ইপেপার । আজ বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আতঙ্কের নাম লাল্টু

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৫:৪৭:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৪
  • / ১২৬ বার পড়া হয়েছে

চুয়াডাঙ্গা জেলার এক সময়ের আতঙ্কের নাম নুরুজ্জামান লাল্টু (নাণ্টু)। মানুষকে হত্যা করে তার আলামত নিশ্চিহ্ন করতে পারদর্শিতায় তার জুড়ি মেলা ভার। সেই অন্ধকার সময়ে কত মানুষের লাশ ইটের ভাটায় পুড়িয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা এখনো অজানা। তিনি বহু মানুষকে জীবন্ত অবস্থায় ইটের ভাটাতে হাত-পা বেঁধে ছুড়ে দিয়েছেন বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তার এই পৈশাচিক কর্মকাণ্ডে অন্যদের সাথে অন্যতম সহযোগী ছিলেন তারই ভাতিজা বিপ্লব। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে আত্মসমর্পণের পর তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ২৬টি মামলা। লাল্টুর প্রকৃত নাম নুরুজ্জামান। চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া এবং ঝিনাইদহের একাংশে তিনি পরিচিত পান লাল্টু নামে।
মুক্তিযোদ্ধা থেকে ত্রাস:
লাল্টুর বাড়ি চুয়াডাঙ্গার কয়রাডাঙ্গা গ্রামে। মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান লাল্টু। বাবা সিরাজুল ইসলাম পরিচিত ছিলেন ‘সিরাজ ডাকাত’ নামে। অন্যের ঘরবাড়ি ও জমি দখল ছিল তার পেশা। গ্রামবাসী জানায়, ১৯৬৩ সালে আলমডাঙ্গা থানার শিবপুর গ্রামে বলপ্রয়োগে একটি বাড়ি দখল করে এক মধ্যাহ্নে বিশ্রাম করছিলেন সিরাজ ডাকাত। অতর্কিতভাবে গ্রামবাসীর হামলায় তিনি মারা যান। লাল্টুর বড় ভাই মতিয়ার রহমান মণ্টু মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসের পরিচয় দেন। লাল্টু নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পর জাসদ গঠিত হলে তাতে যোগ দেন মণ্টু। পরে জাসদের আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডারেরও দায়িত্ব পান। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কাজী আরেফ হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তিনিই মূল পরিকল্পনাকারী। তবে তার আগেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মণ্টু ও লাল্টু। দুই ভাই চুয়াডাঙ্গা উপ-কারাগারে থাকাকালে ১৫২ জন হাজতি ও কয়েদিসহ কারাগার ভেঙে পালিয়ে যান ১৯৭৩ সালের ১৪ জুলাই। এটা ঘটে তাদের নেতৃত্বেই। তাদের অন্য ভাই আণ্টু নিহত হন ১৯৭৪ সালে। দুই ভাই এসময় সশস্ত্র লাইনে কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। মেহেরপুরের ট্রেজারির অস্ত্রাগার লুট করতে গিয়ে মণ্টু নিহত হন ওই বছরের ২১ মার্চ।
কারাগারে লাল্টু:
১৯৭৫ সালের ৩০ মে চুয়াডাঙ্গা সদরের নুরুল্লাপুর গ্রাম থেকে লাল্টু তার ৯ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হন। প্রায় ৯ বছর পর লাল্টু মুক্তি পান ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। এরপর লাল্টু স্বাভাবিক জীবনে থাকার চেষ্টা করেন। জীবিকার প্রয়োজনে পশু বেচাকেনা ও স্থানীয় গোকুলখালী বাজারে আড়তদারি ব্যবসাতে নিয়োজিত হন। গ্রামবাসীর মতে, এসময় তিনি তীব্র হতাশায় ছিলেন। আর্থিক সংকটে কাটছিল তার দিন। এছাড়া ওই অঞ্চলে গোপন কিছু সশস্ত্র গ্রুপের কারণে তার জীবনযাপনও ছিল হুমকির মুখে। ১৯৮৭ সালে আলমডাঙ্গা থানা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার নির্বাচিত হন লাল্টু। ১৯৯৬ সালে লাল্টু পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বিতাড়িত হয়ে ভারতে চলে যান। