ইপেপার । আজ বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চুয়াডাঙ্গায় আইনশৃঙ্খলা সভায় দীর্ঘ ১৭ বছর পর সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ

সকলের অংশগ্রহণে চুয়াডাঙ্গাকে নতুন করে গড়ে তোলার প্রত্যয়

নিজস্ব প্রতিবেদক:
  • আপলোড টাইম : ০১:০৩:৩৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ অগাস্ট ২০২৪
  • / ২৩ বার পড়া হয়েছে

চুয়াডাঙ্গায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রুখতে জেলা প্রশাসনের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ ১৭ বছর পর সব রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এ ধরনের কোনো সভা দেখা গেল। এটিকে চুয়াডাঙ্গার সুধীজনরাও গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন, করেছেন ইতিবাচক আলোচনা।

সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী চুয়াডাঙ্গার কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ ধর্মীয় বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি, বিএনপি, জামায়াত ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন, আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তবে সভার মূল আকর্ষণ ছিলেন জেলা বিএনপির সদস্যসচিব শরীফুজ্জামান শরীফ। তিনি ওই সভায় দাবি করেন, চুয়াডাঙ্গার পরিবেশ দেশের অন্য যেকোনো জেলার থেকে ভালো আছে। জেলা বিএনপি ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠনসহ সকল রাজনৈতিক দলকে সাথে নিয়ে তারা চুয়াডাঙ্গাকে ভালো রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই জেলায় কোনো ধর্মীয় সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। গত কয়েকদিনে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে চুয়াডাঙ্গার পরিবেশ।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক ড. কিসিঞ্জার চাকমার সভাপতিত্বে সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন চুয়াডাঙ্গার দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল জয়নুল আবেদীন, সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর সিদ্দিকুর রহমান, প্রফেসর এস এম ইস্রাফিল, চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সভাপতি রাজীব হাসান কচি, জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির অ্যাড. রুহুল আমিন, জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ডা. মার্টিন হীরক চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজাদুল ইসলাম আজাদ, জাসদের পক্ষে অ্যাড. আকসিদুল ইসলাম রতন, বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম, জেলা ওলামা পরিষদের মুফতি মোস্তফা কামাল, জেলা জাকের পার্টির সাধারণ সম্পাদক মজিবার রহমান, এনপিপির সভাপতি ইদ্রিস চৌধুরী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গার তামান্না খাতুন, রনি বিশ্বাস, সিরাজাম মুনিরা প্রমুখ।

সভায় জেলা বিএনপির সদস্যসচিব শরীফুজ্জামান শরীফ বলেন, ‘আমরা সকলকে সহযোগিতা করেছি। টিম ভাগ করে কাজ করছি। কোনোভাবে কেউ যেন আঘাতের শিকার না হন, সে জন্য আমাদের নেতা-কর্মীরা সর্বপ্রকার সহযোগিতা করছেন। চুয়াডাঙ্গা জেলায় কোনো সরকারি অফিসে একটি ইটপাটকেল মারতে দিইনি। কোনো সরকারি কর্মচারী-পুলিশ আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি। কারো ওপর হামলা করা হয়নি। আমরা সকলকে সেফ করার চেষ্টা করেছি। আমরা আছি বলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে।’

সভায় জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির অ্যাড. রুহুল আমিন বলেন, ‘আমরা সকলে মিলে বাংলাদেশ। আমাদের জেলায় কোনো ধর্মীয় সহিংসতা ঘটতে দেয়া হয়নি। ঘটতে দেয়া হবে না। আমরা রাত জেগে পাহারায় আছি। এখনো কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।’

