ইপেপার । আজ বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অস্থিরতা তৈরি হলেই সংশ্লিষ্ট কারখানা বন্ধ

তৈরি পোশাকশিল্পের মালিক-শ্রমিক উভয়কেই কড়া হুঁশিয়ারি সরকারের

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৫:২২:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / ৫ বার পড়া হয়েছে

CREATOR: gd-jpeg v1.0 (using IJG JPEG v80), default quality

শ্রমিক অসন্তোষকে কেন্দ্র করে মালিক-শ্রমিক উভয়পক্ষকে কঠোর হুঁশিয়ারি জানিয়েছে সরকার। গতকাল শনিবার রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত বিজিএমইএ ভবনে ত্রিপক্ষীয় এক বৈঠকে এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন অন্তর্র্বতী সরকারের পক্ষে শিল্প মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। তিনি বলেন, শ্রমিকদের আহ্বান জানাচ্ছি, রোববার তারা কারখানায় ফিরবেন। আর যে সব মালিক উদ্দেশ্যমূলকভাবে কারখানা বন্ধ রাখবেন, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবেন- তাদেরও মনে রাখা হবে। এদিকে শ্রমিক নেতারা জানান, কালো তালিকাভুক্ত শ্রমিকরাই এখন চাকরি ফিরিয়ে দিতে আন্দোলন করছে। এদিকে, তৈরি পোশাক শিল্পে চলমান অস্থিরতার জন্য তিন কারণকে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
বৈঠকে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা জানান, আজ রোববার থেকে দেশের সব পোশাক কারখানা খোলা থাকবে। তবে দেশ ও শিল্পের স্বার্থে, শ্রমিকদের কর্মসংস্থানকে সুরক্ষিত রাখতে, যদি কোনো কারখানায় শ্রমিকরা কাজ না করেন, কাজ না করে কারখানা থেকে বের হয়ে যান, কারখানায় বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করা হয়, তবে সেই কারখানার মালিক ইচ্ছা করলে আইন অনুযায়ী কারখানা বন্ধ রাখতে পারবেন। বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টা- শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ও শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, শ্রম সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, মেজর জেনারেল মো. মইন খান এনডিসি পিএসি (জিওসি, নবম পদাতিক ডিভিশন), বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিরা, বিকেএমইএ সভাপতি, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতিরা, বিজিএমইএর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এবং বিজিএমইএর সাধারণ সদস্যরা অংশ নেন।
মতবিনিময় সভায় শ্রমিকদের পক্ষে ছিলেন জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি মণ্টু ঘোষ, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশুসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা।
সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা বৈঠকে সবার বক্তব্য শুনেন উপদেষ্টারা, তারা নিজেদের কথাও বলেন। এসময় আদিলুর রহমান খান বলেন, তৈরি পোশাক খাতে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে সরকার কমিটি করেছে। এই কমিটির মাধ্যমে সবার সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সমস্যার সমাধান করা হবে। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করার যে সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তা ফিরিয়ে আনতে হবে। উপদেষ্টা বলেন, পোশাক শিল্পে অস্থিরতা মালিক-শ্রমিক কারোই কাম্য নয়। পোশাক শিল্পে সংঘাতময় পরিস্থিতির সুযোগ নেবে তৃৃতীয় পক্ষ। এতে মালিক-শ্রমিক কারোরই লাভ হবে না। আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে মালিক-শ্রমিকের সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় কমিটি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আজ (রোববার) যেসব কারখানায় কাজ হবে না, সেসব কারখানার সমস্যা সমাধানে আলাদাভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া যে সমস্ত কারখানার মালিকপক্ষ উদ্দেশ্যমূলকভাবে কারখানা বন্ধ রাখবেন ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করবেন, তাদেরও মনে রাখা হবে বলে জানিয়েছেন শিল্প উপদেষ্টা। তিনি বলেন, রোববার সব কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অর্থনীতিকে বিপদে ফেলতে কারখানা বন্ধ রাখার অপচেষ্টা মনে রাখা হবে।
শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হওয়ায় অনেকের মতো শ্রমিকরাও নিজেদের কথা বলছেন। শ্রমিকদের অভিযোগ সমাধানে শ্রমসংক্রান্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা সব অভিযোগ ও দাবি নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তবে শ্রমিকের আন্দোলনে একদমই যে ষড়যন্ত্র নেই, এমনও নয়। শ্রম উপদেষ্টা আরও বলেন, ইতোমধ্যে শ্রমিকদের জন্য কোন প্রক্রিয়ায় রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা যায়, সে বিষয়ে কাজ শুরু করেছে সরকার। এছাড়া গত বছরের শেষ দিকে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর আন্দোলনের সময় যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শ্রম আইনের মধ্য থেকে ট্রেড ইউনিয়ন করার যতটা সুযোগ আছে, তা নিশ্চিত করবে সরকার। তবে এই সব প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে যারা অস্থিরতা করবে, তাদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয়া হবে বলে জানিয়ে আসিফ মাহমুদ বলেন, এ ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া হবে না।
শ্রমিক নেতা বাবুল আখতার বলেন, আমরা বিজিএমইএতে অসংখ্য অভিযোগ করি, কিন্তু কতটি অভিযোগ আপনারা নিষ্পত্তি করেছেন। তিনি বলেন, শ্রমিকদের সমস্যা কেউ কখনো শোনেনি। বিগত দিনে আমরা কথা বলতে পারিনি। যখনই কথা বলতে চেয়েছি, আমাদের পেছনে গোয়েন্দাবাহিনী লাগিয়ে দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, সাড়ে ১৩শ কারখানায় ইউনিয়ন আছে কিন্তু তা কার্যত ভুয়া ইয়েলো ইউনিয়ন বানিয়ে রাখা হয়েছে। বাবুল আখতার বলেন, আমরা নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে অন্যের ওপর বা তৃতীয় পক্ষের ওপর দোষ চাপাচ্ছি। কিন্তু আমাদের নিজেদের দোষগুলো দেখি না। শ্রম মন্ত্রণালয়ে রাজনৈতিকভাবে সব কমিটি করা হয়েছে। এছাড়া যেসব শ্রমিককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, তারা অন্য কোথাও চাকরি করতে পারছে না। এসব কালো তালিকাভুক্ত শ্রমিকরাই এখন চাকরি ফিরিয়ে দিতে আন্দোলন করছে।
মতবিনিময় সভায় বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, সরকার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ায় রবিবার সব পোশাক কারখানা খোলা থাকবে। তবে কোনো কারখানায় অস্থিরতা তৈরি হলে পরের দিন থেকে সেই কারখানা শ্রম আইনের ১৩/১ ধারা (কাজ নেই, বেতন নেই) অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। তার এমন ঘোষণায় সমর্থন দিয়ে বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিকেএমইএ সংগঠনের পক্ষ থেকে এই ঘোষণাকে সমর্থন দিলাম। ভাঙচুর হলে আশুলিয়ার কারখানা বন্ধ করে দেয়া হবে। এর আগে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ব্যাংক থেকে অর্থছাড়ের জটিলতার কারণে কিছু কারখানা সঠিক সময়ে বেতন ভাতা পরিশোধ করতে পারেনি। কাল ও পরশুর মধ্যে সব বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে। গত পাঁচ বছরে উৎপাদন খরচ বাড়লেও চলতি বছর তৈরি পোশাকের দাম কমেছে বলে জানান তিনি। বলেন, চলতি বছর তৈরি পোশাকের দাম ৫ থেকে ৭ শতাংশ কমেছে। গত ৫ বছরে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৫০ শতাংশ।
