ইপেপার । আজ রবিবার, ২০ অক্টোবর ২০২৪

আলমডাঙ্গা সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৮:৪১:৫৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ অগাস্ট ২০২২
  • / ৩৯ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক:  আলমডাঙ্গা সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের সংবাদ প্রকাশের পর দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান। তিনি সহকারী শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। এদিকে, প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে করোনাকালীন দুই বছরে ছাত্র ভর্তি, স্কুল মার্কেটের ভাড়ার টাকা, স্কুল সরকারিকরণের কথা বলে শিক্ষকদের কাছ থেকে নেওয়া টাকাসহ আরও অর্ধকোটি টাকা তসরুপের অভিযোগ করেছেন ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

জানা গেছে, আলমডাঙ্গার সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান বিদ্যালয় সরকারিকরণ ঘোষিত হওয়ার পরপরই বিভিন্ন দপ্তরে টাকা দেওয়ার নাম করে সহকারী শিক্ষকদের কাছ থেকে ৯ লাখ টাকা তোলেন। ওই টাকা তিনি কোনো দপ্তরে না দিয়ে তাদের নাম ভাঙিয়ে নিজে আত্মসাৎ করেন। এ সংক্রান্ত বিষয়ে গত সোমবার চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় কয়েকটি দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হলে রবিউল ইসলাম খান দৌঁড়ঝাপ শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার ভয় দেখিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হুমকি দিচ্ছেন বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন।

এদিকে প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান শুধু শিক্ষকদের টাকাই নয়, করোনাকালীন সময়ে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ছাত্র ভর্তির নামে ১ হাজার ছাত্রের কাছ থেকে সাড়ে ১১ শ টাকা করে দুই বছরে ২৩ লাখ টাকা, ভোকেশনাল ১৬০ ছাত্রের কাছ থেকে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা, স্কুল মার্কেটের প্রতি মাসে ৩৭ হাজার করে দুই বছরে ভাড়ার ৮ লাখ  ৮৮ হাজার টাকা তসরুপ করেছেন বলেও শিক্ষকরা অভিযোগ করেন।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেন, ‘কী আর বলব, কিছু বললেই তো চাকরি থাকবে না। জীবনে সব থেকে বড় কোনো পাপ করেছিলাম মনে হয়। যার সাজাস্বরুপ আল্লাহ আমাকে এমন প্রধান শিক্ষকের আন্ডারে চাকরি করতে দিয়েছেন।’ বিদ্যালয়ের ঝাড়ুদার হিসেবে কাজ করতে আসা এক মহিলা বলেন, ‘আমি গরিব বিধবা মানুষ। আমি এই স্কুলে ঝাড়ুদারের কাজ করতে আসার পর আমার কাছে হেড স্যার ৫০ হাজার টাকা চেয়েছে। আমার বাড়িতে তার সহযোগী ইদরিস ভাইকে পাঠিয়েছে টাকার জন্য অনেক বার। আমি বাধ্য হয়ে আশা এনজিও থেকে লেন তুলেছি টাকা দেওয়ার জন্য।’ আরেক পুরুষ ঝাড়ুদার বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ, এই স্কুলের ময়লা পরিস্কার করি। সরকারিকরণের কথা বলে হেড স্যার আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে।’

বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক ইছাহক বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে যত যায় বলি, বলে শেষ হবে না। প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান তার চেয়ারকে পুঁজি করে ও আমাদেরকে জিম্মি করে অর্থ বাণিজ্য শুরু করেছে। যা আমরা এতদিন মুখ বন্ধ করে সহ্য করেছি। এই স্কুল সরকারিকরণের পর সরকারে নিয়ম অনুসারে এই স্কুলে একটি তিন সদস্যবিশিষ্ট অর্থ কমিটি গঠন হয়। যার আমি একজন সদস্য। কিন্তু গত মহামারি করোনাভাইরাসের সময় থেকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান তার নিজের ইচ্ছামতো ভাউচার বানিয়ে আমাদের কোনো মতামত না নিয়েই অর্থ উত্তোলন করে নিজের আখের গুছিয়েছেন। আমরা অর্থ কমিটির পক্ষ থেকে অনেকবার স্কুলের টাকা-পয়সার হিসাব জানতে চাইলে তিনি আমাদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিয়েছেন। আর বলেছেন এ বিষয়ে তোমাদের জানা লাগবে না, আমি আমার মতো করে ঠিক করে ফেলেছি। স্কুল সরকারিকরণের নামে সে আমাদের সকল সাধারণ শিক্ষককে জিম্মি করে আমাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা তুলে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে খরচের নাম ভাঙিয়ে নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন।’