সভায় চুয়াডাঙ্গার দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আপনাদের সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। আপনাদের সহযোগিতায় অবশ্য চুয়াডাঙ্গা মোটামুটি ভালো আছে। বাজার মনিটরিং থেকে শুরু করে অনেক কাজই চলছে। আপনারা সকল প্রকার সহযোগিতা করবেন এটিই আমাদের আশা।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিহিংসা সবসময় খারাপ। আমি যে অত্যাচারের শিকার হলাম, সেটিই যদি আমি করি, তাহলে আমার আর তার মধ্যে পার্থক্য থাকলো কোথায়? এটা আমাদের শহর, এটা আমাদের দেশ। কারো মনে যদি কোনো প্রতিহিংসা মনোভাব থেকে থাকে, আমি অনুরোধ করব, আমাদের দিয়ে যেন কারো কোনো সমস্যা না হয়। চাঁদাবাজী, লুট এবং বিভিন্ন বাড়িঘরে আগুন দেয়া খুবই অনাকাক্সিক্ষত। এখন পরিস্থিতি এরকম, তাই আমরা কি সবসময় প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে থাকবো? প্রত্যেকটা অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে হবে। আমি নিজে, পরিবারের, সমাজের কাউকে কোনো অন্যায় করতে দেয়া হবে না। আমি আশা করি, পূর্বের সকল ঘটনা ভুলে গিয়ে আমরা আরেকজনকে সহযোগিতা করব। প্রতিবাদ করার চেষ্টা করব।’

সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক ড. কিসিঞ্জার চাকমা বলেন, ‘দেশ আমাদের সকলের। আমাদের সকলকে মিলে আমাদের রাষ্ট্রকে গড়তে হবে। এখানে সমন্বয়কেরা যে সকল দাবি করেছেন, সবগুলো বিবেচনা করা হবে। আমি কথা দিচ্ছি, যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। আপনারা সকলে সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন। আপনাদের সকলের সহযোগিতায় যে নতুন সূর্য উদিত হয়েছে, তা আলো ছড়াবে।’

এদিকে, সভায় চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব শরীফুজ্জামান শরীফ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীসহ সকল শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার দেশ থেকে পলায়ন করে। দ্রুত খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে এই সরকারের আমলে নির্যাতিত জনগণ বিক্ষুদ্ধ হয়ে পড়ে। এসময় স্বৈরাচার সরকারের দলীয় নেতা-কর্মীদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর হয়েছে, সত্য। কিন্তু চুয়াডাঙ্গা জেলাবাসী তারা কেউ কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিষ্ঠানের সামান্যতম ক্ষতি করেনি। এদিন চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন স্থানে যে হামলা-ভাঙচুর হয়েছে, আমি মনে করি তা অত্যাচারিত সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।’

তিনি বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গার যেখানে যেখানে ভাঙচুরের ঘটনায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের নাম এসেছে, আমি নিজে সেখানে তদারকি করেছি। সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে তা যাচাই করেছি। কোথাও বিএনপি বা এর অঙ্গ সংগঠনের কোনো নেতা-কর্মী ছিল না। তবে সেখানে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দেখেছি। ভাঙচুর চালিয়েছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ। সেখানে ছেলুন জোয়ার্দ্দার গ্রুপ, নঈম জোয়ার্দ্দার গ্রুপের ছেলেদের দেখেছি। আমি তাদের নাম প্রশাসনের কাছে দিয়েছি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে যেন ব্যবস্থা নেয়া হয়।’ তিনি বলেন, ‘এখন আমরা সবাই মিলে এই চুয়াডাঙ্গাকে নতুন করে গড়ে তুলতে চাই। যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না। এই জেলায় যেন আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, আমরা তা নিশ্চিতে কাজ করব। ’

শরীফুজ্জামান শরীফ চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের প্রতি প্রস্তাবনা জানিয়ে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং দুর্নীতির মূল জায়গাটা আমাদের জানতে হবে। কোথায় এবং কী কারণে তা হয়েছে। এই কোটা দুর্নীতির জন্য সরকারই দায়ী। সরকারি অফিস আদালতে যাদের চাকরির বয়স ১৫ বছর তারা জানেন কোন প্রক্রিয়ায় তাদের নিয়োগ হয়েছে। সবার আগে খেয়াল করতে হবে বিচার বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগসহ সরকরি সকল বিভাগে যে যেখানে চাকরি করে, সেখানে যেন আর কোনো দুর্নীতি না হয়। জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারসহ সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানাবো, এসব জায়গার দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। বিগত ১৫ বছরের এই প্রাকটিস এখন বদলাতে হবে। সেখানে সঠিকভাবে কাজ হয়নি, সাধারণ মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তা আর করা যাবে না। এই সরকারে আমলে টাকা ছাড়া কাজ না হওয়ায়ই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে, এই নিয়ম ভাঙতে হবে। আপনারা কর্মকর্তারা যার যার জায়গা থেকে এই নিয়ম পরিবর্তনে এগিয়ে আসুন। সাধারণ মানুষ কোনো ভোগান্তির শিকার না হয়ে যেন তাদের ন্যায্য সেবা পায়, তা নিশ্চিত করুন।

