ইপেপার । আজ শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

প্যারাসিটামলের সরবরাহ নেই হাসপাতালে

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:২৩:১৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২২
  • / ৩৩ বার পড়া হয়েছে

চুয়াডাঙ্গা জেলজুড়ে প্রতিনিয়ত বাড়ছে জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

চুয়াডাঙ্গায় করোনাভাইরাস শনাক্তের হার বেড়েই চলেছে। এ পরিস্থিতিতে চুয়াডাঙ্গার অনেক ঘরই যেন জ্বর-সর্দিতে হাসপাতাল ও ওষুধের ফার্মেসিতে পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়মিত করোনা আক্রান্তের যে সংখ্যা জানাচ্ছে, বাস্তব পরিস্থিতি তার থেকেও বেশি ভয়াবহ। করোনা পরীক্ষায় মানুষের অনাগ্রহ এবং সংক্রমিতদের কোনো ব্যবস্থাপনায় না রাখাকে লাগামহীন সংক্রমণের কারণ হিসেবে দায়ী করছেন তারা।

এদিকে, হাসপাতালে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ঠাণ্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা। গতকাল রোববার এক দিনে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শুধুমাত্র বর্হিঃবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৭৯০ জন নারী-পুরুষ ও শিশু রোগী। এর মধ্যে বেশিরভাগ রোগীই ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ শেষ হতে না হতেই হাসপাতালের বর্হিঃবিভাগে ফুরিয়ে গেছে নাপা, প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ। ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অনেকেই প্যারাসিটামল ওষুধের জন্য হাসপাতালে এলেও খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে তাদের।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গতকাল চুয়াডাঙ্গায় ২৪৯টি নমুনার র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করে ৩২টি নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়েছে। নতুন আক্রান্ত ৩২ জনের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ৩ জন, আলমডাঙ্গা উপজেলার ১০ জন, জীবননগর উপজেলার ১২ জন ও দামুড়হুদা উপজেলার ৭ জন রয়েছে। নতুন আক্রান্ত প্রত্যেকেই হোম আইসোলেশনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গতকাল চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের রেড জোনে করোনা আক্রান্ত দুজন ও ইয়োলো জোনে ৯ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন। এদিন রেড জোন থেকে সুস্থ হয়েছেন ৭ জন। এর মধ্যে ভারত ফেরত ৬ জন ও স্থানীয় একজন ছিলেন।

অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞদের মতে জেলায় করোনা আক্রান্তের হার অনেক বেশি। শতকরা ৯৫ শতাংশ মানুষ ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হলেও শুধুমাত্র ঠাণ্ডাজনিত রোগের ওষুধ সেবন করছেন। এই বিপুল পরিমাণ আক্রান্তের সংখ্যা অগোচরে থেকে যাচ্ছে। যে কারণে হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগী বা উপসর্গ নিয়ে আক্রান্ত রোগীর চাপ কম।

চুয়াডাঙ্গা পৌর শহরের বাসিন্দা আলমগীর হোসেন বলেন, গত নভেম্বর মাসে করোনা টিকার দ্বিতীয় ডোজ সম্পন্ন করেছেন তিনি। তবে গত এক সপ্তাহ ধরে তিনি সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত। সঙ্গে কাঁশি থাকায় গলার স্বরও অনেকটা ভেঙে গেছে। তিনি শুধু নিজেই অসুস্থ নন, তাঁর পরিবারের আরও দুই সদস্যও পর্যায়ক্রমে জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হয়েছেন। তার প্রতিবেশী আমির হোসেনও করোনার দুই ডোজ টিকা গ্রহণ করেছেন। তিনিও ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হয়ে নিজ বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এবার শীত আসার পর থেকেই নিজ বাড়িতে ঠাণ্ডা জ্বরের নাপা, প্যারাসিটামলসহ নানা ধরণের ওষুধ কিনে রাখা রয়েছে। চিকিৎসক তাঁদেরকে করোনা পরীক্ষার কথা বললেও তাঁরা কেউই নমুনা দেননি। ফার্মেসি থেকে ঠাণ্ডা-জ্বরের ওষুধ কিনে সেবন করছেন।

