ইপেপার । আজ শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪

সিড়ির নিচে এখন তার মৃত্যুর অপেক্ষা!

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:৫৬:১১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২২
  • / ৩৪ বার পড়া হয়েছে

স্পট : চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল

রুদ্র রাসেল:

সুস্থ হতে নয় যেন মৃত্যুর অপেক্ষায় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের সিড়ির নিচে পড়ে আছেন অজ্ঞাত এক প্রতিবন্ধী বৃদ্ধা। হাটা-চলা করতে না পারলেও শুধুমাত্র নিজের ব্যথার কথা ব্যক্ত করতে পারেন তিনি। যে সিড়ির নিচে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন, সেখানে শুয়েই মলমূত্র ত্যাগ করতে হয় তাঁকে। দুর্গন্ধে চিকিৎসক, নার্স এমন-কী পরীছন্নতাকর্মীরাও তাঁর নিকট যেতে পারেন না।

            তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন গত কয়েকমাস যাবত তিনি অজ্ঞাত পরিচয়ে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন। চিকিৎসকেরা ঠিকঠাক চিকিৎসাও দিয়ে যাচ্ছেন।

জানা যায়, গত বছরের অক্টোবর মাসের ১৯ তারিখে অজ্ঞাত একটি পাখিভ্যান চালক কম্বলে মোড়ানো অবস্থায় ওই বৃদ্ধাকে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের নতুন জরুরি বিভগের সামনে ফেলে রেখে যায়। পরে অজ্ঞাত প্রতিবন্ধী ওই বৃদ্ধাকে জরুরি বিভাগ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতালের মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করে জরুরি বিভাগেরই কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক।

            সদর হাসপাতাল সূত্রে আরো জানা যায়, অজ্ঞাত বৃদ্ধাকে জরুরি বিভগের সামনে ফেলে রেখে যাওয়ার পরদিনই ঐসময় তাকে নিয়ে দৈনিক সময়ের সমীকরণে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। সংবাদ প্রকাশের পরেই ঝিনাইদহ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিআইবি)-এর একটি টিম চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে আসে। তারা বৃদ্ধা রোগীটির পরিচয় শনাক্তে ছবি ও আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে যায়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত অজ্ঞাত এই প্রতিবন্ধী বৃদ্ধার কোনো পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব ঞয়নি।

জরুরি বিভাগের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক জানান, ‘প্রায় চারমাস পূর্বে একটি অজ্ঞাত পাখিভ্যান ওই মহিলাটিকে জরুরি বিভাগের সামনেই রেখে চলে যায়। সেসময় একটি বেগুনি রঙের কম্বল তার শরীরে জড়ানো ছিল। সে কোনো কথা বলতে পারছিল না, এমনকি নিজের হাত-পা নাড়াতেও অক্ষম ছিলেন। পরে তাকে জরুরি বিভাগ থেকে চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করা হয়।

            হাসপাতালের মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডের জেসমিন নামের এক স্বেচ্ছাসেবিকা বলেন, ‘তিনি প্রায় চারমাস ধরে এই ওয়ার্ডে আছেন। তাঁর নাম পর্যন্ত এখনো জানা যায়নি। প্রথমে তাকে ওয়ার্ডের মধ্যে রাখলেও তিনি চলাচল করতে না পারায় ও অপরিচ্ছন্ন থাকায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছেন। যে কারণে অন্য রোগী ও তাদের স্বজনেরা বিরক্ত হচ্ছেন। তাই তাকে বারান্দা সংলগ্ন সিড়ির নিচে বিছানা করে দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এই বৃদ্ধা চলাচল করতে না পারলেও মাঝেমধ্যে ‘ব্যাথা ব্যাথা’ শব্দ উচ্চারণ করেন।’

            মহিলা মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসাধীন এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘আমার মা অসুস্থ হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। এখানে আসার পর থেকেই সিড়ির নিচে একটি অসুস্থ মহিলাকে দেখতে পাচ্ছি। এই কয়দিনে সে একটিবারের জন্য হলেও ওখান থেকে অন্য কোথাও যাননি। তার শরীর থেকে প্রচন্ড দুর্গন্ধ ছড়ানোর কারণে কেউ তার কাছে যেতে পারছেন না। মাঝেমধ্যে হাসপাতালের অন্যান্য রোগীর স্বজনেরা তাকে কিছু খাবার কিনে দিয়ে যেতে দেখেছি। ওয়ার্ডে ডাক্তার আসলেও তাকে ঠিকমত দেখেন না, এটা নিয়মিত খেয়াল করেছি।’