তিনি বলেন, ‘বিগত ১৫ বছরে এতবেশি দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা তৈরি হয়েছে যে, কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার হয়নি। কারণ সেই কর্মকর্তাও দুর্নীতিগ্রস্ত। নিজের হাড়ি ভেঙে যাওয়ার ভয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যার ফলস্বরুপ সাধারণ মানুষ ভোগান্তি সহ্য করেছেন, বঞ্চিত হয়েছেন তাদের অধিকার থেকে। মসজিদ কমিটিগুলোও ভেঙে দিতে হবে। এই সরকারের আমলে এমন সভাপতি তৈরি হয়েছে, যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন অথচ ঘুষ খান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটিগুলোও নতুন করে সাজাতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্ত কাউকে সেখানে ঠাই দেয়া যাবে না।’

শরীফুজ্জামান শরীফ বলেন, ‘আমরা দেখেছি স্বৈরাচার সরকার পতনের আন্দোলনে হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে অংশ নিয়েছে। বিএনপির ছেলে-মেয়েদের সংখ্যা সেখানে খুবই থেকে। তবে সরকার পতনের পর যেখানে ভাঙচুর হয়েছে, তা বিক্ষুদ্ধ জনতাই শুধু করেনি, সেখানে আওয়ামী লীগের ছাত্রলীগ, যুবলীগের ছেলেরাও ভাঙচুর করেছে। আমি এটি আনন্দ মিছিল নিয়ে বের হয়েছিলাম, আমরা পৌরসভা মোড়ে পৌঁছানোর পর দেখেছি আওয়ামী লীগের লোকজনই আওয়ামী লীগের অফিস ভাঙছে। আমি হতবাক হয়েছি। লোকজন আমাকে বলেছে আপনি বিএনপির সদস্যসচিব আপনি এখান থেকে চলে যান। এই হলো আওয়ামী লীগের বাস্তবতা।’

তিনি বলেন, ‘আমরা নির্যাতিত হয়েছি, আমরা চেষ্টা করেছি ডিসি মহোদয়, এসপি মহোদয় জানেন। আমার বিএনপির ছেলেরা বিভিন্ন স্থানে পাহারা দিয়েছে, যেখানে আওয়ামী লীগের ছেলেরা ভাঙচুরের চেষ্টা করেছে, আমার ছেলেরা সেখানে তা প্রতিহত করেছে। এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে আওয়ামী লীগের লোকজন ধান্দা করেছে। মানুষের হাজার হাজার টাকা লুট করেছে। আমরা চাই এই অপসংস্কৃতি বন্ধ হোক। কোথাও যেন আর কোনো রাজনৈতিক লোকজনের পুনরাবৃত্তি না করুক। আমরা চাই কোনো জায়গায় যেন চাঁদাবাজী না হয়, আমরা চাই কোনো সরকারি অফিসে যেন দুর্নীতি না হয়। আমরা চাই চুয়াডাঙ্গার মানুষ ভালো থাকুক, কোথাও যেন পক্ষপাতিত্ব না হয়। আমরা চাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন তাদের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করুক। এই জেলার মানুষ তাদের প্রতি আস্থা রেখে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাদের জীবন সুন্দরভাবে পরিচালনা করুক।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা এই প্রথম দেখেছি কোথাও পুলিশ নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ নেই। মানুষের জান-মালের নিরাপত্তাও ছিল না। আমরা বিএনপি-জামায়াত এমন পরিস্থিতিতে মানুষের জান-মাল রক্ষায় কাজ করেছি। আমাদের নেতা-কর্মীরা এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমরা শান্তি চাই।’

এদিকে, চুয়াডাঙ্গার সুধীজনরা বলছেন, সকলের অংশগ্রহণে আগামীর বাংলাদেশ সুন্দর হবে। সব সংকট কেটে যাবে। সুজনের চুয়াডাঙ্গা জেলা কমিটির সভাপতি সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সকলে মিলে কাজ করলে বড় কাজও সহজ হয়। সবাই মিলে চেষ্টা করলে আমাদের সফলতা আসবেই। সফলতা আসতে বাধ্য।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

