ইপেপার । আজ বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চাহিদা মতো টাকা না দিলে ফেসবুকে মিথ্যা খবর প্রকাশ

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৭:০০:১৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৮ মার্চ ২০২৩
  • / ৩৩ বার পড়া হয়েছে

ঝিনাইদহ অফিস:
এক সময় ঝিনাইদহে চরমপন্থীদের আঁখড়া ছিল। তাদের চাঁদা দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। চাঁদা না দিলে গুলি বা গলাকেটে করা হতো হত্যা। পিলে কাঁপানো সেই পরিবেশ এখন আর নেই। কিন্তু এখন চরমপন্থার চেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে ডিজিটাল চাঁদাবাজি। সম্প্রতি সাংবাদিক, পুলিশ, গোয়েন্দা ও মানবাধিকার কর্মী পরিচয়ে এক শ্রেণির প্রতারক জেলায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। রাস্তায় হরহামেশে দেখা মিলছে প্রেস, মানবাধিকার ও পুলিশ লেখা স্টিকারযুক্ত মোটরসাইকেলের। এরা দলবেধে সরকারি কর্মকর্তা এবং গ্রামের মানুষকে আক্রমণ করছে। চাহিদা মতো টাকা না দিলে ফেক ফেসবুক আইডিতে ভিডিও বা ছবি দিয়ে মিথ্যা খবর ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতিদিন ঝিনাইদহে বহু এমন প্রতারণার ঘটনা ঘটলেও কোনো প্রতিকার মিলছে না।

সম্প্রতি মানবাধিকার কর্মীর পরিচয়ে এমন এক চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে কোটচাঁদপুরের ফুলবাড়িয়া গ্রামে। জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবরে ফুলবাড়ি গ্রামের হারান বিশ্বাসের মেয়ে প্রীতি বিশ্বাস বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় হারান বিশ্বাস কোটচাঁদপুর মডেল থানায় জিডি করেন। এ সুযোগে মানবাধিকার নেতা পরিচয় দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঘোষ নামের এক ব্যক্তি হারান বিশ্বাসের কাছ থেকে তার মেয়েকে উদ্ধার করে দেওয়ার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। কয়েক মাস পার হয়ে গেলেও মেয়েকে ফিরে না পেয়ে রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হন হারান বিশ্বাস। তখন রবীন্দ্রনাথ হারান বিশ্বাসের কাছে আবারও মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন। হারান বিশ্বাস টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। পরে এ ঘটনায় থানা-পুলিশের দ্বারস্থ হন হারান।

এদিকে ঝিনাইদহে অবৈধভাবে মাটির ব্যবসা চলে রমরমা। ইটভাটার মালিকেরা এসব মাটি কিনেন। এখানে কথিত সাংবাদিক পরিচয়ে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। এসব কথিত সাংবাদিকেরা পুকুর খননের খবর পেলেই দল বেধে চলে যান ঘটনাস্থলে। এককালীন কিছু টাকা নিয়ে করেন মাসিক চুক্তি। হাটে-বাজারে গজিয়ে ওঠা কোয়াক ডাক্তাররাও এদের হাত থেকে বাদ যাচ্ছে না। সবাই এই চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, সমাজ বিরোধী ও মাদকসেবীদের একটি বড় অংশ এখন সাংবাদিক সেজে এই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এদের চলাচল বেশি। বেশ কয়েকবার এরা ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক দিয়ে তারা ছাড়া পেয়ে গেছেন। স্কুল-কলেজে নিয়োগ নিয়ে এই চক্রটি প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে। সভাপতির বিরুদ্ধে খবর প্রকাশের ভয় দেখিয়ে সম্প্রতি নগরবাথান এলাকার একটি স্কুলে দলবেঁধে হানা দিয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন। এদিকে ঝিনাইদহ শহরের আলফালাহ ও শামীমা ক্লিনিকে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই এই প্রতারক চক্রকে থামানো যাচ্ছে না।

পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের কর্তারা এ বিষয়ে নীরব রয়েছে। এই চক্রের বিরুদ্ধে আবার পাল্টাপাল্টি সংবাদও প্রচার করা হচ্ছে। টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব হলে নিজেরাই অন্য গ্রুপের বিরুদ্ধে খবর প্রচার করে তারা। অনেক ভুক্তভোগী আবার প্রতিকার না পেয়ে নিজেদের ফেসবুকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কে কখন কত টাকা নিয়েছেন তা প্রচার করেন। এমন কর্মকাণ্ডে পেশাদার সাংবাদিকেরা হতাশ ও অসহায় হয়ে পড়েছেন।

এ বিষয়ে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সালমা সেলিম বলেন, ‘এমন প্রতারণার খবর আমাদের কাছে প্রতিনিয়ত আসছে। আমরা একটি অভিযোগ ফাইল খুলেছি। প্রশাসনের পাশাপাশি এ বিষয়ে সিনিয়র সাংবাদিক ও সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোকে ব্যবস্থা নিতে হবে বলে তিনি মনে করেন। মানবাধিকার কর্মী ও জেলার সিনিয়র সাংবাদিক অধ্যক্ষ আমিনুর রহমান টুকু বলেন, ‘আমি শুনেছি বেশকিছু দিন ধরে একটা প্রতারক চক্র মানবাধিকার নেতা পরিচয়ে জেলার বিভিন্ন এলাকাতে প্রতারণা করে আসছে। এরা স্থানীয় সোর্সদের মাধ্যমে এ কাজ করেন। এদের বিরুদ্ধে সামজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে গণমাধ্যমে এদের প্রতারণার বিষয় তুলে ধরতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে এদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। নইলে পেশাদার সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়বে।

কোটচাঁদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মঈন উদ্দিন বলেন, মানবাধিকার কর্মী পরিচয় দিয়ে এরা একবার তদন্ত করার নামে থানায় এসেছিল। আমাদের এক উপ-পরিদর্শককে হুমকি-ধামকিও দিয়েছিল। তখনই তাদের কার্যক্রম নিয়ে সংশয়বোধ করেছিলাম। পরবর্তীতে তাঁদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে এক ভুক্তভোগী আমাদের অবগত করেন।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

চাহিদা মতো টাকা না দিলে ফেসবুকে মিথ্যা খবর প্রকাশ

আপলোড টাইম : ০৭:০০:১৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৮ মার্চ ২০২৩

ঝিনাইদহ অফিস:
এক সময় ঝিনাইদহে চরমপন্থীদের আঁখড়া ছিল। তাদের চাঁদা দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। চাঁদা না দিলে গুলি বা গলাকেটে করা হতো হত্যা। পিলে কাঁপানো সেই পরিবেশ এখন আর নেই। কিন্তু এখন চরমপন্থার চেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে ডিজিটাল চাঁদাবাজি। সম্প্রতি সাংবাদিক, পুলিশ, গোয়েন্দা ও মানবাধিকার কর্মী পরিচয়ে এক শ্রেণির প্রতারক জেলায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। রাস্তায় হরহামেশে দেখা মিলছে প্রেস, মানবাধিকার ও পুলিশ লেখা স্টিকারযুক্ত মোটরসাইকেলের। এরা দলবেধে সরকারি কর্মকর্তা এবং গ্রামের মানুষকে আক্রমণ করছে। চাহিদা মতো টাকা না দিলে ফেক ফেসবুক আইডিতে ভিডিও বা ছবি দিয়ে মিথ্যা খবর ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতিদিন ঝিনাইদহে বহু এমন প্রতারণার ঘটনা ঘটলেও কোনো প্রতিকার মিলছে না।

সম্প্রতি মানবাধিকার কর্মীর পরিচয়ে এমন এক চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে কোটচাঁদপুরের ফুলবাড়িয়া গ্রামে। জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবরে ফুলবাড়ি গ্রামের হারান বিশ্বাসের মেয়ে প্রীতি বিশ্বাস বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় হারান বিশ্বাস কোটচাঁদপুর মডেল থানায় জিডি করেন। এ সুযোগে মানবাধিকার নেতা পরিচয় দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঘোষ নামের এক ব্যক্তি হারান বিশ্বাসের কাছ থেকে তার মেয়েকে উদ্ধার করে দেওয়ার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। কয়েক মাস পার হয়ে গেলেও মেয়েকে ফিরে না পেয়ে রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হন হারান বিশ্বাস। তখন রবীন্দ্রনাথ হারান বিশ্বাসের কাছে আবারও মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন। হারান বিশ্বাস টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। পরে এ ঘটনায় থানা-পুলিশের দ্বারস্থ হন হারান।

