ইপেপার । আজ বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এমপি আনার হত্যাকাণ্ড : খুনের মোটিভ নিয়ে রাখঢাক

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৭:৫১:৪০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ মে ২০২৪
  • / ১০১ বার পড়া হয়েছে

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে আখতারুজ্জামানকে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ১৩ মে কলকাতার নিউটাউনে সঞ্জীবা গার্ডেন্সের ৫৬/বিইউ ফ্ল্যাটে কিলিং মিশনের নেতৃত্ব দেয়া পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমানউল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়াসহ ইতোমধ্যে ৩ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে আরো বেশ কয়েকজনকে। কলকাতা পুলিশও লাশ গুমে সহায়তা করা সিয়াম ও শাহিনের অন্যতম সহযোগী জিহাদকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে। ৫ কোটি টাকায় এই হত্যাকাণ্ডের চুক্তি দেয়া হয় বলেও দুদেশের গোয়েন্দারা নিশ্চিত করেছেন। এমনকি ঢাকার দুটি বাসায় দফায় দফায় পরিকল্পনা করে কলকাতার ওই ফ্ল্যাটে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ টুকরো টুকরো করে হাড্ডি-মাংস আলাদা করে জলাশয় বা খাল ও জঙ্গলে ফেলা হয়েছে বলেও তথ্য দিয়েছে শিমুল ভূঁইয়া। তদন্তে এত অগ্রগতির পরও কী কারণে এমপি আনারকে হত্যা করা হলো- সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো কারণ জানতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শুধু তাই নয়- চিকিৎসার জন্য কলকাতা গিয়ে এমপি আনার বন্ধুর বাসায় ওঠার পর কেন ওই ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন সে বিষয়েও এখনো ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। এ বিষয়ে খানিকটা রাখঢাকের প্রবণতা লক্ষণীয়। হত্যার কারণ হিসেবে হুন্ডি ব্যবসা ও স্বর্ণের চোরাচালানের নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল, চোরাচালানে সম্পৃক্ত কোনো অপরাধীকে দমন করার মতো বিষয়কে সন্দেহে আনা হয়।

কিন্তু হত্যার সুস্পষ্ট কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আখতারুজ্জামান শাহিনকে প্রয়োজন। এছাড়া সুস্পষ্ট করে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। কারণ আখতারুজ্জামান শাহিন ও এমপি আনার বাল্যবন্ধু ছিলেন। তাদের মধ্যে কী নিয়ে সমস্যা চলছিল- এটি হয়তো মামলার তদন্তে উঠে আসবে। এদিকে হত্যাকাণ্ড নিশ্চিত হলেও এমপি আনারের লাশ এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। গ্রেপ্তার চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়া ডিবি পুলিশকে জানিয়েছেন, ঘটনার সময় শিমুল ভূঁইয়া ছাড়াও ফয়সাল ও মুস্তাফিজ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। এজন্য পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে তারা আগেই চেয়ার, রশি, ছুরি ও কালো রঙের পলিথিন কিনে রেখেছিল। এমপি আনার কক্ষে প্রবেশ করার পর তাকে চেয়ারে হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। পরে লাশ টুকরো টুকরো করা হয়। পরে হাড্ডি-মাংস আলাদা করে ওই কালো রঙের পলিথিনে করে নির্জন জঙ্গল ও খালের বিভিন্ন পয়েন্টে ফেলে দেয়া হয়। ফলে লাশ উদ্ধার করা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। যদিও শিমুল ভূঁইয়ার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ভারতে যাবে বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম।

ডিবি সূত্র জানিয়েছে, লাশের অংশবিশেষ পাওয়া যেতে পারে। এ জন্য ডিবি ওয়ারী বিভাগের একজন এসির নেতৃত্বে একটি টিম দ্রুতই ভারতে রওনা হবে। পাশাপাশি শেরেবাংলা নগর থানায় দায়ের হওয়া মামলায় শিমুল ভূঁইয়া, তার ভাতিজা তানভির ও শাহিনের প্রেমিকা শিলাস্তি রহমানকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হবে আজ শুক্রবার। অন্যদিকে এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো অফিসার অন্তু কুমার ও জয়দীপসহ চারজন এখন ঢাকায়। ডিবি কার্যালয়ে গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তারা; ডিবির তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিনিময় করেছেন।

এদিকে গতকাল মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে হত্যাকাণ্ডের রোমহর্ষক বর্ণনা দেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার পরিকল্পনা হয় দুই থেকে তিন মাস আগে। তারা পরিকল্পনা করেছিল ঢাকায় হত্যা করবে। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশের নজরদারি ও ঢাকায় হত্যাকাণ্ডের পর ক্লু পুলিশ বের করে নেবে- এই আশঙ্কা থেকেই হত্যাকারীরা কলকাতায় এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে তারা এ হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে থাকতে পারেনি। আমরা তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছি। আরো কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