চুয়াডাঙ্গায় আইনশৃঙ্খলা সভায় দীর্ঘ ১৭ বছর পর সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ

সকলের অংশগ্রহণে চুয়াডাঙ্গাকে নতুন করে গড়ে তোলার প্রত্যয়

আপলোড টাইম : ০১:০৩:৩৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ অগাস্ট ২০২৪

চুয়াডাঙ্গায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রুখতে জেলা প্রশাসনের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ ১৭ বছর পর সব রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এ ধরনের কোনো সভা দেখা গেল। এটিকে চুয়াডাঙ্গার সুধীজনরাও গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন, করেছেন ইতিবাচক আলোচনা।

সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী চুয়াডাঙ্গার কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ ধর্মীয় বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি, বিএনপি, জামায়াত ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন, আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তবে সভার মূল আকর্ষণ ছিলেন জেলা বিএনপির সদস্যসচিব শরীফুজ্জামান শরীফ। তিনি ওই সভায় দাবি করেন, চুয়াডাঙ্গার পরিবেশ দেশের অন্য যেকোনো জেলার থেকে ভালো আছে। জেলা বিএনপি ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠনসহ সকল রাজনৈতিক দলকে সাথে নিয়ে তারা চুয়াডাঙ্গাকে ভালো রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই জেলায় কোনো ধর্মীয় সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। গত কয়েকদিনে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে চুয়াডাঙ্গার পরিবেশ।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক ড. কিসিঞ্জার চাকমার সভাপতিত্বে সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন চুয়াডাঙ্গার দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল জয়নুল আবেদীন, সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর সিদ্দিকুর রহমান, প্রফেসর এস এম ইস্রাফিল, চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সভাপতি রাজীব হাসান কচি, জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির অ্যাড. রুহুল আমিন, জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ডা. মার্টিন হীরক চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজাদুল ইসলাম আজাদ, জাসদের পক্ষে অ্যাড. আকসিদুল ইসলাম রতন, বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম, জেলা ওলামা পরিষদের মুফতি মোস্তফা কামাল, জেলা জাকের পার্টির সাধারণ সম্পাদক মজিবার রহমান, এনপিপির সভাপতি ইদ্রিস চৌধুরী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গার তামান্না খাতুন, রনি বিশ্বাস, সিরাজাম মুনিরা প্রমুখ।

সভায় জেলা বিএনপির সদস্যসচিব শরীফুজ্জামান শরীফ বলেন, ‘আমরা সকলকে সহযোগিতা করেছি। টিম ভাগ করে কাজ করছি। কোনোভাবে কেউ যেন আঘাতের শিকার না হন, সে জন্য আমাদের নেতা-কর্মীরা সর্বপ্রকার সহযোগিতা করছেন। চুয়াডাঙ্গা জেলায় কোনো সরকারি অফিসে একটি ইটপাটকেল মারতে দিইনি। কোনো সরকারি কর্মচারী-পুলিশ আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি। কারো ওপর হামলা করা হয়নি। আমরা সকলকে সেফ করার চেষ্টা করেছি। আমরা আছি বলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে।’

সভায় জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির অ্যাড. রুহুল আমিন বলেন, ‘আমরা সকলে মিলে বাংলাদেশ। আমাদের জেলায় কোনো ধর্মীয় সহিংসতা ঘটতে দেয়া হয়নি। ঘটতে দেয়া হবে না। আমরা রাত জেগে পাহারায় আছি। এখনো কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।’