মতবিনিময় সভায় সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মো. মঈন খান বলেন, শ্রমিকদের দাবিগুলো যৌক্তিক, তবে সমাধান না হলে শিল্পের অস্থিরতা নিরসন সম্ভব নয়। পোশাক শিল্পকে রক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করবে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর মতে, পোশাক শিল্পে চলমান এ অস্থিরতার জন্য মূলত তিনটি কারণ দায়ী। এগুলো হলো- বহিরাগতদের আক্রমণ; শ্রমিকদের যৌক্তিক ও অযৌক্তিক দাবির সমন্বয়ে অস্থিরতা ধরে রাখা হচ্ছে; এবং ঝুট ব্যবসার আধিপত্য। তবে বহিরাগতদের আক্রমণ এখন নেই, এটা আর হচ্ছে না। অপরদিকে, শিল্প পুলিশ জানিয়েছে, বর্তমান সরকারকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতেই একটি চক্র শিল্প কারখানায় অস্থিরতা তৈরি করছে। এখন বেক্সিমকো গ্রুপের শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে উপদেষ্টাদের বিশেষভাবে নজর দেয়া জরুরি। বেক্সিমকোর প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক রাস্তায় নেমে বিভিন্ন সময়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করছে। তিনি বলেন, ৯ হাজার ৪৮১টি কারখানার মধ্যে আজ ১৪ তারিখে মাত্র ৪ হাজার ৯৪টি কারখানার বেতন হয়েছে বা ৪৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
এদিকে, গত কয়েকদিনের অচলাবস্থা কাটিয়ে গতকাল দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে সরকার, মালিক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর প্রচেষ্টায় কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে। দিনের প্রথমভাগে বেশিরভাগ কারখানায় উৎপাদন চলেছে। সব কারখানার নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী, বিজিবি, র?্যাব ও শিল্প পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকলেও দুপুরের পর থেকে শ্রমিকদের আন্দোলন শুরু হলে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়। গতকাল সাভার-আশুলিয়ার বন্ধ থাকা ২১৯টি কারখানার মধ্যে ১৭০টি পোশাক কারখানা উৎপাদনে ফিরেছে। তবে বন্ধ ছিল ৪৯টি কারখানা। পরিস্থিতি বিবেচনায় শিগগিরই সব কারখানা উৎপাদনে ফিরবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

অস্থিরতা তৈরি হলেই সংশ্লিষ্ট কারখানা বন্ধ

তৈরি পোশাকশিল্পের মালিক-শ্রমিক উভয়কেই কড়া হুঁশিয়ারি সরকারের

আপলোড টাইম : ০৫:২২:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

শ্রমিক অসন্তোষকে কেন্দ্র করে মালিক-শ্রমিক উভয়পক্ষকে কঠোর হুঁশিয়ারি জানিয়েছে সরকার। গতকাল শনিবার রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত বিজিএমইএ ভবনে ত্রিপক্ষীয় এক বৈঠকে এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন অন্তর্র্বতী সরকারের পক্ষে শিল্প মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। তিনি বলেন, শ্রমিকদের আহ্বান জানাচ্ছি, রোববার তারা কারখানায় ফিরবেন। আর যে সব মালিক উদ্দেশ্যমূলকভাবে কারখানা বন্ধ রাখবেন, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবেন- তাদেরও মনে রাখা হবে। এদিকে শ্রমিক নেতারা জানান, কালো তালিকাভুক্ত শ্রমিকরাই এখন চাকরি ফিরিয়ে দিতে আন্দোলন করছে। এদিকে, তৈরি পোশাক শিল্পে চলমান অস্থিরতার জন্য তিন কারণকে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
বৈঠকে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা জানান, আজ রোববার থেকে দেশের সব পোশাক কারখানা খোলা থাকবে। তবে দেশ ও শিল্পের স্বার্থে, শ্রমিকদের কর্মসংস্থানকে সুরক্ষিত রাখতে, যদি কোনো কারখানায় শ্রমিকরা কাজ না করেন, কাজ না করে কারখানা থেকে বের হয়ে যান, কারখানায় বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করা হয়, তবে সেই কারখানার মালিক ইচ্ছা করলে আইন অনুযায়ী কারখানা বন্ধ রাখতে পারবেন। বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টা- শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ও শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, শ্রম সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, মেজর জেনারেল মো. মইন খান এনডিসি পিএসি (জিওসি, নবম পদাতিক ডিভিশন), বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিরা, বিকেএমইএ সভাপতি, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতিরা, বিজিএমইএর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এবং বিজিএমইএর সাধারণ সদস্যরা অংশ নেন।