আলমডাঙ্গা সরকারি পাইলট হাইস্কুলের অর্থ কমিটির আরেক সদস্য বলেন, ‘আমি অনেকবার জানতে চেয়েছি টাকা উত্তোলনের কাজে আমাদের সিগনেচার ছাড়া আপনি কার সিগনেচারে টাকা উঠালেন, আর কোন ব্যাংকের কোন অ্যাকাউন্টে স্কুলের টাকা আছে বলেন। কিন্তু তিনি আমার প্রশ্নের জবাবে বলেছেন টাকা তুলতে তোমাদের কোনো সিগনেচার লাগবে না। আমি আমার লোক দিয়ে সিগনেচার ম্যানেজ করে নিয়েছি। আর কোন অ্যাকাউন্টে কোন ব্যাংকে টাকা আছে, তা তোমার জেনে লাভ নেই।’

এ বিষয়ে স্কুলের একজন শিক্ষিকার সাথে গোপনে যোগাযোগ করা হলে তিনি নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘আমি আর কী বলব আমি মহিলা মানুষ স্কুল থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিমাণে আমার কাছে টাকা দাবি করত স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আমি টাকা দিতে দিতে এক সময় টাকা না দিতে চাইলে প্রধান শিক্ষক তার পিয়ন ইদ্রিস আলীকে বিভিন্ন সময় পাঠাতো আমার কাছে টাকা চাইতে। তারপরেও আমি টাকা দিতে না চাইলে প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান তিনি নিজেই আমার বাড়িতে টাকার জন্য যেতেন। পরে আমি বাধ্য হয়ে আমার এলাকার মানুষের কাছে থেকে লোকলজ্জার ভয়ে বাঁচার জন্য তার কাছে টাকা দিয়েছি। কিন্তু তিনি সে টাকা প্রতিষ্ঠানের কোনো কাজেই খরচ করেননি বরং সে সমস্ত টাকা তিনি তার পকেটে ঢুকিয়েছেন।’

স্কুলের আরেকজন শিক্ষক বলেন, ‘অনেক বিশ্বাস করে প্রধান শিক্ষকের কাছে তার চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিমাণ টাকা দিয়েছি। ভেবেছিলাম স্কুল সরকারিকরণের কাজে টাকা লাগতেও পারে। কিন্তু আমরা খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি যে সে সমস্ত টাকার একটি টাকাও কোনো দপ্তরে খরচ হয়নি। তিনি কীভাবে করলেন আমাদের সাথে এ প্রতারণা। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই প্রতারণার সুষ্ঠু তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।’

এ সমস্ত অভিযোগের ভিত্তিতে প্রধান শিক্ষকের সহকারী স্কুলের পিয়ন ঈদগাহ আলীর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ‘দোকান ভাড়া আমি প্রধান শিক্ষকের কথায় বিভিন্ন জায়গা থেকে তুলেছি, সে কথা ঠিক। কিন্তু আমি যা করেছি তা প্রধান শিক্ষকের হুকুমেই করেছি। আমি তো হুকুমের গোলাম। আমি টাকা কালেকশন করে স্কুলের ক্যাশিয়ারের নিকট বুঝিয়ে দিতাম, তারপর কী হতো আমি জানি না।’

এ বিষয়ে স্কুলের ক্যাশিয়ারের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এ সমস্ত কোনো অর্থের বিষয় আমি কোনোভাবেই জানি না। আমি স্কুলের যেটুকু হিসাব-নিকাশের সাথে জড়িত, তার সব ডকুমেন্ট সঠিক আছে।’

এ বিষয়ে অভিযুক্ত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষকরা যে অভিযোগ এনেছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। স্কুল সরকারিকরণের সময় শিক্ষকদের কাছ থেকে অল্প কিছু টাকা উঠানো হয়েছিল, যা স্কুলে আগত অতিথিদের আপ্যায়নে ও অডিটে আসা অফিসারদের আপ্যায়নে শেষ হয়ে গেছে। এখান থেকে একটি টাকাও আমি কোনোভাবে নয়-ছয় করিনি।’