ডিবিপ্রধান বলেন, এ ঘটনার মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামানের বাসা একটি গুলশানে, একটি বসুন্ধরা এলাকায়। এই দুই বাসায় বসে অনেক দিন ধরেই খুনের পরিকল্পনা করেছে আসামিরা। আনারকে হত্যার নেপথ্যে রাজনীতি বা অর্থনৈতিক- যে কারণই থাকুক না কেন বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা কলকাতায় গত ২৫ এপ্রিল একটি বাসা ভাড়া নেয়, ৩০ এপ্রিল ওই বাসায় ওঠে তারা। যিনি হত্যার পরিকল্পনা করেছেন তিনিও আরেকজনসহ মোট তিনজন বিমানে করে কলকাতার ভাড়া বাসায় ওঠেন। তারা দুই মাস ধরে খেয়াল রেখেছেন কখন আনার কলকাতা যাবেন। গত ১২ মে আনার তার ভারতীয় বন্ধু গোপালের বাসায় যান। সেখানে আরো দুজনকে ভাড়া করা হয়। তারা ওই বাসায় আসা-যাওয়া করতেন। তারা হলেন- জিহাদ ও সিয়াম। সব পরিকল্পনা ঠিক করে দিয়ে মাস্টারমাইন্ড শাহিন ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসেন। এরই ধারাবাহিকতায় আনার ১৩ মে ওই ভাড়া বাসায় ওঠেন। এর আগে ফয়সাল নামে একজন তাকে রিসিভ করেন। সেখান থেকে নিয়ে মূল হত্যাকারী শিমুল, আনার ও ফয়সালকে নিয়ে চালক রাজা ওই বাসায় যায়। আগে থেকে অবস্থান করা মোস্তাফিজও বাসায় ঢোকেন। আগে সেখানে ভেতরে ছিলেন জাহিদ ও সিয়াম। আধা ঘণ্টার মধ্যে নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।

ভিকটিমের মোবাইল নম্বর থেকে মেসেজ বিভিন্নজনকে করা হয়- যাতে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে তদন্তে বেগ পায়। তাদের পরিকল্পনা ছিল, হত্যার পর আনারের লাশ এমনভাবে গুম করে দেয়া হবে; যাতে করে কেউ কোনোদিন খুঁজে না পায়। হত্যার পর তার শরীর বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। হাড় থেকে শরীরের মাংস আলাদা করা হয়েছে। এরপর গ্রে কালারের লাগেজে ভরে মূল হত্যাকারী শিমুল ও তার সহযোগী জাহিদ ব্রিফকেস নিয়ে বের হয়। এরপর সিয়াম পাবলিক টয়লেটের কাছে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সেখানে গিয়ে অবস্থান করছিলেন আমানুল্লাহ। ভারতীয় চালকসহ তারা গাড়ি নিয়ে চলে যান। পরবর্তী সময়ে ২-৩ জন মিলে আনারের খণ্ড-বিখণ্ড শরীর কয়েকটি ব্যাগে ভরে নিয়ে যান। তারা এমন নৃশংস কায়দায় হত্যার কাজটি সংঘটিত করেছেন- যাতে ধরা না পড়েন। সেজন্য তারা হাড়-মাংস আলাদা করেন, হলুদ মিশিয়ে দেন। যাতে করে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে পারেন, বাজার থেকে আনা।

উদ্দেশ্য একটাই ছিল- কেউ যেন কোনো দিন আনারের অস্তিত্ব খুঁজে না পায়। ১৫ মে শিমুল, শিলাস্তি ও মোস্তাফিজ ফিরে আসেন বাংলাদেশে। সবাই যখন ফিরে আসেন; তখন মূল পরিকল্পনাকারী শাহিন ভিস্তারা এয়ারলাইন্সে দিল্লি হয়ে দুই ঘণ্টার ট্রানজিট নিয়ে নেপালের কাঠমান্ডু চলে যান। সেখান থেকে হয়তো তিনি অন্য কোথায় চলে যেতে পারেন। অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, এই হত্যাকাণ্ডটা পরিকল্পিত। তারা দীর্ঘদিন ধরে সুযোগ খুঁজেই হত্যা করেছে। আমরা ১৮ মের পর তদন্ত শুরু করেছি; যখন আনারের বন্ধু গৌতম কলকাতায় সাধারণ ডায়েরি করেন। হত্যাকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে বিভিন্ন মেসেজ পাঠিয়ে- তিনি জীবিত আছেন। মেসেজ এমন ছিল, ‘আমি হঠাৎ করে দিল্লি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে ভিআইপি আছে।’ ‘আমি অমিত সাহার কাছে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী সেখানে যাবেন। তার মন্ত্রী হওয়া নিয়ে কথা হবে।’ আসলে আনারের ডিভাইস ব্যবহার করে এসব মেসেজ দিয়েছে হত্যাকারীরা। তারা কখনো বেনাপোল, মুজাফফরাবাদ; কখনো কলকাতার শেষ বর্ডারে গিয়ে মেসেজ দিয়ে গেছে। তদন্তকারীরা যাতে ডিভাইসটা খুঁজে না পায়- সেটিই ছিল লক্ষ্য।

ডিবি কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কাছে আটক তিনজন হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। আমাদের সঙ্গে কলকাতা পুলিশ, কলকাতা সিআইডি ও এসটিএফের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে। ভারতের একটি তদন্ত-সংশ্লিষ্ট টিম আমাদের এখানে আসবেন। আমাদের হাতে আটক যে আসামি রয়েছে তাদের সঙ্গে কথা বলবেন, জিজ্ঞাসা করবেন। আমরাও প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে অনুমতি নিয়ে ঘটনাস্থলে যাব। তিনি আরো বলেন, মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহিনের প্রেমিকা শিলাস্তি রহমান। মূল হত্যাকারীর নাম আমানুল্লাহ। তার আসল নাম কিন্তু আমানুল্লাহ নয়; তিনি মিথ্যা নামে পাসপোর্টটি করেছেন। তার আসল নাম আসলে শিমুল ভূঁইয়া। যিনি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির বড় নেতা ছিলেন। তার নামে অনেকগুলো হত্যা মামলা রয়েছে।

