ইপেপার । আজ সোমবার, ২১ অক্টোবর ২০২৪

মিঠে শৈশবের সাথে বিলুপ্ত প্রায় গ্রামীণ খেলাধুলা

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৫:১৬:০৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৩
  • / ২১ বার পড়া হয়েছে

সালিকিন মিয়া সাগর:
সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলাগুলো। সময়ের সঙ্গে তাল মিলেয়ে বদলে যাচ্ছে আমাদের চারপাশের চিত্রও। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান সময় হয়ে উঠেছে যান্ত্রিক। মোবাইল ও অনলাইন গেমের কারণে বিকেল বেলা মাঠে এখন আর প্রায় দেখায় যায় না শিশু-কিশোরদের। মোবাইল গেমস ও উন্নত প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাবে গ্রামীণ খেলাধুলার প্রতি হারিয়ে যাচ্ছে আগ্রহ। হারিয়ে যাচ্ছে ইচিং বিচিং চিচিং চা, প্রজাপতি উড়ে যা, কানা মাছি ভোঁ ভোঁ, গোল্লাছুট, মোরগ লড়ায়, কিঁতকিঁতসহ যুগ যুগ ধরে গ্রামীণ প্রান্তিক জনপদের জনপ্রিয় খেলাগুলো। বর্তমান সময়ের ৯৫ ভাগ শিশুরাই জানে না এসব খেলার নাম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর টিভি সিরিয়ালের দিকে ঝুঁকে পড়ায় শিশুরা এসব খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত।
এক সময় বিদ্যালয়ে ছুটি দেওয়ার পর ছোট ছোট শিশুরা এসব খেলায় মেতে থাকত। তবে এখন এই জাতীয় গ্রামীণ খেলাধুলাগুলো যেন ভুলতে বসেছে সবাই। একসময় কিশোরদের কাছে জনপ্রিয় একটি খেলা ছিল ‘পাখি খেলা’, যেটি অনেক স্থানে ‘গাজি’ খেলা নামেও বেশ পরিচিত। এই খেলায় মেশানো দুই পায়ের ওপরে চার স্তরে পাখির মতো দুই ডানা বেধে প্রতিপক্ষকে বাধা প্রদান করা হতো। আর প্রতিপক্ষকে খুব সাবধানে লাফ দিয়ে একপাশ থেকে অপরপাশে পাড়ি দিতে হতো। হাতের সঙ্গে পা কিংবা শরীরের কোনো অঙ্গ মিশলেই প্রতিপক্ষ শেষ। এভবেই গ্রামীণ জনপদের মানুষগুলো আনন্দ উপভোগ করত।
এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা গ্রামবাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য এসব গ্রামীণ খেলাধুলা তো করেই না, এমনকি এসব খেলাধুলার নাম জানে কি না, সেটি এক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ একসময় এ সমস্ত খেলাধুলাকে বাদ দিয়ে বাঙালি ঐতিহ্যের পূর্ণতাকে কল্পনাও করা যেত না। বর্তমানে এসব ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার প্রচলন না থাকায় গ্রামীণ জনপদ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে হাজার বছরের বাঙালির ঐতিহ্য। ১৫-১৬ বছর আগেও চুয়াডাঙ্গার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিকেল হলেই সব বয়সের মানুষ খেলার মাঠে জড়ো হতো। মাঠে এসে করতালি আর শোরগোলে হা-ডু-ডু, কাবাডি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, গাজি খেলা, বৌচি খেলার মতো অনেক খেলায় মেতে উঠত। ছেলে, বুড়ো সকলের মন ছিল খেলার জন্য পাগলপারা।
