ইপেপার । আজ শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কোটচাঁদপুর বলুহর বাওড় পাড়ে মৎস্যজীবীদের মানববন্ধন

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:০২:২৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৩
  • / ৩৪ বার পড়া হয়েছে

ঝিনাইদহ অফিস:
ঝিনাইদহের ৬টি বাওড় রক্ষায় হালদার সম্প্রদায়ের মৎস্যজীবীরা কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। প্রতিদিন তারা বাওড় পাড়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ করছেন। গতকাল সোমবার কোটচাঁদপুরের বলুহর প্রজেক্ট এলাকায় এই মানববন্ধন করা হয়। মানববন্ধনে অংশ নেওয়া ৭৭ বছর বয়সী শ্রী নরেন হালদার, যার ৬৮ বছরই কেটেছে জাল-দড়া টেনে। তিনি মানববন্ধনে হালদার সম্প্রদায়ের কয়েক’শ মানুষের তাদের পেটে লাথি না মারার আকুতি জানান। সুধীর হালদার নামের অপর এক মৎস্যজীবী বলেন, ‘হালদার সম্প্রদায় জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করে বলে এসেছে ‘হয় বিষ দ্যান না হয় বাওড়ের মালিকানা দ্যান’। বাপ দাদার কর্মক্ষেত্র বলুহর বাওড় ইজারা দেয়া হলে তারা স্বেচ্ছায় আত্মহুতির কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবেন। তাদের ভাষ্য, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী আমল থেকে তারা বাওড়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্র্বাহ করে আসছে। এই বৃদ্ধ বয়সেও বৃহৎ একটি পরিবার তাদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। জীবনের এই সময়ে এসে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন বলুহর বাওড়ের মালিকানা হারাতে বসেছে তারা।
তথ্য নিয়ে জানা গেছে, জেলা প্রশাসন টেন্ডারের মাধ্যমে বাওড়গুলো ইজারাদানের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। ফলে কর্ম হারানোর প্রহর গুনছেন বাওড়পাড়ের হাজারো মৎস্যজীবী পরিবার। শুধু নরেণ হালদার নয়, তার মতো বাওড় পাড়ের রহমতপুর গ্রামের সাধন হালদার, বলুহর গ্রামের নিত্য হালদার, শ্রীমতি কমলা রানী হালদার, বজরাপুর গ্রামের সন্তোষ কুমার হালদারসহ জেলার ৬টি বাওড়ের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ৫ হাজার মানুষের মাঝে নেমে এসেছে চরম হতাশা।
মৎস্যজীবীরা জানান, সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় ঝিনাইদহের ৬টি বাওড় ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাওড়গুলো হচ্ছে- ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার কাঠগড়া, ফতেপুর, কোটচাঁদপুরের বলুহর, জয়দিয়া, কালীগঞ্জের মর্জাদ এবং বেড়গোবিন্দপুর। এসব বাওড়ের মোট জলাকার হচ্ছে ১ হাজার ১৩৭ হেক্টর। ৬টি বাওড় এলাকায় ৭৬৭টি পরিবারের প্রায় ৫ হাজার সদস্য এসব বাওড় থেকে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন থেকে এসব বাওড়ের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। অথচ মৎস্যজীবীরা সরকারের ‘জাল যার জলা তার’ এই নীতির ওপর ভর করে সেই ১৯৭৯ সাল থেকে বাওড়ে মাছ ধরে আসছেন।