স্কুলে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রনি আলম নুরের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘স্কুলে চলমান সমস্যার কথা আমি শুনেছি প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকেই। তিনি আমাকে বলেছেন স্কুলের সাধারণ শিক্ষকরা নাকি তার ওপর বিভিন্নভাবে বিভিন্ন লেনদেনের বিষয় নিয়ে চাপাচাপি করছেন। এ বিষয়ে তিনি আমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন। আমি তাকে লিখিতভাবে অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। যদি তিনি লিখিতভাবে অভিযোগ দেন, তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। তবে এ ঘটনায় স্কুলের সাধারণ শিক্ষকরা এখনো পর্যন্ত আমাকে কোনো কিছু জানায়নি।’

উল্লেখ্য, আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ ঘোষিত হওয়ার পরপরই প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান বিভিন্ন দপ্তরে টাকা দেওয়ার নাম করে সহকারী শিক্ষকদের কাছ থেকে ৯ লাখ টাকা তোলেন। কিন্তু সম্প্রতি এক সচিব আলমডাঙ্গার বাড়িতে বেড়াতে আসলে শিক্ষকরা তাঁর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হন। এসময় তিনি শিক্ষকদের জানান, স্কুল সরকারিকরণে কোনো দপ্তরে টাকা দিতে হয়নি। এতেই প্রধান শিক্ষকের টাকা উত্তোলনের পুরানো কাসুন্দি ভেসে ওঠে। গত ৩০ জুলাই শিক্ষকরা সম্মিলিত হয়ে প্রধান শিক্ষকের ওপর চড়াও হন। তারা বিভিন্ন দপ্তরে টাকা দেওয়ার নাম করে নেওয়া তাদের ৯ লক্ষ টাকা প্রধান শিক্ষকের কাছে ফেরত চান। জোটবদ্ধ শিক্ষকদের রোষানলে পড়ে এক নেতার মধ্যস্থতায় প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান নগদ তিন লাখ টাকা ফেরৎ দিয়ে আপাতত মুক্তি পান।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

আলমডাঙ্গা সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের

আপলোড টাইম : ০৮:৪১:৫৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ অগাস্ট ২০২২

নিজস্ব প্রতিবেদক:  আলমডাঙ্গা সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের সংবাদ প্রকাশের পর দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান। তিনি সহকারী শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। এদিকে, প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে করোনাকালীন দুই বছরে ছাত্র ভর্তি, স্কুল মার্কেটের ভাড়ার টাকা, স্কুল সরকারিকরণের কথা বলে শিক্ষকদের কাছ থেকে নেওয়া টাকাসহ আরও অর্ধকোটি টাকা তসরুপের অভিযোগ করেছেন ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

জানা গেছে, আলমডাঙ্গার সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান বিদ্যালয় সরকারিকরণ ঘোষিত হওয়ার পরপরই বিভিন্ন দপ্তরে টাকা দেওয়ার নাম করে সহকারী শিক্ষকদের কাছ থেকে ৯ লাখ টাকা তোলেন। ওই টাকা তিনি কোনো দপ্তরে না দিয়ে তাদের নাম ভাঙিয়ে নিজে আত্মসাৎ করেন। এ সংক্রান্ত বিষয়ে গত সোমবার চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় কয়েকটি দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হলে রবিউল ইসলাম খান দৌঁড়ঝাপ শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার ভয় দেখিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হুমকি দিচ্ছেন বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন।

