ইপেপার । আজ শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ছেড়াফাটা ময়লা চাদরে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রোগী!

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০২:৪৪:০৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ জুন ২০২২
  • / ২২ বার পড়া হয়েছে

ঝিনাইদহ অফিস: দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে ঝিনাইদহ আড়াই’শ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের কাপড় ধোলাইয়ের কাজ দেওয়া হয়েছে একটি কনষ্ট্রাকশন ফার্মকে। এনিয়ে রোগীদের পাশাপাশি হাসপাতালের দায়িত্বরত নার্সরা পড়েছেন চরম বিপাকে। হাসপাতালের ময়লা বেডসীট ও বালিশের কভার পরিস্কার করে যথাসময়ে সরবরাহ করতে পারছে না ঠিকাদার। অনেক সময় ময়লা বিছানায় রোগীরা রাত যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। শিশু ওয়ার্ডের বেশির ভাগ বিছানায় চাদরের দেখা মেলেনি। সময়মতো পরিস্কার কাপড় চোপড় সরবরাহ করতে না পারায় বিক্ষুদ্ধ হয়ে রোগী ও তার স্বজনরা নার্সদের প্রতি চড়াও হচ্ছেন। নিরুপায় হয়ে ১০টি ওয়ার্ডের নার্স ইনচার্জরা বিষয়টি তত্ত্ব¡াবধায়ককে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। কিন্তু তারপরও কোনো প্রতিকার নেই। নার্সরা জানিয়েছেন, ঠিকাদারের লোকজন রাতের আধারে ময়লা কাপড় নিয়ে যায়, আবার রাতের আধারেই আধাপরিস্কার কাপড় ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে রেখে যাচ্ছেন।

তথ্য নিয়ে জানা গেছে, যাদের অভিজ্ঞতা বিল্ডিং তৈরী করাসহ নানা প্রকৌশলী যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করা, সেই তাদের হাতেই সোপর্দ করা হয়েছে হাসপাতালের রোগীদের ময়লা বেডসীট, অপারেশনের গাউন ও বালিশের কভারসহ ২০ আইটেমের কাপড় ধোলাইয়ের কাজ। ফলে রোগীদের জীবন ঝুকির মধ্যে পড়েছে।

তত্ত্ব¡াবধায়কের দপ্তর সুত্রে জানা গেছে, টেন্ডারের মাধ্যমে গত ১ এপ্রিল থেকে হাসপাতালের ময়লা কাপড় ধোলাইয়ের কাজ শুরু করেন ঝিনাইদহ শহরের মাওলানা ভাসানী সড়কের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এম আর ট্রেডিংয়ের মালিক মো. মহিবুল্লাহ। তাকে দরপত্রের ৯ নম্বর শর্ত ভঙ্গ করে কাজ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। ৯ নম্বর শর্তে উল্লেখ আছে, ময়লা কাপড় ধোলাইয়ের ক্ষেত্রে দরপত্রদাতার নিজস্ব লন্ড্রির ব্যবসা থাকতে হবে। ঠিকাদার মহিবুল্লার ঘরে গিয়ে দেখা গেছে সেখানে কোন লন্ড্রির চিহ্ন নেই। ঝিনাইদহ শহরের নয়ন আবাসিক হোটেলের নিচে তার ঠিকাদারী ফার্ম। এদিকে ঠিকাদারী কাজ পাওয়ার পর থেকেই পরিস্কার পরিচ্ছন্নাতা নিয়ে হাসপাতালে শোরগোল ওঠে। হাসপাতালের সিলযুক্ত বেডসীট পাল্টিয়ে ছেড়া ফাটা বেডসীট সরবরাহ করা, ময়লাযুক্ত বেডসীটই আবার পরিস্কার দেখিয়ে সরবরাহ করে নার্সদের বিপদে ফেলে দিচ্ছেন ঠিকাদার। আবার তিনদিন পর পর ময়লা কাপড় ধোলাই করার নিয়ম থাকলেও তা করা হচ্ছে না।

অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ঠিকাদার মহিবুল্লাহ নিজে বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের ঠিকাদারী কাজ করে বেড়ান। তিনি হাসপাতালের ময়লা কাপড় ধোলাইয়ের কাজ করেন না, লোক দিয়ে করান। তার লাইসেন্সে জনৈক ব্যক্তি কাপড় ধোলাইয়ের কাজ করেন। তিনিও ধোলাইয়ের কাজ করেন না। অর্থাৎ তিন হাত বদল হয়ে হ-য-ব-র-ল ভাবে চলছে ধোলাইয়ের কাজ।

মেল (পুরুষ) মেডিসিন ওয়ার্ডের নার্স ইনচার্জ ফাহমিদা খাতুন জানান, তারা ময়লা কাপড় নিয়ে চরম বিপদে আছেন। ঠিকাদার ঠিকমতো কাপড় ধুয়ে দিতে পারছেন না। এ নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা অতিষ্ঠ। তাছাড়া রোগীদের জীবনও ঝুকির মধ্যে পড়েছে। একই কথা জানালেন শিশু ওয়ার্ডের নার্স ইনচার্জ রাজিয়া খাতুন। তিনি বলেন, হাসপাতালের সিলযুক্ত চাদর পাল্টে ছেড়া ও ফাটা চাদর সরবরাহ করা হয়েছে। সেই চাদর রেখে দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেওয়া চাদর ঠিকমতো পাচ্ছি না। ঠিকাদার কাপড় নেওয়া ও সরবরাহ করার কোন নিয়মই মানছেন না। নার্স রাজিয়া খাতুন আরো বলেন, ময়লা কাপড়ের বিষয়ে ১০টি ওয়ার্ডের নার্স ইনচার্জরা যৌথ সাক্ষর করে বিষয়টি তত্ত্বাবধায়ককে জানিয়েছেন। এদিকে শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে বেশির ভাগ বিছানায় চাদর নেই। ধোলাইয়ের জন্য নিয়ে তা আর ফেরৎ দেয়নি।

শিশু ওয়ার্ডে ইন্টার্নি করা ম্যাটসের ছাত্র হাবিবুর রহমান বলেন, ‘প্রতি রোববার ও বুধবার ময়লা কাপড় নেওয়ার কথা। কিন্তু তারা নেয় না। আবার ৪০টি চাদর ময়লা হলে সবগুলো নিয়ে যায়না। পরিস্কারের জন্য ২০টি নিয়ে যায় আর ময়লা চাদর ২০টি রেখে যায়।’

ফিমেল (মহিলা) ওয়ার্ডে কর্মরত নার্স ও সেচ্ছোসেবী দেলোয়ারা খাতুন ও নুরুন্নাহার অভিযোগ করেন, ‘চাদর ঠিকমতো পরিস্কার হচ্ছে না। রক্তমাখা বেডসীট পরিস্কার বলে চালিয়ে দিচ্ছে।’

এদিকে হাসপাতালের হিসাবরক্ষক ফেরদৌস জানান, ‘গত দুই মাসে ঠিকাদারকে প্রায় ৯৫ হাজার টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ঠিকমতো ধোলাইয়ের কাজ না করার কারণে তারাও বেশ বিপদে আছেন। বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে নার্সরা তাদের কাছে অভিযোগ করছেন।’

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সৈয়দ রেজাউল ইসলাম জানান, ‘বিষয়টি নিয়ে তারা বেশ কঠোর। ঠিকাদারকে ইতিমধ্যে তিনবার শোকজ করা হয়েছে। হাসপাতালের ধোলাইয়ের কাজ নিম্নমানের হচ্ছে বলে নার্সরা তাকে জানিয়েছেন। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রয়োজনে ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিল করা হতে পারে।’

এবিষয়ে ঠিকাদার মহিবুল্লাহ জানান, ‘আমি এ কাজ সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমার লাইসেন্স ব্যবহার করে এই কাজ করা হচ্ছে। হাসপাতালের ধোলাই কাজের সঙ্গে আমি জড়িত নয়।’

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

ছেড়াফাটা ময়লা চাদরে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রোগী!

