ইপেপার । আজ শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘ধলতায়’ কাবু চাষিরা, বাজারে প্রশাসনের নজর নেই

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৮:৫৪:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ জুন ২০২৩
  • / ৩৬ বার পড়া হয়েছে

ঝিনাইদহ অফিস:
ঝিনাইদহের বিভিন্ন হাট-বাজারে দীর্ঘদিন ধরে ‘ধলতা’ (অতিরিক্ত) পণ্যআদায় করার অভিযোগ থাকলেও কৃষকরা কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। বরং ‘ধলতা’ না দেওয়ার কারণে হাটে হাটে প্রায় প্রতিদিন কৃষকদের সঙ্গে ব্যাপারী, ফড়িয়া ও মহাজনদের বাদানুবাদ হচ্ছে। অনেকটা জোর-জবরদস্তি করেই কৃষকদের থেকে ধলতা আদায় করা হচ্ছে। বিশেষ করে সবজি বিক্রি করতে এসে প্রতি মণে চার কেজি বেশি সবজি দিতে হয় চাষিদের। সেই হিসেবে হাটে ১০ মণ সবজি বিক্রি করতে এসে চাষিরা দাম পান ৯ মণের। শুধু সবজিতে নয়, মাছ, পাট, ধানসহ বিভিন্ন উৎপাদিত পণ্যে ধলতা আদায় করা হচ্ছে।
মহাজনরা সিন্ডিকেট করে হাটে-বাজারে এই ধলতা আদায় করলেও ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন এ বিষয়ে নিশ্চুপ। যদিও ক্রেতারা বিক্রেতাদের থেকে হাটের খাজনা আদায় করেন। তারপরও জবরদস্তি করে ইজারাদাররা উভয়ের কাছ থেকেই খাজনা তুলছেন। ওজনের বেশি পণ্য নেওয়ার এই ধলতা আদায় পদ্ধতি যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।
মতিয়ার রহমান নামে ঝিনাইদহের নগরবাথান এলাকার এক সবজি চাষি অভিযোগ করে বলেন, বছরের পর বছর তারা ধলতার ফাঁদে প্রতারিত হলেও ধলতা আদায় বন্ধে প্রশাসনের কোনো তৎপরতা নেই। তিনি আরও বলেন, হাটে সবজি বিক্রি করতে আসা চাষিদের প্রতি মণে দুই থেকে চার কেজি সবজি বেশি দিতে হয় আড়তদার ও ব্যাপারীদের। বেশি দেওয়া এই ব্যবস্থাকে স্থানীয়ভাবে ‘ধলতা’ নামে পরিচিত। ঝিনাইদহ সদর উপজেলা বংকিরা গ্রামের রাবু ইসলাম দশমাইল বাজারে বিভিন্ন সময় ধান বিক্রি করেন। এই বাজারের ধান ব্যবসায়ী জিবনা গ্রামের জিয়া, হাফিজুর রহমান, আশিক ইসলাম, বংকিরা গ্রামের শুনিল, আজাদ হোসেন, মজিবর রহমান ও সানেয়ার হোসেন ৪০ কেজি শুকনা ধানে এক কেজি করে ধলতা নিচ্ছেন বলে তিনি (রাবু ইসলাম) অভিযোগ করেন। একইভাবে সদর উপজেলার ডাকবাংলা বাজারের ধান ব্যবসায়ী আব্দুল হান্নান বাদশা, জোয়াদ আলী টোকন ও আনোয়ার হোসেন, সরোজগঞ্জ বাজারের সুমন, শাহিন, আসাদুল, সামছুল ও মজিবর জোরপূর্বক ধলতা আদায় করে থাকেন বলে শরিফুল ইসলাম নামে এক কৃষক অভিযোগ করেন।
