ইপেপার । আজ শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

শীর্ষ পাচারকারীদের অর্থ শনাক্তে রোডম্যাপ তৈরি

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৫:৫৩:১০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪
  • / ১৫ বার পড়া হয়েছে

CREATOR: gd-jpeg v1.0 (using IJG JPEG v62), quality = 100

এস আলম, বেক্সিমকো, সামিট, নাসার নজরুল ইসলাম মজুমদার, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীসহ শীর্ষ অর্থ পাচারকারীদের দেশে-বিদেশে থাকা অর্থ শনাক্ত করে দেশে ফেরত আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একই সাথে তাদের দেশে থাকা সম্পদ দ্রুত জব্দ করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া অভিযুক্তদের সম্পদ কেউ কিনলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ দেশে ফেরত আনা ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে গঠিত আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের প্রথম সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানায়।
এক সূত্র জানিয়েছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর এ পর্যন্ত ৫টি দেশে ৮ হাজার কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ মিলেছে। শুধু যুক্তরাজ্যেই তার ৩৬০টি বাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে। ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদার তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৪টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর বড় একটি অংশই পাচার করেছে বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে বের হয়েছে। এর মধ্যে আমিরাত, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড এই পাঁচ দেশেই বেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। দেশের ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের অভিশাপ এস আলম ৮টি ব্যাংক দখলে নিয়ে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা নামে বেনামে ঋণ নিয়েছে। ব্যাংকগুলো এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে। বেশির ভাগ ব্যাংকই এখন গ্রাহকের টাকা দিতে পারছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকিং খাত থেকে নামে বেনামে নেয়া ঋণের বেশির ভাগ অংশই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবে সামিট, বেক্সিমকোসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানিয়েছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে নানা কৌশলে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া ও তাদের পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। গত বুধবার টাস্কফোর্সের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় টাস্কফোর্সের সদস্য হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, আইন মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক, সিআইডি, এটার্নি জেনারেলের কার্যালয়, কাস্টমস ও বিএফআইইউর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে দেশ থেকে যেসব অর্থ পাচারকারীদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এস আলম, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সামিট, নাসা গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপসহ শীর্ষ অর্থ পাচারকারীদের দেশ-বিদেশে থাকা অর্থ শনাক্ত করে তা দেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ জন্য দেশ-বিদেশে সব ধরনের আইনগত ও লজিস্টিক সাফোর্ট নেয়া হবে। পাশাপাশি এসব অপরাধীর দেশে থাকা স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ শনাক্ত করে তা দ্রুত জব্দ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যে অভিযোগ ছিল ব্যাংক থেকে অর্থ লুটপাটকারীরা দেশে থাকা তাদের স্থাবর সম্পদ বিক্রি বা হস্তান্তর করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ইতোমধ্যে জানিয়েছিলেন, যারা এসব সম্পদ কিনবে তা নিজ দায়িত্বেই কিনতে হবে। এর দায় দায়িত্ব কেউ নেবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এস আলমসহ অর্থ পাচারকারীদের অর্থ যারাই কিনবে তাদের বিরুদ্ধেই আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।