সুফলভোগী মৎস্যজীবী সুধীর হালদার জানান, বর্তমানে বাওড়গুলো বিল ও বাওড় মৎস্য উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এতে তাদের ৪০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। বাওড়ের মাছ ধরার কাজ তারাই করেন। আর ইজারা দিলে সরকারের এককালীন বেশি টাকা আয় হলেও একদিকে যেমন বাওড়গুলো ক্ষতির মুখে পড়বে, তেমনি মালিকানা হারিয়ে পথে বসবে বাওড়ের ওপর নির্ভরশীল হাজারো পরিবার। ফলে ধ্বংস হবে জীববৈচিত্র্য। বাওড়গুলো চলে যাবে প্রভাবশালী মধ্যসত্বভোগীদের দখলে। মালিকানা হারিয়ে মৎস্যজীবীরা দিশেহারা হয়ে পড়বে। মাছ চাষে সার-ওষুধের ব্যবহারে বাওড় থেকে রাণী মাছ চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে। বাওড়গুলোকে ঘিরে সরকারের যে লোকবল রয়েছে, তারাও হবে বেকার। কোটি কোটি টাকার ভবন ধ্বংস হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে একটি মাফিয়াচক্র বাওড়গুলো ইজারা নিতে কোমর বেধে মাঠে নেমেছে। ভুইফোড় সমিতির নামে কোটি কোটি টাকার ডাক তুলে সিডি জমা দেয়া হয়েছে।
সুধীর হালদার অভিযোগ করেন, কোটচাঁদপুরের শীতল হালদার নামে এক ব্যক্তি দুই কোটি ৩৭ লাখ টাকার বিপরীতে সিডি জমা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে এই টাকার জোগানদাতা কারা? শীতল হালদারের পেছনে কারা টাকার যোগান দিচ্ছে? অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা চুক্তি শেষ হচ্ছে। এই চুক্তি শেষ হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির পরিবর্তে বাওড়গুলো ইজারা দেওয়ার পক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত ডিসেম্বরে বাওড়গুলো ইজারা দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ইজারায় মধ্যসত্বভোগী কোটিপতিরা অংশ নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে বিল বাওড় প্রকল্প পরিচালক মো. আলফাজ উদ্দিন শেখ জানান, মৎস্য বিভাগ চেষ্টা করছে বর্তমান প্রকল্পের মেয়ার বৃদ্ধি করে চলমান নিয়মে মাছের চাষ করা। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয় এগুলো ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা চুড়ান্তভাবে বাস্তবায়িত হলে হাজারো হালদার পরিবার পথে বসবেন।
ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম জানান, বাওড়পাড়ের মানুষগুলোর কথা চিন্তা করে ভূমি মন্ত্রণালয় মৎস্য অধিদপ্তরের এক প্রকল্পের মাধ্যমে মাছ চাষের জন্য দিয়েছিল। কিন্তু তারা সফলতা আনতে পারেনি। যে কারণে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাওড়পাড়ের হলদারদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা বলবেন বলে তিনি জানান।
বিষয়টি নিয়ে কোটচাঁদপুর মহেশপুর এলাকার সংসদ সদস্য অ্যাড শফিকুল আজম খান চঞ্চল জানান, আগামী ৩১ জানুয়ারি বিষয়টি নিয়ে আন্তঃ মন্ত্রণালয়ে সভা হবে। সেখানে বিষয়টি উঠবে। তিনি বলেন, বাওড়গুলো ইজারা দিলে সরকার হয়তো এককালীন টাকা পাবে, কিন্তু হালদার পরিবারগুলো কোথায় যাবে ? এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে মানবতা ভুলুন্ঠিত হবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে জানান, জনপ্রতিনিধি হিসেবে বাওড় রক্ষায় যা যা করার তাই তিনি করবেন।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

