ইপেপার । আজ মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ক্ষরা ও পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে পাটের ফলন বিপর্যয়

মেহেরপুরে পাটকাঠি বিক্রি করে পোষাতে হচ্ছে লোকসান

প্রতিবেদক, মেহেরপুর সদর:
  • আপলোড টাইম : ০৮:৫২:৫২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / ৮ বার পড়া হয়েছে

মেহেরপুরে কয়েক বছর যাবৎ বৈরি আবহাওয়ার কারণে সেচের পানির মাধ্যমে পাট আবাদ করেছিলেন চাষিরা। তবে বারবারই ভালো লাভের আশায় পাট চাষ করে হতাশ তারা। চাষিরা বলছেন, এ বছর পাটের আঁশ কম এবং দামও কম। খরচের টাকায় উঠছে না। পাটের মূল্যবৃদ্ধি না হলে আগামীতে পাট চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন তারা।

পাট চাষিরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে মেহেরপুর জেলায় অনাবৃষ্টি ও প্রচণ্ড তাপদাহের কারণে পাটের আবাদে উৎপাদন খরচ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় ফলন বিপর্যয় ঘটেছে। পাটের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে অনেক চাষি পাটের আবাদ ছেড়ে দিয়েছেন। তবে এবছরও অনেক চাষি পাটের আবাদ করেছেন বুকভরা আশা নিয়ে। কিন্তু সে ‘গুড়ে বালি’। এবছরেও পাটের ভালো ফলন হচ্ছে না। আবার দামও কম। পাট উৎপাদনে যে টাকা খরচ হয়েছে, তা উঠছে না। এমনটা চলতে থাকলে আগামীতে আর পাট চাষ করবেন না চাষিরা।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে মেহেরপুরের গাংনী, মুজিবনগর, সদরসহ মোট তিনটি উপজেলায় ১৬ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। জেলায় এবছর ২ লাখ ৪০ হাজার ৬৩৬ বেল পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। রোপনকৃত সব পাটই প্রায় ম্যাচিওর হয়ে গেছে। জমি থেকে পাট কেটে পুকুর ডোবা কিংবা জমিতেই স্যালোমেশিন দিয়ে পানির ব্যবস্থা করে পাট পচানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ায় পাটের রং হচ্ছে কালো। এতে দাম কম পাচ্ছেন পাট চাষিরা। বিশেষ করে দক্ষিণ পশ্চিমাংশের পাটের আঁশ তুলনামূলক কম ও রংয়ের পার্থক্য থাকায় সরকার নির্ধারিত মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাট ব্যবসায়ীরা জানান, এবছর শুকনা পাট বিকিকিনি চলছে ১৯০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা।

গাংনী উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের পাটচাষি ইদ্রিস আলী জানান, তিনি চৈত্র মাসের শেষের দিকে দুই বিঘা জমিতে পাট বীজ রোপণ করেছিলেন। অতিখরার কারণে দুদিন পরপর সেচ দিতে হতো। নিড়ানি, সার, বিষসহ প্রতিবিঘা জমিতে খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু এখন পাট কেটে পচানো থেকে শুরু করে আঁশ ছাড়ানো পর্যন্ত যে খরচ হচ্ছে তা উঠছে না।

মাইলমারি গ্রামের পাটচাষি হবিবর রহমান বলেন, এক বিঘা জমির পাট কাটতে এবং বহন করে পুকুরে পচানো পর্যন্ত খরচ হচ্ছে ৫ হাজার টাকা। সেই পাট আঁশ ছাড়াতে শ্রমিক খরচ হচ্ছে ৩ হাজার টাকা। এক বিঘা জমিতে পাট হচ্ছে ১২ থেকে ১৩মণ। প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে ১৯০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা। কাঁচা পাট বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা। এতে আমাদের খরচের টাকায় উঠছেনা। পাটকাঠি বিক্রি করে খরচের টাকা তুলতে হচ্ছে।

ষোলমারি গ্রামের পাটচাষি ছহিরুদ্দিন বলেন, তিন বছর যাবৎ পাটের আবাদ করে লোকসান গুনতে হয়েছে। এবছরেও লোকসান হচ্ছে। আগামীতে আর পাটের আবাদ করবো না। অন্য আবাদে ফিরে যাব। ভাটপাড়া গ্রামের পাটচাষি আব্দুল আলিম বলেন, ভারতের মহারাষ্ট্র জাতের পাট লম্বা হয় ৭ থেকে ৮ ফুট। কিন্তু এবছর অনাবৃষ্টির কারণে পাট বাড়তে পারেনি। ৪ থেকে ৫ ফুট লম্বা হয়েই পাট জমিতে শুকিয়ে গেছে। যার ফলে পাটে ফলন কম। এবং আঁশ হয়েছে পাতলা। যদি পাটের ন্যায্যমূল্য থাকতো তাহলে এতেই পুষিয়ে যেত।
পাটের আঁশ ছাড়ানো শ্রমিক লোকমান হোসেন জানান, সকাল ৮টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২ টা পর্যন্ত পাটের আঁশ ছাড়ানোর মজুরি ৬০০ টাকা। প্রায় ১ মাস ধরে পাট সংগ্রহের ভরা মৌসুম। চাষিরা দাম পেলে আমাদেরও ভালো লাগে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে পাটের ফলন কম এবং ওজন হচ্ছে না। পাট মোটা না হওয়ায় আঁশ ছাড়ানোর শ্রমিক লাগছে বেশি।