মরদেহ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা? জানতে চাইলে হারুন বলেন, লাশ পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু বলা সম্ভব নয়। তবে শিমুলের বর্ণনামতে আসলে আনারের মরদেহ তো খণ্ড খণ্ড করা হয়েছে। হাড়-মাংস আলাদা করে হলুদ মিশিয়ে ব্যাগে ভরে ফেলা হয়েছে। আমরা কাজ করছি, লাশ পাওয়ার আগেই মামলা হতে পারে। কলকাতা পুলিশ তো নিশ্চিত হয়েছে হত্যা হয়েছে। যে ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করেছে; সে কলকাতা পুলিশের কাছে আছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা তদন্ত করছি। কেন হত্যাকাণ্ড- সেটি তো বের হবেই; তবে কারা কারা জড়িত, আরো কেউ জড়িত কিনা, রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিল কিনা- তা খতিয়ে দেখা হবে। আমরা আশা করছি পুরোপুরি না পেলেও খণ্ডিত হলেও মরদেহ উদ্ধার সম্ভব হবে।

এ বিষয়ে গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ঝিনাইদহের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারকে যারা হত্যা করেছেন, তাদের প্রায় চিহ্নিত করে ফেলেছি। আমাদের শুধু ঘোষণা বাকি। দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থা একমত হতে পারলে ঘোষণা দেব। তিনি আরো বলেন, আমরা মরদেহটা এখনো উদ্ধার করতে পারিনি। আপনারা যা শুনেছেন, আমরাও সেগুলোই শুনেছি। যে পর্যন্ত মরদেহ উদ্ধার করতে না পারব, সে পর্যন্ত অফিশিয়ালি আপনাদের কিছু বলতে পারছি না। এ বিষয়ে দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। আনোয়ারুল আজীম আমাদের ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের এমপি। ওই বর্ডার এলাকাটা সন্ত্রাসকবলিত। সে এলাকারই তিনি এমপি। কী কারণে হত্যাকাণ্ড হয়েছে সে বিষয়ে সুনিশ্চিত না হয়ে কিছুই বলা ঠিক হবে না। আমরা আগে নিশ্চিত হই, তারপর আপনাদের বিস্তারিত জানাব।

ডিবি সূত্র জানিয়েছে, গত ৩০ এপ্রিল শাহিন ‘কন্ট্রাক্ট কিলার’ শিমুল ভূঁইয়া ও শিলাস্তিকে নিয়ে কলকাতা যান। সেখানে আগে থেকেই ভাড়া করে রাখা নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেন্সের ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন তারা। কলকাতায় আরো আগে থেকেই অবস্থান করছিল শাহিনের দুই সহযোগী সিয়াম ও জিহাদ। সেখানে বসে তারা এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করে। হত্যার দায়িত্ব শিমুল ভূঁইয়াকে বুঝিয়ে দিয়ে ১০ মে দেশে চলে আসেন শাহিন। পরিকল্পনা অনুযায়ী শিমুল ভূঁইয়া বাংলাদেশ থেকে আরো দুই ভাড়াটে কিলারকে নিয়ে যায় কলকাতায়। ফয়সাল শাজী ও মোস্তাফিজ নামে দুই ভাড়াটে খুনি ১১ মে কলকাতায় গিয়ে শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগ দেয়। ১৩ মে এমপি আনারকে সেই ফ্ল্যাটে ডেকে আনেন শিলাস্তি।

ডিবি পুলিশের ধারণা, হত্যাকাণ্ডের সময় শিলাস্তি ওই ফ্ল্যাটের একটি রুমে অবস্থান করছিলেন, সামনে ছিলেন না। হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর তিনি নিচে নেমে আসেন। এরপর লাশ গুমে সহায়তা করেন। শিমুল ভূঁইয়া ও শিলাস্তি মিলেই এমপি আনারের টুকরো করা মরদেহ রাখা একটি ট্রলি নিয়ে প্রথমে বের হয়েছিলেন বলে তথ্য রয়েছে। কিলিং মিশন শেষে ১৫ মে বিমানে করে দেশে ফেরত আসেন ওই নারী। কলকাতা পুলিশ ওই ফ্ল্যাট ও আশপাশের ভবনের সব সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। সেখানে শিলাস্তি বাইরে থেকে পলিথিন ও ব্লিচিং পাউডার নিয়ে আসছেন- এমন দৃশ্য রয়েছে বলে জানা গেছে। জিজ্ঞাসাবাদে শিমুল ভূঁইয়া জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের পরদিন বিকালে একটি ট্রলিব্যাগ হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হন তিনি। বাসা থেকে বের হয়ে পাশের একটি শপিং মলের সামনে সেই ট্রলিব্যাগটি সিয়ামের হাতে তুলে দেন। সিয়াম সেই ব্যাগ নিয়ে তাদের আগে থেকেই ভাড়া করে রাখা গাড়ি নিয়ে অজ্ঞাত স্থানের দিকে চলে যায়। সেই গাড়িচালক কলকাতা পুলিশকে জানিয়েছে, সিয়াম কিছু দূর যাওয়ার পর ব্যাগটি নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে।