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) অস্ত্র ছিনতাইয়ের অভিযোগে ১৯৯৭ সালের ১৭ মার্চ লাল্টু পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হাতে আটক হন। তিন মাস কারাভোগ করে ছাড়া পান তিনি। ১৯৯৯ সালের ২৯ জুলাই লাল্টু খুলনার তৎকালীন ডিআইজি লুৎফুল কবিরের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, সেই সময় একটি প্রভাবশালী মহল চেয়েছিল, লাল্টু যেন আত্মসমর্পণ না করে। আর করলেও যেন তার সাজা মওকুফের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু জনমতের চাপে সরকার তাকে যেকোনো ভাবেই হোক আটকের সিদ্ধান্ত নেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের ওপরও প্রচণ্ড চাপ দেওয়া হয় লাল্টু, ভাতিজা বিপ্লবসহ বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির ক্যাডারদের আত্মসমর্পণে। এটা বুঝতে পেরে লাল্টু আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন।
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি বনাম বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি:
আত্মসমর্পণের সময় দেয়া বক্তব্যে লাল্টু বলেন, ১৯৯১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মারফত ভাই (মুক্তিযোদ্ধা মারফত আলী, কুষ্টিয়ার মীরপুরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান) খুন হলে আমি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) সঙ্গে যোগাযোগ করি। এর পরপরই আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা করে এক দল লোক। এ অবস্থায় ১৯৯২ সালে যোগদান করি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে। কিন্তু ১৯৯৫ সালের ৬ জুলাই দামুড়হুদার কুলবিলা গুচ্ছগ্রামে পার্টির সশস্ত্র ক্যাডাররা ৮ কৃষককে হত্যা করলে আমি ক্ষুব্ধ হয়ে দলত্যাগ করি। পার্টি আমার মৃত্যুদণ্ড দেয়। আমি পালিয়ে ভারতে চলে যাই। সেখান থেকে ফিরে আসার পর আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই আমি একটি গ্রুপ গঠন করি।’
লাল্টু সেদিন তার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ আছে, তা অস্বীকার করেছিলেন। কাজী আরেফ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তার বক্তব্য ছিল, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা আর একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করতে পারে না। তা ছাড়া সন্ত্রাস প্রতিরোধই আমার লক্ষ্য ছিল।’
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কাজী আরেফ হত্যাকাণ্ডের পর পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) তাদের লিফলেটে জানায়, লাল্টু ১৯৯২ সাল নয়, ১৯৯০ সালেই পূর্ব বাংলায় যোগ দিয়েছিলেন। তারা আরও দাবি করে, লাল্টু তার গডফাদারদের সঙ্গে পরামর্শ করেই নিজের ও প্রভূদের রক্ষা, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করাসহ অন্যান্য কারণে দলে যোগদান করেছিল। প্রথমে দল তা বুঝতে না পারলেও পরে স্পষ্ট হয়। তিনি দলের মধ্যে একটি সুবিধাবাদী চক্র গড়ে তোলে। ১৯৯৬ সালে চক্রটি চিহ্নিত করার পর বহিষ্কার করা হয়। তার কাছে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র এবং নগদ চাঁদার অর্থ পার্টি ফেরতের নির্দেশ দিলে তিনি ভারতে চলে যান। লাল্টু চাঁদার টাকা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার রানাঘাটে একটি বাড়ি বানান। দুটি ট্রাকও কেনেন। গ্রহণ করেন ভারতীয় নাগরিকত্ব। ১৯৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে তিন মাস জেল খেটে লাল্টু আবার চলে আসেন চুয়াডাঙ্গাতে, তার নিজ এলাকায়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ওই সময় পরিস্থিতি লাল্টুর অনুকূলে আসে। ১৯৯৭ সালের ৩০ মার্চ পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডার চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার চারুলিয়া গ্রামের রুহুল আমিন গ্রেপ্তার হন। তার স্থানে দলের ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক কমান্ডার হন তার ভাই সবুজ। পূর্ব বাংলার এই ভঙ্গুর অবস্থায় লাল্টু অত্যান্ত দ্রুত নিজের সশস্ত্র গ্রুপ গড়ে তোলে। তার সঙ্গে যোগ দেয় পূর্ব বাংলার কিছু সদস্য, সিরাজ বাহিনীর বেশ কয়েকজন সশস্ত্র ক্যাডার এবং ছোট সন্ত্রাসী ডাকাত গ্রুপ। জনশ্রুতি আছে, তার সশস্ত্র গ্রুপকে শক্তিশালী এবং পূর্ব বাংলার অবস্থান দুর্বল করতে লাল্টু প্রভাবশালী নানা মহলের সহায়তা পায়। ১৯৯৮ সালের ১ ডিসেম্বর লাল্টু গঠন করে ‘বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’।