তবে বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তি কেড়ে নিয়েছে অতীতের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাকে। আর প্রজন্মকে ক্রমেই ঠেলে দিচ্ছে যান্ত্রিকতার দিকে। কেবল যান্ত্রিকতায় যদি সঙ্গী হতো তবুও হয়ত মেধাবী এক ভবিষ্যতের প্রজন্ম গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু খেলাধুলার প্রতি অনাগ্রহ কিশোর-যুবকদেরকে ঝুঁকছে ভয়ঙ্কর মাদকতায়। ফলে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে সুস্থ-সবল ও মেধাবী যুবসমাজ গড়ে তোলা এখন অনেকটাই চ্যালেঞ্জ। এছাড়া বর্তমানে শহরাঞ্চলে তো বটেই গ্রামাঞ্চলেও খোলা জায়গা বা খেলার মাঠের স্বল্পতার কারণে অনেক গ্রামীণ খেলার পরিবেশ সৃষ্টিও হচ্ছে না। যার ফলে বর্তমান ভিডিও গেম, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন ইত্যাদি গ্রামীণ খেলাধুলাগুলো সে স্থান দখল করে নিয়েছে। ছেলে-মেয়েরা একটু সময় পেলেই মেতে ওঠে এসব যান্ত্রিকতার দিকে।
সূত্রে জানা যায়, পড়াশুনা যেমন ছেলে-মেয়েদের মানসিক বিকাশ ঘটায়, তেমনি শারীরিক বিকাশ ঘটাতে খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই। এক যুগ আগেও গ্রামাঞ্চলে হা-ডু-ডু, কাবাডি, নৌকাবাইচ, কানামাছি, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্দা, বলি খেলা ও লাঠিখেলা ছিল শিশু, কিশোর ও যুবকদের পছন্দের খেলাগুলোর তালিকায়। বিভিন্ন গ্রামে এসব খেলার জমজমাট আয়োজন হতো। এ সমস্ত খেলা দেখার জন্য অনেক দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ দলে দলে এসে উপস্থিত হতো মাঠে। অনেক খেলোয়াড় টাকার বিনিময়েও বিভিন্ন দলের হয়ে খেলত। তাতে করে ভালো খেলায় টাকাসহ নানা রকম পুরস্কার যেমন মিলত, সেই সঙ্গে ভালো খেলোয়াড় হিসেবে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ত এলাকায়। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এসমস্ত খেলোয়াড়দের অনেক সম্মান করত। অতীতের সময়ে প্রতিবছর সব স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাগুলোতে নানা ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করা হতো। বর্তমানে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোনো খেলার মাঠও নেই, আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে মাঠ থাকলেও নেই খেলার প্রতি কোনো আগ্রহ। ফলে খেলাধুলায় উপস্থিতি না থাকায় শিক্ষার্থীদের শারীরিক বিকাশ ঘটছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়ত একেবারেই গ্রামীণ খেলাধুলা আমাদের সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে। পরিণত হবে রূপকথার গল্পে। এ সমস্ত গ্রামীণ খেলাধুলার সঙ্গে রয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষদের নাড়ির সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই তাদের স্মৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমাদের উচিত গ্রামীণ খেলাধুলার আয়োজন করা।
মাদকের ভয়াল গ্রাস থেকে প্রজন্মকে রক্ষা ও গ্রামীণ খেলাধুলাগুলোকে বাঁচাতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি সচেতন ও প্রবীণ খেলাপ্রেমী ব্যক্তিদের। সেই সঙ্গে অভিভাবক থেকে শুরু করে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসতে হবে। নানামুখী উদ্যোগ বৃদ্ধির মাধ্যমেই কেবল অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

