ইপেপার । আজ সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এক কিলোমিটার তাড়িয়ে কুপিয়ে দুই পা বিচ্ছিন্ন, কলেজছাত্র রানার মৃত্যু

কেন প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে নির্বাচন হবে না মর্মে হাইকোর্টের রুল জারি

আসিফ কাজল, ঝিনাইদহ:
  • আপলোড টাইম : ১২:০৫:০৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪
  • / ৪০ বার পড়া হয়েছে

ঝিনাইদহের শৈলকুপায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার কলেজছাত্র রানা ইসলামের লাশ গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে নিজ বাড়িতে পৌঁছালে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। একমাত্র ছেলের লাশ দেখে মা রেনু বেগম ও বোন সাদিয়া ইসলাম বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন। শুধু রানার পরিবার নয়, গোটা গ্রামই যেন শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়।
এলাকায় নম্র-ভদ্র হিসেবে পরিচিত ১৮ বছরের সুদর্শন এই যুবককে কী নিষ্ঠুর ও নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা তার শরীরের প্রতিটি ক্ষতচিহ্ন প্রমাণ করে দিচ্ছে। গত বুধবার দুপুরে আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের জের ধরে রানা ইসলামকে এক কিলোমিটার তাড়িয়ে কুপিয়ে তার দুই পা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। তাকে প্রথমে শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও পরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সন্ধ্যার দিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান।
প্রতিবেশী আকামত খাঁ জানান, রানা ইসলাম এলাকায় অত্যন্ত ভদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শৈলকুপা উপজেলার লাঙ্গলবাঁধ হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে এবার স্থানীয় আদিল উদ্দীন ডিগ্রি কলেজে ভর্তির সুপারিশপ্রাপ্ত হন। কিন্তু কলেজে ভর্তি হওয়ার আগেই সুদর্শন ছেলেটির জীবন কেড়ে নেওয়া হলো। তার বাবা সাইফুল ইসলাম সামাজিক দল করেন বলে সেই আক্রোশ ছেলের ওপর খাটানো দুঃখজনক ঘটনা।
তিনি অভিযোগ করেন, শৈলকুপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিয়ার রহমানের ছেলে দিনার বিশ^াসের নেতৃত্বে ফিরোজ, সাজ্জাদ হোসেন ও আকমল মেম্বারসহ শতাধিক মানুষ এই হামলার সঙ্গে জড়িত। রানার লাশ দেখতে আসা গোলাম মোস্তফা জানান, বুধবার আওয়ামী লীগের মতিয়ার রহমান গ্রুপের লোকজন হঠাৎ করেই গ্রামে প্রবেশ করে যাকে ইচ্ছা তাকেই মারধর ও কোপাতে থাকে। তার এক দিন আগে প্রায় শতাধিক বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। রানা ইসলাম তাদের সামনে পড়ে যায়। এসময় তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দৌঁড়ে পার্শ্ববর্তী ডাউটিয়া গ্রামের প্রাচীর ঘেরা নিলুফা খাতুনের বাড়িতে ওঠেন। ওই বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার পর হামলাকারীরা জোটবদ্ধ হয়ে সেই বাড়ির তিনটি দরজা ভেঙে রানাকে বের করে নিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে দুই পা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় রানাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গ্রামবাসী জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই শৈলকুপা আওয়ামী লীগ বহু ধারায় বিভক্ত। শৈলকুপার সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল হাইয়ের মৃত্যুর পর তার গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বর্তমান সভাপতি মতিয়ার রহমান ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকু শিকদার। প্রতিপক্ষ গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন বর্তমান এমপি নায়েব আলী জোয়ারদার, উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা আরিফ রেজা মন্নু ও পৌর মেয়র আশরাফুল আজম। নিহত রানার বাবা সাইফুল ইসলাম ছিলেন বর্তমান এমপি নায়েব আলী জোয়ারদারের নেতৃত্বাধীন গ্রুপের ইউনিয়ন পর্যায়ে নেতৃত্বে থাকা মুস্তাক শিকদারের সমর্থক।
গতকাল বৃহস্পতিবার শৈলকুপার কাশিনাথপুর গিয়ে জানা গেছে, গত সোমবার মধ্যরাতে শৈলকুপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিয়ার রহমানকে কে বা কারা পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করে। সেই ঘটনার জের ধরে মতিয়ার সমর্থকরা কুশোবাড়িয়া, বন্দেখালী ও নন্দিরগাতি গ্রামে আকস্মিক হামলা চালিয়ে মুস্তাক শিকদারের সমর্থকদের ৫০-৬০টি বাড়ি ভাঙচুর করে।
নিহত রানার মা রেনু বেগম অভিযোগ করে বলেন, ‘বুধবার মতিয়ারের ছেলে শৈলকুপা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি দিনার বিশ^াসের নেতৃত্বে আমার ছেলের ওপর হামলা চালানো হয়। আমার ছেলে এসময় নানা বাড়ি থেকে গ্রামে ফিরছিল। সে ভয়ে ডাউটি গ্রামের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিলেও সেই বাড়ির তিন তিনটি দরজা ভেঙ্গে বাড়ি ঢুকে তাকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আমার ছেলে তো কোনো দল করতো না।’
শৈলকুপা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. শফিকুল ইসলাম জানান, ‘রানা নামের এক কলেজছাত্রকে প্রতিপক্ষরা কুপিয়ে ও পিটিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে। পরে তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মারা যায়। এ ঘটনায় এখনো থানায় মামলা না হলেও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ কাজ করছে।’
ঝিনাইদহ-১ আসনের সংসদ সদস্য নায়েব আলী জোয়ারদার বলেন, ‘এতো বাঁচ্চা একটা ছেলেকে ওরা কীভাবে কুপিয়ে মারলো, তা আমার বুঝেই আসছে না। এই হত্যা নির্মম ও নিষ্ঠুর হিসেবে বিবেচিত হবে। হামলার নেতৃত্ব দেওয়া দিনার বিশ^াস হিন্দুদের মন্দির ভাঙাসহ একাধিক মামলার আসামি। এই পরিবারটি শুধু বেআইনি কাজের সঙ্গে জড়িত থাকে। মতিয়ারের ওপর হামলা যারা করেছে, এক দিন তারাই তার সামাজিক দলের সঙ্গে ছিল। তারপরও আমি হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করেছি। যতদূর পারি চেষ্টা করছি এলাকার শান্তি বজায় রাখার।’