নওয়াপাড়া গ্রামের পাট ব্যবসায়ী আফিরুল ইসলাম, আমজাদ হোসেন, কালিগাংনীর শহিদুল ইসলাম, গোপালনগর গ্রামের ব্যবসায়ী আজমাইন হোসেন জানান, শুকনা পাটের বর্তমান বাজার মূল্য ১৯৫০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা। কাঁচা পাট বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা বেল। মেহেরপুরের পাট বড় না হওয়ায় পাটের চাহিদা কম। এখন পর্যন্ত পাট কিনছি। কিন্তু বিক্রি করতে পারছি না। পাট শুকিয়ে গোডাউনে রেখে দিচ্ছি। আগামীতে দাম পেলে বিক্রি করবো। আর যদি দাম আরও কমে যায় তবে লোকসান হবে।

পাট ব্যবসায়ী ইন্দাদুল হক বলেন, নদী এলাকার পাটের দাম ভালো । কিন্তু মেহেরপুর জেলায় খালবিল বা পুকুরে পানি না থাকায় পাটের রং সোনালি হওয়ার পরিবর্তে কাদাযুক্ত কালো হচ্ছে। যার ফলে এখানকার পাটের চাহিদা একেবারেই কম। পাট প্রক্রিয়াজাতকরণ কোন কোম্পানি পাট কিনতে চাচ্ছেনা।

মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার বলেন, আমাদের মেহেরপুর জেলায় অনাবৃষ্টির কারণে পাট বাড়তে পারেনি। আঁশ হয়েছে পাতলা। ওজনও কম হচ্ছে। খালে বিলে পাট পচানোর জন্য পানি না পেয়ে কৃষকরা গর্ত করে সেচ দিয়ে পাট পচানোর ব্যবস্থা করছেন। এতে পাটের যে প্রকৃত রং তা হচ্ছে না। ফলে নদী এলাকার পাটের তুলনায় দাম কম পাচ্ছেন। তারপরেও সনাতন পদ্ধতি বাদ দিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পাট পচানো এবং আঁশ সংগ্রহে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

ক্ষরা ও পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে পাটের ফলন বিপর্যয়

মেহেরপুরে পাটকাঠি বিক্রি করে পোষাতে হচ্ছে লোকসান

আপলোড টাইম : ০৮:৫২:৫২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মেহেরপুরে কয়েক বছর যাবৎ বৈরি আবহাওয়ার কারণে সেচের পানির মাধ্যমে পাট আবাদ করেছিলেন চাষিরা। তবে বারবারই ভালো লাভের আশায় পাট চাষ করে হতাশ তারা। চাষিরা বলছেন, এ বছর পাটের আঁশ কম এবং দামও কম। খরচের টাকায় উঠছে না। পাটের মূল্যবৃদ্ধি না হলে আগামীতে পাট চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন তারা।

পাট চাষিরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে মেহেরপুর জেলায় অনাবৃষ্টি ও প্রচণ্ড তাপদাহের কারণে পাটের আবাদে উৎপাদন খরচ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় ফলন বিপর্যয় ঘটেছে। পাটের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে অনেক চাষি পাটের আবাদ ছেড়ে দিয়েছেন। তবে এবছরও অনেক চাষি পাটের আবাদ করেছেন বুকভরা আশা নিয়ে। কিন্তু সে ‘গুড়ে বালি’। এবছরেও পাটের ভালো ফলন হচ্ছে না। আবার দামও কম। পাট উৎপাদনে যে টাকা খরচ হয়েছে, তা উঠছে না। এমনটা চলতে থাকলে আগামীতে আর পাট চাষ করবেন না চাষিরা।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে মেহেরপুরের গাংনী, মুজিবনগর, সদরসহ মোট তিনটি উপজেলায় ১৬ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। জেলায় এবছর ২ লাখ ৪০ হাজার ৬৩৬ বেল পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। রোপনকৃত সব পাটই প্রায় ম্যাচিওর হয়ে গেছে। জমি থেকে পাট কেটে পুকুর ডোবা কিংবা জমিতেই স্যালোমেশিন দিয়ে পানির ব্যবস্থা করে পাট পচানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ায় পাটের রং হচ্ছে কালো। এতে দাম কম পাচ্ছেন পাট চাষিরা। বিশেষ করে দক্ষিণ পশ্চিমাংশের পাটের আঁশ তুলনামূলক কম ও রংয়ের পার্থক্য থাকায় সরকার নির্ধারিত মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাট ব্যবসায়ীরা জানান, এবছর শুকনা পাট বিকিকিনি চলছে ১৯০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা।