কলকাতায় শাহিনের সহযোগী সিয়াম গ্রেপ্তার :

এদিকে আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ও এমপি আনারের বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহিনের সহযোগী সিয়াম নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে কলকাতা সিআইডি পুলিশ। একই সঙ্গে জিহাদ নামে অপর একজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানানো হয়। এই জিহাদই সিয়াম বলে জানা গেছে। উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ অঞ্চল থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল তাকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দা দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার পরনে ছিল সাদা গেঞ্জি এবং খয়েরি রঙের প্যান্ট। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই এমপি আনারের মৃতদেহ সন্ধান করতে চান তদন্তকারী কর্মকর্তারা। সিয়াম বনগাঁ হয়ে বাংলাদেশে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমপি আনারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার পর তিনি মধ্য কলকাতায় লুকিয়ে ছিলেন। বৃহস্পতিবারেই কোনোভাবে বর্ডার পার হয়ে বাংলাদেশ চলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল সিয়ামের।

কলকাতা পুলিশ গণমাধ্যমকে জানায়, হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় সিয়াম অবৈধভাবে ভারতে এসেছিলেন। ৩০ এপ্রিল ভারতে প্রবেশের পর তিনি মুম্বাই চলে যান। যখন এমপি আনার কলকাতায় বরানগরের মন্ডলপাড়ায় গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন তার আগেই সিয়াম মুম্বাই থেকে কলকাতায় চলে আসেন। এরপর নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেন্সের ফ্ল্যাটে এমপি আনারের লাশ টুকরো টুকরো করেন কয়েকজন। পরে একে একে তারা নিউটাউন ছাড়েন। পুলিশের তথ্যমতে, জিহাদ নিউটাউন থেকে লাগেজে করে লাশের অংশ বের করেন। পরে অপরজনের হাতে সেই ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে গা-ঢাকা দেন। এই একই ঘটনায় জুবের নামে এক ক্যাবচালককেও আটক করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাকে। লাশ গুমের বিষয়ে কলকাতা পুলিশ সূত্র জানাচ্ছে, লাশ টুকরো করা সহজ এবং তা কোনো জলাশয়ে ফেলে দেয়া কঠিন ব্যাপার নয়। কারণ নিউটাউন-সংলগ্ন বহু মাছ চাষের জলাশয় আছে।

কলকাতা পুলিশ গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, ১৩ মে নিউটাউনের আবাসনেই শ্বাসরোধ করে খুনের পর টুকরো টুকরো করে কাটা হয় মরদেহ। ১৬ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত তিনদিন ধরে খণ্ডিত অংশ অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়। কিছু অংশ ওই ফ্ল্যাটের ফ্রিজে রাখা হয়। এমনকি ফ্ল্যাট থেকে প্লাস্টিক ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা, প্লাস্টিক ব্যাগে ভরেই খণ্ডিত অংশ বিভিন্ন জায়গায় ফেলা হয়েছে। তবে কারা ফেলেছে, কোথায় ফেলা হয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। এদিকে এই ঘটনায় একটি গাড়ি জব্দ করেছে পুলিশ। গাড়িটির নম্বর ডব্লিউবি ১৮ এএ ৫৪৭৩। জানা গেছে, সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখে গাড়িটিকে শনাক্ত করা হয়। এর পরই গাড়ির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সেই গাড়িটিকে আনা হয় নিউটাউন থানায়। উদ্ধার হওয়া গাড়ি থেকে ফরেনসিক এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞরা নমুনা সংগ্রহ করেন।

বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশের পর পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডির) জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব কলকাতার বিলাসবহুল এক ফ্ল্যাটে ঝিনাইদহের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যায় তারই এক বন্ধু ঘাতকদের ৫ কোটি টাকায় ভাড়া করেন। ওই বন্ধু তাকে খুন করার জন্য ঘাতকদের এই টাকা দেন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির ওই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, এমপি আনোয়ারুল আজীমকে প্রথমে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় বলে ঘটনাস্থলে পাওয়া আলামতে সেরকম ইঙ্গিত মিলেছে। হত্যাকাণ্ডে মূলত চার ধরনের গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল। পুলিশের মতে, গোপালের বাড়ি থেকে সাদা রঙের সুইফ ডিজায়ার ব্যবহার করে এমপি আনার কলকাতার নিউমার্কেটে যান। এরপর সেখান থেকে আরো একটি গাড়ি করে নিউটাউনে যান। পরে নিউটাউন থেকে একটি লাল গাড়িতে সঞ্জীবা গার্ডেন্স নামের অভিজাত আবাসনে যান। তাকে হত্যার পর আরো একটি কালো গাড়ি ব্যবহার হয়েছিল। সিসিটিভিতে এমনই তথ্য মিলেছে কলকাতা পুলিশের কাছে। এ ঘটনায় আমানুল্লাহ শিমুল, শিলাস্তি রহমান, মুস্তাফিজুর, ফয়সাল আলী সাজি, সিয়াম হোসেন, আখতারু জামান সেলিম ও জুবেরসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে কলকাতায় নিটাইন থানায় মামলা হয়েছে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