গত বুধবারের বৈঠকে এজন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে বলে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে। রোডম্যাপের মধ্যে রয়েছে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথমে শীর্ষ পাচারকারীদের অর্থ চিহ্নিত করে তা নেয়া ফেরত আনার দ্রুত পদক্ষেপ হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্যদের বিষয়েও একই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। দ্বিতীয়ত, পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধারে দায়েরকৃত মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করা ও তা দূরীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ দ্রুত ফিরে আনা ও দেশে থাকা সম্পদ দ্রুত জব্দ করা হবে। জব্দ করা সম্পদ দ্রুত ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশ, বিদেশী সংস্থার সাথে যোগাযোগ, তথ্য আহরণ এবং পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ সমন্বয় সাধারণ করা।
ওই বৈঠকে ৯ সদস্যের টাস্কফোর্সের সাথে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে টাস্কফোর্সের সদস্য সংখ্যা ১০-এ উন্নীত হয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যাংক থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পাচার করা একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতারণা, জালিয়াতি ও হুণ্ডির মাধ্যমে এক লাখ ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম, তার স্ত্রী ও সন্তানদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সূত্রে জানা যায়, এস আলম, তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন ও দুই ছেলে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সাইপ্রাসসহ ইউরোপে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার করেছেন। এসব টাকা দিয়ে তারা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রয় ও ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। পাচারকৃত অর্থে সিঙ্গাপুরে ২৪৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের ক্যানালি লজিস্ট্রিক প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেছেন। এছাড়া ভুয়া নথি তৈরি, জাল-জালিয়াতি এবং প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বিদেশে পণ্য আমদানি-রফতানি ও বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে নামে-বেনামে ছয়টি ব্যাংক থেকে ৯৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছেন। বিদেশে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান শেল কোম্পানি খুলে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১৮ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। এস আলমসহ তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন, ছেলে আহসানুল আলম ও আশরাফুল আলমসহ তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তিদের সহযোগিতায় সংঘবদ্ধ অপরাধের মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছে। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে ওঠা মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছি। পাশাপাশি বেক্সিমকো, সামিটের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়েছে।
অপর এক সূত্র জানিয়েছে, রফতানির আড়ালে বেক্সিকো গ্রুপের বিরুদ্ধেও বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে একাধিক সংস্থা মাঠে নেমেছে। এদিকে সামিটের বিরুদ্ধেও বিপুল অঙ্কের টাকা পাচারের অভিযোগ পেয়েছে সংশ্লিষ্টরা। পাচারের টাকায় দক্ষিণ এশিয়ার সিঙ্গাপুরে শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় আছেন বাংলাদেশের সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক সাময়িকী ফোর্বস প্রকাশিত ২০২৪ সালের ধনকুবের (বিলিয়নিয়ার) তালিকায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
সামিট গ্রুপের বিরুদ্ধে টাকা পাচারের অভিযোগ অনেক পুরনো। হাসিনার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় আজিজ খানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করার সুযোগ দেয়া হয়েছে তাকে। সামিট কমিউনিকেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ফরিদ খান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও হাসিনা সরকারের বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খানের ছোট ভাই। ফরিদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ছেলে ও আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়েরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এ কারণে সামিট গ্রুপ হাসিনা সরকারের ১৫ বছর ধরে বিশেষ সুবিধা নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে টাস্কফোর্স থেকে শীর্ষ ১০ পাচারকারীর বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত করে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ জন্য একাধিক উপকমিটি ও টিম গঠন করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