ত্রিমুখী সংঘাত ও নৃশংসতা:
লাল্টু খুব দ্রুত তার বাহিনীকে সংগঠিত করে পূর্ব বাংলা ও সিরাজ বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ করেন। ত্রিপক্ষীয় ওই সংঘাতে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর এবং কুষ্টিয়ার একাংশে আত্মসমর্পণের পূর্ব পর্যন্ত লাশ পড়তে থাকে একের পর এক। কিন্তু লাল্টু ছিল ব্যতিক্রমী। আত্মসমর্পণের পূর্ব পর্যন্ত লাল্টুর তথাকথিত ‘বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’ আলমডাঙ্গা থানার কালিদাসপুর ইউনিয়ন ছাড়া সব ইউনিয়ন, চুয়াডাঙ্গা সদরের সব ইউনিয়ন এবং দামুড়হুদা ও জীবননগর উপজেলার একাংশে তার কর্তৃত্ব পুরোপুরি বজায় রাখেন। লাল্টুর বিরুদ্ধে সহজে কেউ হত্যা মামলা দায়েরের সাহসও পেত না। এরপরও তার বিরুদ্ধে ২১টি হত্যাসহ ২৬টি মামলা হয়েছিল। আত্মসমর্পণের পর তা আরও বাড়ে। দুটি মামলায় যাবজ্জীবনসহ ১০ বছরের কারাদণ্ড হয় তার।
উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালের ১০ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলায় একটি হত্যা মামলাসহ অর্ধশতাধিক মামলায় কারাগারে বন্দি ছিলেন লাল্টু। গত ১৪/১২/১৭ইং তারিখে উচ্চআদালত থেকে তাকে জামিন দেয়া হয়। এছাড়া ১৯৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার কালিদাসপুর স্কুলমাঠে দলীয় জনসভায় সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে কাজী আরেফ আহমেদসহ ৫ জাসদ নেতা খুন মামলারও অন্যতম আসামি তিনি। বেশ কয়েকটি মামলায় ইতিপূর্বে তিনি খালাস পেলেও অধিকাংশ মামলায় বিচারাধীন।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

আতঙ্কের নাম লাল্টু

আপলোড টাইম : ০৫:৪৭:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৪

চুয়াডাঙ্গা জেলার এক সময়ের আতঙ্কের নাম নুরুজ্জামান লাল্টু (নাণ্টু)। মানুষকে হত্যা করে তার আলামত নিশ্চিহ্ন করতে পারদর্শিতায় তার জুড়ি মেলা ভার। সেই অন্ধকার সময়ে কত মানুষের লাশ ইটের ভাটায় পুড়িয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা এখনো অজানা। তিনি বহু মানুষকে জীবন্ত অবস্থায় ইটের ভাটাতে হাত-পা বেঁধে ছুড়ে দিয়েছেন বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তার এই পৈশাচিক কর্মকাণ্ডে অন্যদের সাথে অন্যতম সহযোগী ছিলেন তারই ভাতিজা বিপ্লব। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে আত্মসমর্পণের পর তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ২৬টি মামলা। লাল্টুর প্রকৃত নাম নুরুজ্জামান। চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া এবং ঝিনাইদহের একাংশে তিনি পরিচিত পান লাল্টু নামে।
মুক্তিযোদ্ধা থেকে ত্রাস:
লাল্টুর বাড়ি চুয়াডাঙ্গার কয়রাডাঙ্গা গ্রামে। মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান লাল্টু। বাবা সিরাজুল ইসলাম পরিচিত ছিলেন ‘সিরাজ ডাকাত’ নামে। অন্যের ঘরবাড়ি ও জমি দখল ছিল তার পেশা। গ্রামবাসী জানায়, ১৯৬৩ সালে আলমডাঙ্গা থানার শিবপুর গ্রামে বলপ্রয়োগে একটি বাড়ি দখল করে এক মধ্যাহ্নে বিশ্রাম করছিলেন সিরাজ ডাকাত। অতর্কিতভাবে গ্রামবাসীর হামলায় তিনি মারা যান। লাল্টুর বড় ভাই মতিয়ার রহমান মণ্টু মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসের পরিচয় দেন। লাল্টু নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পর জাসদ গঠিত হলে তাতে যোগ দেন মণ্টু। পরে জাসদের আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডারেরও দায়িত্ব পান। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কাজী আরেফ হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তিনিই মূল পরিকল্পনাকারী। তবে তার আগেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মণ্টু ও লাল্টু। দুই ভাই চুয়াডাঙ্গা উপ-কারাগারে থাকাকালে ১৫২ জন হাজতি ও কয়েদিসহ কারাগার ভেঙে পালিয়ে যান ১৯৭৩ সালের ১৪ জুলাই। এটা ঘটে তাদের নেতৃত্বেই। তাদের অন্য ভাই আণ্টু নিহত হন ১৯৭৪ সালে। দুই ভাই এসময় সশস্ত্র লাইনে কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। মেহেরপুরের ট্রেজারির অস্ত্রাগার লুট করতে গিয়ে মণ্টু নিহত হন ওই বছরের ২১ মার্চ।
কারাগারে লাল্টু:
১৯৭৫ সালের ৩০ মে চুয়াডাঙ্গা সদরের নুরুল্লাপুর গ্রাম থেকে লাল্টু তার ৯ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হন। প্রায় ৯ বছর পর লাল্টু মুক্তি পান ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। এরপর লাল্টু স্বাভাবিক জীবনে থাকার চেষ্টা করেন। জীবিকার প্রয়োজনে পশু বেচাকেনা ও স্থানীয় গোকুলখালী বাজারে আড়তদারি ব্যবসাতে নিয়োজিত হন। গ্রামবাসীর মতে, এসময় তিনি তীব্র হতাশায় ছিলেন। আর্থিক সংকটে কাটছিল তার দিন। এছাড়া ওই অঞ্চলে গোপন কিছু সশস্ত্র গ্রুপের কারণে তার জীবনযাপনও ছিল হুমকির মুখে। ১৯৮৭ সালে আলমডাঙ্গা থানা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার নির্বাচিত হন লাল্টু। ১৯৯৬ সালে লাল্টু পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বিতাড়িত হয়ে ভারতে চলে যান। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) অস্ত্র ছিনতাইয়ের অভিযোগে ১৯৯৭ সালের ১৭ মার্চ লাল্টু পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হাতে আটক হন। তিন মাস কারাভোগ করে ছাড়া পান তিনি। ১৯৯৯ সালের ২৯ জুলাই লাল্টু খুলনার তৎকালীন ডিআইজি লুৎফুল কবিরের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, সেই সময় একটি প্রভাবশালী মহল চেয়েছিল, লাল্টু যেন আত্মসমর্পণ না করে। আর করলেও যেন তার সাজা মওকুফের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু জনমতের চাপে সরকার তাকে যেকোনো ভাবেই হোক আটকের সিদ্ধান্ত নেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের ওপরও প্রচণ্ড চাপ দেওয়া হয় লাল্টু, ভাতিজা বিপ্লবসহ বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির ক্যাডারদের আত্মসমর্পণে। এটা বুঝতে পেরে লাল্টু আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন।
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি বনাম বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি:
আত্মসমর্পণের সময় দেয়া বক্তব্যে লাল্টু বলেন, ১৯৯১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মারফত ভাই (মুক্তিযোদ্ধা মারফত আলী, কুষ্টিয়ার মীরপুরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান) খুন হলে আমি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) সঙ্গে যোগাযোগ করি। এর পরপরই আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা করে এক দল লোক। এ অবস্থায় ১৯৯২ সালে যোগদান করি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে। কিন্তু ১৯৯৫ সালের ৬ জুলাই দামুড়হুদার কুলবিলা গুচ্ছগ্রামে পার্টির সশস্ত্র ক্যাডাররা ৮ কৃষককে হত্যা করলে আমি ক্ষুব্ধ হয়ে দলত্যাগ করি। পার্টি আমার মৃত্যুদণ্ড দেয়। আমি পালিয়ে ভারতে চলে যাই। সেখান থেকে ফিরে আসার পর আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই আমি একটি গ্রুপ গঠন করি।’
লাল্টু সেদিন তার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ আছে, তা অস্বীকার করেছিলেন। কাজী আরেফ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তার বক্তব্য ছিল, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা আর একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করতে পারে না। তা ছাড়া সন্ত্রাস প্রতিরোধই আমার লক্ষ্য ছিল।’