কোটচাঁদপুর বলুহর বাওড় পাড়ে মৎস্যজীবীদের মানববন্ধন

আপলোড টাইম : ০৯:০২:২৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৩

ঝিনাইদহ অফিস:
ঝিনাইদহের ৬টি বাওড় রক্ষায় হালদার সম্প্রদায়ের মৎস্যজীবীরা কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। প্রতিদিন তারা বাওড় পাড়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ করছেন। গতকাল সোমবার কোটচাঁদপুরের বলুহর প্রজেক্ট এলাকায় এই মানববন্ধন করা হয়। মানববন্ধনে অংশ নেওয়া ৭৭ বছর বয়সী শ্রী নরেন হালদার, যার ৬৮ বছরই কেটেছে জাল-দড়া টেনে। তিনি মানববন্ধনে হালদার সম্প্রদায়ের কয়েক’শ মানুষের তাদের পেটে লাথি না মারার আকুতি জানান। সুধীর হালদার নামের অপর এক মৎস্যজীবী বলেন, ‘হালদার সম্প্রদায় জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করে বলে এসেছে ‘হয় বিষ দ্যান না হয় বাওড়ের মালিকানা দ্যান’। বাপ দাদার কর্মক্ষেত্র বলুহর বাওড় ইজারা দেয়া হলে তারা স্বেচ্ছায় আত্মহুতির কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবেন। তাদের ভাষ্য, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী আমল থেকে তারা বাওড়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্র্বাহ করে আসছে। এই বৃদ্ধ বয়সেও বৃহৎ একটি পরিবার তাদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। জীবনের এই সময়ে এসে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন বলুহর বাওড়ের মালিকানা হারাতে বসেছে তারা।
তথ্য নিয়ে জানা গেছে, জেলা প্রশাসন টেন্ডারের মাধ্যমে বাওড়গুলো ইজারাদানের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। ফলে কর্ম হারানোর প্রহর গুনছেন বাওড়পাড়ের হাজারো মৎস্যজীবী পরিবার। শুধু নরেণ হালদার নয়, তার মতো বাওড় পাড়ের রহমতপুর গ্রামের সাধন হালদার, বলুহর গ্রামের নিত্য হালদার, শ্রীমতি কমলা রানী হালদার, বজরাপুর গ্রামের সন্তোষ কুমার হালদারসহ জেলার ৬টি বাওড়ের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ৫ হাজার মানুষের মাঝে নেমে এসেছে চরম হতাশা।
মৎস্যজীবীরা জানান, সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় ঝিনাইদহের ৬টি বাওড় ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাওড়গুলো হচ্ছে- ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার কাঠগড়া, ফতেপুর, কোটচাঁদপুরের বলুহর, জয়দিয়া, কালীগঞ্জের মর্জাদ এবং বেড়গোবিন্দপুর। এসব বাওড়ের মোট জলাকার হচ্ছে ১ হাজার ১৩৭ হেক্টর। ৬টি বাওড় এলাকায় ৭৬৭টি পরিবারের প্রায় ৫ হাজার সদস্য এসব বাওড় থেকে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন থেকে এসব বাওড়ের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। অথচ মৎস্যজীবীরা সরকারের ‘জাল যার জলা তার’ এই নীতির ওপর ভর করে সেই ১৯৭৯ সাল থেকে বাওড়ে মাছ ধরে আসছেন।
সুফলভোগী মৎস্যজীবী সুধীর হালদার জানান, বর্তমানে বাওড়গুলো বিল ও বাওড় মৎস্য উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এতে তাদের ৪০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। বাওড়ের মাছ ধরার কাজ তারাই করেন। আর ইজারা দিলে সরকারের এককালীন বেশি টাকা আয় হলেও একদিকে যেমন বাওড়গুলো ক্ষতির মুখে পড়বে, তেমনি মালিকানা হারিয়ে পথে বসবে বাওড়ের ওপর নির্ভরশীল হাজারো পরিবার। ফলে ধ্বংস হবে জীববৈচিত্র্য। বাওড়গুলো চলে যাবে প্রভাবশালী মধ্যসত্বভোগীদের দখলে। মালিকানা হারিয়ে মৎস্যজীবীরা দিশেহারা হয়ে পড়বে। মাছ চাষে সার-ওষুধের ব্যবহারে বাওড় থেকে রাণী মাছ চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে। বাওড়গুলোকে ঘিরে সরকারের যে লোকবল রয়েছে, তারাও হবে বেকার। কোটি কোটি টাকার ভবন ধ্বংস হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে একটি মাফিয়াচক্র বাওড়গুলো ইজারা নিতে কোমর বেধে মাঠে নেমেছে। ভুইফোড় সমিতির নামে কোটি কোটি টাকার ডাক তুলে সিডি জমা দেয়া হয়েছে।
সুধীর হালদার অভিযোগ করেন, কোটচাঁদপুরের শীতল হালদার নামে এক ব্যক্তি দুই কোটি ৩৭ লাখ টাকার বিপরীতে সিডি জমা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে এই টাকার জোগানদাতা কারা? শীতল হালদারের পেছনে কারা টাকার যোগান দিচ্ছে? অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা চুক্তি শেষ হচ্ছে। এই চুক্তি শেষ হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির পরিবর্তে বাওড়গুলো ইজারা দেওয়ার পক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত ডিসেম্বরে বাওড়গুলো ইজারা দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ইজারায় মধ্যসত্বভোগী কোটিপতিরা অংশ নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে বিল বাওড় প্রকল্প পরিচালক মো. আলফাজ উদ্দিন শেখ জানান, মৎস্য বিভাগ চেষ্টা করছে বর্তমান প্রকল্পের মেয়ার বৃদ্ধি করে চলমান নিয়মে মাছের চাষ করা। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয় এগুলো ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা চুড়ান্তভাবে বাস্তবায়িত হলে হাজারো হালদার পরিবার পথে বসবেন।
ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম জানান, বাওড়পাড়ের মানুষগুলোর কথা চিন্তা করে ভূমি মন্ত্রণালয় মৎস্য অধিদপ্তরের এক প্রকল্পের মাধ্যমে মাছ চাষের জন্য দিয়েছিল। কিন্তু তারা সফলতা আনতে পারেনি। যে কারণে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাওড়পাড়ের হলদারদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা বলবেন বলে তিনি জানান।
বিষয়টি নিয়ে কোটচাঁদপুর মহেশপুর এলাকার সংসদ সদস্য অ্যাড শফিকুল আজম খান চঞ্চল জানান, আগামী ৩১ জানুয়ারি বিষয়টি নিয়ে আন্তঃ মন্ত্রণালয়ে সভা হবে। সেখানে বিষয়টি উঠবে। তিনি বলেন, বাওড়গুলো ইজারা দিলে সরকার হয়তো এককালীন টাকা পাবে, কিন্তু হালদার পরিবারগুলো কোথায় যাবে ? এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে মানবতা ভুলুন্ঠিত হবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে জানান, জনপ্রতিনিধি হিসেবে বাওড় রক্ষায় যা যা করার তাই তিনি করবেন।