নিজস্ব প্রতিবেদক:
চুয়াডাঙ্গা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (টিটিসি) ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টর মো. মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষাণার্থীদের কাছ থেকে পাশ করিয়ে দেওয়ার নাম করে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রশিক্ষার্থীদের ফেল করানোর বিভিন্ন রকম ভীতি দেখিয়ে জনপ্রতি ২ হাজার ৫ শ টাকা নিয়েছেন তিনি। কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ বলছেন, ইতোপূর্বেও তার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ ছিল। বিষয়টিতে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টর মো. মনিরুজ্জামান বলছেন, প্রশিক্ষণার্থীদের ড্রাইভিংয়ে পাশ করানোর জন্য নিঃস্বার্থ কিছু টাকা নিলেও তিনি তা ফেরত দিয়ে দেবেন।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিভিন্ন ট্রেডে নিয়মিত প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। স্কিলস্ ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (SEIP) এর আওতায় চুয়াডাঙ্গা টিটিসিতে অন্যান্য প্রশিক্ষণের সাথে মোটর ড্রাইভিং উইথ বেসিক মেইনটেন্যান্স প্রশিক্ষণও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে সেইপ প্রকল্পের আওতায় এই প্রশিক্ষণের বেশ কয়েকটি ব্যাচ প্রশিক্ষণ শেষ করেছে। সেইপ প্রকল্পের চুক্তিভিত্তিক ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টর হিসেবে চুয়াডাঙ্গা টিটিসির সামনেই ভিমরুল্লাহ গ্রামের মো. মনিরুজ্জামান ড্রাইভিংয়ের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন।
তবে অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে চুয়াডাঙ্গা টিটিসিতে তিনি নিজস্ব একটি বলয় তৈরি করেছেন। নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছামতো আসা-যাওয়া করেন। তার ভাই তরিকুল ইসলাম লাবলু এই ট্রেডের সহকারী প্রশিক্ষক। দুই ভাই মিলে অনেকটাই ইচ্ছামতো নিয়মের বাইরে গিয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তবে প্রশিক্ষণ প্রদানে যেমন ফাঁকি দেন, তার থেকে বেশি নির্ধারিত ড্রাইভিং পরীক্ষার সময়ে তাদের আচরণ বদলায়। প্রশিক্ষণার্থীদের ফেল করানোর নানা রকম হুমকি-ধমকি দিয়ে প্রতি ব্যাচেই তারা নেন মোটা অংকের টাকা। জনপ্রতি আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা বা তার বেশিও নেওয়ার অভিযোগ আছে।
চুয়াডাঙ্গা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, স্কিলস্ ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (SEIP) এর আওতায় চুয়াডাঙ্গা টিটিসিতে সকাল-বিকেল মিলে মোট চারটি ব্যাচের ৯০ জন প্রশিক্ষণার্থীর পরীক্ষা আজ মঙ্গলবার। চুয়াডাঙ্গা বিআরটিএ-এর মাধ্যমে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। প্রশিক্ষণার্থীদের অভিযোগ, প্রশিক্ষণের বাকি সব ক্লাস ঠিকঠাক হলেও ব্যবহারিক ক্লাসে প্রশিক্ষকরা সময় দেন খুবই কম। প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময় থেকেই তারা প্রশিক্ষণার্থীদের পরীক্ষা নিয়ে নানা ভীতি দেখান। টাকা না দিলে কেউ পাশ করে না, যে টাকা দেবে না, তার দায়িত্ব তার নিজের। এই ধরনের নানা কথায় চাপে রাখেন প্রশিক্ষণার্থীদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক প্রশিক্ষণার্থী বলেন, ‘শুরু থেকেই মনির স্যার ও তরিকুল স্যার আমাদের কাছে টাকা দাবি করে আসছেন। টাকা না দিলে ফেল করব, তারা আমাদের দায়িত্ব নিবে না, এমনটাই বলা হয়ে থাকে। মনির স্যার তো কখনো কখনো বলে থাকেন, যে টাকা দিবা না, সে পাশও করবা না। প্রশিক্ষণ নিয়ে লাভ নেই। বাড়ি যাও।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রশিক্ষণার্থী বলেন, ‘আমার বাড়ি জীবননগর উপজেলায়। আমার আব্বু একজন প্রতিবন্ধী। খুব কষ্টে আমাদের সংসার চলে। যাতায়াত ভাতা দেওয়ায় আমি সেইপ প্রকল্পের এই প্রশিক্ষণে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু দূর থেকে আসা যাওয়ার নানা সমস্যা থাকায় আমি যাতায়াত ভাতার কথা ভেবে চুয়াডাঙ্গায় ম্যাসে উঠেছি। তবে ড্রাইভিং প্রশিক্ষক মনির স্যারের আচরণে আমি খুব টেনশনে ছিলাম। প্রথম থেকেই তিনি পাশ করার জন্য টাকা দাবি করেছিলেন। আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা জানিয়ে আমি স্যারকে অনুরোধ করেছিলাম, আমার টাকাটা যেন না নেওয়া হয়। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তোমার কোর্স করতে হবে না। তুমি পাশ করবা না। তোমার দায়িত্ব আমার না। শেষ পর্যন্ত আমি অনেক কষ্টে আড়াই হাজার টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি।’
এদিকে, টিটিসির ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টর মো. মনিরুজ্জামান ও তার ভাই একই ট্রেডের সহকারী প্রশিক্ষক তরিকুল ইসলাম লাবলুর বিরুদ্ধে এর আগের প্রতিটি ব্যাচের প্রশিক্ষাণার্থীদেও থেকেও মোটা টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যারা দেয়নি, তাদের পাশ করানো হয়নি বলেও জানিয়েছেন পূর্বের ব্যাচের একাধিক প্রশিক্ষণার্থী।
প্রথমে অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে অভিযোগ অনেকটাই স্বীকার করে টিটিসির ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টর মো. মনিরুজ্জামান এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘প্রশিক্ষণার্থীদের ড্রাইভিংয়ে পাশ করানোর জন্য নিঃস্বার্থ কিছু টাকা নিলেও আমি তা ফেরত দিয়ে দেব।’
চুয়াডাঙ্গা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ মো. মুছাব্বেরুজ্জামান বলেন, ‘মনিরুজ্জামান সাহেবের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ আমি আগেও পেয়েছি। এবার বিস্তারিত জানার পর বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখব। প্রয়োজনে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ তিনি আরও জানান, ‘গত তিন দিন আগে সেইপ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এটি এই চুক্তির সর্বশেষ ব্যাচ। মো. মনিরুজ্জামান ও তার ভাই দুজনেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত। তাদের চুক্তির মেয়াদও এই ব্যাচের মাধ্যমে শেষ হচ্ছে। তবে বিষয়টি নিয়ে আমি আইনগত পদক্ষেপ নেব। এটি আমার প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।’
তবে সাবেক ও বর্তমান প্রশিক্ষণার্থীদের দাবি, বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখে এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার। তারা এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।