ইপেপার । আজ সোমবার, ২১ অক্টোবর ২০২৪

ইটভাটায় পুড়ছে কাঠ, ভুগছে মানুষ

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১২:৩১:২৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ নভেম্বর ২০২২
  • / ২৪ বার পড়া হয়েছে

জীবননগর অফিস:
জীবননগরে সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে চলছে ইটভাটা। অধিকাংশ ইটভাটা পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অদূরে ও ফসলি জমিতে স্থাপন করা হয়েছে। ইটভাটায় প্রকাশ্যে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ, যার ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ ও ধ্বংস হচ্ছে বনজ সম্পদ। জীবননগর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত ২৫টি ইটের ভাটা গড়ে উঠেছে। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে পরিবেশ ও সাধারণ মানুষ।

জীবননগর উপজেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য মতে, এই উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় মোট ২৫টি ইটভাটা রয়েছে। যার মধ্যে পাঁচটি ইটের ভাটায় কয়লা পোড়ানো হলেও অন্য ২০টি ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষিজমির মাটি। ফলে একদিকে নির্বিচারে উজাড় হচ্ছে বন, অন্যদিকে উর্বরতা হারিয়ে চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে কৃষিজমি।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রন) আইন ২০১৩-তে বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা, পৌরসভা, বন, বাগান ও কৃষিজমিতে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। তবে আইনের তোয়াক্কা না করেই জীবননগর উপজেলার রায়পুর গ্রামের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে এসটিএইচবি ব্রিকস, জীবননগর পৌরসভার মধ্যে সীমান্ত ইটভাটা, মনোহরপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত জীবননগর কারিগরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে মের্সাস মা-বাবা ব্রিকসসহ একাধিক ইটভাটা চলছে বহাল তবিয়তে।

জানা যায়, সাধারণত মধ্যম সারির একটি ইটভাটায় বছরে ৪৫ থেকে ৬০ লাখ ইট পোড়ানো হয়। আর প্রতি ৮ হাজার ইটের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয় এক হাজার ঘনফুট মাটি। প্রতিটি ইটভাটায় বছরে পাঁচ থেকে ছয় একর জমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহার করা হয় এবং প্রতিটি ইটভাটায় দৈনিক গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ মণ কাঠ পোড়ানো হয়। সে হিসেবে ২০টি ইটভাটায় প্রতিদিন ৮ শ মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৯ সালের পর থেকে জীবননগর উপজেলায় অবস্থিত ২৫টি ইটভাটার মধ্যে কোনোটির লাইসেন্স এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের নবায়ন নেই।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন ইটভাটায় আম, জাম, কাঠাল, রেন্ট্রি, খেজুরসহ একাধিক প্রজাতির ফলজ ও বনজ গাছ পোড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭-এর ৭ ধারা অনুযায়ী কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানোকে অবৈধ ঘোষণা করা হলেও সে আইন মানছে জীবননগর উপজেলার ইটভাটার মালিকগণ।

এদিকে, খড়ির চেয়ে কয়লার দাম বেশি হওয়ায় গত বছরের তুলনায় এ বছর ২৫ হাজার ৫ শ টাকা গাড়ি হিসেবে ইট বিক্রয় করছেন বিবিএম ব্রিকস। যার ফলে ইট সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। উপজেলার রায়পুর গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস নামের এক বৃদ্ধ অভিযোগ করে বলেন, ‘রায়পুরে গ্রামের মধ্যে রফিকুল ইটভাটা স্থাপন করায় আমরা চরম বিপাকে আছি। ইটভাটার গাড়ির কারণে বাইরে বের হওয়া যায় না, ভাটার কালো ধোয়ায় পরিবেশ দূষণসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে গ্রামবাসীর।’ নারায়ণপুর গ্রামের আক্কাচ আলী নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘পৌরসভার শেষ সীমানায় সীমান্ত ইটভাটা নামে যে ভাটাটি গড়ে উঠেছে, প্রশাসন কীভাবে তার অনুমোদন দিয়েছে, আমাদের জানা নেই। এই ভাটার চারিদিকে চাষাবাদ হয়। ভাটার কারণে এলাকার কৃষকরা চরম বিপাকে আছে। তাছাড়া এই ভাটায় প্রতিদিন বিভিন্ন প্রজাতির গাছ পোড়ানো হচ্ছে। যার ফলে এই এলাকার বিভিন্ন ফলজ ও বনজ গাছ কাটা পড়ছে। এ বিষয়ে প্রশাসন ব্যবস্থা না নিলে পরিবেশের চরম ক্ষতি হবে।’

জীবননগর উপজেলা কৃষি অফিসার মোছা. শারমিন আক্তার বলেন, ‘ইটভাটার বিষাক্ত ধোয়ায় ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। খেতের পাশে ইটভাটা গড়ে ওঠায় আগের তুলনায় ফসল উৎপাদন কমে গেছে। সরকার ফসলি জমির ওপর ইটভাটা স্থাপন রোধে ব্যবস্থা না নিলে এসব জমির উৎপাদন শূন্যে নেমে আসবে।’
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মো. আমিনুল ইসলাম খান বলেন, ‘ইটভাটা স্থাপন করার জন্য একটি আইন আছে, সে আইন মেনে ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। আইন অমান্য করে গড়ে ওঠা সকল ইটভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে দ্রত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