শুধুমাত্র আলমগীর হোসেন ও তাঁর প্রতিবেশীই নয়, চুয়াডাঙ্গা শহরসহ এমন আরও অনেক পরিবার আছে, যাদের একাধিক সদস্য জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত। হাসপাতালের বর্হিঃবিভাগ থেকে চিকিৎসা নিলেও কেউই ভর্তি হতে চাচ্ছেন না। পরীক্ষাও করাচ্ছেন না তাঁদের নমুনা। তাদের ঘর এখন যেন একরকম হাসপাতাল ও ফার্মেসিতে পরিণত হয়েছে। শুধু শহরাঞ্চলই নয় জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও গ্রাম এলাকায় জ্বর-সর্দিতে আক্রান্তের হারও যেন প্রতি ঘরে ঘরে। হাসপাতালে গিয়ে অন্যান্য রোগীদের সঙ্গে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে করোনা পরীক্ষা করাকে করোনার ঝুঁকি বলেও মনে করছেন তাঁরা। আবার অনেকে করোনা পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব আছে সেটাই যেন মানতে চাচ্ছেন না।

গত এক সপ্তাহ ধরে করোনার উপসর্গ ঠাণ্ডা, জ্বর, কাঁশি বয়ে বেড়ালেও করোনা পরীক্ষা না করার কারণ হিসেবে আলমগীর হোসনে বলেন, ‘দুইটা টিকা দিয়েছি, শীতের সময় ঠাণ্ডা-জ্বর এমনিতেই হয়। আমার পরিবার সদস্যরা এটিকে সাধারণ সর্দি-জ্বর হিসেবেই নিয়েছে। বাড়িতে ঠাণ্ডা জ্বরের ওষুধ রয়েছে, সেগুলোই তিন বেল খাচ্ছি। আশা করছি কয়েকদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠব। আবার হাসপাতালে করোনা রোগীর ছড়াছড়ি, যে কারণে করোনা পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে যেতেও চাচ্ছি না।’

অপর দিকে, নাজমা বেগম নামের এক রোগী ফ্লু কর্নার থেকে চিকিৎসা নিয়ে ওষুধ কাউন্টারের সামনে ওষুধ হাতে বিরক্তি নিয়েই কথা বলছিলেন। কেন বিরক্তিত আর হাতে কীসের ওষুধ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কয়েকদিন ধরে তিনি ও তাঁর স্বামী ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত। দুজনেই হাসপাতালে এসেছেন ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ নিতে। বাড়িতে প্যারাসিটামল ফুরিয়ে গেছে। ভেবেছিলেন হাসপাতাল থেকে প্যারাসিটামল নিয়ে যাবেন। কিন্তু ডাক্তার প্যারাসিটামল ওষুধ দেয়নি। হাসপাতালে নাকি প্যারাসিটামল ফুরিয়ে গেছে।

এ জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি হাসপাতাল চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল। নতুন বছরের শুরু থেকেই এ হাসপাতালে জ্বর-সর্দিসহ করোনা উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গতকাল হাসপাতালের বর্হিঃবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৭৯০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৩৫৫ জন, নারী ২৫৬ জন ও শিশু ১৭২ জন।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ফ্লু কর্নারের একজন চিকিৎসক বলেন, ‘সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রোগী দেখেও রোগীর সিরিয়াল শেষ করা যাচ্ছে না। প্রত্যেকেই ঠাণ্ড-জ্বর কাঁশিসহ ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসছেন। এদের মধ্যে কোন রোগীর শরীরে করোনাভাইরাস আছে আর কোন রোগীর শরীরে নেই, তা বলাও যাচ্ছে না। প্রত্যেকেরই একই রকম উপসর্গ। রোগীদের করোনা পরীক্ষার কথা বললেই তারা অনিচ্ছা প্রকাশ করছেন। শুধুমাত্র ওষুধ লিখে দিখে দিতে বলছেন। আমরা যতটা সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছি। রোগীদরা চেম্বারে প্রবেশের পূর্বে মাস্ক পরলেও বাইরে গেলে আর মাস্ক রাখছেন না। প্রতিদিন যে পরিমাণ রোগী হাপসাতালের ফ্লু কর্নারে চিকিৎসা নিতে আসছেন, তাদের মধ্যে যদি শতকরা পাঁচজন রোগীর শরীরে করোনাভাইরাস থাকে, তবে খুব দ্রুতই করোনা মহামারি পূর্বেও থেকেও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।’

