ইপেপার । আজ শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অস্ত্র, স্বর্ণ ও মানব পাচারে মহেশপুর সীমান্তে একাধিক চোরাচালান সিন্ডিকেট

পুলিশ, বিজিবি ও জনপ্রতিনিধির পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:৪২:০৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৪
  • / ৩৯ বার পড়া হয়েছে

ঝিনাইদহ অফিস:

মহেশপুর উপজেলার বাঘাডাঙ্গা গ্রামে এক চোরাকারবারির গুলিতে দুই ব্যক্তি নিহত হওয়ার পর সীমান্ত এলাকায় এখন প্রধান আলোচনার বিষয় চোরাচালান সিন্ডিকেট। দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ ও বিজিবির দুর্বল নজরদারির কারণে সীমান্ত উপজেলা মহেশপুরে বিভিন্ন গ্রামে চোরাচালান সিন্ডিকেটের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেট মূলত ভাড়ায় অস্ত্র আনা নেওয়া, সোনার বার ও ধুড় (মানব) পাচার করে থাকে। আর এই কাজে প্রধান সহযোগী হলো সীমান্তে বসবাসকারী কতিপয় জনপ্রতিনিধি, বিজিবির সোর্স ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা।

বাঘাডাঙ্গা গ্রামে শামীম হোসেন ও মণ্টু মিয়া নামের দুই ব্যক্তি নিহত হওয়ার নেপথ্যে ছিল চোরাকারবারির টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব। তারা মূলত বাঘাডাঙ্গা গ্রামের মতিয়ার রহমান মতির নিয়ন্ত্রণে থেকে পাচার কাজে নিয়োজিত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। নেপা ইউনিয়নের ৮ নম্বর বিটের এসআই মো. জমির হোসেন গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে জানান, তরিকুল ইসলাম আকালে ও রফিকের মধ্যে প্রায় ৬ মাস ধরে চোরাচালানের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ¦ চলছিল। সীমান্তে তাদের একটি সিন্ডিকেট আছে। এই বিরোধের জের ধরে দেড় মাস আগে শামীমকে কুপিয়ে আহত করেছিল আকালে। গত বুধবার সকালে শামীমের বাবা শামসুল ঘাস কাটতে মাঠে যাওয়ার সময় আকালে ও তার ভাই ইব্রাহীম এবং ভগ্নিপতি আব্দুল জলিল গালিগালাজ করে। বিষয়টি বাড়ি এসে জানালে শামীম, বাবা শামসুল ও চাচা মণ্টু মন্ডল দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আকালের বাড়িতে যান। এসময় আকালে তার কাছে থাকা অবৈধ ৯ এমএম পিস্তল (৭.৬২) দিয়ে গুলি চালিয়ে চাচা মণ্টু মন্ডল ও ভাতিজা শামীমকে খুন করে পালিয়ে যান। গুলিবিদ্ধ হন শামসুল মন্ডল।

স্থানীয় ইউপি সদস্য ও বাঘাডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা ওবাইদুল ইসলাম জানান, এ ঘটনার পর পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তিনটি গুলির খোসা উদ্ধার করেছে। তরিকুল ইসলাম আকালে সম্ভবত ভারতে পালিয়ে যেতে পারেন। মহেশপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে হামলাকারী ও নিহত উভয় পাচারকারী। টাকা ভাগাভাগি নিয়ে তারা দ্বন্দে¦ জড়িয়ে খুন হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, এজাহার হাতে পেলে এ ঘটনার সঙ্গে আরও কারা কারা সম্পৃক্ত, তা জানা যাবে।

