ইপেপার । আজ সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পুনঃতদন্ত হবে পিলখানা হত্যার

সমীকরণ প্রতিবেদন:
  • আপলোড টাইম : ০৪:৪২:০৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / ২৬ বার পড়া হয়েছে

রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে ‘দরবার অনুষ্ঠানে’ নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী সময়ে এর বিচার কার্যক্রম এবং প্রক্রিয়া নিয়ে রয়েছে সমালোচনা ও বিতর্ক। নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবার এবং স্বজনরা হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারণ ও বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছেন শুরু থেকেই। একই সঙ্গে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে যেসব সেনা সদস্যকে গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে- তাদের স্বজনরাও এর প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ঘটনায় জড়িত অনেককে আড়াল করে বিনা অপরাধে অনেককে শাস্তি দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। একাধিক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ওই ঘটনার বিচার বিভাগীয় এমনকি আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করা হয়েছে। ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে বর্বরোচিতভাবে হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রাজনৈতিক এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র থাকার কথাও বলছেন কেউ কেউ। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের পর সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) করা হয়। বিতর্ক, সমালোচনা ও বিভিন্ন মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ বছর আগে সংঘটিত পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনা পুনঃতদন্ত শুরু করতে যাচ্ছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গতকাল বলেছেন, ১৫ বছর আগে বিডিআর বিদ্রোহের সময় ঢাকার পিলখানায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত করা হবে। গতকাল সোমবার সকালে বাংলাদেশ নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত র‌্যাটো র‌্যাংলির সঙ্গে সচিবালয়ে নিজের দপ্তরে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান তিনি। এ সময় পিলখানা হত্যাকাণ্ডের তদন্তের বিষয়ে এক প্রশ্নে সাবেক সেনা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার জনগণের অধিকার, সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। শুধু স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে নয়, একজন সাধারণ নাগরিক ও সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য হিসেবে আমি বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার চাই। সঠিকভাবে এ হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া শিগগিরই শুরু করা হবে। সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে মর্মান্তিক ওই ঘটনা নিয়ে সেনাবাহিনী গঠিত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এর আগে বিডিআর প্রধানেরও দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকারের পটপরিবর্তনের পর বিডিআর বিদ্রোহের সময় হত্যাকাণ্ডের মামলায় যেসব তদন্ত হয়েছে, সেসব তদন্তের প্রতিবেদন পাবলিক করা এবং ২৫ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ সেনা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিচার করার দাবি জানান নিহত সেনাসদস্যদের স্বজনরা। ১৭ আগস্ট শনিবার দুপুরে রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেনে সাত দফা দাবি জানান তারা।
সংবাদ সম্মেলনে বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) নিহত মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে একজন সিটিং প্রধানমন্ত্রী একটি বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সেনা অফিসারদের হত্যা করেন। এজন্যই আমরা শহীদ দিবস দাবি করছি। ১৫ বছর যেভাবে তদন্ত হয়েছে, তা আমরা মানি না। কারণ প্রধান হত্যাকারী (যিনি নির্দেশ দিয়েছেন) তখন গণভবনে। এ ঘটনায় যারা নির্দোষ, এখনো জেল খাটছেন, তাদের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে মুক্তি দেয়ার দাবি জানান তারা।

নিহত মেজর কাজী মোসাদ্দেক হোসেনের মেয়ে নাজিয়া বলেন, আমাদের কষ্টের কথা যদি বলি, একই পরিস্থিতিতে এখনো যাচ্ছি। কষ্ট দূরে হয়ে যায়নি। এর পেছনে অনেক ঘটনা ছিল। আমরা তো আমাদের স্বজনদের হারিয়ে ফেলেছি। মানুষ জানুক এই হত্যাকাণ্ড কারা করেছে। কেন এত বছর পরও আমাদের মুভমেন্টে বাধা হয়।

নিহত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এনায়েতুল হকের মেয়ে নাবিলা বলেন, এটা আন্তর্জাতিক চক্রের কাজ। আন্তর্জাতিক শক্তির দ্বারাই কাজটি করা হয়েছে। আপনারা বের করবেন আসল কারণ। এটা বিদ্রোহ নয়, এটা হত্যাকাণ্ড, পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড। আমার বাবা মারা যাননি। হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কিছু অপপ্রচারের জন্য আমরা হেনস্তা হয়েছি। এতদিন ভয়ে কথা বলিনি, আজ নির্ভয়ে কথা বলছি। নিহত সেনা সদস্যদের স্বজনরা আরো বলেন, ‘১৫ বছর ধরে আমাদের একটাই দাবি, বিচার চাই। একটা স্বচ্ছ বিচার হোক। আমরা এ বিষয়ে আর লুকোচুরি চাই না। চাপ দিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করা হয়েছিল। বাধার মধ্যে ১৬ বছর পার করেছি। ওইদিন সংবাদ সম্মেলনে নিহত এক সেনা কর্মকর্তার ছেলে সাকিব ও মেজর শাকিলের ছেলে রাকিন ছাড়াও অন্য নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনরাও বক্তব্য রাখেন।

