প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়েছে। সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা সম্পর্কে তারা জানতে চেয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি এ সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার বলে তাদের জানানো হয়েছে। আর্থিক ও রাজস্ব খাতের সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্র, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শ্রম পরিবেশ, মানবাধিকার সুরক্ষা, রোহিঙ্গা সংকটসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
কোন কোন খাতে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে- জানতে চাইলে জসিম উদ্দিন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এক মাসের কিছুটা বেশি। বৈঠকে পরিবর্তিত যে পরিস্থিতি ও সরকারের সংস্কার বিষয়ে যে ধ্যানধারণা এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে, তা নিয়ে সাধারণ আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা আশা করি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যথাযথ যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য এ সফর একটি ভিত্তি। সামনে আমরা এ আলোচনাকে বিভিন্ন পর্যায়ে এগিয়ে নেব। পাচার হওয়া টাকা ফেরত প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমরা বড় আকারে আর্থিক খাতে সংস্কার নিয়ে আলোচনা করেছি এবং পাচার হওয়া অর্থসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিশেষায়িত জ্ঞান রয়েছে, সেটি হয়তো আমরা ব্যবহার করব, কিন্তু আলাপ-আলোচনা সবে শুরু হয়েছে। এর চূড়ান্ত রূপ পেতে কিছুটা সময় লাগবে। পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিন বলেন, প্রতিনিধি দলের এ সফরে প্রথম যে আশ্বাস, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করতে চায়। সেটারই প্রতিফলন হিসেবে সরকার গঠনের দ্বিতীয় মাসেই যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিক সংস্কারের যেসব খাত চিহ্নিত করা হয়েছে, তার সবকটি খাতে তারা সার্বিকভাবে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। শ্রম আইন নিয়ে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো তাদের জানানো হয়েছে এবং এ আলোচনা অব্যাহত থাকবে। ঢাকা আসার আগে ডোনাল্ড লুর দিল্লি সফরে ভারত থেকে কোনো বার্তা এসেছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এ বিষয়ে আজ কোনো আলোচনা হয়নি।

২০০ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে ইউএসএইড :
উন্নয়ন সহায়তার অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে ২০০ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইড। এ জন্য গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় উভয় দেশের মধ্যে এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ঢাকা সফররত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলে থাকা ইউএসএইডের ডেপুটি এসিসট্যান্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর অঞ্জলি কৌর এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী এতে স্বাক্ষর করেন। এসময় অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
চুক্তি শেষে উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা আজ (গতকাল) মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলাপ করেছি। আমাদের মূল আলোচনা ছিল তাদের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও ইউএসএআইডির সঙ্গে। বিশেষ করে আর্থিক সংস্কার, আর্থিক খাতে যে সহযোগিতা দরকার সেটা দ্বিতীয় বাণিজ্যের। আমরা এক্সপোর্ট ডাইভারসিফিকেশন এবং বাণিজ্য খাতে বিভিন্ন কারিগরি সহায়তা বা বাজার এক্সপ্লোর করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোবো, তারা সে ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।

উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তির বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এটা যে চুক্তি আগে হয়েছিল সেটার সঙ্গে আরও ২০০ মিলিয়ন যোগ করা হয়েছে। আগে যা ছিল তার সঙ্গে এটি যুক্ত হয়েছে। তারা আরও বাড়তি ২০০ মিলিয়ন ডলার দেবে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সহযোগিতা চেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো সব আলাপ হয়েছে। পরে বিস্তারিত আলোচনা হবে। কর কাঠামোর সংস্কারের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় ইউএসএইডের ডেপুটি অ্যাসিসট্যান্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর অঞ্জলি কৌর সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছি। প্রাথমিকভাবে আমরা অগ্রাধিকার খাতে ২০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিচ্ছি। এটি নতুন একটি চুক্তি। আমরা এই অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চাই। উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তির আওতায় এই অর্থ দেওয়া হবে বলে জানান অঞ্জলি কৌর।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