মতবিনিময় সভায় শ্রমিকদের পক্ষে ছিলেন জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি মণ্টু ঘোষ, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশুসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা।
সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা বৈঠকে সবার বক্তব্য শুনেন উপদেষ্টারা, তারা নিজেদের কথাও বলেন। এসময় আদিলুর রহমান খান বলেন, তৈরি পোশাক খাতে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে সরকার কমিটি করেছে। এই কমিটির মাধ্যমে সবার সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সমস্যার সমাধান করা হবে। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করার যে সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তা ফিরিয়ে আনতে হবে। উপদেষ্টা বলেন, পোশাক শিল্পে অস্থিরতা মালিক-শ্রমিক কারোই কাম্য নয়। পোশাক শিল্পে সংঘাতময় পরিস্থিতির সুযোগ নেবে তৃৃতীয় পক্ষ। এতে মালিক-শ্রমিক কারোরই লাভ হবে না। আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে মালিক-শ্রমিকের সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় কমিটি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আজ (রোববার) যেসব কারখানায় কাজ হবে না, সেসব কারখানার সমস্যা সমাধানে আলাদাভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া যে সমস্ত কারখানার মালিকপক্ষ উদ্দেশ্যমূলকভাবে কারখানা বন্ধ রাখবেন ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করবেন, তাদেরও মনে রাখা হবে বলে জানিয়েছেন শিল্প উপদেষ্টা। তিনি বলেন, রোববার সব কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অর্থনীতিকে বিপদে ফেলতে কারখানা বন্ধ রাখার অপচেষ্টা মনে রাখা হবে।
শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হওয়ায় অনেকের মতো শ্রমিকরাও নিজেদের কথা বলছেন। শ্রমিকদের অভিযোগ সমাধানে শ্রমসংক্রান্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা সব অভিযোগ ও দাবি নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তবে শ্রমিকের আন্দোলনে একদমই যে ষড়যন্ত্র নেই, এমনও নয়। শ্রম উপদেষ্টা আরও বলেন, ইতোমধ্যে শ্রমিকদের জন্য কোন প্রক্রিয়ায় রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা যায়, সে বিষয়ে কাজ শুরু করেছে সরকার। এছাড়া গত বছরের শেষ দিকে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর আন্দোলনের সময় যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শ্রম আইনের মধ্য থেকে ট্রেড ইউনিয়ন করার যতটা সুযোগ আছে, তা নিশ্চিত করবে সরকার। তবে এই সব প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে যারা অস্থিরতা করবে, তাদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয়া হবে বলে জানিয়ে আসিফ মাহমুদ বলেন, এ ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া হবে না।
শ্রমিক নেতা বাবুল আখতার বলেন, আমরা বিজিএমইএতে অসংখ্য অভিযোগ করি, কিন্তু কতটি অভিযোগ আপনারা নিষ্পত্তি করেছেন। তিনি বলেন, শ্রমিকদের সমস্যা কেউ কখনো শোনেনি। বিগত দিনে আমরা কথা বলতে পারিনি। যখনই কথা বলতে চেয়েছি, আমাদের পেছনে গোয়েন্দাবাহিনী লাগিয়ে দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, সাড়ে ১৩শ কারখানায় ইউনিয়ন আছে কিন্তু তা কার্যত ভুয়া ইয়েলো ইউনিয়ন বানিয়ে রাখা হয়েছে। বাবুল আখতার বলেন, আমরা নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে অন্যের ওপর বা তৃতীয় পক্ষের ওপর দোষ চাপাচ্ছি। কিন্তু আমাদের নিজেদের দোষগুলো দেখি না। শ্রম মন্ত্রণালয়ে রাজনৈতিকভাবে সব কমিটি করা হয়েছে। এছাড়া যেসব শ্রমিককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, তারা অন্য কোথাও চাকরি করতে পারছে না। এসব কালো তালিকাভুক্ত শ্রমিকরাই এখন চাকরি ফিরিয়ে দিতে আন্দোলন করছে।