পরিবারগুলোর সাত দাবি :
১. সত্য উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে আগে যেসব তদন্ত হয়েছে, সেসব তদন্তের প্রতিবেদন পাবলিক করতে হবে। ২. হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় মোতাবেক তিন বিচারক যে ইনকোয়ারি কমিশনের কথা বলেছেন অবিলম্বে সেই ইনকোয়ারি কমিশন গঠন করতে হবে। এতে পর্দার আড়ালে রয়ে যাওয়া ষড়যন্ত্রকারীদের নাম বেরিয়ে আসবে। ৩. অফিসিয়াল গ্যাজেট করে ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে এবং গ্যাজেটে নিহতদের সবাইকে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। ৪. ২৫ ফেব্রুয়ারি শোক দিবসকে ঘিরে দেশজুড়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখতে হবে। ৫. পিলখানা ট্র্যাজেডিকে স্কুলের পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ৬. এ ঘটনাকে ঘিরে যেসব সেনা কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন, তাদের চাকরি ফিরিয়ে দিতে হবে অথবা যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৭. নির্দোষ কোনো বিডিআর জওয়ানকে যেন কোনোভাবেই সাজা না দেয়া হয়।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি বিএনপি নেতা হাফিজ উদ্দিনও বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে সেনাবাহিনীর তদন্ত প্রতিবেদন জনগণের সামনে প্রকাশের দাবি তোলেছেন। প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদরদপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক ও ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন তোলে ওই ঘটনা। এই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। হত্যা মামলায় খালাস বা সাজাভোগ শেষে বিস্ফোরক মামলার কারণে আটকে আছে ৪৬৮ বিডিআর সদস্যের। হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। তাতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয়ে যায় হাইকোর্টে। তাতে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয় ১৮৫ জনকে। আরো ২২৮ জনকে দেয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস পান ২৮৩ জন। হাইকোর্টের রায়ের আগে ১৫ জনসহ সব মিলিয়ে ৫৪ জন আসামি মারা গেছেন।
হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২২৬ জন আসামি আপিল ও লিভ টু আপিল করেছেন। অন্যদিকে হাইকোর্টে ৮৩ জন আসামির খালাস এবং সাজা কমানোর রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আপিল ও লিভ টু আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায়। বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮৩৪ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। কিন্তু মাঝপথে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম এক প্রকার স্থগিত রেখে শুধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। যে কারণে এই মামলার বিচার ঝুলে যায়।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

পুনঃতদন্ত হবে পিলখানা হত্যার

আপলোড টাইম : ০৪:৪২:০৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে ‘দরবার অনুষ্ঠানে’ নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী সময়ে এর বিচার কার্যক্রম এবং প্রক্রিয়া নিয়ে রয়েছে সমালোচনা ও বিতর্ক। নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবার এবং স্বজনরা হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারণ ও বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছেন শুরু থেকেই। একই সঙ্গে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে যেসব সেনা সদস্যকে গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে- তাদের স্বজনরাও এর প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ঘটনায় জড়িত অনেককে আড়াল করে বিনা অপরাধে অনেককে শাস্তি দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। একাধিক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ওই ঘটনার বিচার বিভাগীয় এমনকি আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করা হয়েছে। ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে বর্বরোচিতভাবে হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রাজনৈতিক এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র থাকার কথাও বলছেন কেউ কেউ। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের পর সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) করা হয়। বিতর্ক, সমালোচনা ও বিভিন্ন মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ বছর আগে সংঘটিত পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনা পুনঃতদন্ত শুরু করতে যাচ্ছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গতকাল বলেছেন, ১৫ বছর আগে বিডিআর বিদ্রোহের সময় ঢাকার পিলখানায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত করা হবে। গতকাল সোমবার সকালে বাংলাদেশ নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত র‌্যাটো র‌্যাংলির সঙ্গে সচিবালয়ে নিজের দপ্তরে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান তিনি। এ সময় পিলখানা হত্যাকাণ্ডের তদন্তের বিষয়ে এক প্রশ্নে সাবেক সেনা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার জনগণের অধিকার, সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। শুধু স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে নয়, একজন সাধারণ নাগরিক ও সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য হিসেবে আমি বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার চাই। সঠিকভাবে এ হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া শিগগিরই শুরু করা হবে। সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে মর্মান্তিক ওই ঘটনা নিয়ে সেনাবাহিনী গঠিত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এর আগে বিডিআর প্রধানেরও দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকারের পটপরিবর্তনের পর বিডিআর বিদ্রোহের সময় হত্যাকাণ্ডের মামলায় যেসব তদন্ত হয়েছে, সেসব তদন্তের প্রতিবেদন পাবলিক করা এবং ২৫ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ সেনা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিচার করার দাবি জানান নিহত সেনাসদস্যদের স্বজনরা। ১৭ আগস্ট শনিবার দুপুরে রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেনে সাত দফা দাবি জানান তারা।
সংবাদ সম্মেলনে বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) নিহত মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে একজন সিটিং প্রধানমন্ত্রী একটি বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সেনা অফিসারদের হত্যা করেন। এজন্যই আমরা শহীদ দিবস দাবি করছি। ১৫ বছর যেভাবে তদন্ত হয়েছে, তা আমরা মানি না। কারণ প্রধান হত্যাকারী (যিনি নির্দেশ দিয়েছেন) তখন গণভবনে। এ ঘটনায় যারা নির্দোষ, এখনো জেল খাটছেন, তাদের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে মুক্তি দেয়ার দাবি জানান তারা।