শীর্ষ পাচারকারীদের অর্থ শনাক্তে রোডম্যাপ তৈরি

আপলোড টাইম : ০৫:৫৩:১০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪

এস আলম, বেক্সিমকো, সামিট, নাসার নজরুল ইসলাম মজুমদার, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীসহ শীর্ষ অর্থ পাচারকারীদের দেশে-বিদেশে থাকা অর্থ শনাক্ত করে দেশে ফেরত আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একই সাথে তাদের দেশে থাকা সম্পদ দ্রুত জব্দ করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া অভিযুক্তদের সম্পদ কেউ কিনলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ দেশে ফেরত আনা ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে গঠিত আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের প্রথম সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানায়।
এক সূত্র জানিয়েছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর এ পর্যন্ত ৫টি দেশে ৮ হাজার কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ মিলেছে। শুধু যুক্তরাজ্যেই তার ৩৬০টি বাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে। ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদার তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৪টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর বড় একটি অংশই পাচার করেছে বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে বের হয়েছে। এর মধ্যে আমিরাত, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড এই পাঁচ দেশেই বেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। দেশের ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের অভিশাপ এস আলম ৮টি ব্যাংক দখলে নিয়ে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা নামে বেনামে ঋণ নিয়েছে। ব্যাংকগুলো এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে। বেশির ভাগ ব্যাংকই এখন গ্রাহকের টাকা দিতে পারছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকিং খাত থেকে নামে বেনামে নেয়া ঋণের বেশির ভাগ অংশই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবে সামিট, বেক্সিমকোসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানিয়েছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে নানা কৌশলে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া ও তাদের পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। গত বুধবার টাস্কফোর্সের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় টাস্কফোর্সের সদস্য হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, আইন মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক, সিআইডি, এটার্নি জেনারেলের কার্যালয়, কাস্টমস ও বিএফআইইউর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে দেশ থেকে যেসব অর্থ পাচারকারীদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এস আলম, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সামিট, নাসা গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপসহ শীর্ষ অর্থ পাচারকারীদের দেশ-বিদেশে থাকা অর্থ শনাক্ত করে তা দেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ জন্য দেশ-বিদেশে সব ধরনের আইনগত ও লজিস্টিক সাফোর্ট নেয়া হবে। পাশাপাশি এসব অপরাধীর দেশে থাকা স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ শনাক্ত করে তা দ্রুত জব্দ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যে অভিযোগ ছিল ব্যাংক থেকে অর্থ লুটপাটকারীরা দেশে থাকা তাদের স্থাবর সম্পদ বিক্রি বা হস্তান্তর করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ইতোমধ্যে জানিয়েছিলেন, যারা এসব সম্পদ কিনবে তা নিজ দায়িত্বেই কিনতে হবে। এর দায় দায়িত্ব কেউ নেবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এস আলমসহ অর্থ পাচারকারীদের অর্থ যারাই কিনবে তাদের বিরুদ্ধেই আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।
গত বুধবারের বৈঠকে এজন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে বলে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে। রোডম্যাপের মধ্যে রয়েছে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথমে শীর্ষ পাচারকারীদের অর্থ চিহ্নিত করে তা নেয়া ফেরত আনার দ্রুত পদক্ষেপ হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্যদের বিষয়েও একই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। দ্বিতীয়ত, পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধারে দায়েরকৃত মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করা ও তা দূরীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ দ্রুত ফিরে আনা ও দেশে থাকা সম্পদ দ্রুত জব্দ করা হবে। জব্দ করা সম্পদ দ্রুত ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশ, বিদেশী সংস্থার সাথে যোগাযোগ, তথ্য আহরণ এবং পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ সমন্বয় সাধারণ করা।
ওই বৈঠকে ৯ সদস্যের টাস্কফোর্সের সাথে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে টাস্কফোর্সের সদস্য সংখ্যা ১০-এ উন্নীত হয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যাংক থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পাচার করা একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতারণা, জালিয়াতি ও হুণ্ডির মাধ্যমে এক লাখ ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম, তার স্ত্রী ও সন্তানদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সূত্রে জানা যায়, এস আলম, তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন ও দুই ছেলে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সাইপ্রাসসহ ইউরোপে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার করেছেন। এসব টাকা দিয়ে তারা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রয় ও ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। পাচারকৃত অর্থে সিঙ্গাপুরে ২৪৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের ক্যানালি লজিস্ট্রিক প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেছেন। এছাড়া ভুয়া নথি তৈরি, জাল-জালিয়াতি এবং প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বিদেশে পণ্য আমদানি-রফতানি ও বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে নামে-বেনামে ছয়টি ব্যাংক থেকে ৯৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছেন। বিদেশে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান শেল কোম্পানি খুলে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১৮ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। এস আলমসহ তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন, ছেলে আহসানুল আলম ও আশরাফুল আলমসহ তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তিদের সহযোগিতায় সংঘবদ্ধ অপরাধের মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছে। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে ওঠা মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছি। পাশাপাশি বেক্সিমকো, সামিটের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়েছে।
অপর এক সূত্র জানিয়েছে, রফতানির আড়ালে বেক্সিকো গ্রুপের বিরুদ্ধেও বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে একাধিক সংস্থা মাঠে নেমেছে। এদিকে সামিটের বিরুদ্ধেও বিপুল অঙ্কের টাকা পাচারের অভিযোগ পেয়েছে সংশ্লিষ্টরা। পাচারের টাকায় দক্ষিণ এশিয়ার সিঙ্গাপুরে শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় আছেন বাংলাদেশের সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক সাময়িকী ফোর্বস প্রকাশিত ২০২৪ সালের ধনকুবের (বিলিয়নিয়ার) তালিকায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
সামিট গ্রুপের বিরুদ্ধে টাকা পাচারের অভিযোগ অনেক পুরনো। হাসিনার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় আজিজ খানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করার সুযোগ দেয়া হয়েছে তাকে। সামিট কমিউনিকেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ফরিদ খান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও হাসিনা সরকারের বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খানের ছোট ভাই। ফরিদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ছেলে ও আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়েরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এ কারণে সামিট গ্রুপ হাসিনা সরকারের ১৫ বছর ধরে বিশেষ সুবিধা নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে টাস্কফোর্স থেকে শীর্ষ ১০ পাচারকারীর বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত করে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ জন্য একাধিক উপকমিটি ও টিম গঠন করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।