ইপেপার । আজ শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোই চ্যালেঞ্জ

১০ লক্ষ্য-কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ইসি, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার : বিশ্লেষক

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:০৭:১০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪
  • / ৬১ বার পড়া হয়েছে

ষষ্ট উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপে ১৩৯টি উপজেলায় ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়ায় নানামুখী সমালোচনার সম্মুখিন হতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)। সে জন্য ভোটের হার কীভাবে বাড়ানো যায়- তা নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকও করে তারা। এসব বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে মোটামুটি ১০টি পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। এদিকে স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনের সব আয়োজন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করলেও কেন্দ্রে ভোটার আনাকেই প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। উল্লেখ্য, ১৫ বছর আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে তৃতীয় উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। এরপর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬১ শতাংশের মতো। আর ২০১৯ সালে প্রথমবার দলীয় প্রতীকে উপজেলা নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ। এবার প্রথম ধাপে ভোটের হার ৩৬ শতাংশে নেমে এসেছে। পরপর চারটি উপজেলা নির্বাচনে ভোট কমেছে ধারবাহিকভাবে। ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দফায় সব চেয়ে কম (৩৬.০১) ভোট পড়ায় দুশ্চিন্তা বেড়েছেস ইসির। কেন এত কম ভোট পড়ল; তাই নিয়ে চলে বিশ্লেষণ। ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করার কৌশল বের করতে কয়েক দফা বৈঠকে বসে কমিশন। এসব বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। তারই ধারাবাহিকতায় আগামী ২১ মে অনুষ্ঠিতব্য দ্বিতীয় দফায় ১৬১টি উপজেলা ভোট ও পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে অন্তত জাতীয় নির্বাচনের (৪১ দশমিক ৮ শতাংশ) চেয়ে কম ভোট যাতে না পড়ে- সে জন্য ১০ দফা কর্মসূচি নিয়েছে এ সাংবিধানিক সংস্থাটি।
এর মধ্যে রয়েছে- এক. প্রত্যেক নির্বাচন কমিশনার দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত দেড় শতাধিক উপজেলার প্রায় প্রতিটিতে গিয়ে সভা করবেন। সেখানে প্রশাসন এবং প্রার্থী ছাড়াও ভোটারদের অভিযোগ শুনবেন ও ভোটারদের নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে আসার আহ্বান জানাবেন তারা। দ্বিতীয়ত. প্রশাসনকে ভোটকেন্দ্র ও আশপাশের পরিস্থিতি ভোটের উপযোগী বা উৎসবমুখর করার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। তৃতীয়. প্রার্থীরা যাতে আচরণবিধি ভেঙে ভোটারদের ভয়ভীতি না দেখায় বা মন্ত্রী-এমপিরা আচরণবিধি ভেঙে কোনো প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে ভোটারদের চাপে না রাখতে পারেন- সে বিষয়ে বিচারিক ও নির্বাহী ম্যাজিট্রেটরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবেন। চতুর্থ. নির্বাচন উপলক্ষে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও মাস্তান বা সমাজ বিরোধীদের গেপ্তারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পঞ্চম. প্রার্থীদের যে নিজ নিজ সমর্থক ও এলাকার ভোটারদের ভোট দিতে উৎসাহ দেয়ার জন্য বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে- সে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে।
ষষ্ঠ. ভোটের হার বাড়াতে বড় বড় দলগুলো যাতে কেন্দ্রীয়ভাবে স্থানীয় পর্যায়ে নির্দেশনা দেয় এবং অনাকাক্সিক্ষতভাবে এমপি মন্ত্রীরা যাতে ভোটারদের ভয় ভীতি না দেখান- সে বিষয়েও ইসি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান, সংসদের স্পিকার ও মুখ্য সচিব বরাবর চিঠি দিয়েছে। সপ্তম. প্রতিটি উপজেলা নির্বাচনী কর্মকর্তারা মাইক নিয়ে বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে ভোটারদের কেন্দ্রে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। অষ্টম. বিভিন্ন মিডিয়ায় বিজ্ঞাপণ দিয়ে ভোট দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে ইসি। নবম. প্রতিটি উপজেলা এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ব্যানার