ডালু মন্ডল নামে বংকিরা গ্রামের অপর এক কৃষক অভিযোগ করেন, ধলতা আদায় নিয়ে কৃষকদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসক হাট ইজারা দিলেও হাট চলে গেছে ইজারাদার ও ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। ওই কৃষকের ভাষ্যমতে, বাজারে শুকনা ধান নিয়ে গেলেও প্রতি মণে জেলার বদরগঞ্জ বাজারে এক কেজি, ডাকবাংলা বাজারে ৫ শ গ্রাম ও সরোজগঞ্জ বাজারে ৭ শ গ্রাম করে ধান আদায় করা হচ্ছে। জোরপূর্বক এই ধান আদায়ের ফলে বিক্রেতারা ঠকলেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। আবুল কালাম নামে এক সবজি ব্যবসায়ী জানান, কাঁচা সবজি পঁচনশীল হওয়ায় ৮-১০ বছর ধরে ঝিনাইদহ হাটে সব ধরনের সবজিতে মণ প্রতি দুই কেজি করে ধলতা নেওয়ার নিয়ম চালু আছে। এতে ব্যাপারীদের কোনো লাভ নেই। এক হাজার কেজি সবজি কিনলে আড়তদার-ব্যবসায়ীদের ৫০ কেজি সবজি ধলতা দিতে হয়।
গতকাল সোমবার ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হলিধানী হাটে এই ধলতা গ্রহণের বিষয়ে চাষিরা অভিযোগ করেন, শীতের সবজি ফলাতে বেশ বেগ পেতে হলেও ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, মুলা, গাজর, কাঁচা মরিচ, পটল, ঝিঙে, বেগুন, ঢ্যাঁড়স, কচুমুখি, কাঁকরোল, শসা, করলা, পেঁপেতে ধলতা নেওয়া হয়। তবে হাট ইজারাদাররা ধলতা গ্রহণের বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে চাননি।
ঝিনাইদহ নতুন হোটখোলার ব্যাপারী সাগর ইসলাম বলেন, আড়ত থেকে পাইকারি মোকামে সবজি পরিবহনের সময় কিছু সবজি পঁচে যায়। কিছু নষ্ট হয়। এ কারণে হাটে সবজি বিক্রি করতে আসা চাষিদের কাছ থেকে প্রতি মণে দুই কেজি ধলতা নেওয়া হয়। চাষিরা এটা নিয়ে কখনো অভিযোগ করেন না। ধলতা তোলার নিয়ম বন্ধ হলে ব্যবসায়ীরা মণ প্রতি দুই কেজি সবজি নষ্ট হিসেব করেই চাষিদের কাছ থেকে সেই মূল্য কম দিয়ে সবজি কিনবেন।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক আজগর আলী বলেন, ধলতা গ্রহণ করা চরম অন্যায়। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। কৃষি বিপণন নামে একটি বিভাগ বিষয়টি দেখভাল করেন। ঝিনাইদহ জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা গোলাম মারুফ খান বলেন, ধলতা গ্রহণ বেআইনি। এ বিষয়ে সরকারি আইন আছে। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমি জেলা প্রশাসককে অবহিত করেছি। তিনি বলেছেন ধলতা গ্রহণ বন্ধে কঠোর হতে হবে। কোনোভাবেই যাতে কৃষকরা না ঠকে, সে বিষয়ে জেলা প্রশাসক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন অচিরেই আমরা বাজার মনিটরিংয়ে অভিযান চালাবো।’