এমপি আনার হত্যাকাণ্ড : খুনের মোটিভ নিয়ে রাখঢাক

আপলোড টাইম : ০৭:৫১:৪০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ মে ২০২৪

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে আখতারুজ্জামানকে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ১৩ মে কলকাতার নিউটাউনে সঞ্জীবা গার্ডেন্সের ৫৬/বিইউ ফ্ল্যাটে কিলিং মিশনের নেতৃত্ব দেয়া পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমানউল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়াসহ ইতোমধ্যে ৩ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে আরো বেশ কয়েকজনকে। কলকাতা পুলিশও লাশ গুমে সহায়তা করা সিয়াম ও শাহিনের অন্যতম সহযোগী জিহাদকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে। ৫ কোটি টাকায় এই হত্যাকাণ্ডের চুক্তি দেয়া হয় বলেও দুদেশের গোয়েন্দারা নিশ্চিত করেছেন। এমনকি ঢাকার দুটি বাসায় দফায় দফায় পরিকল্পনা করে কলকাতার ওই ফ্ল্যাটে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ টুকরো টুকরো করে হাড্ডি-মাংস আলাদা করে জলাশয় বা খাল ও জঙ্গলে ফেলা হয়েছে বলেও তথ্য দিয়েছে শিমুল ভূঁইয়া। তদন্তে এত অগ্রগতির পরও কী কারণে এমপি আনারকে হত্যা করা হলো- সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো কারণ জানতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শুধু তাই নয়- চিকিৎসার জন্য কলকাতা গিয়ে এমপি আনার বন্ধুর বাসায় ওঠার পর কেন ওই ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন সে বিষয়েও এখনো ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। এ বিষয়ে খানিকটা রাখঢাকের প্রবণতা লক্ষণীয়। হত্যার কারণ হিসেবে হুন্ডি ব্যবসা ও স্বর্ণের চোরাচালানের নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল, চোরাচালানে সম্পৃক্ত কোনো অপরাধীকে দমন করার মতো বিষয়কে সন্দেহে আনা হয়।

কিন্তু হত্যার সুস্পষ্ট কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আখতারুজ্জামান শাহিনকে প্রয়োজন। এছাড়া সুস্পষ্ট করে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। কারণ আখতারুজ্জামান শাহিন ও এমপি আনার বাল্যবন্ধু ছিলেন। তাদের মধ্যে কী নিয়ে সমস্যা চলছিল- এটি হয়তো মামলার তদন্তে উঠে আসবে। এদিকে হত্যাকাণ্ড নিশ্চিত হলেও এমপি আনারের লাশ এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। গ্রেপ্তার চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়া ডিবি পুলিশকে জানিয়েছেন, ঘটনার সময় শিমুল ভূঁইয়া ছাড়াও ফয়সাল ও মুস্তাফিজ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। এজন্য পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে তারা আগেই চেয়ার, রশি, ছুরি ও কালো রঙের পলিথিন কিনে রেখেছিল। এমপি আনার কক্ষে প্রবেশ করার পর তাকে চেয়ারে হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। পরে লাশ টুকরো টুকরো করা হয়। পরে হাড্ডি-মাংস আলাদা করে ওই কালো রঙের পলিথিনে করে নির্জন জঙ্গল ও খালের বিভিন্ন পয়েন্টে ফেলে দেয়া হয়। ফলে লাশ উদ্ধার করা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। যদিও শিমুল ভূঁইয়ার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ভারতে যাবে বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম।

ডিবি সূত্র জানিয়েছে, লাশের অংশবিশেষ পাওয়া যেতে পারে। এ জন্য ডিবি ওয়ারী বিভাগের একজন এসির নেতৃত্বে একটি টিম দ্রুতই ভারতে রওনা হবে। পাশাপাশি শেরেবাংলা নগর থানায় দায়ের হওয়া মামলায় শিমুল ভূঁইয়া, তার ভাতিজা তানভির ও শাহিনের প্রেমিকা শিলাস্তি রহমানকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হবে আজ শুক্রবার। অন্যদিকে এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো অফিসার অন্তু কুমার ও জয়দীপসহ চারজন এখন ঢাকায়। ডিবি কার্যালয়ে গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তারা; ডিবির তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিনিময় করেছেন।

এদিকে গতকাল মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে হত্যাকাণ্ডের রোমহর্ষক বর্ণনা দেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার পরিকল্পনা হয় দুই থেকে তিন মাস আগে। তারা পরিকল্পনা করেছিল ঢাকায় হত্যা করবে। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশের নজরদারি ও ঢাকায় হত্যাকাণ্ডের পর ক্লু পুলিশ বের করে নেবে- এই আশঙ্কা থেকেই হত্যাকারীরা কলকাতায় এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে তারা এ হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে থাকতে পারেনি। আমরা তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছি। আরো কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