এবং পোস্টার লাগিয়ে ‘নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে এসে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার’ জন্য আহ্বান জানাচ্ছে স্থানীয় নির্বাচনী অফিস। দশম. নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি ভোটার ও প্রার্থীদের আস্থা ফেরাতে নির্বাচনী এলাকার পরিবেশ সুষ্ঠু রাখা, অনিয়ম বা কারচুপি এড়াতে ভোটের দিন ভোরে কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানো, পর্যাপ্ত পরিমান আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নির্বাহী ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েন করে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা করেছে এ ইসি।
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনার রাশেদা বেগম খুলনার বিভিন্ন উপজেলায় গিয়ে বলেছেন, ভোট পড়ার হার বাড়াতে ভোটারদের কেন্দ্রে এসে তার গণতান্ত্রিক অধিকারে প্রয়োগ করতে হবে। আপনার পছন্দের প্রার্থীতে ভোট দিন। এছাড়া তিনি প্রার্থীদেরও দ্বায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে প্রার্থীদের ভূমিকা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ভোটারদের নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশ দেন তিনি। এমনি করে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর ইসলাম, কমিশনার আহসান হাবিব খান এবং কমিশনার মো. আলমগীর নিজ দ্বায়িত্বে থাকা বিভাগ ও জেলায় ভোট সুষ্ঠু করতে ও ভোটার কেন্দ্রে আনতে বৈঠক করে বেড়াচ্ছেন। যদিও সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল মনে করেন- ভোট কম হলো কি বেশি হলো তা নিয়ে ইসির খুব একটা কিছু করার থাকে না। এটা একেবারেই প্রার্থী ও ভোটারদের নিজস্ব ব্যাপার। তিনি বলেন, ইসি তো ভোটারদের বাড়ি থেকে জোর করে ধরে এনে ভোট দিতে বাধ্য করতে পারে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি যাতে ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট দিয়ে নির্ভয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন; সেটা নিশ্চিত করা। সে অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা তৎপর আছেন। তার সঙ্গে পর্যাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে আছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, কোথাও ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো হলে বা ভোট নিয়ে নিরুসাহিত করলে তাৎক্ষণিক ভাবে সে প্রার্থী বা সমর্থকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াৎ হোসেন মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে এক তরফা ভোট হয়ে চলেছে। তারপর বিএনপির মতো একটি বড় দল নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় ভোটারদের একটা বড় অংশ ভোট দিতে আসবে না- এটাই স্বাভাবিক। আবার ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে একাধিক প্রার্থীর রেষারেষি, ক্ষমতাসীন দলের ২/৩ জন করে প্রার্থী- অথচ উপযুক্ত জনদরদী প্রার্থী নেই। আবার মন্ত্রী এমপিরা তাদের নিজস্ব প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য ভোটারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। এসব যাতাকলে পড়ে অনেক সাধারণ ভোটার ভোট বিমুখ হয়েছেন বা ভোটকেন্দ্রে যেতে ভয় পাচ্ছেন। তাছাড়া ভোটাররা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছেন- ভোট দিয়ে তাদের কোনো লাভ হয় না; প্রার্থীরা সম্পদশালী হচ্ছেন; কিন্তু ভোটারের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। সব মিলিয়ে বর্তমানে যে গণতান্ত্রিক ধারা তা-ও ভোটাদের কেন্দ্রবিমুখ হওয়ার অন্যতম কারণ। এখন কীভাবে কি করলে তারা ভোট দিতে আসবে- সেটা বলা মুশকিল। এটা রাজনৈতিক দলগুলোই ভালো বলতে পারবে।
আরেক সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ মনে করেন, ভোটার কেন্দ্রে না আসাটা ইসি, রাজনীতিবিদ ও সামগ্রিক অর্থে গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে হলে তাদের পছন্দমত প্রার্থী থাকা একটা ফ্যাক্টর। আবার একটি বড় রাজনৈতিক দল বেশ কয়েকটি নির্বাচনে না আসায় ভোটারদের একটা বড় অংশ কেন্দ্রে আসছে না, এটাও সত্য।