পাচারের অর্থ ফেরাতে সহায়তা কামনা, ২০০ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে ইউএসএইড

সংস্কারে সরাসরি যুক্ত থাকবে যুক্তরাষ্ট্র

আপলোড টাইম : ১১:৪৩:০৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সফরে আসা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে রাষ্ট্র সংস্কার প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত থাকার আগ্রহের কথা জানিয়েছে। এ জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। গতকাল রোববার সফরের দ্বিতীয় দিনে দিনভর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ বিভিন্ন উপদেষ্টা ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তারা এ বার্তা দেন। বাংলাদেশের পক্ষেও এ রাষ্ট্র পুনর্গঠন, সংস্কার ও বিশেষত পাচার হয়ে যাওয়া বিশাল অংকের অর্থ ফেরত আনতে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুসহ ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দল গতকাল সকালে পরপর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে তারা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় মার্কিন প্রতিনিধি দল ওয়ার্কিং লাঞ্চে অংশ নেন পররাষ্ট্র সচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাণিজ্য সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। বিকালে বৈঠক হয় বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের সঙ্গে। এর বাইরে আরও বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে ব্যস্ত সময় পার করেন তারা।

রাষ্ট্র পুনর্গঠন, সংস্কার ও পাচার অর্থ ফেরাতে সহায়তার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার :
রাষ্ট্র পুনর্গঠন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এবং পাচার হওয়া সম্পদ ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি দল তাঁর সঙ্গে দেখা করলে প্রধান উপদেষ্টা এ সহায়তা চান। এসময় আগের স্বৈরাচারী শাসনের সঙ্গে জড়িত দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের পাচারকৃত সম্পদ ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। ঘুষ-দুর্নীতি প্রতিরোধে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আমরা দুর্নীতির সাগরে ছিলাম। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা ওই প্রতিনিধি দলকে জানান, তাঁর প্রশাসন অর্থনীতিকে পুনরায় একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে এবং সচল করতে আর্থিক খাতে দ্রুত সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে। একই সঙ্গে বিচার বিভাগ ও পুলিশের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিক করতে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ঘণ্টাব্যাপী আলোচনায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক সংস্কার, বিনিয়োগ, শ্রমিক ইস্যু, রোহিঙ্গা সংকট এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন নিউইয়র্ক সফর নিয়ে আলোচনা হয়। মার্কিন প্রতিনিধি দলের কাছে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিপ্লবের কথা তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, এটি আমাদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় এবং আমাদের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যা বাংলাদেশে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। প্রধান উপদেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গৃহীত সংস্কার উদ্যোগের একটি রূপরেখা তুলে ধরেন মার্কিন প্রতিনিধি দলের কাছে। তিনি বলেন, ভোট কারচুপি প্রতিরোধ, বিচার বিভাগ, পুলিশ, বেসামরিক প্রশাসন, দেশের দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা এবং সংবিধান সংশোধনের প্রয়াসে তাঁর সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেই ছয়টি কমিশন গঠন করেছে।

মার্কিন প্রতিনিধি দলের প্রধান ব্রেন্ট নেইম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলেন, এ সংস্কার কার্যক্রমে সহায়তা করতে পারলে ওয়াশিংটন খুশি হবে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলেন, তাদের দেশ অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কার উদ্যোগে প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক সহায়তা দিতে আগ্রহী। বৈঠকে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান; সঙ্গে ছিলেন দেশটির সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু, সহকারী মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ, উপ-সহকারী প্রশাসক অঞ্জলি কৌর এবং মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের পরিচালক জেরোড ম্যাসন। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, সিনিয়র সচিব ও এসডিজিবিষয়ক প্রধান লামিয়া মোর্শেদ, পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন।