ডিবিপ্রধান বলেন, এ ঘটনার মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামানের বাসা একটি গুলশানে, একটি বসুন্ধরা এলাকায়। এই দুই বাসায় বসে অনেক দিন ধরেই খুনের পরিকল্পনা করেছে আসামিরা। আনারকে হত্যার নেপথ্যে রাজনীতি বা অর্থনৈতিক- যে কারণই থাকুক না কেন বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা কলকাতায় গত ২৫ এপ্রিল একটি বাসা ভাড়া নেয়, ৩০ এপ্রিল ওই বাসায় ওঠে তারা। যিনি হত্যার পরিকল্পনা করেছেন তিনিও আরেকজনসহ মোট তিনজন বিমানে করে কলকাতার ভাড়া বাসায় ওঠেন। তারা দুই মাস ধরে খেয়াল রেখেছেন কখন আনার কলকাতা যাবেন। গত ১২ মে আনার তার ভারতীয় বন্ধু গোপালের বাসায় যান। সেখানে আরো দুজনকে ভাড়া করা হয়। তারা ওই বাসায় আসা-যাওয়া করতেন। তারা হলেন- জিহাদ ও সিয়াম। সব পরিকল্পনা ঠিক করে দিয়ে মাস্টারমাইন্ড শাহিন ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসেন। এরই ধারাবাহিকতায় আনার ১৩ মে ওই ভাড়া বাসায় ওঠেন। এর আগে ফয়সাল নামে একজন তাকে রিসিভ করেন। সেখান থেকে নিয়ে মূল হত্যাকারী শিমুল, আনার ও ফয়সালকে নিয়ে চালক রাজা ওই বাসায় যায়। আগে থেকে অবস্থান করা মোস্তাফিজও বাসায় ঢোকেন। আগে সেখানে ভেতরে ছিলেন জাহিদ ও সিয়াম। আধা ঘণ্টার মধ্যে নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।

ভিকটিমের মোবাইল নম্বর থেকে মেসেজ বিভিন্নজনকে করা হয়- যাতে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে তদন্তে বেগ পায়। তাদের পরিকল্পনা ছিল, হত্যার পর আনারের লাশ এমনভাবে গুম করে দেয়া হবে; যাতে করে কেউ কোনোদিন খুঁজে না পায়। হত্যার পর তার শরীর বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। হাড় থেকে শরীরের মাংস আলাদা করা হয়েছে। এরপর গ্রে কালারের লাগেজে ভরে মূল হত্যাকারী শিমুল ও তার সহযোগী জাহিদ ব্রিফকেস নিয়ে বের হয়। এরপর সিয়াম পাবলিক টয়লেটের কাছে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সেখানে গিয়ে অবস্থান করছিলেন আমানুল্লাহ। ভারতীয় চালকসহ তারা গাড়ি নিয়ে চলে যান। পরবর্তী সময়ে ২-৩ জন মিলে আনারের খণ্ড-বিখণ্ড শরীর কয়েকটি ব্যাগে ভরে নিয়ে যান। তারা এমন নৃশংস কায়দায় হত্যার কাজটি সংঘটিত করেছেন- যাতে ধরা না পড়েন। সেজন্য তারা হাড়-মাংস আলাদা করেন, হলুদ মিশিয়ে দেন। যাতে করে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে পারেন, বাজার থেকে আনা।

উদ্দেশ্য একটাই ছিল- কেউ যেন কোনো দিন আনারের অস্তিত্ব খুঁজে না পায়। ১৫ মে শিমুল, শিলাস্তি ও মোস্তাফিজ ফিরে আসেন বাংলাদেশে। সবাই যখন ফিরে আসেন; তখন মূল পরিকল্পনাকারী শাহিন ভিস্তারা এয়ারলাইন্সে দিল্লি হয়ে দুই ঘণ্টার ট্রানজিট নিয়ে নেপালের কাঠমান্ডু চলে যান। সেখান থেকে হয়তো তিনি অন্য কোথায় চলে যেতে পারেন। অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, এই হত্যাকাণ্ডটা পরিকল্পিত। তারা দীর্ঘদিন ধরে সুযোগ খুঁজেই হত্যা করেছে। আমরা ১৮ মের পর তদন্ত শুরু করেছি; যখন আনারের বন্ধু গৌতম কলকাতায় সাধারণ ডায়েরি করেন। হত্যাকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে বিভিন্ন মেসেজ পাঠিয়ে- তিনি জীবিত আছেন। মেসেজ এমন ছিল, ‘আমি হঠাৎ করে দিল্লি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে ভিআইপি আছে।’ ‘আমি অমিত সাহার কাছে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী সেখানে যাবেন। তার মন্ত্রী হওয়া নিয়ে কথা হবে।’ আসলে আনারের ডিভাইস ব্যবহার করে এসব মেসেজ দিয়েছে হত্যাকারীরা। তারা কখনো বেনাপোল, মুজাফফরাবাদ; কখনো কলকাতার শেষ বর্ডারে গিয়ে মেসেজ দিয়ে গেছে। তদন্তকারীরা যাতে ডিভাইসটা খুঁজে না পায়- সেটিই ছিল লক্ষ্য।

ডিবি কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কাছে আটক তিনজন হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। আমাদের সঙ্গে কলকাতা পুলিশ, কলকাতা সিআইডি ও এসটিএফের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে। ভারতের একটি তদন্ত-সংশ্লিষ্ট টিম আমাদের এখানে আসবেন। আমাদের হাতে আটক যে আসামি রয়েছে তাদের সঙ্গে কথা বলবেন, জিজ্ঞাসা করবেন। আমরাও প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে অনুমতি নিয়ে ঘটনাস্থলে যাব। তিনি আরো বলেন, মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহিনের প্রেমিকা শিলাস্তি রহমান। মূল হত্যাকারীর নাম আমানুল্লাহ। তার আসল নাম কিন্তু আমানুল্লাহ নয়; তিনি মিথ্যা নামে পাসপোর্টটি করেছেন। তার আসল নাম আসলে শিমুল ভূঁইয়া। যিনি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির বড় নেতা ছিলেন। তার নামে অনেকগুলো হত্যা মামলা রয়েছে।