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. এ এস এম ফাতেহ আকরাম বলেন, ‘হাপসাতালের বর্হিঃবিভাগে প্রতিনিয়ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত শনিবার বর্হিঃবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫৯৫ জন। এক দিনের ব্যবধানে আজ (গতকাল রোববার) বর্হিঃবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৭৯০ জন। শনিবারের থেকে মাত্র এক দিনের ব্যবধানে হাসপাতালের বর্হিঃবিভাগে রোগী বেড়েছে দুই শতাধিক। শুধুমাত্র বর্হিঃবিভাগেই নয়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগেও রোগীর চাপ বাড়ছে। এদের মধ্যে সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যায় এক বেশি। এসব রোগীর মধ্যে যারা নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন, তাদের মধ্যে থেকে অনেকের নমুনাতে করোনাভাইরাস শনাক্ত হচ্ছে। কিন্তু জটিলতা কম থাকায়  হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা খুবই কম। বর্তমানে সদর হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ৯ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত দুইজন রেড জোনে ও করোনা উপসর্গ নিয়ে ইয়োলো রোগী ভর্তি আছেন সাতজন। তাদের মধ্যে উপসর্গ নিয়ে ইয়োলো জোনে নতুন দুজন ও বাকিরা আগে থেকেই ভর্তি ছিলেন।’

হাসপাতালের বর্হিঃবিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ঠাণ্ডা-জ্বরের ওষুধ প্যারাসিটামল না দেওয়ার পেছনের কারণ জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ঠাণ্ডা-জ্বরের ওষুধ প্যারাসিটামল সাপ্লাই থাকলেও তা শেষ হয়ে গেছে। তবে হাসপাতালের অন্ত বিভাগে এ ধরণের ওষুধ এখনও সাপ্লাই রয়েছে। এই ধরণের ফ্লু জাতীয় রোগের অন্যান্য ওষুধ রোগীদের দেওয়া হচ্ছে।’

এসময় ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত রোগীসহ সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে সর্তকতার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, কোনো রোগীর যদি শুধুমাত্র সর্দি-জ্বর বা কাঁশি থাকে, তাহলে ভয় কম। যদি মাত্রাতিরিক্ত জ্বর, গলাব্যথা বা শ্বাসকষ্ট থাকে, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপণ্ন হতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। অন্যথায়, বাসায় থেকে টেলিমেডিসিন সেবা নিতে হবে। সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বাসায় থাকলেও আইসোলেটেড থাকতে হবে। বাইরে একেবারে ঘোরাফেরা করা যাবে না। আশা করি, আক্রান্তরা চার-পাঁচ দিন বা এক সপ্তাহের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবেন। তবে শ্বাসকষ্ট বা অন্য কোনো সমস্যা হলেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. আওলিয়ার রহমান (এমওডিসি) বলেন, বর্তমান সময়ে ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার অনেকটাই কম। বেশিরভাগ রোগীরাই ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হয়েও ঘরে বসেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। সেটাও করা যায় তবে সে ক্ষেত্রে ঘরে বসে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য আলাদা গাইডলাইন তৈরি করা প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে যত গাইডলাইন তৈরি হয়েছে, সবই হাসপাতালভিত্তিক। কিন্তু মানুষ ঘরে বসেও কীভাবে চিকিৎসা নিতে পারেন, সে সংক্রান্ত কোনো গাইডলাইন নেই।’ তিনি আরও বলেন, বর্তমানে করোনা সংক্রমণ পূর্বের ন্যায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তবে আতঙ্কের বিষয় হলো বর্তমানে যেন প্রতি ঘরে ঘরেই মানুষ সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। এদের মধ্যে কারও শরীরে করোনাভাইরাস আছে কী না, তা জানার চেষ্টাও করা হচ্ছে না। যে কারণে তারা করোনা পরীক্ষাও করাচ্ছেন না। আর করোনা সংক্রমণ প্রমাণিত না হওয়ায় তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করছেন এবং স্বাভাবিকভাবেই মেলামেশা করছেন। ফলে সহজেই করোনা একজন থেকে আরেকজনে দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাই সংক্রমিত মানুষদের সরকারি উদ্যোগে একটি ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসা উচিত। একইসঙ্গে করোনা পরীক্ষাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও সহজলভ্য করা উচিত।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