সভায় চুয়াডাঙ্গার দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আপনাদের সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। আপনাদের সহযোগিতায় অবশ্য চুয়াডাঙ্গা মোটামুটি ভালো আছে। বাজার মনিটরিং থেকে শুরু করে অনেক কাজই চলছে। আপনারা সকল প্রকার সহযোগিতা করবেন এটিই আমাদের আশা।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিহিংসা সবসময় খারাপ। আমি যে অত্যাচারের শিকার হলাম, সেটিই যদি আমি করি, তাহলে আমার আর তার মধ্যে পার্থক্য থাকলো কোথায়? এটা আমাদের শহর, এটা আমাদের দেশ। কারো মনে যদি কোনো প্রতিহিংসা মনোভাব থেকে থাকে, আমি অনুরোধ করব, আমাদের দিয়ে যেন কারো কোনো সমস্যা না হয়। চাঁদাবাজী, লুট এবং বিভিন্ন বাড়িঘরে আগুন দেয়া খুবই অনাকাক্সিক্ষত। এখন পরিস্থিতি এরকম, তাই আমরা কি সবসময় প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে থাকবো? প্রত্যেকটা অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে হবে। আমি নিজে, পরিবারের, সমাজের কাউকে কোনো অন্যায় করতে দেয়া হবে না। আমি আশা করি, পূর্বের সকল ঘটনা ভুলে গিয়ে আমরা আরেকজনকে সহযোগিতা করব। প্রতিবাদ করার চেষ্টা করব।’

সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক ড. কিসিঞ্জার চাকমা বলেন, ‘দেশ আমাদের সকলের। আমাদের সকলকে মিলে আমাদের রাষ্ট্রকে গড়তে হবে। এখানে সমন্বয়কেরা যে সকল দাবি করেছেন, সবগুলো বিবেচনা করা হবে। আমি কথা দিচ্ছি, যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। আপনারা সকলে সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন। আপনাদের সকলের সহযোগিতায় যে নতুন সূর্য উদিত হয়েছে, তা আলো ছড়াবে।’

এদিকে, সভায় চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব শরীফুজ্জামান শরীফ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীসহ সকল শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার দেশ থেকে পলায়ন করে। দ্রুত খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে এই সরকারের আমলে নির্যাতিত জনগণ বিক্ষুদ্ধ হয়ে পড়ে। এসময় স্বৈরাচার সরকারের দলীয় নেতা-কর্মীদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর হয়েছে, সত্য। কিন্তু চুয়াডাঙ্গা জেলাবাসী তারা কেউ কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিষ্ঠানের সামান্যতম ক্ষতি করেনি। এদিন চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন স্থানে যে হামলা-ভাঙচুর হয়েছে, আমি মনে করি তা অত্যাচারিত সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।’

তিনি বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গার যেখানে যেখানে ভাঙচুরের ঘটনায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের নাম এসেছে, আমি নিজে সেখানে তদারকি করেছি। সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে তা যাচাই করেছি। কোথাও বিএনপি বা এর অঙ্গ সংগঠনের কোনো নেতা-কর্মী ছিল না। তবে সেখানে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দেখেছি। ভাঙচুর চালিয়েছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ। সেখানে ছেলুন জোয়ার্দ্দার গ্রুপ, নঈম জোয়ার্দ্দার গ্রুপের ছেলেদের দেখেছি। আমি তাদের নাম প্রশাসনের কাছে দিয়েছি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে যেন ব্যবস্থা নেয়া হয়।’ তিনি বলেন, ‘এখন আমরা সবাই মিলে এই চুয়াডাঙ্গাকে নতুন করে গড়ে তুলতে চাই। যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না। এই জেলায় যেন আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, আমরা তা নিশ্চিতে কাজ করব। ’

শরীফুজ্জামান শরীফ চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের প্রতি প্রস্তাবনা জানিয়ে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং দুর্নীতির মূল জায়গাটা আমাদের জানতে হবে। কোথায় এবং কী কারণে তা হয়েছে। এই কোটা দুর্নীতির জন্য সরকারই দায়ী। সরকারি অফিস আদালতে যাদের চাকরির বয়স ১৫ বছর তারা জানেন কোন প্রক্রিয়ায় তাদের নিয়োগ হয়েছে। সবার আগে খেয়াল করতে হবে বিচার বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগসহ সরকরি সকল বিভাগে যে যেখানে চাকরি করে, সেখানে যেন আর কোনো দুর্নীতি না হয়। জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারসহ সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানাবো, এসব জায়গার দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। বিগত ১৫ বছরের এই প্রাকটিস এখন বদলাতে হবে। সেখানে সঠিকভাবে কাজ হয়নি, সাধারণ মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তা আর করা যাবে না। এই সরকারে আমলে টাকা ছাড়া কাজ না হওয়ায়ই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে, এই নিয়ম ভাঙতে হবে। আপনারা কর্মকর্তারা যার যার জায়গা থেকে এই নিয়ম পরিবর্তনে এগিয়ে আসুন। সাধারণ মানুষ কোনো ভোগান্তির শিকার না হয়ে যেন তাদের ন্যায্য সেবা পায়, তা নিশ্চিত করুন।