মতবিনিময় সভায় বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, সরকার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ায় রবিবার সব পোশাক কারখানা খোলা থাকবে। তবে কোনো কারখানায় অস্থিরতা তৈরি হলে পরের দিন থেকে সেই কারখানা শ্রম আইনের ১৩/১ ধারা (কাজ নেই, বেতন নেই) অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। তার এমন ঘোষণায় সমর্থন দিয়ে বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিকেএমইএ সংগঠনের পক্ষ থেকে এই ঘোষণাকে সমর্থন দিলাম। ভাঙচুর হলে আশুলিয়ার কারখানা বন্ধ করে দেয়া হবে। এর আগে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ব্যাংক থেকে অর্থছাড়ের জটিলতার কারণে কিছু কারখানা সঠিক সময়ে বেতন ভাতা পরিশোধ করতে পারেনি। কাল ও পরশুর মধ্যে সব বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে। গত পাঁচ বছরে উৎপাদন খরচ বাড়লেও চলতি বছর তৈরি পোশাকের দাম কমেছে বলে জানান তিনি। বলেন, চলতি বছর তৈরি পোশাকের দাম ৫ থেকে ৭ শতাংশ কমেছে। গত ৫ বছরে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৫০ শতাংশ।
মতবিনিময় সভায় সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মো. মঈন খান বলেন, শ্রমিকদের দাবিগুলো যৌক্তিক, তবে সমাধান না হলে শিল্পের অস্থিরতা নিরসন সম্ভব নয়। পোশাক শিল্পকে রক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করবে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর মতে, পোশাক শিল্পে চলমান এ অস্থিরতার জন্য মূলত তিনটি কারণ দায়ী। এগুলো হলো- বহিরাগতদের আক্রমণ; শ্রমিকদের যৌক্তিক ও অযৌক্তিক দাবির সমন্বয়ে অস্থিরতা ধরে রাখা হচ্ছে; এবং ঝুট ব্যবসার আধিপত্য। তবে বহিরাগতদের আক্রমণ এখন নেই, এটা আর হচ্ছে না। অপরদিকে, শিল্প পুলিশ জানিয়েছে, বর্তমান সরকারকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতেই একটি চক্র শিল্প কারখানায় অস্থিরতা তৈরি করছে। এখন বেক্সিমকো গ্রুপের শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে উপদেষ্টাদের বিশেষভাবে নজর দেয়া জরুরি। বেক্সিমকোর প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক রাস্তায় নেমে বিভিন্ন সময়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করছে। তিনি বলেন, ৯ হাজার ৪৮১টি কারখানার মধ্যে আজ ১৪ তারিখে মাত্র ৪ হাজার ৯৪টি কারখানার বেতন হয়েছে বা ৪৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
এদিকে, গত কয়েকদিনের অচলাবস্থা কাটিয়ে গতকাল দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে সরকার, মালিক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর প্রচেষ্টায় কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে। দিনের প্রথমভাগে বেশিরভাগ কারখানায় উৎপাদন চলেছে। সব কারখানার নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী, বিজিবি, র?্যাব ও শিল্প পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকলেও দুপুরের পর থেকে শ্রমিকদের আন্দোলন শুরু হলে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়। গতকাল সাভার-আশুলিয়ার বন্ধ থাকা ২১৯টি কারখানার মধ্যে ১৭০টি পোশাক কারখানা উৎপাদনে ফিরেছে। তবে বন্ধ ছিল ৪৯টি কারখানা। পরিস্থিতি বিবেচনায় শিগগিরই সব কারখানা উৎপাদনে ফিরবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।