প্যারাসিটামলের সরবরাহ নেই হাসপাতালে

আপলোড টাইম : ০৯:২৩:১৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২২

চুয়াডাঙ্গা জেলজুড়ে প্রতিনিয়ত বাড়ছে জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

চুয়াডাঙ্গায় করোনাভাইরাস শনাক্তের হার বেড়েই চলেছে। এ পরিস্থিতিতে চুয়াডাঙ্গার অনেক ঘরই যেন জ্বর-সর্দিতে হাসপাতাল ও ওষুধের ফার্মেসিতে পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়মিত করোনা আক্রান্তের যে সংখ্যা জানাচ্ছে, বাস্তব পরিস্থিতি তার থেকেও বেশি ভয়াবহ। করোনা পরীক্ষায় মানুষের অনাগ্রহ এবং সংক্রমিতদের কোনো ব্যবস্থাপনায় না রাখাকে লাগামহীন সংক্রমণের কারণ হিসেবে দায়ী করছেন তারা।

এদিকে, হাসপাতালে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ঠাণ্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা। গতকাল রোববার এক দিনে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শুধুমাত্র বর্হিঃবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৭৯০ জন নারী-পুরুষ ও শিশু রোগী। এর মধ্যে বেশিরভাগ রোগীই ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ শেষ হতে না হতেই হাসপাতালের বর্হিঃবিভাগে ফুরিয়ে গেছে নাপা, প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ। ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অনেকেই প্যারাসিটামল ওষুধের জন্য হাসপাতালে এলেও খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে তাদের।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গতকাল চুয়াডাঙ্গায় ২৪৯টি নমুনার র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করে ৩২টি নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়েছে। নতুন আক্রান্ত ৩২ জনের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ৩ জন, আলমডাঙ্গা উপজেলার ১০ জন, জীবননগর উপজেলার ১২ জন ও দামুড়হুদা উপজেলার ৭ জন রয়েছে। নতুন আক্রান্ত প্রত্যেকেই হোম আইসোলেশনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গতকাল চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের রেড জোনে করোনা আক্রান্ত দুজন ও ইয়োলো জোনে ৯ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন। এদিন রেড জোন থেকে সুস্থ হয়েছেন ৭ জন। এর মধ্যে ভারত ফেরত ৬ জন ও স্থানীয় একজন ছিলেন।

অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞদের মতে জেলায় করোনা আক্রান্তের হার অনেক বেশি। শতকরা ৯৫ শতাংশ মানুষ ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হলেও শুধুমাত্র ঠাণ্ডাজনিত রোগের ওষুধ সেবন করছেন। এই বিপুল পরিমাণ আক্রান্তের সংখ্যা অগোচরে থেকে যাচ্ছে। যে কারণে হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগী বা উপসর্গ নিয়ে আক্রান্ত রোগীর চাপ কম।

চুয়াডাঙ্গা পৌর শহরের বাসিন্দা আলমগীর হোসেন বলেন, গত নভেম্বর মাসে করোনা টিকার দ্বিতীয় ডোজ সম্পন্ন করেছেন তিনি। তবে গত এক সপ্তাহ ধরে তিনি সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত। সঙ্গে কাঁশি থাকায় গলার স্বরও অনেকটা ভেঙে গেছে। তিনি শুধু নিজেই অসুস্থ নন, তাঁর পরিবারের আরও দুই সদস্যও পর্যায়ক্রমে জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হয়েছেন। তার প্রতিবেশী আমির হোসেনও করোনার দুই ডোজ টিকা গ্রহণ করেছেন। তিনিও ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হয়ে নিজ বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এবার শীত আসার পর থেকেই নিজ বাড়িতে ঠাণ্ডা জ্বরের নাপা, প্যারাসিটামলসহ নানা ধরণের ওষুধ কিনে রাখা রয়েছে। চিকিৎসক তাঁদেরকে করোনা পরীক্ষার কথা বললেও তাঁরা কেউই নমুনা দেননি। ফার্মেসি থেকে ঠাণ্ডা-জ্বরের ওষুধ কিনে সেবন করছেন।