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

‘ধলতায়’ কাবু চাষিরা, বাজারে প্রশাসনের নজর নেই

আপলোড টাইম : ০৮:৫৪:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ জুন ২০২৩

ঝিনাইদহ অফিস:
ঝিনাইদহের বিভিন্ন হাট-বাজারে দীর্ঘদিন ধরে ‘ধলতা’ (অতিরিক্ত) পণ্যআদায় করার অভিযোগ থাকলেও কৃষকরা কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। বরং ‘ধলতা’ না দেওয়ার কারণে হাটে হাটে প্রায় প্রতিদিন কৃষকদের সঙ্গে ব্যাপারী, ফড়িয়া ও মহাজনদের বাদানুবাদ হচ্ছে। অনেকটা জোর-জবরদস্তি করেই কৃষকদের থেকে ধলতা আদায় করা হচ্ছে। বিশেষ করে সবজি বিক্রি করতে এসে প্রতি মণে চার কেজি বেশি সবজি দিতে হয় চাষিদের। সেই হিসেবে হাটে ১০ মণ সবজি বিক্রি করতে এসে চাষিরা দাম পান ৯ মণের। শুধু সবজিতে নয়, মাছ, পাট, ধানসহ বিভিন্ন উৎপাদিত পণ্যে ধলতা আদায় করা হচ্ছে।
মহাজনরা সিন্ডিকেট করে হাটে-বাজারে এই ধলতা আদায় করলেও ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন এ বিষয়ে নিশ্চুপ। যদিও ক্রেতারা বিক্রেতাদের থেকে হাটের খাজনা আদায় করেন। তারপরও জবরদস্তি করে ইজারাদাররা উভয়ের কাছ থেকেই খাজনা তুলছেন। ওজনের বেশি পণ্য নেওয়ার এই ধলতা আদায় পদ্ধতি যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।
মতিয়ার রহমান নামে ঝিনাইদহের নগরবাথান এলাকার এক সবজি চাষি অভিযোগ করে বলেন, বছরের পর বছর তারা ধলতার ফাঁদে প্রতারিত হলেও ধলতা আদায় বন্ধে প্রশাসনের কোনো তৎপরতা নেই। তিনি আরও বলেন, হাটে সবজি বিক্রি করতে আসা চাষিদের প্রতি মণে দুই থেকে চার কেজি সবজি বেশি দিতে হয় আড়তদার ও ব্যাপারীদের। বেশি দেওয়া এই ব্যবস্থাকে স্থানীয়ভাবে ‘ধলতা’ নামে পরিচিত। ঝিনাইদহ সদর উপজেলা বংকিরা গ্রামের রাবু ইসলাম দশমাইল বাজারে বিভিন্ন সময় ধান বিক্রি করেন। এই বাজারের ধান ব্যবসায়ী জিবনা গ্রামের জিয়া, হাফিজুর রহমান, আশিক ইসলাম, বংকিরা গ্রামের শুনিল, আজাদ হোসেন, মজিবর রহমান ও সানেয়ার হোসেন ৪০ কেজি শুকনা ধানে এক কেজি করে ধলতা নিচ্ছেন বলে তিনি (রাবু ইসলাম) অভিযোগ করেন। একইভাবে সদর উপজেলার ডাকবাংলা বাজারের ধান ব্যবসায়ী আব্দুল হান্নান বাদশা, জোয়াদ আলী টোকন ও আনোয়ার হোসেন, সরোজগঞ্জ বাজারের সুমন, শাহিন, আসাদুল, সামছুল ও মজিবর জোরপূর্বক ধলতা আদায় করে থাকেন বলে শরিফুল ইসলাম নামে এক কৃষক অভিযোগ করেন।
ডালু মন্ডল নামে বংকিরা গ্রামের অপর এক কৃষক অভিযোগ করেন, ধলতা আদায় নিয়ে কৃষকদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসক হাট ইজারা দিলেও হাট চলে গেছে ইজারাদার ও ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। ওই কৃষকের ভাষ্যমতে, বাজারে শুকনা ধান নিয়ে গেলেও প্রতি মণে জেলার বদরগঞ্জ বাজারে এক কেজি, ডাকবাংলা বাজারে ৫ শ গ্রাম ও সরোজগঞ্জ বাজারে ৭ শ গ্রাম করে ধান আদায় করা হচ্ছে। জোরপূর্বক এই ধান আদায়ের ফলে বিক্রেতারা ঠকলেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। আবুল কালাম নামে এক সবজি ব্যবসায়ী জানান, কাঁচা সবজি পঁচনশীল হওয়ায় ৮-১০ বছর ধরে ঝিনাইদহ হাটে সব ধরনের সবজিতে মণ প্রতি দুই কেজি করে ধলতা নেওয়ার নিয়ম চালু আছে। এতে ব্যাপারীদের কোনো লাভ নেই। এক হাজার কেজি সবজি কিনলে আড়তদার-ব্যবসায়ীদের ৫০ কেজি সবজি ধলতা দিতে হয়।
গতকাল সোমবার ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হলিধানী হাটে এই ধলতা গ্রহণের বিষয়ে চাষিরা অভিযোগ করেন, শীতের সবজি ফলাতে বেশ বেগ পেতে হলেও ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, মুলা, গাজর, কাঁচা মরিচ, পটল, ঝিঙে, বেগুন, ঢ্যাঁড়স, কচুমুখি, কাঁকরোল, শসা, করলা, পেঁপেতে ধলতা নেওয়া হয়। তবে হাট ইজারাদাররা ধলতা গ্রহণের বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে চাননি।
ঝিনাইদহ নতুন হোটখোলার ব্যাপারী সাগর ইসলাম বলেন, আড়ত থেকে পাইকারি মোকামে সবজি পরিবহনের সময় কিছু সবজি পঁচে যায়। কিছু নষ্ট হয়। এ কারণে হাটে সবজি বিক্রি করতে আসা চাষিদের কাছ থেকে প্রতি মণে দুই কেজি ধলতা নেওয়া হয়। চাষিরা এটা নিয়ে কখনো অভিযোগ করেন না। ধলতা তোলার নিয়ম বন্ধ হলে ব্যবসায়ীরা মণ প্রতি দুই কেজি সবজি নষ্ট হিসেব করেই চাষিদের কাছ থেকে সেই মূল্য কম দিয়ে সবজি কিনবেন।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক আজগর আলী বলেন, ধলতা গ্রহণ করা চরম অন্যায়। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। কৃষি বিপণন নামে একটি বিভাগ বিষয়টি দেখভাল করেন। ঝিনাইদহ জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা গোলাম মারুফ খান বলেন, ধলতা গ্রহণ বেআইনি। এ বিষয়ে সরকারি আইন আছে। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমি জেলা প্রশাসককে অবহিত করেছি। তিনি বলেছেন ধলতা গ্রহণ বন্ধে কঠোর হতে হবে। কোনোভাবেই যাতে কৃষকরা না ঠকে, সে বিষয়ে জেলা প্রশাসক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন অচিরেই আমরা বাজার মনিটরিংয়ে অভিযান চালাবো।’