গাংনী উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের পাটচাষি ইদ্রিস আলী জানান, তিনি চৈত্র মাসের শেষের দিকে দুই বিঘা জমিতে পাট বীজ রোপণ করেছিলেন। অতিখরার কারণে দুদিন পরপর সেচ দিতে হতো। নিড়ানি, সার, বিষসহ প্রতিবিঘা জমিতে খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু এখন পাট কেটে পচানো থেকে শুরু করে আঁশ ছাড়ানো পর্যন্ত যে খরচ হচ্ছে তা উঠছে না।

মাইলমারি গ্রামের পাটচাষি হবিবর রহমান বলেন, এক বিঘা জমির পাট কাটতে এবং বহন করে পুকুরে পচানো পর্যন্ত খরচ হচ্ছে ৫ হাজার টাকা। সেই পাট আঁশ ছাড়াতে শ্রমিক খরচ হচ্ছে ৩ হাজার টাকা। এক বিঘা জমিতে পাট হচ্ছে ১২ থেকে ১৩মণ। প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে ১৯০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা। কাঁচা পাট বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা। এতে আমাদের খরচের টাকায় উঠছেনা। পাটকাঠি বিক্রি করে খরচের টাকা তুলতে হচ্ছে।

ষোলমারি গ্রামের পাটচাষি ছহিরুদ্দিন বলেন, তিন বছর যাবৎ পাটের আবাদ করে লোকসান গুনতে হয়েছে। এবছরেও লোকসান হচ্ছে। আগামীতে আর পাটের আবাদ করবো না। অন্য আবাদে ফিরে যাব। ভাটপাড়া গ্রামের পাটচাষি আব্দুল আলিম বলেন, ভারতের মহারাষ্ট্র জাতের পাট লম্বা হয় ৭ থেকে ৮ ফুট। কিন্তু এবছর অনাবৃষ্টির কারণে পাট বাড়তে পারেনি। ৪ থেকে ৫ ফুট লম্বা হয়েই পাট জমিতে শুকিয়ে গেছে। যার ফলে পাটে ফলন কম। এবং আঁশ হয়েছে পাতলা। যদি পাটের ন্যায্যমূল্য থাকতো তাহলে এতেই পুষিয়ে যেত।
পাটের আঁশ ছাড়ানো শ্রমিক লোকমান হোসেন জানান, সকাল ৮টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২ টা পর্যন্ত পাটের আঁশ ছাড়ানোর মজুরি ৬০০ টাকা। প্রায় ১ মাস ধরে পাট সংগ্রহের ভরা মৌসুম। চাষিরা দাম পেলে আমাদেরও ভালো লাগে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে পাটের ফলন কম এবং ওজন হচ্ছে না। পাট মোটা না হওয়ায় আঁশ ছাড়ানোর শ্রমিক লাগছে বেশি।

নওয়াপাড়া গ্রামের পাট ব্যবসায়ী আফিরুল ইসলাম, আমজাদ হোসেন, কালিগাংনীর শহিদুল ইসলাম, গোপালনগর গ্রামের ব্যবসায়ী আজমাইন হোসেন জানান, শুকনা পাটের বর্তমান বাজার মূল্য ১৯৫০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা। কাঁচা পাট বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা বেল। মেহেরপুরের পাট বড় না হওয়ায় পাটের চাহিদা কম। এখন পর্যন্ত পাট কিনছি। কিন্তু বিক্রি করতে পারছি না। পাট শুকিয়ে গোডাউনে রেখে দিচ্ছি। আগামীতে দাম পেলে বিক্রি করবো। আর যদি দাম আরও কমে যায় তবে লোকসান হবে।

পাট ব্যবসায়ী ইন্দাদুল হক বলেন, নদী এলাকার পাটের দাম ভালো । কিন্তু মেহেরপুর জেলায় খালবিল বা পুকুরে পানি না থাকায় পাটের রং সোনালি হওয়ার পরিবর্তে কাদাযুক্ত কালো হচ্ছে। যার ফলে এখানকার পাটের চাহিদা একেবারেই কম। পাট প্রক্রিয়াজাতকরণ কোন কোম্পানি পাট কিনতে চাচ্ছেনা।

মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার বলেন, আমাদের মেহেরপুর জেলায় অনাবৃষ্টির কারণে পাট বাড়তে পারেনি। আঁশ হয়েছে পাতলা। ওজনও কম হচ্ছে। খালে বিলে পাট পচানোর জন্য পানি না পেয়ে কৃষকরা গর্ত করে সেচ দিয়ে পাট পচানোর ব্যবস্থা করছেন। এতে পাটের যে প্রকৃত রং তা হচ্ছে না। ফলে নদী এলাকার পাটের তুলনায় দাম কম পাচ্ছেন। তারপরেও সনাতন পদ্ধতি বাদ দিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পাট পচানো এবং আঁশ সংগ্রহে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।