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটা সার্বিকভাবে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভোট সম্পর্কে ও নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আস্থাহীনতার প্রতিফলন। আমাদের যে নির্বাচনী ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলছে; তাতে ক্রমাগতভাবে ভোটারদের অংশগ্রহণ কমে গেছে। এটা আরো কমতে থাকলে আমাদের যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তা খারাপের দিকে যাবে। এখানে ভোট উৎসবমুখর নেই। এখানে একমাত্র লক্ষ্য থাকে কীভাবে বিজয়ী হওয়া যাবে। নির্বাচনে জনগণের রায়ে পরাজিত হওয়ার বিষয়টি মেনে নেয়ার সংস্কৃতি উঠে গেছে। এতে শুধুমাত্র ভোটারের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হচ্ছে তাই নয়; এর পাশাপাশি ভোটের সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠান জড়িত আছে- যেমন ইসি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সর্বপরি দলগুলো- এরা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এসব কারণে মানুষ মনে করে এতে অনেক নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকে, প্রতিপক্ষের মারামারি, সহিংসতা নির্বাচনে পরবর্তী সময়ে ভোটারদের বাড়িতে হামলা হয়, এসব কারণে অনেক ভোটারা কেন্দ্রমুখী হনই না।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কারণ হিসেবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনে যদি সব রাজনৈতিক দল অংশ নেয় এবং সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ঠিক থাকে- তাহলে ভোটাররা উৎসাহ নিয়ে ভোট দিতে আসবে। তিনি বলেন, এখানে ভুলে গেলে চলবে না, আমরা এমন একটা দেশ- যেখানে ভোটের রায়ের ফলাফলকে প্রতিষ্ঠিত করতেই আমরা একটা দেশকে স্বাধীন করে ফেললাম। ১৯৭০ এর নির্বাচনের রায় পাকিস্তান সরকার মানেনি, আমাদের সরকার গঠন করতে দেয়নি, এর প্রতিবাদ করতে গিয়েই কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয় লাভ। এটা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। আর আজ সেই দেশে ভোটের কোনো মূল্য থাকবে না- সেটা তো হতে পারে না। এ অবস্থা থেকে ফিরতে হলে প্রথম দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর- তাদের সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে। নির্বাচন কমিশন যতই শক্তিশালী হোক নির্বাচনকালীন সরকার ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো যদি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করে; তাহলে ভোটারদের ভোট দিতে আগ্রহী করা যাবে না।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোই চ্যালেঞ্জ

১০ লক্ষ্য-কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ইসি, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার : বিশ্লেষক

আপলোড টাইম : ১০:০৭:১০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪

ষষ্ট উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপে ১৩৯টি উপজেলায় ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়ায় নানামুখী সমালোচনার সম্মুখিন হতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)। সে জন্য ভোটের হার কীভাবে বাড়ানো যায়- তা নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকও করে তারা। এসব বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে মোটামুটি ১০টি পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। এদিকে স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনের সব আয়োজন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করলেও কেন্দ্রে ভোটার আনাকেই প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। উল্লেখ্য, ১৫ বছর আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে তৃতীয় উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। এরপর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬১ শতাংশের মতো। আর ২০১৯ সালে প্রথমবার দলীয় প্রতীকে উপজেলা নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ। এবার প্রথম ধাপে ভোটের হার ৩৬ শতাংশে নেমে এসেছে। পরপর চারটি উপজেলা নির্বাচনে ভোট কমেছে ধারবাহিকভাবে। ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দফায় সব চেয়ে কম (৩৬.০১) ভোট পড়ায় দুশ্চিন্তা বেড়েছেস ইসির। কেন এত কম ভোট পড়ল; তাই নিয়ে চলে বিশ্লেষণ। ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করার কৌশল বের করতে কয়েক দফা বৈঠকে বসে কমিশন। এসব বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। তারই ধারাবাহিকতায় আগামী ২১ মে অনুষ্ঠিতব্য দ্বিতীয় দফায় ১৬১টি উপজেলা ভোট ও পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে অন্তত জাতীয় নির্বাচনের (৪১ দশমিক ৮ শতাংশ) চেয়ে কম ভোট যাতে না পড়ে- সে জন্য ১০ দফা কর্মসূচি নিয়েছে এ সাংবিধানিক সংস্থাটি।