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কাজী আরেফ হত্যাকাণ্ডের পর পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) তাদের লিফলেটে জানায়, লাল্টু ১৯৯২ সাল নয়, ১৯৯০ সালেই পূর্ব বাংলায় যোগ দিয়েছিলেন। তারা আরও দাবি করে, লাল্টু তার গডফাদারদের সঙ্গে পরামর্শ করেই নিজের ও প্রভূদের রক্ষা, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করাসহ অন্যান্য কারণে দলে যোগদান করেছিল। প্রথমে দল তা বুঝতে না পারলেও পরে স্পষ্ট হয়। তিনি দলের মধ্যে একটি সুবিধাবাদী চক্র গড়ে তোলে। ১৯৯৬ সালে চক্রটি চিহ্নিত করার পর বহিষ্কার করা হয়। তার কাছে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র এবং নগদ চাঁদার অর্থ পার্টি ফেরতের নির্দেশ দিলে তিনি ভারতে চলে যান। লাল্টু চাঁদার টাকা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার রানাঘাটে একটি বাড়ি বানান। দুটি ট্রাকও কেনেন। গ্রহণ করেন ভারতীয় নাগরিকত্ব। ১৯৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে তিন মাস জেল খেটে লাল্টু আবার চলে আসেন চুয়াডাঙ্গাতে, তার নিজ এলাকায়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ওই সময় পরিস্থিতি লাল্টুর অনুকূলে আসে। ১৯৯৭ সালের ৩০ মার্চ পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডার চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার চারুলিয়া গ্রামের রুহুল আমিন গ্রেপ্তার হন। তার স্থানে দলের ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক কমান্ডার হন তার ভাই সবুজ। পূর্ব বাংলার এই ভঙ্গুর অবস্থায় লাল্টু অত্যান্ত দ্রুত নিজের সশস্ত্র গ্রুপ গড়ে তোলে। তার সঙ্গে যোগ দেয় পূর্ব বাংলার কিছু সদস্য, সিরাজ বাহিনীর বেশ কয়েকজন সশস্ত্র ক্যাডার এবং ছোট সন্ত্রাসী ডাকাত গ্রুপ। জনশ্রুতি আছে, তার সশস্ত্র গ্রুপকে শক্তিশালী এবং পূর্ব বাংলার অবস্থান দুর্বল করতে লাল্টু প্রভাবশালী নানা মহলের সহায়তা পায়। ১৯৯৮ সালের ১ ডিসেম্বর লাল্টু গঠন করে ‘বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’।
ত্রিমুখী সংঘাত ও নৃশংসতা:
লাল্টু খুব দ্রুত তার বাহিনীকে সংগঠিত করে পূর্ব বাংলা ও সিরাজ বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ করেন। ত্রিপক্ষীয় ওই সংঘাতে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর এবং কুষ্টিয়ার একাংশে আত্মসমর্পণের পূর্ব পর্যন্ত লাশ পড়তে থাকে একের পর এক। কিন্তু লাল্টু ছিল ব্যতিক্রমী। আত্মসমর্পণের পূর্ব পর্যন্ত লাল্টুর তথাকথিত ‘বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’ আলমডাঙ্গা থানার কালিদাসপুর ইউনিয়ন ছাড়া সব ইউনিয়ন, চুয়াডাঙ্গা সদরের সব ইউনিয়ন এবং দামুড়হুদা ও জীবননগর উপজেলার একাংশে তার কর্তৃত্ব পুরোপুরি বজায় রাখেন। লাল্টুর বিরুদ্ধে সহজে কেউ হত্যা মামলা দায়েরের সাহসও পেত না। এরপরও তার বিরুদ্ধে ২১টি হত্যাসহ ২৬টি মামলা হয়েছিল। আত্মসমর্পণের পর তা আরও বাড়ে। দুটি মামলায় যাবজ্জীবনসহ ১০ বছরের কারাদণ্ড হয় তার।
উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালের ১০ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলায় একটি হত্যা মামলাসহ অর্ধশতাধিক মামলায় কারাগারে বন্দি ছিলেন লাল্টু। গত ১৪/১২/১৭ইং তারিখে উচ্চআদালত থেকে তাকে জামিন দেয়া হয়। এছাড়া ১৯৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার কালিদাসপুর স্কুলমাঠে দলীয় জনসভায় সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে কাজী আরেফ আহমেদসহ ৫ জাসদ নেতা খুন মামলারও অন্যতম আসামি তিনি। বেশ কয়েকটি মামলায় ইতিপূর্বে তিনি খালাস পেলেও অধিকাংশ মামলায় বিচারাধীন।