শুধুমাত্র আলমগীর হোসেন ও তাঁর প্রতিবেশীই নয়, চুয়াডাঙ্গা শহরসহ এমন আরও অনেক পরিবার আছে, যাদের একাধিক সদস্য জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত। হাসপাতালের বর্হিঃবিভাগ থেকে চিকিৎসা নিলেও কেউই ভর্তি হতে চাচ্ছেন না। পরীক্ষাও করাচ্ছেন না তাঁদের নমুনা। তাদের ঘর এখন যেন একরকম হাসপাতাল ও ফার্মেসিতে পরিণত হয়েছে। শুধু শহরাঞ্চলই নয় জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও গ্রাম এলাকায় জ্বর-সর্দিতে আক্রান্তের হারও যেন প্রতি ঘরে ঘরে। হাসপাতালে গিয়ে অন্যান্য রোগীদের সঙ্গে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে করোনা পরীক্ষা করাকে করোনার ঝুঁকি বলেও মনে করছেন তাঁরা। আবার অনেকে করোনা পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব আছে সেটাই যেন মানতে চাচ্ছেন না।

গত এক সপ্তাহ ধরে করোনার উপসর্গ ঠাণ্ডা, জ্বর, কাঁশি বয়ে বেড়ালেও করোনা পরীক্ষা না করার কারণ হিসেবে আলমগীর হোসনে বলেন, ‘দুইটা টিকা দিয়েছি, শীতের সময় ঠাণ্ডা-জ্বর এমনিতেই হয়। আমার পরিবার সদস্যরা এটিকে সাধারণ সর্দি-জ্বর হিসেবেই নিয়েছে। বাড়িতে ঠাণ্ডা জ্বরের ওষুধ রয়েছে, সেগুলোই তিন বেল খাচ্ছি। আশা করছি কয়েকদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠব। আবার হাসপাতালে করোনা রোগীর ছড়াছড়ি, যে কারণে করোনা পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে যেতেও চাচ্ছি না।’

অপর দিকে, নাজমা বেগম নামের এক রোগী ফ্লু কর্নার থেকে চিকিৎসা নিয়ে ওষুধ কাউন্টারের সামনে ওষুধ হাতে বিরক্তি নিয়েই কথা বলছিলেন। কেন বিরক্তিত আর হাতে কীসের ওষুধ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কয়েকদিন ধরে তিনি ও তাঁর স্বামী ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত। দুজনেই হাসপাতালে এসেছেন ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ নিতে। বাড়িতে প্যারাসিটামল ফুরিয়ে গেছে। ভেবেছিলেন হাসপাতাল থেকে প্যারাসিটামল নিয়ে যাবেন। কিন্তু ডাক্তার প্যারাসিটামল ওষুধ দেয়নি। হাসপাতালে নাকি প্যারাসিটামল ফুরিয়ে গেছে।

এ জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি হাসপাতাল চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল। নতুন বছরের শুরু থেকেই এ হাসপাতালে জ্বর-সর্দিসহ করোনা উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গতকাল হাসপাতালের বর্হিঃবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৭৯০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৩৫৫ জন, নারী ২৫৬ জন ও শিশু ১৭২ জন।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ফ্লু কর্নারের একজন চিকিৎসক বলেন, ‘সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রোগী দেখেও রোগীর সিরিয়াল শেষ করা যাচ্ছে না। প্রত্যেকেই ঠাণ্ড-জ্বর কাঁশিসহ ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসছেন। এদের মধ্যে কোন রোগীর শরীরে করোনাভাইরাস আছে আর কোন রোগীর শরীরে নেই, তা বলাও যাচ্ছে না। প্রত্যেকেরই একই রকম উপসর্গ। রোগীদের করোনা পরীক্ষার কথা বললেই তারা অনিচ্ছা প্রকাশ করছেন। শুধুমাত্র ওষুধ লিখে দিখে দিতে বলছেন। আমরা যতটা সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছি। রোগীদরা চেম্বারে প্রবেশের পূর্বে মাস্ক পরলেও বাইরে গেলে আর মাস্ক রাখছেন না। প্রতিদিন যে পরিমাণ রোগী হাপসাতালের ফ্লু কর্নারে চিকিৎসা নিতে আসছেন, তাদের মধ্যে যদি শতকরা পাঁচজন রোগীর শরীরে করোনাভাইরাস থাকে, তবে খুব দ্রুতই করোনা মহামারি পূর্বেও থেকেও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।’