মরদেহ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা? জানতে চাইলে হারুন বলেন, লাশ পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু বলা সম্ভব নয়। তবে শিমুলের বর্ণনামতে আসলে আনারের মরদেহ তো খণ্ড খণ্ড করা হয়েছে। হাড়-মাংস আলাদা করে হলুদ মিশিয়ে ব্যাগে ভরে ফেলা হয়েছে। আমরা কাজ করছি, লাশ পাওয়ার আগেই মামলা হতে পারে। কলকাতা পুলিশ তো নিশ্চিত হয়েছে হত্যা হয়েছে। যে ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করেছে; সে কলকাতা পুলিশের কাছে আছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা তদন্ত করছি। কেন হত্যাকাণ্ড- সেটি তো বের হবেই; তবে কারা কারা জড়িত, আরো কেউ জড়িত কিনা, রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিল কিনা- তা খতিয়ে দেখা হবে। আমরা আশা করছি পুরোপুরি না পেলেও খণ্ডিত হলেও মরদেহ উদ্ধার সম্ভব হবে।

এ বিষয়ে গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ঝিনাইদহের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারকে যারা হত্যা করেছেন, তাদের প্রায় চিহ্নিত করে ফেলেছি। আমাদের শুধু ঘোষণা বাকি। দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থা একমত হতে পারলে ঘোষণা দেব। তিনি আরো বলেন, আমরা মরদেহটা এখনো উদ্ধার করতে পারিনি। আপনারা যা শুনেছেন, আমরাও সেগুলোই শুনেছি। যে পর্যন্ত মরদেহ উদ্ধার করতে না পারব, সে পর্যন্ত অফিশিয়ালি আপনাদের কিছু বলতে পারছি না। এ বিষয়ে দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। আনোয়ারুল আজীম আমাদের ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের এমপি। ওই বর্ডার এলাকাটা সন্ত্রাসকবলিত। সে এলাকারই তিনি এমপি। কী কারণে হত্যাকাণ্ড হয়েছে সে বিষয়ে সুনিশ্চিত না হয়ে কিছুই বলা ঠিক হবে না। আমরা আগে নিশ্চিত হই, তারপর আপনাদের বিস্তারিত জানাব।

ডিবি সূত্র জানিয়েছে, গত ৩০ এপ্রিল শাহিন ‘কন্ট্রাক্ট কিলার’ শিমুল ভূঁইয়া ও শিলাস্তিকে নিয়ে কলকাতা যান। সেখানে আগে থেকেই ভাড়া করে রাখা নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেন্সের ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন তারা। কলকাতায় আরো আগে থেকেই অবস্থান করছিল শাহিনের দুই সহযোগী সিয়াম ও জিহাদ। সেখানে বসে তারা এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করে। হত্যার দায়িত্ব শিমুল ভূঁইয়াকে বুঝিয়ে দিয়ে ১০ মে দেশে চলে আসেন শাহিন। পরিকল্পনা অনুযায়ী শিমুল ভূঁইয়া বাংলাদেশ থেকে আরো দুই ভাড়াটে কিলারকে নিয়ে যায় কলকাতায়। ফয়সাল শাজী ও মোস্তাফিজ নামে দুই ভাড়াটে খুনি ১১ মে কলকাতায় গিয়ে শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগ দেয়। ১৩ মে এমপি আনারকে সেই ফ্ল্যাটে ডেকে আনেন শিলাস্তি।

ডিবি পুলিশের ধারণা, হত্যাকাণ্ডের সময় শিলাস্তি ওই ফ্ল্যাটের একটি রুমে অবস্থান করছিলেন, সামনে ছিলেন না। হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর তিনি নিচে নেমে আসেন। এরপর লাশ গুমে সহায়তা করেন। শিমুল ভূঁইয়া ও শিলাস্তি মিলেই এমপি আনারের টুকরো করা মরদেহ রাখা একটি ট্রলি নিয়ে প্রথমে বের হয়েছিলেন বলে তথ্য রয়েছে। কিলিং মিশন শেষে ১৫ মে বিমানে করে দেশে ফেরত আসেন ওই নারী। কলকাতা পুলিশ ওই ফ্ল্যাট ও আশপাশের ভবনের সব সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। সেখানে শিলাস্তি বাইরে থেকে পলিথিন ও ব্লিচিং পাউডার নিয়ে আসছেন- এমন দৃশ্য রয়েছে বলে জানা গেছে। জিজ্ঞাসাবাদে শিমুল ভূঁইয়া জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের পরদিন বিকালে একটি ট্রলিব্যাগ হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হন তিনি। বাসা থেকে বের হয়ে পাশের একটি শপিং মলের সামনে সেই ট্রলিব্যাগটি সিয়ামের হাতে তুলে দেন। সিয়াম সেই ব্যাগ নিয়ে তাদের আগে থেকেই ভাড়া করে রাখা গাড়ি নিয়ে অজ্ঞাত স্থানের দিকে চলে যায়। সেই গাড়িচালক কলকাতা পুলিশকে জানিয়েছে, সিয়াম কিছু দূর যাওয়ার পর ব্যাগটি নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে।