আপলোড টাইম : ০২:৪৪:০৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ জুন ২০২২

ঝিনাইদহ অফিস: দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে ঝিনাইদহ আড়াই’শ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের কাপড় ধোলাইয়ের কাজ দেওয়া হয়েছে একটি কনষ্ট্রাকশন ফার্মকে। এনিয়ে রোগীদের পাশাপাশি হাসপাতালের দায়িত্বরত নার্সরা পড়েছেন চরম বিপাকে। হাসপাতালের ময়লা বেডসীট ও বালিশের কভার পরিস্কার করে যথাসময়ে সরবরাহ করতে পারছে না ঠিকাদার। অনেক সময় ময়লা বিছানায় রোগীরা রাত যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। শিশু ওয়ার্ডের বেশির ভাগ বিছানায় চাদরের দেখা মেলেনি। সময়মতো পরিস্কার কাপড় চোপড় সরবরাহ করতে না পারায় বিক্ষুদ্ধ হয়ে রোগী ও তার স্বজনরা নার্সদের প্রতি চড়াও হচ্ছেন। নিরুপায় হয়ে ১০টি ওয়ার্ডের নার্স ইনচার্জরা বিষয়টি তত্ত্ব¡াবধায়ককে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। কিন্তু তারপরও কোনো প্রতিকার নেই। নার্সরা জানিয়েছেন, ঠিকাদারের লোকজন রাতের আধারে ময়লা কাপড় নিয়ে যায়, আবার রাতের আধারেই আধাপরিস্কার কাপড় ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে রেখে যাচ্ছেন।

তথ্য নিয়ে জানা গেছে, যাদের অভিজ্ঞতা বিল্ডিং তৈরী করাসহ নানা প্রকৌশলী যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করা, সেই তাদের হাতেই সোপর্দ করা হয়েছে হাসপাতালের রোগীদের ময়লা বেডসীট, অপারেশনের গাউন ও বালিশের কভারসহ ২০ আইটেমের কাপড় ধোলাইয়ের কাজ। ফলে রোগীদের জীবন ঝুকির মধ্যে পড়েছে।

তত্ত্ব¡াবধায়কের দপ্তর সুত্রে জানা গেছে, টেন্ডারের মাধ্যমে গত ১ এপ্রিল থেকে হাসপাতালের ময়লা কাপড় ধোলাইয়ের কাজ শুরু করেন ঝিনাইদহ শহরের মাওলানা ভাসানী সড়কের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এম আর ট্রেডিংয়ের মালিক মো. মহিবুল্লাহ। তাকে দরপত্রের ৯ নম্বর শর্ত ভঙ্গ করে কাজ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। ৯ নম্বর শর্তে উল্লেখ আছে, ময়লা কাপড় ধোলাইয়ের ক্ষেত্রে দরপত্রদাতার নিজস্ব লন্ড্রির ব্যবসা থাকতে হবে। ঠিকাদার মহিবুল্লার ঘরে গিয়ে দেখা গেছে সেখানে কোন লন্ড্রির চিহ্ন নেই। ঝিনাইদহ শহরের নয়ন আবাসিক হোটেলের নিচে তার ঠিকাদারী ফার্ম। এদিকে ঠিকাদারী কাজ পাওয়ার পর থেকেই পরিস্কার পরিচ্ছন্নাতা নিয়ে হাসপাতালে শোরগোল ওঠে। হাসপাতালের সিলযুক্ত বেডসীট পাল্টিয়ে ছেড়া ফাটা বেডসীট সরবরাহ করা, ময়লাযুক্ত বেডসীটই আবার পরিস্কার দেখিয়ে সরবরাহ করে নার্সদের বিপদে ফেলে দিচ্ছেন ঠিকাদার। আবার তিনদিন পর পর ময়লা কাপড় ধোলাই করার নিয়ম থাকলেও তা করা হচ্ছে না।

অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ঠিকাদার মহিবুল্লাহ নিজে বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের ঠিকাদারী কাজ করে বেড়ান। তিনি হাসপাতালের ময়লা কাপড় ধোলাইয়ের কাজ করেন না, লোক দিয়ে করান। তার লাইসেন্সে জনৈক ব্যক্তি কাপড় ধোলাইয়ের কাজ করেন। তিনিও ধোলাইয়ের কাজ করেন না। অর্থাৎ তিন হাত বদল হয়ে হ-য-ব-র-ল ভাবে চলছে ধোলাইয়ের কাজ।

মেল (পুরুষ) মেডিসিন ওয়ার্ডের নার্স ইনচার্জ ফাহমিদা খাতুন জানান, তারা ময়লা কাপড় নিয়ে চরম বিপদে আছেন। ঠিকাদার ঠিকমতো কাপড় ধুয়ে দিতে পারছেন না। এ নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা অতিষ্ঠ। তাছাড়া রোগীদের জীবনও ঝুকির মধ্যে পড়েছে। একই কথা জানালেন শিশু ওয়ার্ডের নার্স ইনচার্জ রাজিয়া খাতুন। তিনি বলেন, হাসপাতালের সিলযুক্ত চাদর পাল্টে ছেড়া ও ফাটা চাদর সরবরাহ করা হয়েছে। সেই চাদর রেখে দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেওয়া চাদর ঠিকমতো পাচ্ছি না। ঠিকাদার কাপড় নেওয়া ও সরবরাহ করার কোন নিয়মই মানছেন না। নার্স রাজিয়া খাতুন আরো বলেন, ময়লা কাপড়ের বিষয়ে ১০টি ওয়ার্ডের নার্স ইনচার্জরা যৌথ সাক্ষর করে বিষয়টি তত্ত্বাবধায়ককে জানিয়েছেন। এদিকে শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে বেশির ভাগ বিছানায় চাদর নেই। ধোলাইয়ের জন্য নিয়ে তা আর ফেরৎ দেয়নি।

শিশু ওয়ার্ডে ইন্টার্নি করা ম্যাটসের ছাত্র হাবিবুর রহমান বলেন, ‘প্রতি রোববার ও বুধবার ময়লা কাপড় নেওয়ার কথা। কিন্তু তারা নেয় না। আবার ৪০টি চাদর ময়লা হলে সবগুলো নিয়ে যায়না। পরিস্কারের জন্য ২০টি নিয়ে যায় আর ময়লা চাদর ২০টি রেখে যায়।’

ফিমেল (মহিলা) ওয়ার্ডে কর্মরত নার্স ও সেচ্ছোসেবী দেলোয়ারা খাতুন ও নুরুন্নাহার অভিযোগ করেন, ‘চাদর ঠিকমতো পরিস্কার হচ্ছে না। রক্তমাখা বেডসীট পরিস্কার বলে চালিয়ে দিচ্ছে।’

এদিকে হাসপাতালের হিসাবরক্ষক ফেরদৌস জানান, ‘গত দুই মাসে ঠিকাদারকে প্রায় ৯৫ হাজার টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ঠিকমতো ধোলাইয়ের কাজ না করার কারণে তারাও বেশ বিপদে আছেন। বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে নার্সরা তাদের কাছে অভিযোগ করছেন।’

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সৈয়দ রেজাউল ইসলাম জানান, ‘বিষয়টি নিয়ে তারা বেশ কঠোর। ঠিকাদারকে ইতিমধ্যে তিনবার শোকজ করা হয়েছে। হাসপাতালের ধোলাইয়ের কাজ নিম্নমানের হচ্ছে বলে নার্সরা তাকে জানিয়েছেন। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রয়োজনে ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিল করা হতে পারে।’

এবিষয়ে ঠিকাদার মহিবুল্লাহ জানান, ‘আমি এ কাজ সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমার লাইসেন্স ব্যবহার করে এই কাজ করা হচ্ছে। হাসপাতালের ধোলাই কাজের সঙ্গে আমি জড়িত নয়।’