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. এ এস এম ফাতেহ আকরাম বলেন, ‘হাপসাতালের বর্হিঃবিভাগে প্রতিনিয়ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত শনিবার বর্হিঃবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫৯৫ জন। এক দিনের ব্যবধানে আজ (গতকাল রোববার) বর্হিঃবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৭৯০ জন। শনিবারের থেকে মাত্র এক দিনের ব্যবধানে হাসপাতালের বর্হিঃবিভাগে রোগী বেড়েছে দুই শতাধিক। শুধুমাত্র বর্হিঃবিভাগেই নয়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগেও রোগীর চাপ বাড়ছে। এদের মধ্যে সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যায় এক বেশি। এসব রোগীর মধ্যে যারা নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন, তাদের মধ্যে থেকে অনেকের নমুনাতে করোনাভাইরাস শনাক্ত হচ্ছে। কিন্তু জটিলতা কম থাকায়  হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা খুবই কম। বর্তমানে সদর হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ৯ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত দুইজন রেড জোনে ও করোনা উপসর্গ নিয়ে ইয়োলো রোগী ভর্তি আছেন সাতজন। তাদের মধ্যে উপসর্গ নিয়ে ইয়োলো জোনে নতুন দুজন ও বাকিরা আগে থেকেই ভর্তি ছিলেন।’

হাসপাতালের বর্হিঃবিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ঠাণ্ডা-জ্বরের ওষুধ প্যারাসিটামল না দেওয়ার পেছনের কারণ জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ঠাণ্ডা-জ্বরের ওষুধ প্যারাসিটামল সাপ্লাই থাকলেও তা শেষ হয়ে গেছে। তবে হাসপাতালের অন্ত বিভাগে এ ধরণের ওষুধ এখনও সাপ্লাই রয়েছে। এই ধরণের ফ্লু জাতীয় রোগের অন্যান্য ওষুধ রোগীদের দেওয়া হচ্ছে।’

এসময় ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত রোগীসহ সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে সর্তকতার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, কোনো রোগীর যদি শুধুমাত্র সর্দি-জ্বর বা কাঁশি থাকে, তাহলে ভয় কম। যদি মাত্রাতিরিক্ত জ্বর, গলাব্যথা বা শ্বাসকষ্ট থাকে, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপণ্ন হতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। অন্যথায়, বাসায় থেকে টেলিমেডিসিন সেবা নিতে হবে। সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বাসায় থাকলেও আইসোলেটেড থাকতে হবে। বাইরে একেবারে ঘোরাফেরা করা যাবে না। আশা করি, আক্রান্তরা চার-পাঁচ দিন বা এক সপ্তাহের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবেন। তবে শ্বাসকষ্ট বা অন্য কোনো সমস্যা হলেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. আওলিয়ার রহমান (এমওডিসি) বলেন, বর্তমান সময়ে ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার অনেকটাই কম। বেশিরভাগ রোগীরাই ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হয়েও ঘরে বসেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। সেটাও করা যায় তবে সে ক্ষেত্রে ঘরে বসে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য আলাদা গাইডলাইন তৈরি করা প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে যত গাইডলাইন তৈরি হয়েছে, সবই হাসপাতালভিত্তিক। কিন্তু মানুষ ঘরে বসেও কীভাবে চিকিৎসা নিতে পারেন, সে সংক্রান্ত কোনো গাইডলাইন নেই।’ তিনি আরও বলেন, বর্তমানে করোনা সংক্রমণ পূর্বের ন্যায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তবে আতঙ্কের বিষয় হলো বর্তমানে যেন প্রতি ঘরে ঘরেই মানুষ সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। এদের মধ্যে কারও শরীরে করোনাভাইরাস আছে কী না, তা জানার চেষ্টাও করা হচ্ছে না। যে কারণে তারা করোনা পরীক্ষাও করাচ্ছেন না। আর করোনা সংক্রমণ প্রমাণিত না হওয়ায় তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করছেন এবং স্বাভাবিকভাবেই মেলামেশা করছেন। ফলে সহজেই করোনা একজন থেকে আরেকজনে দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাই সংক্রমিত মানুষদের সরকারি উদ্যোগে একটি ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসা উচিত। একইসঙ্গে করোনা পরীক্ষাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও সহজলভ্য করা উচিত।