তিনি বলেন, ‘বিগত ১৫ বছরে এতবেশি দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা তৈরি হয়েছে যে, কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার হয়নি। কারণ সেই কর্মকর্তাও দুর্নীতিগ্রস্ত। নিজের হাড়ি ভেঙে যাওয়ার ভয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যার ফলস্বরুপ সাধারণ মানুষ ভোগান্তি সহ্য করেছেন, বঞ্চিত হয়েছেন তাদের অধিকার থেকে। মসজিদ কমিটিগুলোও ভেঙে দিতে হবে। এই সরকারের আমলে এমন সভাপতি তৈরি হয়েছে, যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন অথচ ঘুষ খান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটিগুলোও নতুন করে সাজাতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্ত কাউকে সেখানে ঠাই দেয়া যাবে না।’

শরীফুজ্জামান শরীফ বলেন, ‘আমরা দেখেছি স্বৈরাচার সরকার পতনের আন্দোলনে হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে অংশ নিয়েছে। বিএনপির ছেলে-মেয়েদের সংখ্যা সেখানে খুবই থেকে। তবে সরকার পতনের পর যেখানে ভাঙচুর হয়েছে, তা বিক্ষুদ্ধ জনতাই শুধু করেনি, সেখানে আওয়ামী লীগের ছাত্রলীগ, যুবলীগের ছেলেরাও ভাঙচুর করেছে। আমি এটি আনন্দ মিছিল নিয়ে বের হয়েছিলাম, আমরা পৌরসভা মোড়ে পৌঁছানোর পর দেখেছি আওয়ামী লীগের লোকজনই আওয়ামী লীগের অফিস ভাঙছে। আমি হতবাক হয়েছি। লোকজন আমাকে বলেছে আপনি বিএনপির সদস্যসচিব আপনি এখান থেকে চলে যান। এই হলো আওয়ামী লীগের বাস্তবতা।’

তিনি বলেন, ‘আমরা নির্যাতিত হয়েছি, আমরা চেষ্টা করেছি ডিসি মহোদয়, এসপি মহোদয় জানেন। আমার বিএনপির ছেলেরা বিভিন্ন স্থানে পাহারা দিয়েছে, যেখানে আওয়ামী লীগের ছেলেরা ভাঙচুরের চেষ্টা করেছে, আমার ছেলেরা সেখানে তা প্রতিহত করেছে। এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে আওয়ামী লীগের লোকজন ধান্দা করেছে। মানুষের হাজার হাজার টাকা লুট করেছে। আমরা চাই এই অপসংস্কৃতি বন্ধ হোক। কোথাও যেন আর কোনো রাজনৈতিক লোকজনের পুনরাবৃত্তি না করুক। আমরা চাই কোনো জায়গায় যেন চাঁদাবাজী না হয়, আমরা চাই কোনো সরকারি অফিসে যেন দুর্নীতি না হয়। আমরা চাই চুয়াডাঙ্গার মানুষ ভালো থাকুক, কোথাও যেন পক্ষপাতিত্ব না হয়। আমরা চাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন তাদের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করুক। এই জেলার মানুষ তাদের প্রতি আস্থা রেখে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাদের জীবন সুন্দরভাবে পরিচালনা করুক।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা এই প্রথম দেখেছি কোথাও পুলিশ নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ নেই। মানুষের জান-মালের নিরাপত্তাও ছিল না। আমরা বিএনপি-জামায়াত এমন পরিস্থিতিতে মানুষের জান-মাল রক্ষায় কাজ করেছি। আমাদের নেতা-কর্মীরা এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমরা শান্তি চাই।’

এদিকে, চুয়াডাঙ্গার সুধীজনরা বলছেন, সকলের অংশগ্রহণে আগামীর বাংলাদেশ সুন্দর হবে। সব সংকট কেটে যাবে। সুজনের চুয়াডাঙ্গা জেলা কমিটির সভাপতি সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সকলে মিলে কাজ করলে বড় কাজও সহজ হয়। সবাই মিলে চেষ্টা করলে আমাদের সফলতা আসবেই। সফলতা আসতে বাধ্য।