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

এক কিলোমিটার তাড়িয়ে কুপিয়ে দুই পা বিচ্ছিন্ন, কলেজছাত্র রানার মৃত্যু

কেন প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে নির্বাচন হবে না মর্মে হাইকোর্টের রুল জারি

আপলোড টাইম : ১২:০৫:০৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪

ঝিনাইদহের শৈলকুপায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার কলেজছাত্র রানা ইসলামের লাশ গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে নিজ বাড়িতে পৌঁছালে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। একমাত্র ছেলের লাশ দেখে মা রেনু বেগম ও বোন সাদিয়া ইসলাম বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন। শুধু রানার পরিবার নয়, গোটা গ্রামই যেন শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়।
এলাকায় নম্র-ভদ্র হিসেবে পরিচিত ১৮ বছরের সুদর্শন এই যুবককে কী নিষ্ঠুর ও নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা তার শরীরের প্রতিটি ক্ষতচিহ্ন প্রমাণ করে দিচ্ছে। গত বুধবার দুপুরে আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের জের ধরে রানা ইসলামকে এক কিলোমিটার তাড়িয়ে কুপিয়ে তার দুই পা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। তাকে প্রথমে শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও পরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সন্ধ্যার দিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান।
প্রতিবেশী আকামত খাঁ জানান, রানা ইসলাম এলাকায় অত্যন্ত ভদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শৈলকুপা উপজেলার লাঙ্গলবাঁধ হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে এবার স্থানীয় আদিল উদ্দীন ডিগ্রি কলেজে ভর্তির সুপারিশপ্রাপ্ত হন। কিন্তু কলেজে ভর্তি হওয়ার আগেই সুদর্শন ছেলেটির জীবন কেড়ে নেওয়া হলো। তার বাবা সাইফুল ইসলাম সামাজিক দল করেন বলে সেই আক্রোশ ছেলের ওপর খাটানো দুঃখজনক ঘটনা।
তিনি অভিযোগ করেন, শৈলকুপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিয়ার রহমানের ছেলে দিনার বিশ^াসের নেতৃত্বে ফিরোজ, সাজ্জাদ হোসেন ও আকমল মেম্বারসহ শতাধিক মানুষ এই হামলার সঙ্গে জড়িত। রানার লাশ দেখতে আসা গোলাম মোস্তফা জানান, বুধবার আওয়ামী লীগের মতিয়ার রহমান গ্রুপের লোকজন হঠাৎ করেই গ্রামে প্রবেশ করে যাকে ইচ্ছা তাকেই মারধর ও কোপাতে থাকে। তার এক দিন আগে প্রায় শতাধিক বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। রানা ইসলাম তাদের সামনে পড়ে যায়। এসময় তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দৌঁড়ে পার্শ্ববর্তী ডাউটিয়া গ্রামের প্রাচীর ঘেরা নিলুফা খাতুনের বাড়িতে ওঠেন। ওই বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার পর হামলাকারীরা জোটবদ্ধ হয়ে সেই বাড়ির তিনটি দরজা ভেঙে রানাকে বের করে নিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে দুই পা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় রানাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গ্রামবাসী জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই শৈলকুপা আওয়ামী লীগ বহু ধারায় বিভক্ত। শৈলকুপার সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল হাইয়ের মৃত্যুর পর তার গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বর্তমান সভাপতি মতিয়ার রহমান ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকু শিকদার। প্রতিপক্ষ গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন বর্তমান এমপি নায়েব আলী জোয়ারদার, উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা আরিফ রেজা মন্নু ও পৌর মেয়র আশরাফুল আজম। নিহত রানার বাবা সাইফুল ইসলাম ছিলেন বর্তমান এমপি নায়েব আলী জোয়ারদারের নেতৃত্বাধীন গ্রুপের ইউনিয়ন পর্যায়ে নেতৃত্বে থাকা মুস্তাক শিকদারের সমর্থক।
গতকাল বৃহস্পতিবার শৈলকুপার কাশিনাথপুর গিয়ে জানা গেছে, গত সোমবার মধ্যরাতে শৈলকুপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিয়ার রহমানকে কে বা কারা পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করে। সেই ঘটনার জের ধরে মতিয়ার সমর্থকরা কুশোবাড়িয়া, বন্দেখালী ও নন্দিরগাতি গ্রামে আকস্মিক হামলা চালিয়ে মুস্তাক শিকদারের সমর্থকদের ৫০-৬০টি বাড়ি ভাঙচুর করে।
নিহত রানার মা রেনু বেগম অভিযোগ করে বলেন, ‘বুধবার মতিয়ারের ছেলে শৈলকুপা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি দিনার বিশ^াসের নেতৃত্বে আমার ছেলের ওপর হামলা চালানো হয়। আমার ছেলে এসময় নানা বাড়ি থেকে গ্রামে ফিরছিল। সে ভয়ে ডাউটি গ্রামের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিলেও সেই বাড়ির তিন তিনটি দরজা ভেঙ্গে বাড়ি ঢুকে তাকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আমার ছেলে তো কোনো দল করতো না।’
শৈলকুপা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. শফিকুল ইসলাম জানান, ‘রানা নামের এক কলেজছাত্রকে প্রতিপক্ষরা কুপিয়ে ও পিটিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে। পরে তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মারা যায়। এ ঘটনায় এখনো থানায় মামলা না হলেও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ কাজ করছে।’
ঝিনাইদহ-১ আসনের সংসদ সদস্য নায়েব আলী জোয়ারদার বলেন, ‘এতো বাঁচ্চা একটা ছেলেকে ওরা কীভাবে কুপিয়ে মারলো, তা আমার বুঝেই আসছে না। এই হত্যা নির্মম ও নিষ্ঠুর হিসেবে বিবেচিত হবে। হামলার নেতৃত্ব দেওয়া দিনার বিশ^াস হিন্দুদের মন্দির ভাঙাসহ একাধিক মামলার আসামি। এই পরিবারটি শুধু বেআইনি কাজের সঙ্গে জড়িত থাকে। মতিয়ারের ওপর হামলা যারা করেছে, এক দিন তারাই তার সামাজিক দলের সঙ্গে ছিল। তারপরও আমি হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করেছি। যতদূর পারি চেষ্টা করছি এলাকার শান্তি বজায় রাখার।’