মিঠে শৈশবের সাথে বিলুপ্ত প্রায় গ্রামীণ খেলাধুলা

আপলোড টাইম : ০৫:১৬:০৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৩

সালিকিন মিয়া সাগর:
সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলাগুলো। সময়ের সঙ্গে তাল মিলেয়ে বদলে যাচ্ছে আমাদের চারপাশের চিত্রও। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান সময় হয়ে উঠেছে যান্ত্রিক। মোবাইল ও অনলাইন গেমের কারণে বিকেল বেলা মাঠে এখন আর প্রায় দেখায় যায় না শিশু-কিশোরদের। মোবাইল গেমস ও উন্নত প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাবে গ্রামীণ খেলাধুলার প্রতি হারিয়ে যাচ্ছে আগ্রহ। হারিয়ে যাচ্ছে ইচিং বিচিং চিচিং চা, প্রজাপতি উড়ে যা, কানা মাছি ভোঁ ভোঁ, গোল্লাছুট, মোরগ লড়ায়, কিঁতকিঁতসহ যুগ যুগ ধরে গ্রামীণ প্রান্তিক জনপদের জনপ্রিয় খেলাগুলো। বর্তমান সময়ের ৯৫ ভাগ শিশুরাই জানে না এসব খেলার নাম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর টিভি সিরিয়ালের দিকে ঝুঁকে পড়ায় শিশুরা এসব খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত।
এক সময় বিদ্যালয়ে ছুটি দেওয়ার পর ছোট ছোট শিশুরা এসব খেলায় মেতে থাকত। তবে এখন এই জাতীয় গ্রামীণ খেলাধুলাগুলো যেন ভুলতে বসেছে সবাই। একসময় কিশোরদের কাছে জনপ্রিয় একটি খেলা ছিল ‘পাখি খেলা’, যেটি অনেক স্থানে ‘গাজি’ খেলা নামেও বেশ পরিচিত। এই খেলায় মেশানো দুই পায়ের ওপরে চার স্তরে পাখির মতো দুই ডানা বেধে প্রতিপক্ষকে বাধা প্রদান করা হতো। আর প্রতিপক্ষকে খুব সাবধানে লাফ দিয়ে একপাশ থেকে অপরপাশে পাড়ি দিতে হতো। হাতের সঙ্গে পা কিংবা শরীরের কোনো অঙ্গ মিশলেই প্রতিপক্ষ শেষ। এভবেই গ্রামীণ জনপদের মানুষগুলো আনন্দ উপভোগ করত।
এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা গ্রামবাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য এসব গ্রামীণ খেলাধুলা তো করেই না, এমনকি এসব খেলাধুলার নাম জানে কি না, সেটি এক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ একসময় এ সমস্ত খেলাধুলাকে বাদ দিয়ে বাঙালি ঐতিহ্যের পূর্ণতাকে কল্পনাও করা যেত না। বর্তমানে এসব ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার প্রচলন না থাকায় গ্রামীণ জনপদ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে হাজার বছরের বাঙালির ঐতিহ্য। ১৫-১৬ বছর আগেও চুয়াডাঙ্গার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিকেল হলেই সব বয়সের মানুষ খেলার মাঠে জড়ো হতো। মাঠে এসে করতালি আর শোরগোলে হা-ডু-ডু, কাবাডি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, গাজি খেলা, বৌচি খেলার মতো অনেক খেলায় মেতে উঠত। ছেলে, বুড়ো সকলের মন ছিল খেলার জন্য পাগলপারা।
তবে বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তি কেড়ে নিয়েছে অতীতের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাকে। আর প্রজন্মকে ক্রমেই ঠেলে দিচ্ছে যান্ত্রিকতার দিকে। কেবল যান্ত্রিকতায় যদি সঙ্গী হতো তবুও হয়ত মেধাবী এক ভবিষ্যতের প্রজন্ম গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু খেলাধুলার প্রতি অনাগ্রহ কিশোর-যুবকদেরকে ঝুঁকছে ভয়ঙ্কর মাদকতায়। ফলে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে সুস্থ-সবল ও মেধাবী যুবসমাজ গড়ে তোলা এখন অনেকটাই চ্যালেঞ্জ। এছাড়া বর্তমানে শহরাঞ্চলে তো বটেই গ্রামাঞ্চলেও খোলা জায়গা বা খেলার মাঠের স্বল্পতার কারণে অনেক গ্রামীণ খেলার পরিবেশ সৃষ্টিও হচ্ছে না। যার ফলে বর্তমান ভিডিও গেম, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন ইত্যাদি গ্রামীণ খেলাধুলাগুলো সে স্থান দখল করে নিয়েছে। ছেলে-মেয়েরা একটু সময় পেলেই মেতে ওঠে এসব যান্ত্রিকতার দিকে।
সূত্রে জানা যায়, পড়াশুনা যেমন ছেলে-মেয়েদের মানসিক বিকাশ ঘটায়, তেমনি শারীরিক বিকাশ ঘটাতে খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই। এক যুগ আগেও গ্রামাঞ্চলে হা-ডু-ডু, কাবাডি, নৌকাবাইচ, কানামাছি, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্দা, বলি খেলা ও লাঠিখেলা ছিল শিশু, কিশোর ও যুবকদের পছন্দের খেলাগুলোর তালিকায়। বিভিন্ন গ্রামে এসব খেলার জমজমাট আয়োজন হতো। এ সমস্ত খেলা দেখার জন্য অনেক দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ দলে দলে এসে উপস্থিত হতো মাঠে। অনেক খেলোয়াড় টাকার বিনিময়েও বিভিন্ন দলের হয়ে খেলত। তাতে করে ভালো খেলায় টাকাসহ নানা রকম পুরস্কার যেমন মিলত, সেই সঙ্গে ভালো খেলোয়াড় হিসেবে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ত এলাকায়। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এসমস্ত খেলোয়াড়দের অনেক সম্মান করত। অতীতের সময়ে প্রতিবছর সব স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাগুলোতে নানা ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করা হতো। বর্তমানে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোনো খেলার মাঠও নেই, আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে মাঠ থাকলেও নেই খেলার প্রতি কোনো আগ্রহ। ফলে খেলাধুলায় উপস্থিতি না থাকায় শিক্ষার্থীদের শারীরিক বিকাশ ঘটছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়ত একেবারেই গ্রামীণ খেলাধুলা আমাদের সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে। পরিণত হবে রূপকথার গল্পে। এ সমস্ত গ্রামীণ খেলাধুলার সঙ্গে রয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষদের নাড়ির সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই তাদের স্মৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমাদের উচিত গ্রামীণ খেলাধুলার আয়োজন করা।
মাদকের ভয়াল গ্রাস থেকে প্রজন্মকে রক্ষা ও গ্রামীণ খেলাধুলাগুলোকে বাঁচাতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি সচেতন ও প্রবীণ খেলাপ্রেমী ব্যক্তিদের। সেই সঙ্গে অভিভাবক থেকে শুরু করে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসতে হবে। নানামুখী উদ্যোগ বৃদ্ধির মাধ্যমেই কেবল অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।