এর মধ্যে রয়েছে- এক. প্রত্যেক নির্বাচন কমিশনার দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত দেড় শতাধিক উপজেলার প্রায় প্রতিটিতে গিয়ে সভা করবেন। সেখানে প্রশাসন এবং প্রার্থী ছাড়াও ভোটারদের অভিযোগ শুনবেন ও ভোটারদের নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে আসার আহ্বান জানাবেন তারা। দ্বিতীয়ত. প্রশাসনকে ভোটকেন্দ্র ও আশপাশের পরিস্থিতি ভোটের উপযোগী বা উৎসবমুখর করার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। তৃতীয়. প্রার্থীরা যাতে আচরণবিধি ভেঙে ভোটারদের ভয়ভীতি না দেখায় বা মন্ত্রী-এমপিরা আচরণবিধি ভেঙে কোনো প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে ভোটারদের চাপে না রাখতে পারেন- সে বিষয়ে বিচারিক ও নির্বাহী ম্যাজিট্রেটরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবেন। চতুর্থ. নির্বাচন উপলক্ষে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও মাস্তান বা সমাজ বিরোধীদের গেপ্তারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পঞ্চম. প্রার্থীদের যে নিজ নিজ সমর্থক ও এলাকার ভোটারদের ভোট দিতে উৎসাহ দেয়ার জন্য বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে- সে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে।
ষষ্ঠ. ভোটের হার বাড়াতে বড় বড় দলগুলো যাতে কেন্দ্রীয়ভাবে স্থানীয় পর্যায়ে নির্দেশনা দেয় এবং অনাকাক্সিক্ষতভাবে এমপি মন্ত্রীরা যাতে ভোটারদের ভয় ভীতি না দেখান- সে বিষয়েও ইসি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান, সংসদের স্পিকার ও মুখ্য সচিব বরাবর চিঠি দিয়েছে। সপ্তম. প্রতিটি উপজেলা নির্বাচনী কর্মকর্তারা মাইক নিয়ে বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে ভোটারদের কেন্দ্রে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। অষ্টম. বিভিন্ন মিডিয়ায় বিজ্ঞাপণ দিয়ে ভোট দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে ইসি। নবম. প্রতিটি উপজেলা এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ব্যানার এবং পোস্টার লাগিয়ে ‘নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে এসে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার’ জন্য আহ্বান জানাচ্ছে স্থানীয় নির্বাচনী অফিস। দশম. নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি ভোটার ও প্রার্থীদের আস্থা ফেরাতে নির্বাচনী এলাকার পরিবেশ সুষ্ঠু রাখা, অনিয়ম বা কারচুপি এড়াতে ভোটের দিন ভোরে কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানো, পর্যাপ্ত পরিমান আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নির্বাহী ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েন করে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা করেছে এ ইসি।
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনার রাশেদা বেগম খুলনার বিভিন্ন উপজেলায় গিয়ে বলেছেন, ভোট পড়ার হার বাড়াতে ভোটারদের কেন্দ্রে এসে তার গণতান্ত্রিক অধিকারে প্রয়োগ করতে হবে। আপনার পছন্দের প্রার্থীতে ভোট দিন। এছাড়া তিনি প্রার্থীদেরও দ্বায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে প্রার্থীদের ভূমিকা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ভোটারদের নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশ দেন তিনি। এমনি করে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর ইসলাম, কমিশনার আহসান হাবিব খান এবং কমিশনার মো. আলমগীর নিজ দ্বায়িত্বে থাকা বিভাগ ও জেলায় ভোট সুষ্ঠু করতে ও ভোটার কেন্দ্রে আনতে বৈঠক করে বেড়াচ্ছেন। যদিও সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল মনে করেন- ভোট কম হলো কি বেশি হলো তা নিয়ে ইসির খুব একটা কিছু করার থাকে না। এটা একেবারেই প্রার্থী ও ভোটারদের নিজস্ব ব্যাপার। তিনি বলেন, ইসি তো ভোটারদের বাড়ি থেকে জোর করে ধরে এনে ভোট দিতে বাধ্য করতে পারে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি যাতে ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট দিয়ে নির্ভয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন; সেটা নিশ্চিত করা। সে অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা তৎপর আছেন। তার সঙ্গে পর্যাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে আছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, কোথাও ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো হলে বা ভোট নিয়ে নিরুসাহিত করলে তাৎক্ষণিক ভাবে সে প্রার্থী বা সমর্থকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াৎ হোসেন মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে এক তরফা ভোট হয়ে চলেছে। তারপর বিএনপির মতো একটি বড় দল নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় ভোটারদের একটা বড় অংশ ভোট দিতে আসবে না- এটাই স্বাভাবিক। আবার ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে একাধিক প্রার্থীর রেষারেষি, ক্ষমতাসীন দলের ২/৩ জন করে প্রার্থী- অথচ উপযুক্ত জনদরদী প্রার্থী নেই। আবার মন্ত্রী এমপিরা তাদের নিজস্ব প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য ভোটারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। এসব যাতাকলে পড়ে অনেক সাধারণ ভোটার ভোট বিমুখ হয়েছেন বা ভোটকেন্দ্রে যেতে ভয় পাচ্ছেন। তাছাড়া ভোটাররা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছেন- ভোট দিয়ে তাদের কোনো লাভ হয় না; প্রার্থীরা সম্পদশালী হচ্ছেন; কিন্তু ভোটারের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। সব মিলিয়ে বর্তমানে যে গণতান্ত্রিক ধারা তা-ও ভোটাদের কেন্দ্রবিমুখ হওয়ার অন্যতম কারণ। এখন কীভাবে কি করলে তারা ভোট দিতে আসবে- সেটা বলা মুশকিল। এটা রাজনৈতিক দলগুলোই ভালো বলতে পারবে।
আরেক সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ মনে করেন, ভোটার কেন্দ্রে না আসাটা ইসি, রাজনীতিবিদ ও সামগ্রিক অর্থে গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে হলে তাদের পছন্দমত প্রার্থী থাকা একটা ফ্যাক্টর। আবার একটি বড় রাজনৈতিক দল বেশ কয়েকটি নির্বাচনে না আসায় ভোটারদের একটা বড় অংশ কেন্দ্রে আসছে না, এটাও সত্য।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটা সার্বিকভাবে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভোট সম্পর্কে ও নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আস্থাহীনতার প্রতিফলন। আমাদের যে নির্বাচনী ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলছে; তাতে ক্রমাগতভাবে ভোটারদের অংশগ্রহণ কমে গেছে। এটা আরো কমতে থাকলে আমাদের যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তা খারাপের দিকে যাবে। এখানে ভোট উৎসবমুখর নেই। এখানে একমাত্র লক্ষ্য থাকে কীভাবে বিজয়ী হওয়া যাবে। নির্বাচনে জনগণের রায়ে পরাজিত হওয়ার বিষয়টি মেনে নেয়ার সংস্কৃতি উঠে গেছে। এতে শুধুমাত্র ভোটারের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হচ্ছে তাই নয়; এর পাশাপাশি ভোটের সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠান জড়িত আছে- যেমন ইসি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সর্বপরি দলগুলো- এরা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এসব কারণে মানুষ মনে করে এতে অনেক নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকে, প্রতিপক্ষের মারামারি, সহিংসতা নির্বাচনে পরবর্তী সময়ে ভোটারদের বাড়িতে হামলা হয়, এসব কারণে অনেক ভোটারা কেন্দ্রমুখী হনই না।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কারণ হিসেবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনে যদি সব রাজনৈতিক দল অংশ নেয় এবং সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ঠিক থাকে- তাহলে ভোটাররা উৎসাহ নিয়ে ভোট দিতে আসবে। তিনি বলেন, এখানে ভুলে গেলে চলবে না, আমরা এমন একটা দেশ- যেখানে ভোটের রায়ের ফলাফলকে প্রতিষ্ঠিত করতেই আমরা একটা দেশকে স্বাধীন করে ফেললাম। ১৯৭০ এর নির্বাচনের রায় পাকিস্তান সরকার মানেনি, আমাদের সরকার গঠন করতে দেয়নি, এর প্রতিবাদ করতে গিয়েই কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয় লাভ। এটা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। আর আজ সেই দেশে ভোটের কোনো মূল্য থাকবে না- সেটা তো হতে পারে না। এ অবস্থা থেকে ফিরতে হলে প্রথম দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর- তাদের সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে। নির্বাচন কমিশন যতই শক্তিশালী হোক নির্বাচনকালীন সরকার ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো যদি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করে; তাহলে ভোটারদের ভোট দিতে আগ্রহী করা যাবে না।