ইটভাটায় পুড়ছে কাঠ, ভুগছে মানুষ

আপলোড টাইম : ১২:৩১:২৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ নভেম্বর ২০২২

জীবননগর অফিস:
জীবননগরে সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে চলছে ইটভাটা। অধিকাংশ ইটভাটা পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অদূরে ও ফসলি জমিতে স্থাপন করা হয়েছে। ইটভাটায় প্রকাশ্যে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ, যার ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ ও ধ্বংস হচ্ছে বনজ সম্পদ। জীবননগর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত ২৫টি ইটের ভাটা গড়ে উঠেছে। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে পরিবেশ ও সাধারণ মানুষ।

জীবননগর উপজেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য মতে, এই উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় মোট ২৫টি ইটভাটা রয়েছে। যার মধ্যে পাঁচটি ইটের ভাটায় কয়লা পোড়ানো হলেও অন্য ২০টি ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষিজমির মাটি। ফলে একদিকে নির্বিচারে উজাড় হচ্ছে বন, অন্যদিকে উর্বরতা হারিয়ে চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে কৃষিজমি।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রন) আইন ২০১৩-তে বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা, পৌরসভা, বন, বাগান ও কৃষিজমিতে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। তবে আইনের তোয়াক্কা না করেই জীবননগর উপজেলার রায়পুর গ্রামের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে এসটিএইচবি ব্রিকস, জীবননগর পৌরসভার মধ্যে সীমান্ত ইটভাটা, মনোহরপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত জীবননগর কারিগরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে মের্সাস মা-বাবা ব্রিকসসহ একাধিক ইটভাটা চলছে বহাল তবিয়তে।

জানা যায়, সাধারণত মধ্যম সারির একটি ইটভাটায় বছরে ৪৫ থেকে ৬০ লাখ ইট পোড়ানো হয়। আর প্রতি ৮ হাজার ইটের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয় এক হাজার ঘনফুট মাটি। প্রতিটি ইটভাটায় বছরে পাঁচ থেকে ছয় একর জমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহার করা হয় এবং প্রতিটি ইটভাটায় দৈনিক গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ মণ কাঠ পোড়ানো হয়। সে হিসেবে ২০টি ইটভাটায় প্রতিদিন ৮ শ মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৯ সালের পর থেকে জীবননগর উপজেলায় অবস্থিত ২৫টি ইটভাটার মধ্যে কোনোটির লাইসেন্স এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের নবায়ন নেই।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন ইটভাটায় আম, জাম, কাঠাল, রেন্ট্রি, খেজুরসহ একাধিক প্রজাতির ফলজ ও বনজ গাছ পোড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭-এর ৭ ধারা অনুযায়ী কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানোকে অবৈধ ঘোষণা করা হলেও সে আইন মানছে জীবননগর উপজেলার ইটভাটার মালিকগণ।

এদিকে, খড়ির চেয়ে কয়লার দাম বেশি হওয়ায় গত বছরের তুলনায় এ বছর ২৫ হাজার ৫ শ টাকা গাড়ি হিসেবে ইট বিক্রয় করছেন বিবিএম ব্রিকস। যার ফলে ইট সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। উপজেলার রায়পুর গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস নামের এক বৃদ্ধ অভিযোগ করে বলেন, ‘রায়পুরে গ্রামের মধ্যে রফিকুল ইটভাটা স্থাপন করায় আমরা চরম বিপাকে আছি। ইটভাটার গাড়ির কারণে বাইরে বের হওয়া যায় না, ভাটার কালো ধোয়ায় পরিবেশ দূষণসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে গ্রামবাসীর।’ নারায়ণপুর গ্রামের আক্কাচ আলী নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘পৌরসভার শেষ সীমানায় সীমান্ত ইটভাটা নামে যে ভাটাটি গড়ে উঠেছে, প্রশাসন কীভাবে তার অনুমোদন দিয়েছে, আমাদের জানা নেই। এই ভাটার চারিদিকে চাষাবাদ হয়। ভাটার কারণে এলাকার কৃষকরা চরম বিপাকে আছে। তাছাড়া এই ভাটায় প্রতিদিন বিভিন্ন প্রজাতির গাছ পোড়ানো হচ্ছে। যার ফলে এই এলাকার বিভিন্ন ফলজ ও বনজ গাছ কাটা পড়ছে। এ বিষয়ে প্রশাসন ব্যবস্থা না নিলে পরিবেশের চরম ক্ষতি হবে।’

জীবননগর উপজেলা কৃষি অফিসার মোছা. শারমিন আক্তার বলেন, ‘ইটভাটার বিষাক্ত ধোয়ায় ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। খেতের পাশে ইটভাটা গড়ে ওঠায় আগের তুলনায় ফসল উৎপাদন কমে গেছে। সরকার ফসলি জমির ওপর ইটভাটা স্থাপন রোধে ব্যবস্থা না নিলে এসব জমির উৎপাদন শূন্যে নেমে আসবে।’
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মো. আমিনুল ইসলাম খান বলেন, ‘ইটভাটা স্থাপন করার জন্য একটি আইন আছে, সে আইন মেনে ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। আইন অমান্য করে গড়ে ওঠা সকল ইটভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে দ্রত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’