এদিকে প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান শুধু শিক্ষকদের টাকাই নয়, করোনাকালীন সময়ে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ছাত্র ভর্তির নামে ১ হাজার ছাত্রের কাছ থেকে সাড়ে ১১ শ টাকা করে দুই বছরে ২৩ লাখ টাকা, ভোকেশনাল ১৬০ ছাত্রের কাছ থেকে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা, স্কুল মার্কেটের প্রতি মাসে ৩৭ হাজার করে দুই বছরে ভাড়ার ৮ লাখ  ৮৮ হাজার টাকা তসরুপ করেছেন বলেও শিক্ষকরা অভিযোগ করেন।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেন, ‘কী আর বলব, কিছু বললেই তো চাকরি থাকবে না। জীবনে সব থেকে বড় কোনো পাপ করেছিলাম মনে হয়। যার সাজাস্বরুপ আল্লাহ আমাকে এমন প্রধান শিক্ষকের আন্ডারে চাকরি করতে দিয়েছেন।’ বিদ্যালয়ের ঝাড়ুদার হিসেবে কাজ করতে আসা এক মহিলা বলেন, ‘আমি গরিব বিধবা মানুষ। আমি এই স্কুলে ঝাড়ুদারের কাজ করতে আসার পর আমার কাছে হেড স্যার ৫০ হাজার টাকা চেয়েছে। আমার বাড়িতে তার সহযোগী ইদরিস ভাইকে পাঠিয়েছে টাকার জন্য অনেক বার। আমি বাধ্য হয়ে আশা এনজিও থেকে লেন তুলেছি টাকা দেওয়ার জন্য।’ আরেক পুরুষ ঝাড়ুদার বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ, এই স্কুলের ময়লা পরিস্কার করি। সরকারিকরণের কথা বলে হেড স্যার আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে।’

বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক ইছাহক বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে যত যায় বলি, বলে শেষ হবে না। প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান তার চেয়ারকে পুঁজি করে ও আমাদেরকে জিম্মি করে অর্থ বাণিজ্য শুরু করেছে। যা আমরা এতদিন মুখ বন্ধ করে সহ্য করেছি। এই স্কুল সরকারিকরণের পর সরকারে নিয়ম অনুসারে এই স্কুলে একটি তিন সদস্যবিশিষ্ট অর্থ কমিটি গঠন হয়। যার আমি একজন সদস্য। কিন্তু গত মহামারি করোনাভাইরাসের সময় থেকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান তার নিজের ইচ্ছামতো ভাউচার বানিয়ে আমাদের কোনো মতামত না নিয়েই অর্থ উত্তোলন করে নিজের আখের গুছিয়েছেন। আমরা অর্থ কমিটির পক্ষ থেকে অনেকবার স্কুলের টাকা-পয়সার হিসাব জানতে চাইলে তিনি আমাদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিয়েছেন। আর বলেছেন এ বিষয়ে তোমাদের জানা লাগবে না, আমি আমার মতো করে ঠিক করে ফেলেছি। স্কুল সরকারিকরণের নামে সে আমাদের সকল সাধারণ শিক্ষককে জিম্মি করে আমাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা তুলে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে খরচের নাম ভাঙিয়ে নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন।’

আলমডাঙ্গা সরকারি পাইলট হাইস্কুলের অর্থ কমিটির আরেক সদস্য বলেন, ‘আমি অনেকবার জানতে চেয়েছি টাকা উত্তোলনের কাজে আমাদের সিগনেচার ছাড়া আপনি কার সিগনেচারে টাকা উঠালেন, আর কোন ব্যাংকের কোন অ্যাকাউন্টে স্কুলের টাকা আছে বলেন। কিন্তু তিনি আমার প্রশ্নের জবাবে বলেছেন টাকা তুলতে তোমাদের কোনো সিগনেচার লাগবে না। আমি আমার লোক দিয়ে সিগনেচার ম্যানেজ করে নিয়েছি। আর কোন অ্যাকাউন্টে কোন ব্যাংকে টাকা আছে, তা তোমার জেনে লাভ নেই।’

এ বিষয়ে স্কুলের একজন শিক্ষিকার সাথে গোপনে যোগাযোগ করা হলে তিনি নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘আমি আর কী বলব আমি মহিলা মানুষ স্কুল থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিমাণে আমার কাছে টাকা দাবি করত স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আমি টাকা দিতে দিতে এক সময় টাকা না দিতে চাইলে প্রধান শিক্ষক তার পিয়ন ইদ্রিস আলীকে বিভিন্ন সময় পাঠাতো আমার কাছে টাকা চাইতে। তারপরেও আমি টাকা দিতে না চাইলে প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান তিনি নিজেই আমার বাড়িতে টাকার জন্য যেতেন। পরে আমি বাধ্য হয়ে আমার এলাকার মানুষের কাছে থেকে লোকলজ্জার ভয়ে বাঁচার জন্য তার কাছে টাকা দিয়েছি। কিন্তু তিনি সে টাকা প্রতিষ্ঠানের কোনো কাজেই খরচ করেননি বরং সে সমস্ত টাকা তিনি তার পকেটে ঢুকিয়েছেন।’