নিহত মেজর কাজী মোসাদ্দেক হোসেনের মেয়ে নাজিয়া বলেন, আমাদের কষ্টের কথা যদি বলি, একই পরিস্থিতিতে এখনো যাচ্ছি। কষ্ট দূরে হয়ে যায়নি। এর পেছনে অনেক ঘটনা ছিল। আমরা তো আমাদের স্বজনদের হারিয়ে ফেলেছি। মানুষ জানুক এই হত্যাকাণ্ড কারা করেছে। কেন এত বছর পরও আমাদের মুভমেন্টে বাধা হয়।

নিহত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এনায়েতুল হকের মেয়ে নাবিলা বলেন, এটা আন্তর্জাতিক চক্রের কাজ। আন্তর্জাতিক শক্তির দ্বারাই কাজটি করা হয়েছে। আপনারা বের করবেন আসল কারণ। এটা বিদ্রোহ নয়, এটা হত্যাকাণ্ড, পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড। আমার বাবা মারা যাননি। হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কিছু অপপ্রচারের জন্য আমরা হেনস্তা হয়েছি। এতদিন ভয়ে কথা বলিনি, আজ নির্ভয়ে কথা বলছি। নিহত সেনা সদস্যদের স্বজনরা আরো বলেন, ‘১৫ বছর ধরে আমাদের একটাই দাবি, বিচার চাই। একটা স্বচ্ছ বিচার হোক। আমরা এ বিষয়ে আর লুকোচুরি চাই না। চাপ দিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করা হয়েছিল। বাধার মধ্যে ১৬ বছর পার করেছি। ওইদিন সংবাদ সম্মেলনে নিহত এক সেনা কর্মকর্তার ছেলে সাকিব ও মেজর শাকিলের ছেলে রাকিন ছাড়াও অন্য নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনরাও বক্তব্য রাখেন।

পরিবারগুলোর সাত দাবি :
১. সত্য উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে আগে যেসব তদন্ত হয়েছে, সেসব তদন্তের প্রতিবেদন পাবলিক করতে হবে। ২. হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় মোতাবেক তিন বিচারক যে ইনকোয়ারি কমিশনের কথা বলেছেন অবিলম্বে সেই ইনকোয়ারি কমিশন গঠন করতে হবে। এতে পর্দার আড়ালে রয়ে যাওয়া ষড়যন্ত্রকারীদের নাম বেরিয়ে আসবে। ৩. অফিসিয়াল গ্যাজেট করে ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে এবং গ্যাজেটে নিহতদের সবাইকে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। ৪. ২৫ ফেব্রুয়ারি শোক দিবসকে ঘিরে দেশজুড়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখতে হবে। ৫. পিলখানা ট্র্যাজেডিকে স্কুলের পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ৬. এ ঘটনাকে ঘিরে যেসব সেনা কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন, তাদের চাকরি ফিরিয়ে দিতে হবে অথবা যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৭. নির্দোষ কোনো বিডিআর জওয়ানকে যেন কোনোভাবেই সাজা না দেয়া হয়।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি বিএনপি নেতা হাফিজ উদ্দিনও বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে সেনাবাহিনীর তদন্ত প্রতিবেদন জনগণের সামনে প্রকাশের দাবি তোলেছেন। প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদরদপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক ও ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন তোলে ওই ঘটনা। এই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। হত্যা মামলায় খালাস বা সাজাভোগ শেষে বিস্ফোরক মামলার কারণে আটকে আছে ৪৬৮ বিডিআর সদস্যের। হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। তাতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয়ে যায় হাইকোর্টে। তাতে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয় ১৮৫ জনকে। আরো ২২৮ জনকে দেয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস পান ২৮৩ জন। হাইকোর্টের রায়ের আগে ১৫ জনসহ সব মিলিয়ে ৫৪ জন আসামি মারা গেছেন।
হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২২৬ জন আসামি আপিল ও লিভ টু আপিল করেছেন। অন্যদিকে হাইকোর্টে ৮৩ জন আসামির খালাস এবং সাজা কমানোর রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আপিল ও লিভ টু আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায়। বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮৩৪ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। কিন্তু মাঝপথে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম এক প্রকার স্থগিত রেখে শুধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। যে কারণে এই মামলার বিচার ঝুলে যায়।