এদিকে ঝিনাইদহে অবৈধভাবে মাটির ব্যবসা চলে রমরমা। ইটভাটার মালিকেরা এসব মাটি কিনেন। এখানে কথিত সাংবাদিক পরিচয়ে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। এসব কথিত সাংবাদিকেরা পুকুর খননের খবর পেলেই দল বেধে চলে যান ঘটনাস্থলে। এককালীন কিছু টাকা নিয়ে করেন মাসিক চুক্তি। হাটে-বাজারে গজিয়ে ওঠা কোয়াক ডাক্তাররাও এদের হাত থেকে বাদ যাচ্ছে না। সবাই এই চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, সমাজ বিরোধী ও মাদকসেবীদের একটি বড় অংশ এখন সাংবাদিক সেজে এই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এদের চলাচল বেশি। বেশ কয়েকবার এরা ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক দিয়ে তারা ছাড়া পেয়ে গেছেন। স্কুল-কলেজে নিয়োগ নিয়ে এই চক্রটি প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে। সভাপতির বিরুদ্ধে খবর প্রকাশের ভয় দেখিয়ে সম্প্রতি নগরবাথান এলাকার একটি স্কুলে দলবেঁধে হানা দিয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন। এদিকে ঝিনাইদহ শহরের আলফালাহ ও শামীমা ক্লিনিকে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই এই প্রতারক চক্রকে থামানো যাচ্ছে না।

পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের কর্তারা এ বিষয়ে নীরব রয়েছে। এই চক্রের বিরুদ্ধে আবার পাল্টাপাল্টি সংবাদও প্রচার করা হচ্ছে। টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব হলে নিজেরাই অন্য গ্রুপের বিরুদ্ধে খবর প্রচার করে তারা। অনেক ভুক্তভোগী আবার প্রতিকার না পেয়ে নিজেদের ফেসবুকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কে কখন কত টাকা নিয়েছেন তা প্রচার করেন। এমন কর্মকাণ্ডে পেশাদার সাংবাদিকেরা হতাশ ও অসহায় হয়ে পড়েছেন।

এ বিষয়ে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সালমা সেলিম বলেন, ‘এমন প্রতারণার খবর আমাদের কাছে প্রতিনিয়ত আসছে। আমরা একটি অভিযোগ ফাইল খুলেছি। প্রশাসনের পাশাপাশি এ বিষয়ে সিনিয়র সাংবাদিক ও সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোকে ব্যবস্থা নিতে হবে বলে তিনি মনে করেন। মানবাধিকার কর্মী ও জেলার সিনিয়র সাংবাদিক অধ্যক্ষ আমিনুর রহমান টুকু বলেন, ‘আমি শুনেছি বেশকিছু দিন ধরে একটা প্রতারক চক্র মানবাধিকার নেতা পরিচয়ে জেলার বিভিন্ন এলাকাতে প্রতারণা করে আসছে। এরা স্থানীয় সোর্সদের মাধ্যমে এ কাজ করেন। এদের বিরুদ্ধে সামজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে গণমাধ্যমে এদের প্রতারণার বিষয় তুলে ধরতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে এদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। নইলে পেশাদার সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়বে।

কোটচাঁদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মঈন উদ্দিন বলেন, মানবাধিকার কর্মী পরিচয় দিয়ে এরা একবার তদন্ত করার নামে থানায় এসেছিল। আমাদের এক উপ-পরিদর্শককে হুমকি-ধামকিও দিয়েছিল। তখনই তাদের কার্যক্রম নিয়ে সংশয়বোধ করেছিলাম। পরবর্তীতে তাঁদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে এক ভুক্তভোগী আমাদের অবগত করেন।