স্কুলের আরেকজন শিক্ষক বলেন, ‘অনেক বিশ্বাস করে প্রধান শিক্ষকের কাছে তার চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিমাণ টাকা দিয়েছি। ভেবেছিলাম স্কুল সরকারিকরণের কাজে টাকা লাগতেও পারে। কিন্তু আমরা খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি যে সে সমস্ত টাকার একটি টাকাও কোনো দপ্তরে খরচ হয়নি। তিনি কীভাবে করলেন আমাদের সাথে এ প্রতারণা। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই প্রতারণার সুষ্ঠু তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।’

এ সমস্ত অভিযোগের ভিত্তিতে প্রধান শিক্ষকের সহকারী স্কুলের পিয়ন ঈদগাহ আলীর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ‘দোকান ভাড়া আমি প্রধান শিক্ষকের কথায় বিভিন্ন জায়গা থেকে তুলেছি, সে কথা ঠিক। কিন্তু আমি যা করেছি তা প্রধান শিক্ষকের হুকুমেই করেছি। আমি তো হুকুমের গোলাম। আমি টাকা কালেকশন করে স্কুলের ক্যাশিয়ারের নিকট বুঝিয়ে দিতাম, তারপর কী হতো আমি জানি না।’

এ বিষয়ে স্কুলের ক্যাশিয়ারের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এ সমস্ত কোনো অর্থের বিষয় আমি কোনোভাবেই জানি না। আমি স্কুলের যেটুকু হিসাব-নিকাশের সাথে জড়িত, তার সব ডকুমেন্ট সঠিক আছে।’

এ বিষয়ে অভিযুক্ত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষকরা যে অভিযোগ এনেছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। স্কুল সরকারিকরণের সময় শিক্ষকদের কাছ থেকে অল্প কিছু টাকা উঠানো হয়েছিল, যা স্কুলে আগত অতিথিদের আপ্যায়নে ও অডিটে আসা অফিসারদের আপ্যায়নে শেষ হয়ে গেছে। এখান থেকে একটি টাকাও আমি কোনোভাবে নয়-ছয় করিনি।’

স্কুলে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রনি আলম নুরের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘স্কুলে চলমান সমস্যার কথা আমি শুনেছি প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকেই। তিনি আমাকে বলেছেন স্কুলের সাধারণ শিক্ষকরা নাকি তার ওপর বিভিন্নভাবে বিভিন্ন লেনদেনের বিষয় নিয়ে চাপাচাপি করছেন। এ বিষয়ে তিনি আমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন। আমি তাকে লিখিতভাবে অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। যদি তিনি লিখিতভাবে অভিযোগ দেন, তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। তবে এ ঘটনায় স্কুলের সাধারণ শিক্ষকরা এখনো পর্যন্ত আমাকে কোনো কিছু জানায়নি।’

উল্লেখ্য, আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ ঘোষিত হওয়ার পরপরই প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান বিভিন্ন দপ্তরে টাকা দেওয়ার নাম করে সহকারী শিক্ষকদের কাছ থেকে ৯ লাখ টাকা তোলেন। কিন্তু সম্প্রতি এক সচিব আলমডাঙ্গার বাড়িতে বেড়াতে আসলে শিক্ষকরা তাঁর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হন। এসময় তিনি শিক্ষকদের জানান, স্কুল সরকারিকরণে কোনো দপ্তরে টাকা দিতে হয়নি। এতেই প্রধান শিক্ষকের টাকা উত্তোলনের পুরানো কাসুন্দি ভেসে ওঠে। গত ৩০ জুলাই শিক্ষকরা সম্মিলিত হয়ে প্রধান শিক্ষকের ওপর চড়াও হন। তারা বিভিন্ন দপ্তরে টাকা দেওয়ার নাম করে নেওয়া তাদের ৯ লক্ষ টাকা প্রধান শিক্ষকের কাছে ফেরত চান। জোটবদ্ধ শিক্ষকদের রোষানলে পড়ে এক নেতার মধ্যস্থতায় প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান নগদ তিন লাখ টাকা ফেরৎ দিয়ে আপাতত মুক্তি পান।