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জুনিয়র কার্ডিওলজি কনসালটেন্ট ডা. আবুল হোসেন বলেন, ‘কয়েকমাস পূর্বে রোগীটিকে হাসপাতালের মহিলা মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করা হয়। সে শারীরিক ও মানুষিক প্রতিবন্ধী। মাঝেমধ্যে দু-একটা কথা বললেও হাটা-চলা করতে পারেন না। আমি নিয়মিত তাঁকে দেখছি। তবে সে চলাচল করতে না পারায় নিজ বিছানাতেই মলমূত্র ত্যাগ করে অপরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। যে কারণে সে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এখনো তার সার্বক্ষণিক সেবার জন্য একজন মানুষ প্রয়োজন।’

            চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. ওয়াহেদ মাহমুদ রবিন বলেন, ‘রোগীটির ভাল চিকিৎসা ও সেবার প্রয়োজন। কিন্তু তার পরিবারের সদস্যদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমন-কী রোগীটির নাম পর্যন্ত আমরা জানিনা। অজ্ঞাত পরিচয়ের এই রোগীটিকে প্রথমে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ভেতরে রাখা হলেও সে নিজ বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ করে অনেক দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছেন। এতে করে ওই ওয়ার্ডের অন্য রোগীরা ওয়ার্ডের বাইরে চলে যাচ্ছিল। তবে আমরা রোগীটিকে যথাসাধ্য চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছি। তাঁর প্রয়োজনীয় সকল ওষুধপত্র ও খাবারের ব্যবস্থাও নিয়মিত করা হচ্ছে। আর হাসপাতালে জনবল সঙ্কটের কারণে তার সার্বক্ষণিক সেবা দেওয়ার জন্য কোনো স্টাফকেও আমরা রাখতে পারছিনা, তার পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য।’

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

সিড়ির নিচে এখন তার মৃত্যুর অপেক্ষা!

আপলোড টাইম : ০৯:৫৬:১১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২২

স্পট : চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল

রুদ্র রাসেল:

সুস্থ হতে নয় যেন মৃত্যুর অপেক্ষায় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের সিড়ির নিচে পড়ে আছেন অজ্ঞাত এক প্রতিবন্ধী বৃদ্ধা। হাটা-চলা করতে না পারলেও শুধুমাত্র নিজের ব্যথার কথা ব্যক্ত করতে পারেন তিনি। যে সিড়ির নিচে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন, সেখানে শুয়েই মলমূত্র ত্যাগ করতে হয় তাঁকে। দুর্গন্ধে চিকিৎসক, নার্স এমন-কী পরীছন্নতাকর্মীরাও তাঁর নিকট যেতে পারেন না।

            তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন গত কয়েকমাস যাবত তিনি অজ্ঞাত পরিচয়ে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন। চিকিৎসকেরা ঠিকঠাক চিকিৎসাও দিয়ে যাচ্ছেন।

জানা যায়, গত বছরের অক্টোবর মাসের ১৯ তারিখে অজ্ঞাত একটি পাখিভ্যান চালক কম্বলে মোড়ানো অবস্থায় ওই বৃদ্ধাকে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের নতুন জরুরি বিভগের সামনে ফেলে রেখে যায়। পরে অজ্ঞাত প্রতিবন্ধী ওই বৃদ্ধাকে জরুরি বিভাগ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতালের মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করে জরুরি বিভাগেরই কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক।

            সদর হাসপাতাল সূত্রে আরো জানা যায়, অজ্ঞাত বৃদ্ধাকে জরুরি বিভগের সামনে ফেলে রেখে যাওয়ার পরদিনই ঐসময় তাকে নিয়ে দৈনিক সময়ের সমীকরণে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। সংবাদ প্রকাশের পরেই ঝিনাইদহ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিআইবি)-এর একটি টিম চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে আসে। তারা বৃদ্ধা রোগীটির পরিচয় শনাক্তে ছবি ও আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে যায়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত অজ্ঞাত এই প্রতিবন্ধী বৃদ্ধার কোনো পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব ঞয়নি।