এদিকে মহেশপুর সীমান্তের বিভিন্ন গ্রামে একাধিক সিন্ডিকেট রয়েছে বলে জানা গেছে। বিজিবির সোর্স পরিচয় দিয়ে কতিপয় ব্যক্তি এই চোরাচালান সিন্ডিকেট পরিচালনা করে বলে তথ্যানুসন্ধানে উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সীমান্তের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে জানা গেছে, মহেশপুরের ৯টি গ্রাম একেবারেই সীমান্ত ঘেঁষা হওয়ায় সেখান দিয়ে সোনা, অস্ত্র, গরু ও ধুড় পাচার করা হয়। গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে বাঘাডাঙ্গা, পলিয়ানপুর, যাদবপুর, জুলুলী, লেবুতলা, মরকধ্বজপুর, শ্যামকুড়, রায়পুর ও কচুয়ারপোতা। এরমধ্যে মকরধ্বজপুর, বাঘাডাঙ্গা ও রায়পুর দিয়ে ভারতীয় গরু ও বাংলাদেশি ধুড় পাচার হয়। বাঘাডাঙ্গা ও শ্যামকুড় বর্ডার দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র এবং লেবতলা ও রায়পুর বর্ডার দিয়ে সোনা পাচার হয়।

বিজিবির সোর্স পরিচয় দিয়ে একাধিক ব্যক্তি সীমান্তের এগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, রায়পুর সীমান্তে কুটি মিয়া, শ্যামকুড় এলাকায় আলী, নেপা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন নওশের খোঁড়া, হুদাপাড়া, কাঞ্চনপুর ও বাঘাডাঙ্গা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন আল আমিন ও রতনপুর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন আল আমিন। এরা সবাই বিজিবির কথিত সোর্স পরিচয় দিয়ে চোরাকারবারিদের সহায়তা করেন বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেন। তবে বিজিবির দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ সীমান্তের চোরাচালান নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। বাঘাডাঙ্গা বিজিবির ক্যাম্প কমান্ডার সুবেদার শরাফৎ আলী ও টুআইসি হাবিলদার আব্দুল আজিজ এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহেশপুর-৫৮ বিজিবির এক কর্মকর্তা জানান, তাদের কোনো সোর্স নেই। তারা নিজস্ব গোয়েন্দা নজরদারি দিয়ে চোরাচালানসহ সীমান্তে সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করেন। বিজিবির নাম ভাঙিয়ে যারা চোরাকারবারিদের সহায়তা করে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

অস্ত্র, স্বর্ণ ও মানব পাচারে মহেশপুর সীমান্তে একাধিক চোরাচালান সিন্ডিকেট

পুলিশ, বিজিবি ও জনপ্রতিনিধির পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ

আপলোড টাইম : ০৯:৪২:০৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৪

ঝিনাইদহ অফিস:

মহেশপুর উপজেলার বাঘাডাঙ্গা গ্রামে এক চোরাকারবারির গুলিতে দুই ব্যক্তি নিহত হওয়ার পর সীমান্ত এলাকায় এখন প্রধান আলোচনার বিষয় চোরাচালান সিন্ডিকেট। দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ ও বিজিবির দুর্বল নজরদারির কারণে সীমান্ত উপজেলা মহেশপুরে বিভিন্ন গ্রামে চোরাচালান সিন্ডিকেটের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেট মূলত ভাড়ায় অস্ত্র আনা নেওয়া, সোনার বার ও ধুড় (মানব) পাচার করে থাকে। আর এই কাজে প্রধান সহযোগী হলো সীমান্তে বসবাসকারী কতিপয় জনপ্রতিনিধি, বিজিবির সোর্স ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা।