সংস্কারে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা :
দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক ও মধ্যাহ্নভোজের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন। পররাষ্ট্র সচিব জানান, অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সেগুলোর বিষয়ে প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়েছে। সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা সম্পর্কে তারা জানতে চেয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি এ সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার বলে তাদের জানানো হয়েছে। আর্থিক ও রাজস্ব খাতের সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্র, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শ্রম পরিবেশ, মানবাধিকার সুরক্ষা, রোহিঙ্গা সংকটসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
কোন কোন খাতে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে- জানতে চাইলে জসিম উদ্দিন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এক মাসের কিছুটা বেশি। বৈঠকে পরিবর্তিত যে পরিস্থিতি ও সরকারের সংস্কার বিষয়ে যে ধ্যানধারণা এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে, তা নিয়ে সাধারণ আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা আশা করি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যথাযথ যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য এ সফর একটি ভিত্তি। সামনে আমরা এ আলোচনাকে বিভিন্ন পর্যায়ে এগিয়ে নেব। পাচার হওয়া টাকা ফেরত প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমরা বড় আকারে আর্থিক খাতে সংস্কার নিয়ে আলোচনা করেছি এবং পাচার হওয়া অর্থসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিশেষায়িত জ্ঞান রয়েছে, সেটি হয়তো আমরা ব্যবহার করব, কিন্তু আলাপ-আলোচনা সবে শুরু হয়েছে। এর চূড়ান্ত রূপ পেতে কিছুটা সময় লাগবে। পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিন বলেন, প্রতিনিধি দলের এ সফরে প্রথম যে আশ্বাস, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করতে চায়। সেটারই প্রতিফলন হিসেবে সরকার গঠনের দ্বিতীয় মাসেই যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিক সংস্কারের যেসব খাত চিহ্নিত করা হয়েছে, তার সবকটি খাতে তারা সার্বিকভাবে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। শ্রম আইন নিয়ে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো তাদের জানানো হয়েছে এবং এ আলোচনা অব্যাহত থাকবে। ঢাকা আসার আগে ডোনাল্ড লুর দিল্লি সফরে ভারত থেকে কোনো বার্তা এসেছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এ বিষয়ে আজ কোনো আলোচনা হয়নি।

২০০ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে ইউএসএইড :
উন্নয়ন সহায়তার অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে ২০০ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইড। এ জন্য গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় উভয় দেশের মধ্যে এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ঢাকা সফররত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলে থাকা ইউএসএইডের ডেপুটি এসিসট্যান্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর অঞ্জলি কৌর এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী এতে স্বাক্ষর করেন। এসময় অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
চুক্তি শেষে উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা আজ (গতকাল) মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলাপ করেছি। আমাদের মূল আলোচনা ছিল তাদের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও ইউএসএআইডির সঙ্গে। বিশেষ করে আর্থিক সংস্কার, আর্থিক খাতে যে সহযোগিতা দরকার সেটা দ্বিতীয় বাণিজ্যের। আমরা এক্সপোর্ট ডাইভারসিফিকেশন এবং বাণিজ্য খাতে বিভিন্ন কারিগরি সহায়তা বা বাজার এক্সপ্লোর করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোবো, তারা সে ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।

উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তির বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এটা যে চুক্তি আগে হয়েছিল সেটার সঙ্গে আরও ২০০ মিলিয়ন যোগ করা হয়েছে। আগে যা ছিল তার সঙ্গে এটি যুক্ত হয়েছে। তারা আরও বাড়তি ২০০ মিলিয়ন ডলার দেবে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সহযোগিতা চেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো সব আলাপ হয়েছে। পরে বিস্তারিত আলোচনা হবে। কর কাঠামোর সংস্কারের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় ইউএসএইডের ডেপুটি অ্যাসিসট্যান্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর অঞ্জলি কৌর সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছি। প্রাথমিকভাবে আমরা অগ্রাধিকার খাতে ২০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিচ্ছি। এটি নতুন একটি চুক্তি। আমরা এই অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চাই। উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তির আওতায় এই অর্থ দেওয়া হবে বলে জানান অঞ্জলি কৌর।