জরুরি বিভাগের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক জানান, ‘প্রায় চারমাস পূর্বে একটি অজ্ঞাত পাখিভ্যান ওই মহিলাটিকে জরুরি বিভাগের সামনেই রেখে চলে যায়। সেসময় একটি বেগুনি রঙের কম্বল তার শরীরে জড়ানো ছিল। সে কোনো কথা বলতে পারছিল না, এমনকি নিজের হাত-পা নাড়াতেও অক্ষম ছিলেন। পরে তাকে জরুরি বিভাগ থেকে চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করা হয়।

            হাসপাতালের মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডের জেসমিন নামের এক স্বেচ্ছাসেবিকা বলেন, ‘তিনি প্রায় চারমাস ধরে এই ওয়ার্ডে আছেন। তাঁর নাম পর্যন্ত এখনো জানা যায়নি। প্রথমে তাকে ওয়ার্ডের মধ্যে রাখলেও তিনি চলাচল করতে না পারায় ও অপরিচ্ছন্ন থাকায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছেন। যে কারণে অন্য রোগী ও তাদের স্বজনেরা বিরক্ত হচ্ছেন। তাই তাকে বারান্দা সংলগ্ন সিড়ির নিচে বিছানা করে দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এই বৃদ্ধা চলাচল করতে না পারলেও মাঝেমধ্যে ‘ব্যাথা ব্যাথা’ শব্দ উচ্চারণ করেন।’

            মহিলা মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসাধীন এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘আমার মা অসুস্থ হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। এখানে আসার পর থেকেই সিড়ির নিচে একটি অসুস্থ মহিলাকে দেখতে পাচ্ছি। এই কয়দিনে সে একটিবারের জন্য হলেও ওখান থেকে অন্য কোথাও যাননি। তার শরীর থেকে প্রচন্ড দুর্গন্ধ ছড়ানোর কারণে কেউ তার কাছে যেতে পারছেন না। মাঝেমধ্যে হাসপাতালের অন্যান্য রোগীর স্বজনেরা তাকে কিছু খাবার কিনে দিয়ে যেতে দেখেছি। ওয়ার্ডে ডাক্তার আসলেও তাকে ঠিকমত দেখেন না, এটা নিয়মিত খেয়াল করেছি।’

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জুনিয়র কার্ডিওলজি কনসালটেন্ট ডা. আবুল হোসেন বলেন, ‘কয়েকমাস পূর্বে রোগীটিকে হাসপাতালের মহিলা মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করা হয়। সে শারীরিক ও মানুষিক প্রতিবন্ধী। মাঝেমধ্যে দু-একটা কথা বললেও হাটা-চলা করতে পারেন না। আমি নিয়মিত তাঁকে দেখছি। তবে সে চলাচল করতে না পারায় নিজ বিছানাতেই মলমূত্র ত্যাগ করে অপরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। যে কারণে সে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এখনো তার সার্বক্ষণিক সেবার জন্য একজন মানুষ প্রয়োজন।’

            চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. ওয়াহেদ মাহমুদ রবিন বলেন, ‘রোগীটির ভাল চিকিৎসা ও সেবার প্রয়োজন। কিন্তু তার পরিবারের সদস্যদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমন-কী রোগীটির নাম পর্যন্ত আমরা জানিনা। অজ্ঞাত পরিচয়ের এই রোগীটিকে প্রথমে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ভেতরে রাখা হলেও সে নিজ বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ করে অনেক দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছেন। এতে করে ওই ওয়ার্ডের অন্য রোগীরা ওয়ার্ডের বাইরে চলে যাচ্ছিল। তবে আমরা রোগীটিকে যথাসাধ্য চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছি। তাঁর প্রয়োজনীয় সকল ওষুধপত্র ও খাবারের ব্যবস্থাও নিয়মিত করা হচ্ছে। আর হাসপাতালে জনবল সঙ্কটের কারণে তার সার্বক্ষণিক সেবা দেওয়ার জন্য কোনো স্টাফকেও আমরা রাখতে পারছিনা, তার পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য।’