বাঘাডাঙ্গা গ্রামে শামীম হোসেন ও মণ্টু মিয়া নামের দুই ব্যক্তি নিহত হওয়ার নেপথ্যে ছিল চোরাকারবারির টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব। তারা মূলত বাঘাডাঙ্গা গ্রামের মতিয়ার রহমান মতির নিয়ন্ত্রণে থেকে পাচার কাজে নিয়োজিত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। নেপা ইউনিয়নের ৮ নম্বর বিটের এসআই মো. জমির হোসেন গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে জানান, তরিকুল ইসলাম আকালে ও রফিকের মধ্যে প্রায় ৬ মাস ধরে চোরাচালানের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ¦ চলছিল। সীমান্তে তাদের একটি সিন্ডিকেট আছে। এই বিরোধের জের ধরে দেড় মাস আগে শামীমকে কুপিয়ে আহত করেছিল আকালে। গত বুধবার সকালে শামীমের বাবা শামসুল ঘাস কাটতে মাঠে যাওয়ার সময় আকালে ও তার ভাই ইব্রাহীম এবং ভগ্নিপতি আব্দুল জলিল গালিগালাজ করে। বিষয়টি বাড়ি এসে জানালে শামীম, বাবা শামসুল ও চাচা মণ্টু মন্ডল দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আকালের বাড়িতে যান। এসময় আকালে তার কাছে থাকা অবৈধ ৯ এমএম পিস্তল (৭.৬২) দিয়ে গুলি চালিয়ে চাচা মণ্টু মন্ডল ও ভাতিজা শামীমকে খুন করে পালিয়ে যান। গুলিবিদ্ধ হন শামসুল মন্ডল।

স্থানীয় ইউপি সদস্য ও বাঘাডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা ওবাইদুল ইসলাম জানান, এ ঘটনার পর পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তিনটি গুলির খোসা উদ্ধার করেছে। তরিকুল ইসলাম আকালে সম্ভবত ভারতে পালিয়ে যেতে পারেন। মহেশপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে হামলাকারী ও নিহত উভয় পাচারকারী। টাকা ভাগাভাগি নিয়ে তারা দ্বন্দে¦ জড়িয়ে খুন হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, এজাহার হাতে পেলে এ ঘটনার সঙ্গে আরও কারা কারা সম্পৃক্ত, তা জানা যাবে।

এদিকে মহেশপুর সীমান্তের বিভিন্ন গ্রামে একাধিক সিন্ডিকেট রয়েছে বলে জানা গেছে। বিজিবির সোর্স পরিচয় দিয়ে কতিপয় ব্যক্তি এই চোরাচালান সিন্ডিকেট পরিচালনা করে বলে তথ্যানুসন্ধানে উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সীমান্তের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে জানা গেছে, মহেশপুরের ৯টি গ্রাম একেবারেই সীমান্ত ঘেঁষা হওয়ায় সেখান দিয়ে সোনা, অস্ত্র, গরু ও ধুড় পাচার করা হয়। গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে বাঘাডাঙ্গা, পলিয়ানপুর, যাদবপুর, জুলুলী, লেবুতলা, মরকধ্বজপুর, শ্যামকুড়, রায়পুর ও কচুয়ারপোতা। এরমধ্যে মকরধ্বজপুর, বাঘাডাঙ্গা ও রায়পুর দিয়ে ভারতীয় গরু ও বাংলাদেশি ধুড় পাচার হয়। বাঘাডাঙ্গা ও শ্যামকুড় বর্ডার দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র এবং লেবতলা ও রায়পুর বর্ডার দিয়ে সোনা পাচার হয়।

বিজিবির সোর্স পরিচয় দিয়ে একাধিক ব্যক্তি সীমান্তের এগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, রায়পুর সীমান্তে কুটি মিয়া, শ্যামকুড় এলাকায় আলী, নেপা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন নওশের খোঁড়া, হুদাপাড়া, কাঞ্চনপুর ও বাঘাডাঙ্গা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন আল আমিন ও রতনপুর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন আল আমিন। এরা সবাই বিজিবির কথিত সোর্স পরিচয় দিয়ে চোরাকারবারিদের সহায়তা করেন বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেন। তবে বিজিবির দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ সীমান্তের চোরাচালান নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। বাঘাডাঙ্গা বিজিবির ক্যাম্প কমান্ডার সুবেদার শরাফৎ আলী ও টুআইসি হাবিলদার আব্দুল আজিজ এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহেশপুর-৫৮ বিজিবির এক কর্মকর্তা জানান, তাদের কোনো সোর্স নেই। তারা নিজস্ব গোয়েন্দা নজরদারি দিয়ে চোরাচালানসহ সীমান্তে সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করেন। বিজিবির নাম ভাঙিয়ে যারা চোরাকারবারিদের সহায়তা করে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।