কলকাতায় শাহিনের সহযোগী সিয়াম গ্রেপ্তার :

এদিকে আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ও এমপি আনারের বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহিনের সহযোগী সিয়াম নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে কলকাতা সিআইডি পুলিশ। একই সঙ্গে জিহাদ নামে অপর একজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানানো হয়। এই জিহাদই সিয়াম বলে জানা গেছে। উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ অঞ্চল থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল তাকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দা দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার পরনে ছিল সাদা গেঞ্জি এবং খয়েরি রঙের প্যান্ট। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই এমপি আনারের মৃতদেহ সন্ধান করতে চান তদন্তকারী কর্মকর্তারা। সিয়াম বনগাঁ হয়ে বাংলাদেশে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমপি আনারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার পর তিনি মধ্য কলকাতায় লুকিয়ে ছিলেন। বৃহস্পতিবারেই কোনোভাবে বর্ডার পার হয়ে বাংলাদেশ চলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল সিয়ামের।

কলকাতা পুলিশ গণমাধ্যমকে জানায়, হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় সিয়াম অবৈধভাবে ভারতে এসেছিলেন। ৩০ এপ্রিল ভারতে প্রবেশের পর তিনি মুম্বাই চলে যান। যখন এমপি আনার কলকাতায় বরানগরের মন্ডলপাড়ায় গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন তার আগেই সিয়াম মুম্বাই থেকে কলকাতায় চলে আসেন। এরপর নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেন্সের ফ্ল্যাটে এমপি আনারের লাশ টুকরো টুকরো করেন কয়েকজন। পরে একে একে তারা নিউটাউন ছাড়েন। পুলিশের তথ্যমতে, জিহাদ নিউটাউন থেকে লাগেজে করে লাশের অংশ বের করেন। পরে অপরজনের হাতে সেই ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে গা-ঢাকা দেন। এই একই ঘটনায় জুবের নামে এক ক্যাবচালককেও আটক করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাকে। লাশ গুমের বিষয়ে কলকাতা পুলিশ সূত্র জানাচ্ছে, লাশ টুকরো করা সহজ এবং তা কোনো জলাশয়ে ফেলে দেয়া কঠিন ব্যাপার নয়। কারণ নিউটাউন-সংলগ্ন বহু মাছ চাষের জলাশয় আছে।

কলকাতা পুলিশ গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, ১৩ মে নিউটাউনের আবাসনেই শ্বাসরোধ করে খুনের পর টুকরো টুকরো করে কাটা হয় মরদেহ। ১৬ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত তিনদিন ধরে খণ্ডিত অংশ অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়। কিছু অংশ ওই ফ্ল্যাটের ফ্রিজে রাখা হয়। এমনকি ফ্ল্যাট থেকে প্লাস্টিক ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা, প্লাস্টিক ব্যাগে ভরেই খণ্ডিত অংশ বিভিন্ন জায়গায় ফেলা হয়েছে। তবে কারা ফেলেছে, কোথায় ফেলা হয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। এদিকে এই ঘটনায় একটি গাড়ি জব্দ করেছে পুলিশ। গাড়িটির নম্বর ডব্লিউবি ১৮ এএ ৫৪৭৩। জানা গেছে, সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখে গাড়িটিকে শনাক্ত করা হয়। এর পরই গাড়ির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সেই গাড়িটিকে আনা হয় নিউটাউন থানায়। উদ্ধার হওয়া গাড়ি থেকে ফরেনসিক এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞরা নমুনা সংগ্রহ করেন।

বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশের পর পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডির) জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব কলকাতার বিলাসবহুল এক ফ্ল্যাটে ঝিনাইদহের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যায় তারই এক বন্ধু ঘাতকদের ৫ কোটি টাকায় ভাড়া করেন। ওই বন্ধু তাকে খুন করার জন্য ঘাতকদের এই টাকা দেন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির ওই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, এমপি আনোয়ারুল আজীমকে প্রথমে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় বলে ঘটনাস্থলে পাওয়া আলামতে সেরকম ইঙ্গিত মিলেছে। হত্যাকাণ্ডে মূলত চার ধরনের গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল। পুলিশের মতে, গোপালের বাড়ি থেকে সাদা রঙের সুইফ ডিজায়ার ব্যবহার করে এমপি আনার কলকাতার নিউমার্কেটে যান। এরপর সেখান থেকে আরো একটি গাড়ি করে নিউটাউনে যান। পরে নিউটাউন থেকে একটি লাল গাড়িতে সঞ্জীবা গার্ডেন্স নামের অভিজাত আবাসনে যান। তাকে হত্যার পর আরো একটি কালো গাড়ি ব্যবহার হয়েছিল। সিসিটিভিতে এমনই তথ্য মিলেছে কলকাতা পুলিশের কাছে। এ ঘটনায় আমানুল্লাহ শিমুল, শিলাস্তি রহমান, মুস্তাফিজুর, ফয়সাল আলী সাজি, সিয়াম হোসেন, আখতারু জামান সেলিম ও জুবেরসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে কলকাতায় নিটাইন থানায় মামলা হয়েছে।